একজন অঞ্জন দত্ত



‘আমি সিগারেট খুবই কম খেতাম। এখন হয়তো একটু বেড়েছে। কেন? কেননা আমার মদ খাওয়াটা বেড়ে যাচ্ছিল। হা হা হা…’


উপরের কথাগুলো অঞ্জন দত্তর। এরকম সরল স্বীকারোক্তিতে কথা আর কজনই-বা বলতে পারে, বলুন? কেউ মদ খেলে জাত যায়, কেউবা মদ খেলে জাতে ওঠে। আর অঞ্জন দত্তদের জাতটাই এমন, ওঁদের কাছে এলে বরং মদ নিজেই জাতে ওঠে!


‘হয়তো ঠিক সময়ে, ঠিক বয়সে অভিনেতার স্বীকৃতি পেলে বেশ বড়ো মাপের একজন অভিনেতা হতে পারতাম। সেই সম্ভাবনা আমার ছিল। কিন্তু আমার বয়স যখন চল্লিশ পেরিয়ে গেল এবং যথেষ্ট পরিমাণে অভিনয় করার সুযোগ পেলাম না, তখন বুঝেছিলাম, বাংলা সিনেমায় অভিনয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেবার মতো ক্ষমতা এই জীবনে আর হবে না।’


এই কথাগুলোও অঞ্জন দত্তর। যাঁরা তাঁর অভিনয় দেখেছেন, তাঁদের বিশ্বাস হয় তিনিও এমন কথা বলতে পারেন? অঞ্জনদের এই সবিনয় সততা কখনওই সত্যকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।


‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ…’, ‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হতো না…’, কিংবা ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না…’-র মতন অত উঁচুদরের অমর কিছু সংগীতের স্রষ্টা যিনি, তাঁর আক্ষেপটা কোথায়, খেয়াল করেছেন? এমন তৃষ্ণা না থাকলে অমৃতের সন্ধানে ছোটা যায় না।


অঞ্জন নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘আমি মোটামুটি পেশাদার একজন শিল্পী। নাটক, আধুনিক গান, চলচ্চিত্র---এই আমার জগত, যা ক্রমশ মধ্যমেধায় ডুবে যাচ্ছে। বড়ো মাপের শিল্পীর অভাবটা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। ৬৩ বছর বয়সে এসে নতুন সম্ভাবনা খুঁজে চলি। তাদের হদিস পেলে খুবই উত্তেজিত হয়ে তাদের দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। ভালো শিক্ষক হতে চাই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, তাদেরও মধ্যমেধায় ডুবে যেতে দেখি। বেশিরভাগ ওই ছাপোষা সেলেব্রিটি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওই ঘুরেই বেড়ায়, তার বেশি কিছু নয়।


আসলে সত্যি কথা না থাকলে আত্মকথা হয় না। সাজ্জাদ গল্প বানিয়ে বানিয়ে অঞ্জন দত্তকে একটা বড়ো মাপের শিল্পী বানাতে চায়নি। ও খুঁজেছে সেই অঞ্জনকে, যাকে কেউ বুঝতে পারেনি, চিনতে পারেনি। পারেনি বলেই হয়তো তার কোনো সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। কিংবা চিনতে পারেনি বলেই হয়তো সে বড়ো মাপের শিল্পী হতে পারল না এই জীবনে।


তাই সাজ্জাদের বেশ কিছু টাকা খরচা করে দিই আমি। প্লেনের টিকিট কেটে ওকে বাধ্য করি আমার সঙ্গে দার্জিলিং যেতে। এবং সেই ছেলেবেলার মিষ্টি এবং অনেক কষ্টের, অনেক সুন্দর আবহাওয়ায় অকপটে অনেক অনেক সত্যি কথা বলে ফেলি।


আমি যে শুধু কষ্ট করেছি, তা নয়। প্রচুর কষ্ট দিয়েছিও অন্যদেরকে, কাছের মানুষদের। কষ্ট এবং প্রচ্ছন্ন দুঃখ থেকেই আনন্দের জন্ম হয়।


আমি সাজ্জাদকে বন্ধুর মতন গড়গড় করে বলে গেছি সব, যেমন করে একজন রোগী তার ডাক্তারকে সব সত্য কথা উগড়ে দেয়, সেভাবে। আমি ওকে বন্ধুর মতন করে ওইসব বলেছি, যা আমার আমি হবার জন্য মূল্যবান ছিল। অনেক অলিগলির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে নিজের এগোবার রাস্তা এবং সাহস খুঁজে পেয়েছি। হারিয়ে যাবার দরকার ছিল আমার। ভালো মানুষ, ভালো স্বামী, ভালো বাবা---কোনোটাই আমি নই। আমার কাছে চিরকালের প্রশ্ন: ভালো কী? মাথা উঁচু করে বলতে পারি, খারাপ লোক আমি নই। গুণ সকলের মধ্যে থাকে। গুণ আসলে টেবিলসল্টের মতন। কিন্তু সেই গুণগুলো নিয়ে মানুষ কী করে? জনপ্রিয় হতে চায়? সকলের কাছে ভালো হতে চায়? না কি নিজের কাছে সৎ? সততার সংজ্ঞাটা আসলে কী?’


