ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১০)

জগতে যে-সমস্ত মনীষী নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে হৃদয়ের ভক্তির সাহায্যে ধর্মপ্রচার করে গেছেন, তাঁদের মৃত্যুতে কিন্তু সেই অসীম ভক্তি মানুষের কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। দেখা যায়, তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের হৃদয়ের সেই আলো যুগে যুগে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে; তাঁদের দেবতুল্য চরিত্র, কাজ, আদর্শ, বিবিধ গুণ প্রভৃতি মানুষ মনে রাখে এবং অনুসরণ করে; শুধু তা-ই নয়, নিজের ও তাঁর সন্তানের জীবনে সেসবের প্রতিফলন দেখতে পেলে মানুষ তৃপ্ত হয়। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর বহু বছর কেটে গেছে, অথচ তাঁর প্রজ্ঞা, আদর্শ, জীবনাচরণ, সব কিছুই মানুষের হৃদয়ে আজও শ্রদ্ধায় জায়গা করে আছে এবং দিনদিন তা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ চলে যায়, পেছনে ফেলে রেখে যায় তার হৃদয়ের আলো; আর সেই আলো দিনদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে—এই আলোর নামই আত্মা।




এ যেন ঈশ্বরেরই এক আশ্চর্য বিধান! ইহজীবনে মানুষ যে-সকল সদ্‌গুণ অর্জন করে, তা যে মৃত্যুর পর কেবল তার আধ্যাত্মিক জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে ব্যক্তিগত অমরত্বে প্রকাশ পায়, তা-ই নয়, বরং ইহজগতেও সে-সকল সদ্‌গুণ অসংখ্য মানুষের চরিত্রে, এমনকি, সমগ্র মানবজাতির জীবনে চিরদিন অক্ষয় হয়ে বেঁচে থাকে। এ সকল সদ্‌গুণ শুধুই যে স্বর্গে মানুষের প্রসন্নতা বৃদ্ধি করে, তা নয়, বরং এই ইহজগতেও অন্যান্য মানুষের চরিত্রে-জীবনে রক্ষিত ও প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে পুরুষ-পরম্পরায় সেইসব গুণ সঞ্চারিত হয়ে পুরো জাতিকে এবং সমগ্র মানবজাতিকে উন্নত ও ধন্য করে। বিধাতার এই বিধানের গুণে যেমনি মহৎ ব্যক্তির প্রাণে আনন্দের ধারা প্রবাহিত হয়, তেমনি তাঁর মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয় এবং আনন্দ লাভ করে।




প্রাচীনকালের মহাপুরুষেরা, যেমন মোহাম্মদ, কনফুসিয়াস, বুদ্ধ, চৈতন্য, সক্রেটিস, প্লেটো, যিশুখ্রিস্ট, জরথুস্ত্র, নানক, মহাবীর এবং আরও অনেক মহাত্মা আজ পর্যন্ত আমাদেরকে অশেষ উপায়ে সাহায্য করে চলেছেন। এই সমস্ত খ্যাতনামা মহাপুরুষ এবং তাঁদের পারিষদবর্গ সবাই প্রচুর পরিমাণে মানবসমাজের আধ্যাত্মিক শক্তি বিকশিত ও বর্ধিত করেছেন এবং আজ‌ও করছেন। লোকে এঁদেরকে জানুক আর না-ই জানুক, এঁরাই প্রকৃতপক্ষে স্বর্গরাজ্যের অভিজাত শ্রেণী, এঁরাই স্বয়ং ঈশ্বরের সৃষ্টি। যে জ্ঞান ও সম্পত্তি এঁরা উত্তরাধিকার-স্বত্বে নিজেদের পূর্বপুরুষগণের কাছ থেকে লাভ করেছেন এবং নিজেরা অসীম সাধনার সাহায্যে মৃত্যুর আগেই অর্জন করেছেন, জীবদ্দশায় সেটি তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে থাকলেও মৃত্যুর পর সেই সকল মহাসম্পদ সমগ্র মানবজাতির সম্পত্তির অসীম ভাণ্ডারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।




বর্তমান সভ্যজগতে এমন একটিও গরিব মানুষ নেই, যিনি এই মহানুভব মহাত্মাগণের অমূল্য আধ্যাত্মিক সম্পত্তির অংশীদার হতে পারেননি। এমন এক জন‌ও প্রতিভাশালী ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি এঁদের কৃপায় আজ উন্নততর ও মহত্তর চরিত্র লাভ করতে পারেননি। তাঁরা এই জগতের সকলেরই সম্পদ। জগতের সবাই তাঁদের দ্বারা উপকৃত, এমনকি, যাঁরা এঁদের মহৎ জীবন এবং মহৎ দৃষ্টান্তসমূহ একটুও জানেন না, তাঁরাও এই মহাপুরুষদের উপার্জিত জ্ঞান ও ভক্তির অংশীদারিত্ব হতে বঞ্চিত হননি; কারণ এ জগতে জন্মগ্রহণ করে এঁরা জনসমাজের মন ও কাজ পরিবর্তিত ও সংশোধিত করে গেছেন।




সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী আকাশ যেমনি ইথারে পরিপূর্ণ এবং এই ইথার অবলম্বন করে যেমনি সূর্যের উত্তাপ পৃথিবীতে এসে পড়ে এবং তার কাজ করতে থাকে, ঠিক তেমনি ভিন্ন ভিন্ন মানুষের চরিত্রের চারিদিকে প্রাকৃতিক ইথারের চাইতেও সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক ইথারমণ্ডল রয়েছে। এবং এই আধ্যাত্মিক ইথার অবলম্বন করেই এক ব্যক্তির ভাব ও শক্তি অন্যের উপর এসে পতিত হয়। প্রাকৃতিক আকাশের ইথারমণ্ডল যেমন কোনো ব্যক্তি বা সমাজবিশেষের সম্পত্তি নয়, তেমনি এই আধ্যাত্মিক ইথারমণ্ডল‌ও ব্যক্তিগত বা জাতীয় সম্পত্তি নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির সম্পত্তি। একে মানবসমাজের অক্সিজেন বলা যায়।




সব ধরনের আধ্যাত্মিক শক্তি ও সম্পত্তি উপার্জন যেমনি বিশেষভাবে আমাদের পরিবারের পুরুষ-পরম্পরাগত শিক্ষা ও সাধনা এবং নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিভা ও প্রজ্ঞার উপরে নির্ভর করে, মানবজাতির এই আধ্যাত্মিক অক্সিজেনের উপরেও সেটি নির্ভর করে থাকে। মানুষ তাই বেড়ে ওঠে তিন ভাবে। নিজের পরিবার থেকে শিখে, নিজের কাছ থেকে শিখে এবং মহাত্মাদের কাছ থেকে শিখে। মহাপুরুষগণ মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করেছেন, অভিনব নানান সত্যকে মানুষের বুদ্ধির আয়ত্তাধীন করেছেন। এ জ্ঞান ও সত্য পৃথিবীর সমস্ত সভ্য জাতির মধ্যে পরিব্যাপ্ত এবং উত্তরোত্তর বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বচ্ছন্দে অনুপ্রবেশ করে ক্রমাগতই মানুষের শক্তি বৃদ্ধি করছে।




একটি লৌহদণ্ড চুম্বকের সংস্পর্শে চুম্বকত্ব প্রাপ্ত হয়। শুরুতে দণ্ডটির একটি ক্ষুদ্র পরমাণু এই চুম্বকত্ব লাভ করে এবং ধীরে ধীরে তা পুরো দণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। চুম্বকত্বপ্রাপ্ত হতে হলে পরমাণুর ইলেকট্রন উদ্দীপ্ত হয়, যা পার্শ্ববর্তী সকল ইলেকট্রনেও ছড়িয়ে যায়, কেননা এই উদ্দীপনা এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না। এমন অভিনব শক্তির অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির প্রভাবেই লৌহদণ্ডের এক পরমাণু থেকে অন্য পরমাণুতে, একসময় সকল পরমাণুতে চুম্বকত্ব সঞ্চারিত হয়ে যায়। এভাবে, যে-লৌহদণ্ড আগে পাথরের মতো অসাড় ছিল, সেটি চুম্বক হবার পর অভিনব শক্তি লাভ করে এবং কেবল যে নিজে এমন শক্তি লাভ করে নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখে, তা নয়, বরং যথাযথ প্রক্রিয়ায় সেটির সংস্পর্শে কিংবা কাছাকাছি স্থাপন করা হলে অন্যান্য হাজার হাজার লৌহদণ্ডকেও তা চুম্বকে পরিণত করতে সক্ষম হয়।




নিজের স্বভাব অনুযায়ী সত্যকে নির্মল ও নিষ্কামভাবে ধারণ করে মানুষ বুদ্ধিগত ভক্তি থেকে সবচাইতে বেশি ক্ষমতা লাভ করে থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষের চোখ যেমন সহজেই আলোর দিকে ছুটে চলে, মানুষের বুদ্ধিও ঠিক একইভাবে সহজ ও সুস্থ অবস্থায় সত্যের দিকে ছুটে চলে। প্রকৃতির মধ্যে আমরা অত্যন্ত আগ্রহ ও অধ্যবসায় নিয়ে সত্যের অন্বেষণ করে যাচ্ছি। আমাদের চারপাশের এই সুন্দর পৃথিবীতে ভৌত বিজ্ঞানের যে-সকল সত্য মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে, সেগুলির অন্বেষণ ও আলোচনার জন্য সভ্য পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে বড়ো বড়ো সমিতি তৈরি হয়েছে, যেগুলি বিদ্বানদের দ্বারা পরিচালিত। এরকম সংগঠন, জাতীয় একাডেমি, ইনস্টিটিউট বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সব জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত আছে। ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য সদস্যদের বা সমগ্র মানবজাতির শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সাধন করা নয়; বরং প্রকৃতির মধ্যে যা-কিছু সত্য নিহিত রয়েছে, সেগুলির খোঁজে প্রতিষ্ঠানগুলো দিনরাত্রি গবেষণা করতে থাকেন।




