ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৮)

যে-কোনো ব্যক্তিই এই ভক্তি লাভ করতে পারেন। ভক্তিলাভ করার সামর্থ্য সকলেরই রয়েছে, কিন্তু তাই বলে ভক্তি খুব সহজলভ্য বস্তু নয়। অনেক শ্রম ও সাধনার বিনিময়ে, উচ্চতর স্বার্থের প্রতি আকর্ষণ ও বিভিন্ন প্রকারে বারবার নিম্নতর স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারলেই কেবল ক্রমে ক্রমে এই ভক্তিলাভ করা সম্ভব। এই ভক্তিলাভ করতে হলে আমাদেরকে অশেষ পরিশ্রম ও অবিশ্রান্ত সাধনা করতে হবে। কৃষক যদি তাঁর ভূমি ফসলের জন্য উপযোগী করতে চান, তবে অশেষ পরিশ্রমের সাহায্যে ভূমিকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করতে হয়। যখন ছয়টি রিপুর উত্তেজনা আমাদের বশীভূত করে ফেলার চেষ্টা করে, তখন আমাদেরকে প্রাকৃত বাসনাগুলিকে বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় ও আত্মার স্বাভাবিক সুবিবেচনা, ন্যায়পরায়ণতা, প্রেম এবং পবিত্রতার সাহায্যে সবসময়ই সংযত রাখতে হবে। ইন্দ্রিয়ের প্রতি আসক্তিকে আত্মার প্রেমভাবের দ্বারা বশীভূত করে রাখতে হবে।




জীবনে ধন, মান, যশ ইত্যাদি লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই অভূতপূর্ব স্ফুরণের সময় সবসময় সব ধরনের সংকীর্ণ ও ব্যক্তিগত স্বার্থভাবকে অন্যনিরপেক্ষ সত্য, মঙ্গল, পুণ্য ও প্রেমভাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং তা করতে গেলেই সবসময় আমাদেরকে বিশেষ প্রকারের ত্যাগস্বীকার করতেই হবে—কখনোবা ইন্দ্রিয়বাসনাকে সংযত, কখনোবা স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছাকে প্রতিরোধ করতে হবেই হবে। এইভাবে অনেক বিষয়ে আমাদেরকে স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে, কিন্তু এ দ্বারা আমাদের নিজ নিজ বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় ও আত্মা আরাম, শান্তি ও বিকাশ লাভ করবে।




আমাদেরকে সত্য, ন্যায়, পবিত্রতা বা প্রীতি বিসর্জন দিতে হবে না, কিন্তু ইন্দ্রিয়কামনা ও বিষয়বাসনা আগের চেয়ে সংকুচিত করলে ও বিসর্জন দিলেই এই সকল আধ্যাত্মিক সম্পদ আমরা আরও অধিক মাত্রায় লাভ করব—বর্তমানের জন্য এবং ভবিষ্যতের জন্য—নিত্যকালের জন্যই সত্য, ন্যায়, মঙ্গল, প্রীতি ও পবিত্রতা আমাদের জীবনের ভূষণ হয়ে যাবে। এতে আমরা অনির্বচনীয় আত্মপ্রসাদ লাভ করব। হৃদয়ে অসীম বল, অন্তরে অসীম শান্তি, জীবনে অসীম মাধুরী এবং ভগবানের সঙ্গে থেকে আমরা অপূর্ব আনন্দ লাভ করব; তিনিও আমাদের অন্তরে সাবলীলভাবে বিচরণ করবেন।




অধ্যাত্মযোগে বিধাতার সঙ্গে ও প্রেমযোগে জগতের মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জীবনযাপন করা এবং উত্তরোত্তর এই উভয় প্রকারের যোগের অধীনতার ঘনিষ্ঠতা লাভ করা—এর চাইতে বড়ো সৌভাগ্য আর নেই। এভাবে জীবনযাপন করতে পারলে মানবজন্ম সার্থক হয়। তাই নিজের মনুষ্যত্বের এমন উৎকর্ষসাধনে যত্নশীল হতে হবে, তাতে অনন্তকালের জন্য সিদ্ধিলাভ হবে।