জোয়ান বায়াজের গানের বাঙলায়নে সুমনের কণ্ঠে শুনেছি: কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়...অঞ্জনকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে: আর কতটা পথ পেরোলে তবে বড়ো শিল্পী বলা যায়!


‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘মেরী আন’, ‘আমি বৃষ্টি দেখেছি’, ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’, ‘শুনতে কি চাও তুমি’, ‘বসে আছি ইস্টিশানেতে’ শুনে শুনে বড়ো হয়েছি আমরা যারা, তারা বড্ড ভাগ্যবান। নির্ঘুম রাত কাটানোর ট্রেডমার্ক গানের লিস্টে প্রথম দিকেই থাকত ও থাকে অঞ্জন দত্তর এরকম আশ্চর্য সুন্দর কিছু সৃষ্টি। বড়ো হয়ে যাবার পর যখন জানতে পারলাম, অঞ্জন সিনেমা বানান, সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন, তখন ডুব দিলাম তাঁর সৃষ্টির সেই ভুবনেও। মৃণাল সেনের সিনেমা খারিজ – চালচিত্র - অন্তরীণ, অপর্ণা সেনের সিনেমা যুগান্ত, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সিনেমা গৃহযুদ্ধ ইত্যাদিতে তাঁর অমন অভিনয় দেখে থ হয়ে যায়নি কোন বাঙালিসন্তান? ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’, ‘দত্ত ভার্সাস দত্ত’, ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ দেখে আমরা চিনতে পারি একজন ফিল্মমেকার অঞ্জন দত্তর শক্ত জাতটা। মেকি এলিটিজমের ধার না ধেরে অমন চমৎকার সাবলীলতার মেঠোপথ ধরেও সিনেমা হাঁটতে পারে, অঞ্জন তা দেখিয়েছেন খুব সাফল্যের সাথেই।


আমার এই লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের বলি, হাতে সময় থাকলে, এমনকী সময় না থাকলেও সময় বের করে নিয়ে অঞ্জন দত্তর ট্র্যাভেল চ্যাট-শো ‘চলো অঞ্জন’-এর সবকটা এপিসোড না দেখে থাকলে দেখে ফেলতে পারেন। ওগুলি ইউটিউবে আছে, খুঁজলেই পেয়ে যাবেন। সেখানে অঞ্জন বিভিন্ন বড়ো মানুষকে পশ্চিমবঙ্গের অপূর্ব সুন্দর কিছু জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যান এবং তাঁদের সাথে খুবই অকপট ভঙ্গিতে জীবন নিয়ে গল্প করেন। প্রকৃতির কোলে আয়েশ করে শরীর-মন এলিয়ে দিয়ে চায়ের উষ্ণ ধোঁয়ায় কিংবা হুইস্কির অকৃত্রিম মাদকতায় আবিষ্ট ওঁরা যেমনি করে নিজেদের মেলে ধরেন, খুব মন দিয়ে শুনলে আপনি বুঝতে পারবেন, বড়ো মানুষদের সাথে আমাদের তফাত আসলে অনেক জায়গাতেই। ওঁদের পড়াশোনা কি জানাশোনা, ভাবনা কি সাধনা, সারল্য কি স্বাচ্ছন্দ্য, দর্শন কি মনস্তত্ত্ব এসবের তেমন কিছুই আমাদের সাথে মেলে না। আর মেলে না বলেই আমরা কবরে শোয়ার কিংবা চিতায় ওঠার আগ অবধি এরকম সাধারণ হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিই। সাধারণত্ব ও অসাধারণত্ব, এই দুইয়ের মধ্যকার দূরত্বটি এতটাই বেশি যে অনভ্যস্ত মস্তিষ্কে অনুমান পর্যন্ত করা যায় না। বড়োদের ভাবনা ও কাজ দুই-ই অনেক বড়ো।


কি অভিনয়ে, কি নির্দেশনায়, কি সংগীতে অত বড়ো মাপের একজন শিল্পী, একজন গ্রেট অঞ্জন দত্ত নিজেকে নিয়ে অত অবলীলায়, অত সারল্য নিয়ে, অত অকপটে, বিন্দুমাত্রও রাখঢাক না রেখেই কী করে বলে ফেলেন অতটা? কী করেই-বা নিজের দিকে, অন্যদের দিকে এবং সমাজের দিকে এতসব প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন? কতটা পথ পেরুলে তবে মানুষ এতটা নির্ভীক হতে পারে?


