ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৭)

অন্তর্নিহিত বৃত্তিসমূহের শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাণে এমন এক গভীর ও অটল শান্তি এসে উপস্থিত হয়, যা এ পৃথিবীতে আর অন্য কিছুতেই পাওয়া যায় না এবং ভক্তের চরিত্র এমনই এক অপূর্ব সৌন্দর্য লাভ করে, যা এ পৃথিবীতে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বুদ্ধিগত, বিবেকগত এবং হৃদয়গত ভক্তি অধ্যাত্মযোগের সাহায্যে সজ্ঞান ভগবদ্‌প্রেমের সাথে যখন মিলিত হয়, বিবিধ অংশের সমন্বয়ে তৈরি এই ভক্তি যখন প্রাত্যহিক জীবনে সাধুতারূপে বিকশিত হয়ে ওঠে এবং এই সাধুতা যখন পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণে প্রবৃত্ত হয়, তখন ভক্ত এই পৃথিবীতে মানবজীবনের চরম উৎকর্ষ ও শোভা উপভোগ করেন এবং তাঁর মনের শক্তি, হৃদয়ের প্রশান্তি এবং আত্মার অলৌকিক মধুরিমা অভ্রভেদী শালগাছের মতো এই সংসারে লোকারণ্যের মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।




কেউ কেউ ভক্তির নাম শুনলেই বিদ্রুপ ও উপহাস করে থাকেন। এমন বিদ্রুপে আমি বিস্ময়ের কিছু দেখি না, কারণ প্রকৃতপক্ষেই, ক্ষুদ্রতা, নীচতা, হিংসা, সংকীর্ণতা, কপট কুসংস্কার এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রকারের অকথ্য জঘন্যতার প্রতিমূর্তি হিসেবে ভক্তি জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সচরাচর লোকে যাকে ভক্তি বলে, তার অভাব কোথাও নেই। এই ভক্তি পথের পাশে আগাছার মতো পৃথিবীর সব জায়গাতে প্রচুর পরিমাণে গজিয়ে উঠে সমাজচক্রের গতিরোধ করছে, কিন্তু প্রকৃত ভক্তি—গুণে ও পরিমাণে পরিণত ও পরিপক্ব মানুষের সম্পূর্ণ উপযোগী ভক্তি—সব জায়গাতেই অতি বিরল। এই এক ভক্তির অভাব হতেই মানুষের চরিত্রে আরও শত শত প্রকারের অভাব ঘটে, যা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।




পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে যুগে যে-সকল খ্যাতনামা পুরুষের নাম লেখা হয়েছে, তাঁদের দিকে তাকানো যাক। তাঁদের চরিত্র ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাঁদের করা বিভিন্ন কাজের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যগুলি বিচার করা যাক। তাঁদের জীবনের অশেষ প্রকারের দুর্গতি ও ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যাক। দেখা যাবে, এক ভক্তির অভাবেই এ সকল কর্মঠ জীবনও অপেক্ষাকৃত অকেজো হয়ে পড়েছিল। এঁরা অনেকেই সত্য, মঙ্গল বা প্রেমভাবকে ভালোবাসতেন না। সমস্ত মন, সমস্ত বিবেক, সমস্ত হৃদয় ও সমস্ত আত্মার দ্বারা পরমাত্মাকে প্রীত করা কাকে বলে, তা জানতেন না। এই কারণেই এই সকল উন্নত মনের ব্যক্তিদের জীবন একেবারে বিফলে শেষ হয়েছে।




জীবন সাজাতে সাফল্যের প্রয়োজন, আর জীবন বাঁচাতে প্রয়োজন শান্তির। ঈশ্বরপ্রেমের শরণাগত না হলে প্রকৃত শান্তির দেখা পাওয়া খুবই কঠিন। গভীর চিন্তাশক্তি ও ধৃতি, উদার অনুভূতি, অদ্ভুত বিচারক্ষমতা এবং এ ধরনের বিবিধ উন্নত গুণের অধিকারী অসংখ্য মানুষ কালে কালে অশান্তি ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। ধর্মের শক্তি, শান্তি এবং পবিত্রতার অভাবে এই সকল পৃথিবীবিখ্যাত লোকের জীবনে শোচনীয়ভাবে শক্তিক্ষয় হয়েছে। প্রতিভা ও বিদ্যা ধর্মের সংসর্গে এলে বিকশিত হয়, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, যাঁর প্রতিভা ও বিদ্যা আছে, তিনি ধর্মের কাছাকাছি আসতেও কুণ্ঠিত হন এবং ঈশ্বরের নাম শুনলেও তাঁর নাক অবজ্ঞায় কুঁচকে যায়। এর কুফল সমাজে কতটা বেশি পরিমাণে ঘটছে, তা খুঁজতে বেশিদূর যেতে হয় না। শক্তি ও ভক্তি—এই দুই মিলেই শান্তি।