আমরা যেন নিজের আত্মার অস্তিত্ব অনুভব করে নিজেকেই বলি: হে অনন্তপুরুষ! তোমাকে অন্তরে আকাঙ্ক্ষা জানাবার জন্য আমাদের বাক্যের প্রয়োজন হয় না। তুমি অন্তর্যামী, অন্তরে অবস্থান করেই দেখছ যে, আমাদের প্রাণ তোমার কাছে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। আমরা তোমার শক্তিকে প্রণাম করি; তোমার জ্ঞানকে পূজা করি; তোমার মঙ্গলভাবে মনপ্রাণ সঁপে ভজনা করি; তোমার প্রীতিতে আনন্দিত হই এবং তোমার সাহচর্য লাভ করে ধন্য হতে চাই। আমরা জানি, আমাদের কাছে তুমি কোনো বাহ্যিক বলিদান চাও না, আমাদের ভাষার নৈবেদ্যেরও তোমার কোনো প্রয়োজন নেই; কিন্তু আমরা তোমারই জগতে বাস করছি, তোমারই সদা-কল্যাণব্রতে প্রতিপালিত হচ্ছি, তোমারই দেওয়া বাতাস গ্রহণ করে জীবনধারণ করছি। তোমারই শক্তি আমাদেরকে রক্ষা করছে, তোমারই মঙ্গলভাব আমাদেরকে পরিচালিত করছে, তোমারই দয়া আমাদেরকে নিরাপত্তা দিচ্ছে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত তোমারই প্রেম আমাদেরকে আনন্দ প্রদান করে যাবে।




হে পরমেশ্বর! আমরা তোমার প্রশংসা না করে থাকতে পারি না; আর যতই স্তব-স্তুতি করি না কেন, কিছুতেই যেন প্রাণের সাধ মেটে না। আমরা বিনীত হৃদয়ে তোমাকে প্রণাম করি। আমরা ক্ষণকালের জন্য হলেও তোমার সান্নিধ্যে থেকে আমাদের আত্মাকে সরস ও সবল করতে চাই, যেন তোমার প্রসাদে জীবনের কর্তব্যপালনে আরও বেশি সক্ষম হতে পারি, যেন সহজে জীবনের সকল পরীক্ষা এবং শোক-দুঃখসমূহ সহ্য করে পরিণামে তোমারই অক্ষয় আনন্দলাভে সক্ষম হই।




এই বিচিত্র জগতে আমাদেরকে স্থাপন করেছ বলে আমরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। আমাদের চারিদিকে জল ও প্রকৃতি কখনোবা সূর্যের আলোতে রঞ্জিত হয়ে প্রশান্তভাবে বিরাজ করে, কখনোবা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে প্রবল মাত্রায় আন্দোলিত হয়; কিন্তু আমরা সুদিনে ও দুর্দিনে সকল সময়ে তোমার রক্ষণাবেক্ষণে বাস করে ধন্য হচ্ছি। ইহজীবনে আমরা যা-কিছু লাভ করেছি, তার সব কিছুই তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ এবং ভবিষ্যতে আরও হাজারো পথে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করবে বলে তুমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। আমরা তোমাকে স্তুতি করি, আমাদের প্রতিদিনের জীবনের জন্য তোমাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।




আমাদের শক্তিচালনার জন্য তুমি যে-সকল কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছ, আমাদের হৃদয়ের বলবৃদ্ধির জন্য যে-সকল পরীক্ষা-প্রলোভনের মধ্যে তুমি আমাদের নিক্ষেপ করছ—জাগ্রত অবস্থায় যাঁরা আমাদেরকে চোখে আনন্দ দেন এবং রাত্রিকালে স্বপ্নেও যাঁরা আমাদের সামনে থেকে অবিরত ধারায় হৃদয়ে আনন্দবর্ষণ করেন, এমন‌ই যে-সকল প্রিয় বন্ধুবান্ধব তুমি আমাদেরকে দিয়েছ, এর সব কিছুর জন্য আমরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।




এ হৃদয়ের প্রভু! তোমার যে সুকোমল বিধাতৃশক্তি আমাদের সকলকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। তোমার যে-দয়া আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের সুখবিধান করছে—যা তোমার সাধুচরিত্রের সন্তানদেরকে সততই প্রেমদান করে এবং পাপীর প্রতিও সতত স্নেহশীল, তার জন্য আমরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরা জানি, আমরা অনেকসময় তোমার সত্য পথ হতে ভ্রষ্ট হ‌ই। আমরা জানি, আমরা তোমার বিধান অনেকসময় ভুলে যাই। আমরা জানি, অনেকসময় এই অনিত্য সংসার আমাদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে থাকে এবং আমরা রিপু ও ইন্দ্রিয়সমূহের দাসত্ব গ্রহণ করে থাকি।




তবু, তোমার অলৌকিক দয়া ও অনন্ত প্রেমের কথা স্মরণ করে—তুমি যে সতত তোমার সন্তানদের মঙ্গলসাধনে ব্যস্ত এবং মেষপালক যেমনি করে দুর্বল মেষশাবককে নিজের বুকে করে বহন করে ও স্নেহভরে প্রত্যেক বিপথগামী মেষশিশুকে নিজের ঘরে নিয়ে চিকিৎসিত করে, ঠিক তেমনি তুমিও দুর্বল মানুষকে তোমার বুকে করে বহন করো ও পথভ্রষ্ট পাপাচারীকে তোমার অক্ষয়ধামে নিয়ে যাও। এসব কথা স্মরণ করে আমরা আশা ও আনন্দ লাভ করি।




তবু, তোমার অলৌকিক দয়া ও অনন্ত প্রেমের কথা স্মরণ করে—তুমি যে সতত তোমার সন্তানদের মঙ্গলসাধনে ব্যস্ত এবং মেষপালক যেমনি করে দুর্বল মেষশাবককে নিজের বুকে করে বহন করে ও স্নেহভরে প্রত্যেক বিপথগামী মেষশিশুকে নিজের ঘরে নিয়ে চিকিৎসিত করে, ঠিক তেমনি তুমিও দুর্বল মানুষকে তোমার বুকে করে বহন করো ও পথভ্রষ্ট পাপাচারীকে তোমার অক্ষয়ধামে নিয়ে যাও। এসব কথা স্মরণ করে আমরা আশা ও আনন্দ লাভ করি।




হে ঈশ্বর! জ্ঞান, বিশ্বাস ও সাধুতা সহকারে সংসারসম্ভোগ করতে তুমি আমাদেরকে শিক্ষা দাও। এখানকার প্রতিদিনের কাজ ও পরীক্ষার মধ্যে আমরা যেন জ্ঞান, মঙ্গল এবং ভক্তি লাভ করতে সমর্থ হ‌ই। তুমি যে-সকল পরীক্ষা-প্রলোভন আমাদের সামনে পাঠাও, তার প্রত্যেকটি হতে যেন আমরা সৎশিক্ষা লাভ করি। তুমি যে-সকল আপদ-বিপদ ও দুঃখ-ক্লেশ উপস্থিত করো, তা হতেই যেন আমরা শক্তিলাভ করি এবং নিজের অপরাধের জন্য নতমুখে বিষাদের তিক্ত অশ্রু পান করতে হলেও সেটি দ্বারা যেন জীবনে নতুন স্বাস্থ্য ও নতুন তেজ লাভ করতে সমর্থ হ‌ই।




আমাদেরকে আমাদের আত্মার সঙ্গে শান্তিতে বাস করতে সাহায্য করো। এই হাজারো তন্ত্রীর একটাও তন্ত্রী যেন আমরা বেসুরো করে না বাজাই, এবং সকল তন্ত্রীর মধ্যেই যেন সুন্দর সামঞ্জস্য বিদ্যমান থাকে এবং আমাদের জীবন যেন তোমারই এক মহান জয়গানরূপে এই জগতে প্রচারিত হতে পারে, তুমি এই আশীর্বাদ করো। আমরা কোনো কিছু পাবার জন্য অশ্রুআকুল চোখে প্রবল চিৎকার করে প্রার্থনা করলেও যদি তা আমাদের জন্য অমঙ্গলকর হয়, তবে তা সবসময় আমাদের কাছ থেকে দূরে রেখো। আমাদের জন্য যা ভালো, তুমি তা-ই করো।




তোমার প্রিয়পাত্রদের স্বার্থের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা করে তাঁদের দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে এবং তাঁদের সফলতাতে ঈর্ষান্বিত না হয়ে আর নিজের মতো করে তাঁদেরকে প্রীত করে তাঁদের সঙ্গে সৎভাবে ও একতাতে বাস করতে তুমি আমাদেরকে সাহায্য করো। যারা আমাদের প্রেমকে আকর্ষণ করতে পারে না, তাদেরকে ভালোবাসতে শিক্ষা দাও। যারা আমাদের অকল্যাণ সাধন করতে চায়, তাদের কল্যাণ সাধনে আমাদের মানসিকভাবে সক্ষম করো। যারা এই পৃথিবীর পাপের ভার বৃদ্ধি করে যাচ্ছে, তাদের উদ্ধার করার জন্য আমরা যেন ভালো কাজ করতে পারি। যাতে সকলে তোমাকে পিতা, মানুষকে ভাই ও বোন বলে চিনতে পেরে তোমার প্রতি বিশ্বাসী ও মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে সমর্থ হয়, সেজন্য আমাদেরকে ধৈর্য সহকারে পরিশ্রম করার শিক্ষা দাও। তোমার সাথেও এক হয়ে বাস করতে আমাদের সক্ষম করো। আলস্য যেন আমাদেরকে তোমার দৃষ্টির অন্তরালে নিয়ে না যায়। রিপুর উত্তেজনা যেন আমাদেরকে তোমার বিধান হতে ভ্রষ্ট না করে। বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় ও আত্মা দ্বারা আমরা যেন তোমার সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত হয়ে যাই যে, তোমার সত্য আমাদের বুদ্ধিতে বাস করবে, তোমার মঙ্গল আমাদের বিবেককে আলোকিত করে রাখবে এবং তোমার প্রেম আমাদের হৃদয়ে-আত্মাতে অক্ষয় অনন্ত আনন্দের উৎস হয়ে চিরদিন প্রবাহিত হতে থাকবে।