এসব সত্যিই আমার মাথায় আসে না। কিংবা সত্যবচনে বলা যায়, আমার মতন এতটা নগণ্য লোকের মাথায় অতদূর আসে না বলেই মানুষটা অঞ্জন দত্ত। যথেষ্ট মানসিক পরিপক্বতা ও প্রস্তুতি ছাড়া জিনিয়াসদের বোঝা পুরোপুরিই অসম্ভব! জাতশিল্পী যাঁদের বলি আমরা, তাঁদের কাউকেই বোঝা আমাদের সাধ্যের অনেক অনেক অনেক বাইরে। ওঁরা যখন বেঁচে থাকেন, তখন তো বুঝতে পারিই না, মৃত্যুর পরেও ওঁরা আমাদের বোধবুদ্ধিতে অনাবিষ্কৃত থেকে যান।


দূর থেকে ওঁদের ক্রিয়েটিভ আর্ট উপভোগ করবার সময়ে আমরা মাথাতেই আনতে পারি না যে আমরা একজন আর্টিস্টের নির্দিষ্ট একটি সত্তাকে দেখেছি, শুনছি বা অনুভব করছি মাত্র। সেই সত্তাটির সঙ্গে ব্যক্তি-আর্টিস্টের অনেকটা দূরত্ব থাকতে পারে, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। আমরা ভাবতেও পারি না, হয়তোবা আর্টিস্টের আর্টের সাথে আর্টিস্টের লাইফের ন্যূনতমও সম্পর্ক নেই। স্রষ্টার সাথে তাঁর সৃষ্টির সখ্য আছে বটে, তবে অভিন্নতা না-ও থাকতে পারে। আর্টিস্ট তাঁর কাজের মতো হতে বাধ্য নন। আর্টিস্টের কমিটমেন্ট কেবলই তাঁর আর্টের প্রতি। আর্টিস্টের পার্সোনাল লাইফের সাথে তাঁর আর্টের যোগসূত্র খোঁজে যারা, কিংবা আর্টিস্টের পার্সোনাল লাইফের ব্যবচ্ছেদ করতে বসে যারা, তারা মূলত আর্টিস্টের শিল্পসত্তাকে ধ্বংস করে দেবার আয়োজন করে।


নগণ্য, অতএব অগণ্য অসৃষ্টিশীল মানুষের চেয়ে একজন বড়ো মাপের আর্টিস্টের স্থানটি বরাবরই অনেক উঁচুতে। তাঁকে কোনও গ্রামারে ফেলা যায় না। সে চেষ্টা করে যারা, তারা প্রকৃতপক্ষে এক-একটা ক্রিমিনাল। ওই অন্ধ মূর্খের দল নিজেরাই জানে না, মূর্খতার কোন ধাপে তারা পৌঁছে গেছে! গাধারা সিংহের শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে জানে না বলেই আমৃত্যু গাধা থেকে যায়। গাধারা সবাই মিলে কোনও এক বড়ো গাধাকেই তাদের রাজা বানায় ও সেই বড়ো গাধাটির মতো হওয়ার চেষ্টায় জীবন কাটায়।


আর্টিস্টদের নিয়ে জাজমেন্টাল হওয়ার চাইতে বড়ো পাপ আর হয় না। আমরা তো শুধুই বিচার করে আয়ুক্ষয় করি, আর ওদিকে অঞ্জন দত্তরা নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষুধায়, নতুন জন্মের প্রসববেদনায় কাতরাতে থাকেন। জন্মের উৎসবের দিকে সেই মহতী যাত্রায় শারীরিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তেই মানসিক স্বেচ্ছামৃত্যুর এই যে একের পর এক শ্রমসাধ্য মঞ্চায়ন, তার খোঁজ আমরা রাখি না। সত্যিকারের শিল্পের জন্যই যদি আমরা আন্তরিক প্রতীক্ষায় থাকি, তবে কেন শিল্পীদের জীবন ঘেঁটে সেইসব আপাত-খুঁতের অন্বেষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, হয়তো যা আছে বলেই আর্টিস্টরা শেষপর্যন্ত আর্টিস্ট হয়ে ওঠেন?


আমরা এতটাই অপদার্থ যে আর্টিস্টদের স্বর্গে নিতে গিয়ে তাঁদের আর্টকেই স্বর্গচ্যুত করি। যা দেখে আমরা নরক ভাবি, তা থেকেই যে ওঁদের স্বর্গের সিঁড়ির প্রথম ধাপটার শুরু হয়, সেটি আমাদের স্থূলবুদ্ধিতে কিছুতেই ধরে না। জ্ঞানীর স্বর্গযাত্রা আর মূর্খের স্বর্গযাত্রা দূরতম বিবেচনাতেও কখনও এক নয়। মূর্খের স্বর্গের সবকটি দরোজার চাবি দিয়েও জ্ঞানীর নরকের একটিও দরোজার তালা খোলা যায় না। তাই নীরবতাই হোক মূর্খের প্রধান কর্তব্য।