বর্তমান জগতে সুখী হতে চাইলে প্রথমেই প্রকৃত ভক্তির সন্ধান করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে ও প্রকৃত আকারে এই ভক্তি লাভ করা সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাবসা-বাণিজ্যের যে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে, তাতে মানুষের শরীর ও মন বৈষয়িক কাজ সম্পাদনের জন্য নিরতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মানুষের মস্তিষ্কে সারাক্ষণই ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। উপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজতে খুঁজতে মানুষ আজ নিজের সাথে সময় কাটাতেই ভুলে গেছে। প্রকৃতির শক্তিগুলি খুব অদ্ভুতভাবে আজ মানুষের বুদ্ধির কাছে পরাস্ত হয়ে তার হাতে আত্মসমর্পণ করছে। মানুষের আদেশে নদীর স্রোত নিজের স্বাভাবিক গতি বদলে ফেলে সন্তুষ্ট চিত্তে মানুষের দাসত্বে নিযুক্ত হচ্ছে। সাগর মানুষকে মণি-মুক্তা-প্রবালসহ বিভিন্ন মূল্যবান ধন-সম্পত্তি দান করছে এবং নতমস্তকে বাণিজ্যের সমস্ত জাহাজ নিজের বুকে ধারণ করে মানুষের সেবা করছে। বিদ্যুৎ যেন স্বর্গ হতে পৃথিবীতে অবতরণ করে মানুষের চিন্তা ও ভাবনার ভার এক নগর হতে আরেক নগরে পাঠিয়ে দিচ্ছে।




এ সবই মানুষের প্রাকৃত বুদ্ধির পরিচালনার ফসল, কিন্তু এর মতন করেই কি অনুশীলন হচ্ছে সজ্ঞান ভক্তির? নিম্নতর বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কি সত্য, মঙ্গল ও প্রেমের দিকে সচেতনভাবে প্রীতি ও মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়ে ভগবদ্‌প্রীতি ও ভক্তির পরিস্ফুটন ঘটছে? রাজশক্তির আধার রাজা ও রাজকর্মচারীগণ, ধর্মশক্তির রক্ষক পুরোহিতগণ, সমাজশক্তির পরিচালক দলপতিগণ ও পারিবারিক শক্তির অবলম্বন নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাগণ—এঁদের সকলকে জিজ্ঞেস করে দেখলে দেখা যাবে, ওঁরা যে-উত্তর দেবেন, তা আমাদের মনে প্রীতির উৎপাদন করছে না।




অতীতে যতটুকু ভক্তি থাকলে তা মানুষের জন্য যথেষ্ট বলে পরিগণিত হতো, বর্তমানে ততটুকু ভক্তি কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। প্রাচীনকালের ঋষি, ধর্মপ্রবক্তা, ধর্মপ্রচারক, ধর্মসংস্কারক প্রভৃতি সরলসহজ মানুষ যতটুকু জটিলতার মুখোমুখি হতেন, বর্তমান সময়ে তার চাইতে অনেক বেশি পরিমাণে জটিলতার মধ্যে মানুষকে বাঁচতে হয়। তাই আধুনিককালের মানুষের উন্নত ও জটিল জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ভক্তির পরিমাণ অনেক বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন বিদ্যুতের গতিতে চিন্তা করে, মন্থর গতিতে আরাধনা তখন চলে কি? মানুষের চিন্তাশক্তির যে-উন্নতি হয়েছে, ঈশ্বরপূজা ও ভগবদ্‌ভক্তিরও ঠিক একই অনুপাতে বিকাশ হওয়া সমীচীন।




প্রাচীনকালের তত্ত্ববিদ্যা ও প্রাচীন সময়ের শাস্ত্র, দর্শন, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি আধুনিক সময়ের উপযোগী ধর্মলাভের জন্য কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না। এখন আমরা বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় এবং আত্মার উপযোগী ধর্ম চাই। মানুষের সমস্ত অন্তর্বৃত্তির বিকাশ ও তৃপ্তিসাধনের উপযোগী এক অভিনব ধর্মের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যেমন এই ধর্মের প্রাণ, তেমনি এর শরীর; যেমন তার আন্তরিক ভাব ও ভক্তি, তেমনি তার বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপ; এই নতুন যুগের নতুন ধর্মের সমস্ত কিছুই সহজ ও নতুন হওয়া আবশ্যক। সহজ করে বলতে গেলে, সাধুতা এবং লোকপ্রীতির অবয়বে সহজ ভক্তি লাভ করাই আমাদের একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।