উদাহরণ দিয়ে বলি। বৃহস্পতি গ্রহের কয়টি উপগ্রহ, তা জানলে কি আমাদের পকেটে পয়সা আসবে? ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিতেরা পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী সত্য লুকিয়ে আছে, তা আয়ত্ত করার জন্য এমন পরিশ্রমের মাধ্যমে তন্নতন্ন করে খুঁজে যে চলেছেন, তার আর্থিক মূল্য কতটুকু? কেউ কেউ হাজার বছরেরও আগের সময়ে কোথায় কোন জলাভূমিতে কোন মৃত জন্তুর কঙ্কাল লুকিয়ে ছিল, তা আবিষ্কার ও আলোচনা করার জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করছেন। কেউবা আবার পৃথিবীর কোথায় কোন পর্বতশিখরে কী কী পাথর পাওয়া যায়, তা সংগ্রহ করার জন্য দেশ-বিদেশে পরিভ্রমণ করছেন, আবার কেউ ভূগর্ভস্থ গাছ, লতাপাতা, জীবাশ্ম ইত্যাদিকে নিজের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়ে সেগুলির গভীর তত্ত্বের মধ্যেই সারাক্ষণ নিমগ্ন হয়ে আছেন।




সাত সমুদ্র তেরো নদী অতিক্রম করে দেশ-দেশান্তরে ছুটে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের খোঁজে ব্যস্ত রয়েছে। ঘরের সমস্ত সুখকে পেছনে ফেলে কোথাও কোনো দূরের দ্বীপে গিয়ে সেখানকার জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করতে করতে সারাটি জীবন পার করে দিচ্ছেন অনেক বিজ্ঞানী। তাঁরা তাঁদের আবিষ্কারগুলিকে সন্তানতুল্য মনে করেন, সেগুলির যত্ন করেন এবং আরও আবিষ্কারের জন্য গভীর পরিশ্রম করতে থাকেন। অথচ তাঁদের এই মহৎ প্রেমের প্রতিদান হিসেবে তাঁরা কিছুই পান না। যাদেরকে বুকে আঁকড়ে ধরে তাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরাও এইসব বিজ্ঞানীকে কোনো পোশাক, আশ্রয়, খাদ্য বা পানীয় সরবরাহ করতে পারে না।




আকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর তথ্য জানার জন্য জ্যোতির্বিদদের প্রাণে বড়ো গভীর আগ্রহ দেখা যায়, কিন্তু আকাশের সেই বাসিন্দারা গবেষকদেরকে বা তাঁদের পরিবারকে মৌলিক চাহিদাসমূহের একটিও দিতে পারে না। আমরা দেখেছি, মৃত্যুভয়ও গ্যালিলিওকে নক্ষত্রের তত্ত্বানুসন্ধান থেকে বিরত করতে পারেনি। কৃপণ ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখুন। জগতের সমস্ত সম্পদের তুলনায় সে তার নিজের সম্পদকেই বেশি ভালোবাসে। এই সম্পদের জন্য সে নিজের বুদ্ধি, বিবেক ও ধর্মজ্ঞান, সব কিছুই জলাঞ্জলি দিতে পারে, এমনকি, পরিবারের সাথে সকল বন্ধন ছিন্ন করতে পারে। বিজ্ঞানের প্রকৃত ভক্ত বৈজ্ঞানিক সত্যকে এমন কৃপণের ধনের চাইতেও বুকে বেশি করে আঁকড়ে ধরেন এবং সেই সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সব ধরনের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত। অত পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতে গিয়ে তাঁকে যে ত্যাগটা স্বীকার করতে হয়, তা ভাবতেও অবাক লাগে।




সত্যের প্রতি এমন নিষ্কাম ও পবিত্র প্রেম জ্ঞানী ব্যক্তিকে আজীবন শান্তি ও তৃপ্তি দিলেও তাঁর আবিষ্কৃত সত্য তাঁর ঘরে আসে একেবারেই খালি হাতে; সত্যের হাতে বিজ্ঞানীর জন্য কোনো কিছুই থাকে না; তাঁর ঘরের সদস্যদের জন্য কোনো ধরনের উপহার বা খাদ্যসামগ্রী সত্যের হাতে থাকে না, এ জগতের কোনো মূল্যবান পার্থিব বস্তুই সত্য সঙ্গে করে তার দ্রষ্টার ঘরে নিয়ে আসে না। মানুষের সমস্ত বুদ্ধিগত ও আত্মাগত অর্জনের কোনো আর্থিক মূল্য না থাকলেও সেগুলির তৃপ্তিমূল্য অসীম। আত্মিক ও আধ্যাত্মিক খাদ্য ছাড়াই যে-মানুষ বেঁচে আছেন, তিনি মানবজন্মের সর্বোচ্চ স্তরের সুখ ও স্বস্তিগুলি থেকে বঞ্চিত।