ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৯)

অজ্ঞানতার অন্ধকারে থাকার সময়ে মানুষ যখন তোমার পথভ্রষ্ট হয়, জ্ঞানী লোকেরা যখন অসত্যে এবং সাধারণ মানুষ যখন অসারতা ও সাংসারিক আয়োজনে নিমগ্ন হয়ে যায়, সেই সময়ও, হে ঈশ্বর, তুমি আমাদেরকে তোমার প্রতি বিশ্বাসী থাকতে সমর্থ কর! তখনও আমাদের অহংকার, অভিমান বিনাশ করে ধৈর্য এবং বীর্য প্রদর্শন করতে শিক্ষা দিয়ো। আমরা যেন তোমার বলে ও কৃপায় সেই দুর্দিনের অন্ধকারের মধ্যে থেকেও আমাদের বিশ্বাসের আলো উজ্জ্বল রাখতে পারি এবং এই বিশ্বাস যেন ঝড়বিক্ষুব্ধ সংসারপথে আলোর উজ্জ্বল চিহ্নের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে জীবনতরণীকে অবশেষে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়—তুমি এই শিক্ষাই আমাদেরকে দাও।




আমাদের দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনের উপযোগী বল আমাদেরকে প্রদান করো। ক্লেশ-যন্ত্রণা কিংবা আকস্মিক বিপদ-আপদ বহন করার উপযোগী ধৈর্য আমাদের প্রদান করো এবং যে-বিশ্বাস পরীক্ষা-প্রলোভনের সময় পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করে এবং হৃদয়ে শান্তি ও আনন্দ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়, আমাদেরকে সেই বিশ্বাস প্রদান করো।




সকল ক্ষেত্রে সংযত আচরণ করা ভক্তির প্রধান লক্ষণ। এর ফলে মানুষের শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ ও সবল থাকে, ওদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় এবং মন ও শরীরের মধ্যে একটি নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তখন মানুষ খুব সহজেই তার অন্তরস্থিত ঈশ্বরের আরাধনা করতে পারে। ইন্দ্রিয় যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, তাহলে এই প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে তেমন কোনো কষ্ট হয় না। শরীরের সাথে এমন মিতাচারের যে সম্পর্ক, বুদ্ধিবৃত্তির সাথে জ্ঞানেরও একই সম্পর্ক। জ্ঞানই বুদ্ধিগত ভক্তি। জ্ঞানের দ্বারা মানুষের বুদ্ধিতে বিধিবিধান অনুযায়ী শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়; বুদ্ধির বিভিন্ন শক্তির মধ্যকার সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় এবং পরস্পরের মধ্যে ও সমস্ত মনের সঙ্গে তাদের যথাযথ সম্পর্ক তৈরি হয়। এই জ্ঞানই বুদ্ধিশক্তির সাধারণ নামান্তর মাত্র। সেই শক্তি যে-বিষয়েই প্রযুক্ত ও যে-প্রক্রিয়াতেই পরিচালিত হোক না কেন, সব জায়গাতেই তা জ্ঞান নামে পরিচিত।




লেখকেরা লেখালেখিতে জ্ঞানী; দার্শনিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী, প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে জ্ঞানী। তাই বলা যায়, জ্ঞান মানুষের মনের সাধারণ শক্তি মাত্র। আমরা সচরাচর বলে থাকি, বিদ্যার অসীম ক্ষমতা আছে। কিন্তু যে সাধারণ বুদ্ধিশক্তির সাহায্যে মানুষ সত্যের সন্ধান পায় এবং লব্ধ সত্যকে জীবনে কাজে লাগাতে পারে, সেই জ্ঞানেরই প্রতিশব্দ হিসেবে 'বিদ্যা' শব্দটি প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।




জ্ঞানের দ্বারা দুইটি জিনিস বোঝায়: এক, সত্যের প্রতি স্বার্থহীন প্রেম, যাকে বুদ্ধিগত ভক্তিও বলা হয়। দুই, সেই সত্যকে অধিকার ও ব্যবহার করার শক্তি। বিশেষ ও সাধারণ, এই দুইভাবে সত্যের সাধনা করা হয়। দার্শনিক, লেখক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সকল ধরনের চাকরিজীবী, এঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ উপায়ে বিশেষ সত্যের সাধনা করেন। কেউ কেউ আবার সাধারণভাবে সত্য বলতে যা বোঝায়, তার‌ই সাধনা করে থাকেন—সেই সত্য তাঁর কাজের অধিক্ষেত্রের মধ্যে থাকুক বা না থাকুক।




সত্যলাভের প্রক্রিয়াও দুই প্রকার: প্রথমত, সহজ জ্ঞানের সাহায্যে প্রত্যক্ষভাবে সত্য লাভ করা যায়। দ্বিতীয়ত, তর্ক, যুক্তি ও বিচারের অনুশীলনে প্রামাণ্যভাবেও সত্য লাভ করা যায়। প্রত্যক্ষ ও বিচার, এই দুই রকমের প্রক্রিয়ায়, বিশেষ ও সাধারণ, এই দুই ধরনের সত্য লাভ করার যে শক্তি এবং লব্ধ সত্যের প্রতি যে স্বার্থশূন্য আকর্ষণ, জ্ঞান বলতে এই দুটিকেই মূলত বোঝানো হয়।




সত্যই মানুষের বুদ্ধির বিষয় হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত। চোখের যেমন দৃষ্টিশক্তি থাকে এবং আমরা যে-সকল বস্তু দেখি, তা যেমন চোখের বিষয়, তেমনি সত্য বিভিন্ন আকারে মানুষের বুদ্ধির বিষয়। মিতাচারী হয়ে সংযত উপায় অবলম্বন করে শরীরকে সুস্থ রাখলে লোকে স্বাস্থ্য, সামর্থ্য ও সৌন্দর্য, এই তিনটি বস্তু লাভ করে। সাধারণত শারীরিক নিয়মনীতির অনুসরণ করে চললে এই তিনটি বস্তু পাওয়া যায়, তবে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে এই সুফলটি পাওয়া না-ও যেতে পারে, কিন্তু সেটি সাধারণ নিয়মের খুবই বিরল ধরনের ব্যতিক্রম মাত্র।




কোনো সমাজের বা জাতির লোকেরা যদি এক-শো বছর ধরে শারীরিক উন্নতি লাভের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়মবিধি মেনে চলেন এবং শরীরকে সুস্থ রাখতে পারেন, তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা স্বাস্থ্য, সামর্থ্য ও সৌন্দর্য বিষয়ে পৃথিবীতে প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারবেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাপানে মানুষের গড় আয়ু অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। তাই সেখানকার মানুষের লাইফস্টাইলকে পুরো পৃথিবী আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।




কোনো ব্যক্তি যদি বুদ্ধির নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করেন এবং যে-সকল স্বাভাবিক উপায়ে বুদ্ধির বিকাশ হয়, তা অবলম্বন করে চলেন, তবে তিনিও জ্ঞানী হতে পারেন। একইসাথে, মানসিক স্বাস্থ্য, সামর্থ্য এবং সৌন্দর্য লাভ করাও তাঁর পক্ষে সহজ হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে, কিন্তু সেটা সাধারণ নিয়মের চিরায়ত ব্যতিক্রম মাত্র। প্রাচীনকালে গ্রিসের লোকেরা মানসিক উৎকর্ষে পৃথিবীতে সেরা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বর্তমানে যদি কোনো জাতি বা সম্প্রদায় এক-শো বছর ধরে বুদ্ধিবিকাশের প্রাকৃতিক নিয়মগুলি অনুসরণ করে চলতে পারে এবং বুদ্ধির সুনির্দিষ্ট প্রথাগুলি মেনে চলতে পারে, তবে নিশ্চয়ই গ্রিসের লোকেদের চাইতেও অধিক মানসিক স্বাস্থ্য, শক্তি এবং সৌন্দর্য লাভ করতে সক্ষম হবে। যদিও তাদের জ্ঞানের সঙ্গে এদের জ্ঞানের গুণগত কোনো তারতম্য থাকবে না, তবু বর্তমানকালের লোকেরা বুদ্ধির তেজ, শক্তি ও সৌন্দর্য, সব কিছু মিলিয়ে সত্যের আরও বেশি কাছাকাছি যেতে পারবেন এবং সেই সত্য ব্যবহারের জন্য অধিক শক্তি লাভ করতে পারবেন। এর কারণ, গ্রিসের শ্রেষ্ঠতম মনীষীদের মৃত্যুর পর এই দুই হাজার বছর ধরে মানুষের সভ্যতার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ইসরাইলের লোকজন মেধাবী ও বুদ্ধিমান হিসেবে পৃথিবীতে বেশ পরিচিত। সেখানে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর থেকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত যে-প্রক্রিয়ায় পরিবারে ও সমাজে তাকে বড়ো করা হয়, সেই প্রক্রিয়াটি পৃথিবীর অনেক দেশেই আদর্শ হিসেবে অনুসৃত হয়।




যে-নিয়মের অনুসরণের ফলে ব্যক্তিগত বা জাতীয় জীবনে মানসিক বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে, জগতের অন্যান্য নিয়মের মতো সেটিও স্থির ও অটল এবং এই নিয়মের অনুসরণে বিশেষ কোনো ব্যক্তিতে বা জাতিতে, কিংবা সমগ্র মানবজাতিতে কিছু নির্দিষ্ট ফল উৎপাদন করবেই করবে। উৎকর্ষের চেহারা ভিন্ন ভিন্ন হলেও উৎকর্ষ অর্জনের রাস্তা যে-কোনো কালেই মোটামুটি অভিন্ন। যুগে যুগে পুরুষ-পরম্পরায় যা অনুসৃত হয়ে থাকে, তা কখনও নষ্ট হয়ে যায় না। কেবল এক উপায়েই উৎকর্ষের এই যাত্রা ধ্বংস করা সম্ভব, এবং তা হলো, সেই জাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা। ইতিহাস বলে, নিকৃষ্টতর জাতির সংস্পর্শে এলে উৎকৃষ্ট জাতির আগেকার ধরন, ভাব ও জ্ঞান ক্রমশ ক্ষীন হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন সে জাতির জনসাধারণ নিকৃষ্ট মনমানসিকতায় বেড়ে উঠতে থাকে এবং একটা সময়ে এসে মোটামুটি সকলেই প্রজন্মের নিয়ম অনুযায়ী নিকৃষ্ট মনমানসিকতা ধারণ করে থাকে। মানুষের বেলাতেও একই বিষয় সত্য। এ কারণেই, নিকৃষ্ট সঙ্গীর সাথে সময় কাটানোর চাইতে বরং একা থাকা অনেক ভালো।




মানসিক প্রতিভা নির্দিষ্ট পরিবারে বেশি দিন আবদ্ধ থাকে না; দেখা যায়, একই পদবির দুই জন অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তি জগতে খুব বিরল। শাক্যকূলে একাধিক বুদ্ধ, মিশ্র বংশে একাধিক চৈতন্য জন্মাননি; শেক্সপিয়ার, আইনস্টাইন, পিকাসো কিংবা সমগোত্রীয় অনন্যসাধারণ প্রতিভাধর মানুষ একই পরিবারে বা একই গোষ্ঠীতে বা একই সম্প্রদায়ে তেমন একটা জন্মগ্রহণ করেননি। ক্যুরি দম্পতি, ব্র্যাগ-বোর পিতা-পুত্র বা উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমার-সত্যজিৎ পরম্পরা-সহ হাতেগোনা দু-একটি ব্যতিক্রম অবশ্য এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি। এ সকল অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তিদের মধ্যে যে-বুদ্ধিশক্তি একসময়ে বিকশিত হয়েছিল, তাঁদের নিজ নিজ পরিবার বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় থেকে তেমন বুদ্ধি শক্তি অন্তর্হিত হয়ে গেলেও মানবসমাজ হতে তা লোপ পায়নি। রবীন্দ্রনাথের ছেলে বা নাতি বা পরবর্তী বংশধরদের কেউই রবীন্দ্রনাথ না হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা অন্য অসংখ্য পরিবারকে উৎসাহিত ও সার্থক করতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে, নিজের বংশে না হলেও অন্যান্য বংশে এবং পরিবারের মধ্যে মহৎ মানুষের প্রতিভাশক্তি আবারও স্ফুরিত হয়ে ওঠে। প্রতিভা বা আত্মার কখনও মৃত্যু হয় না।




এই সংসারে যে-প্রতিভা বিকশিত হয় এবং তার সাহায্যে যে-সকল শক্তি ও সম্পদ উপার্জিত হয়, অনন্তকালের জন্য তা কোনো বিশেষ পরিবারে নয়, বরং সমগ্র মানবজাতিতেই তার উত্তরাধিকারী-স্বত্ব আপনাআপনি অর্পিত হয়। সকল যুগের ক্ষেত্রে এই কথা সত্য। মহৎ মানুষেরা বর্তমানে যে-জ্ঞান লাভ করবে, তা তাঁদের পরিবার বা বংশের মধ্যে না ছড়ালেও সেই পরিবার বা বংশের বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানের কোনো বিনাশ হবে না, বরং অন্যান্য বংশে পরবর্তী সময়ে তাঁদের সেই জ্ঞান আরও বিকশিত, বর্ধিত ও পরিপক্ব হবে।




মানুষের আধ্যাত্মিক ধনভাণ্ডারে যুক্ত হয়ে বর্তমানের জ্ঞানরাশি অনন্তকাল পর্যন্ত ভবিষ্যতের মানুষের ভোগ ও ব্যবহারের জন্য সঞ্চিত থাকবে। এই জ্ঞানসম্পত্তি অমূল্য; কালক্রমে এর কোনো ক্ষয় তো হবেই না, বরং বিভিন্ন উপায়ে পরিচালনা ও ব্যবহারের দ্বারা এর উত্তরোত্তর বিকাশ ও উন্নতি হতেই থাকবে। অথচ খুব সম্ভবত, বর্তমান কালের কোনো প্রতিভাশালী ব্যক্তি নিজেদের অনুরূপ প্রতিভাসম্পন্ন একটিও সন্তান এই পৃথিবীতে রেখে যেতে পারবেন না, তবে মৃত্যুর পর প্রত্যেক মহৎ ব্যক্তির মহত্ত্ব পরবর্তী বংশধর এবং প্রজন্মসমূহের উপকার করবে এবং তা সমাজের সম্পত্তি হয়ে যাবে, যদিও সেই বংশের কেউই অনুরূপ প্রতিভার অধিকারী বোধ হয় হবেন না।