সংসারকে পরিহার করার জন্য নয়, বরং তাকে অধিকার করার জন্যই ভক্তির প্রয়োজন। অরণ্যবাসী যোগী-ঋষি-ভৈরবীদের জীবনে প্রকটিত হবার জন্য নয়, বরং গৃহস্থ নর-নারী'র চরিত্রে বিকশিত হয়ে ঘরের শোভা বাড়ানোর জন্যই ভক্তির আবশ্যক। মানুষের জীবনের বিভিন্ন দুরূহ কর্তব্যসাধন কে করবে? নিশ্চয়ই ভক্তি। নাস্তিক অবিশ্বাসীদের মতো স্বার্থভাবের পরিচালনায় নয়, বরং ধর্মবুদ্ধির প্রেরণায় বিধাতা-পুরুষের বিধানের অনুগামী হয়ে ভক্তকেই জ্ঞাতসারে এ সকল কর্তব্যপালন করতে হবে।




ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রচলিত পাপ ও দুর্নীতিকে কে নিবারণ করবে? ভক্তিই তো, তাই না? বণিকের, কারিগরের, আমলার, কৃষকের, চিকিৎসকের, উকিলের বৃত্তি অবলম্বন করেও জীবনের কর্মক্ষেত্রে মানুষ প্রকৃত সাধু, প্রকৃত সন্ন্যাসী হতে পারে—ভক্তকে এটাই প্রমাণ করতে হবে। দর্শনের, তত্ত্ববিদ্যার বা নীতিশাস্ত্রের ভ্রান্তি কে অপনোদন করবে? সেই ভক্তিই! এই সমস্ত ভ্রান্তি ও কুসংস্কার দূর করে ভক্তিকেই ঈশ্বরের জ্ঞান ও প্রেমালোকে সমুজ্জ্বল নতুন সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।




ধর্মীয় ব্যবস্থার বা শাসন প্রণালীর, সামাজিক বা পারিবারিক জীবনের কোনো লক্ষণীয় অনিষ্ট দূর করা, কোনো অত্যাচারের প্রতিবিধান করা বা অমঙ্গলের হাত হতে মানুষের সমাজকে মুক্ত করা—এ সকলই ভক্তির কাজ। এ যুগে ধর্মজীবনের প্রশস্ত পথ পরিত্যাগ করে কখনোই কেউ সুখী হতে পারে না। ধর্মকে জনাকীর্ণ রাজপথে পরিভ্রমণ করতে হবে, লোকাকীর্ণ বিপণিকেন্দ্রে দোকানপাট খুলে বসতে হবে এবং মুখের কথায় নয়, বরং অনুষ্ঠিত কর্মকাণ্ডের দ্বারা ও নিজের জীবনের দ্বারা লোকসমাজকে ভক্তিশিক্ষা দিতে হবে। ভক্তিকে এখন আর প্রাচীনকালের সাধু ও সন্ন্যাসীদের মতো অরণ্যে রোদন করলে হবে না, বরং লোকালয়ের মধ্যে নর-নারী'কে ধর্মের সহজ-সরল-সত্য পথে আহ্বান করতে হবে।




এই ভক্তির বিবিধ অঙ্গ লাভ করতে হলে আমাদেরকে বুদ্ধিগত, বিবেকগত ও হৃদয়গত সর্বাঙ্গীণ ভক্তিসাধন করতে হবে। এই যুগে মানুষ ধর্মের নামে দর্শন কিংবা বিজ্ঞানের প্রতি নিরাপদে তুচ্ছতাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে আর পারবে না; ইন্দ্রিয়াচারী বলে মানুষের বুদ্ধির প্রতি ঘৃণা বা ন্যায় ও মঙ্গলের নিত্য বিধানের প্রতি ভ্রুকুটি কিংবা জনসাধারণকে নরকের আগুনে নিক্ষেপ করার ভয় দেখালেও চলবে না। সাধুতাবর্জিত বা প্রেমবর্জিত ধর্মকে, ভণ্ডের ভণ্ডামি বলে লোকে মনে করবেই করবে। জ্ঞান কি ধর্মশূন্য হয়ে কখনো আমাদের তৃপ্তিসাধন করতে পারে? ভক্তির অভাবে জ্ঞান পর্যন্ত নিজের সংকীর্ণতা অনুভব করে থাকে। মহৎ প্রতিভা ও ক্ষুদ্র বুদ্ধি, সকলেই এক মূল নিয়মে পরিচালিত ও পরিবর্ধিত হয় এবং সকলেরই ঈশ্বরপ্রীতির বিশেষ প্রয়োজন। ভক্তিকে অবহেলা ও অগ্রাহ্য করে সবচাইতে প্রতিভাশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিগণ সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন।