ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৬)

মনে রাখা দরকার, ভক্তির একটা স্বাভাবিক বিকাশ আছে। শক্তিশালী ব্যক্তির শক্তির কিংবা জ্ঞানী ব্যক্তির জ্ঞানের প্রকৃত ব্যবহার হচ্ছে জীবনের কর্তব্যসাধনে সেই শক্তি বা জ্ঞান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। ব্যক্তির খামখেয়ালিপনার কারণে শক্তি বা জ্ঞান তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। ঠিক একইভাবে, ভক্তিরও সংগত ব্যবহার হচ্ছে সেটিকে জীবনের লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যবহার করা; সবাই যেন নিজ নিজ স্বাভাবিক কাজকর্ম করার সময় মনোবৃত্তির ক্ষমতা অনুযায়ী ভক্তিকে ব্যবহার করে। ঈশ্বর সত্য-মঙ্গল-প্রেমময়, ঈশ্বরপ্রেমও স্বভাবতই সত্য-মঙ্গল-প্রেমভাবপূর্ণ হয়ে জীবনে প্রকাশিত হয়—এই সত্য‌, মঙ্গল ও প্রেমের সাধন‌ই মানুষের জন্য একমাত্র উপযোগী বিধান; নতুবা কেবল কিছু মত ও পথে বিশ্বাসস্থাপন করা, কিংবা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়া, কিংবা ধর্মের কোনো আচারঅনুষ্ঠানে বুঝে না বুঝে যোগদান করা, এর বাইরে আর কিছুই মানুষ করতে পারে না, যদিও প্রকৃত ভক্তির সাথে এসবের তেমন কোনো সম্পর্কই নেই। ভক্তি কী, তা না জেনেই মানুষ নিজেকে ভক্ত দাবি করে বসে থাকে।




ভক্তের ভাব হৃদয়ে ধারণ করে তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে সদাচারী, ন্যায়বান ঈশ্বরপ্রেমিকের চরিত্র লাভ করাই ভক্তির সহজ ও স্বাভাবিক প্রকাশ। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত না ঘটলে ভক্তি সবসময়ই মানুষের জীবনে সাধুতার জন্ম দেয় এবং ভক্তকে সব বিষয়ে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল ও তাঁর বিধানের প্রতি অনুগত করে রাখে। এমন আনুগত্যই শান্তি ও উন্নতির প্রধান চাবিকাঠি। এভাবেই ভক্তির শক্তি, ভক্তের অন্তরের ভাবুকতাকে অহেতুক নষ্ট না করে, মানুষকে নিজের কর্তব্যকর্ম পালনে সাহায্য করে।




গুণের তারতম্য না থাকলেও ভিন্ন ভিন্ন জীবনে ভক্তির পরিমাণের তারতম্য থাকে এবং এ কারণেই, সাধুতার তারতম্য‌ও ঘটে থাকে। ভক্তি যেখানে অল্প, সাধুতাও সেখানে কেবল শুকনো কর্তব্য বা অকেজো নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ভক্ত তখন হৃদয়ের আগ্রহে নয়, বরং বৈরী ও সহিংস ধর্মসেনাদের ভয়ে ও জোরে সাধুর মতন আচরণ করে থাকে। তখন কর্তব্যের সঙ্গে বাসনার মিলন ঘটে না, কিন্তু কর্তব্যবুদ্ধি অধিকতর শক্তিশালী বিধায় বাসনা ও বিষয়বুদ্ধিকে দমন করে রাখে মাত্র। এটাই ধর্মজগতের শিশুদের সাধুতা; ঘটনাচক্রে, সংসারেও সাধারণত এটাই সাধুতা নামে অভিহিত ও সমাদৃত। অনেকেই এভাবে আশেপাশের লোকেদের গায়ের জোরে সাধুতার চর্চা করতে বাধ্য হয়। এ পৃথিবীর অনেক মানুষই, ধর্মপালন করে না, বরং করতে বাধ্য হয়। নিজের স্বর্গের কোনো খোঁজ নেই, অথচ অন্যের স্বর্গ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, এমন অপদার্থের সংখ্যা এ সমাজে অনেক।




প্রকৃত ভক্ত ক্রমেই সাধুতার এই অঙ্কুরাবস্থা অতিক্রম করে ওঠেন। ধীরে ধীরে তার মধ্যে ঈশ্বরপ্রেম বাড়তে থাকে এবং তার‌ই সাথে সাথে মানুষ পরিপুষ্ট হয়। সাধুতা তখন আর কঠোর সাধনের কোনো বিষয় থাকে না, বরং চরিত্রের সহজ ও স্বাভাবিক ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। সেসময় যে-কোনো ধরনের ভালো কাজ নিজের জীবনপথে এসে উপস্থিত হলে ভক্ত উৎসাহ ও উল্লাসের সাথে তা সম্পাদন করেন; এবং নিজের বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় এবং আত্মার সহজ ও প্রকৃত বিকাশ সাধনেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখ অনুভব করেন। সকল প্রাণের মধ্যে আত্মা বাস করেন, এমন দিব্যদৃষ্টি লাভ করার কারণে কারও প্রতি কোনো ধরনের অন্যায় বা অসংগত আচরণ করার বিষয়ে ভক্তের মনে কখনোই প্রবৃত্তি জন্মায় না; এমনকি, অন্যের কল্যাণে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিতে হলেও, তাতেই ভক্ত পরম পরিতোষ লাভ করে থাকেন।




অত্যন্ত কঠোর ও ক্লেশকর যা-কিছু, ভক্তের কাছে তা-ই অতি সহজ এবং সুখপ্রদ মনে হয়। ভক্তের মনের এমন শক্তি সাধারণ মানুষের মনের শক্তির চাইতে অনেক বেশি হয়। ভক্তের অন্তরে বাসনা ও কর্তব্যবুদ্ধির দ্বন্দ্বের আপনাআপনি নিবৃত্তি হয়ে যায়। এ কারণেই, ভক্তের শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। অসহায় দরিদ্র লোকেরা অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখোমুখি হলে ভক্তের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ভক্ত তখন বিবেকের তাড়নায় তাদের দুঃখমোচনে নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে থাকেন। সাধুতার চর্চা যাঁরা করে, তাঁদের জীবনে ভক্তি ঠিক এরকম আকারই ধারণ করে।




হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, এবং সভ্যজগতের সকল ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেই এই শ্রেণীর ভক্ত দেখতে পাওয়া যায়। পরিবারের মধ্যে এঁরা স্নেহশীল, সমাজে উদার চরিত্রের; এঁদের বৈষয়িক আচার-আচরণ সন্দেহাতীতভাবে ভালো এবং এঁদের সামগ্রিক জীবন পরম সুন্দর ও অনুকরণীয়। সংসারের গুরুতর কার্যকলাপে কিংবা অবসরের সময়ে খেলাধুলা ও গল্পে-আড্ডায় এঁদের ভক্তিভাব নম্রতা ও বিনয়ের সাথে প্রকাশিত হয়। কি সামাজিক, কি ধর্মবিষয়ক, কি রাজনীতি-সম্পর্কিত, সব ধরনের কর্মকাণ্ডেই এঁদের জীবনে ভক্তির ভাব সুস্পষ্টরূপে দেখা যায়।




ভক্তিবিকাশের এখানেই কিন্তু শেষ নয়। ভক্তির দ্বারা সাধক আরও পরিতৃপ্তি লাভ করেন। সত্যের মঙ্গল এবং প্রেমভাবের প্রতি তাঁর অনুরক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ভগবদ্‌ভক্তি তাঁর প্রাণে আরও প্রকটিত হয়ে ওঠে। অন্তরে যা ভক্তি, বাইরে সেটি নীতি ও সাধুতা। অন্তরস্থিত ভক্তির গুণ ও পরিমাণ অনুযায়ী বাইরের সাধুতাও গুণে এবং পরিমাণে স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই অতি উৎকৃষ্ট ধরনের ভক্তি, অতি উৎকৃষ্ট ধরনের নীতি একসময় বিশ্বপ্রেমরূপে অনুভূত হবেই হবে। ভক্ত তখন আর কেবল নিজের কাছের আত্মীয়-স্বজনগণকে বা নিজের মাতৃভূমিকেই সেবা করেন না, বরং তাঁর প্রেমভাব ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এই গভীর ও উচ্ছ্বসিত মানবকল্যাণ দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে আর আবদ্ধ থাকতে না পেরে ব্যক্তিজীবনের সকল সীমা অতিক্রম করে জলপ্লাবনের জলরাশির মতো সকলের শুকনো জীবনক্ষেত্রকে প্রেমরসে অভিষিক্ত করে দেয়।




ভক্ত আগে যেখানে কেবল নিজের কর্তব্যকর্ম সাধনেই সন্তুষ্ট থাকতেন, এখন সেখানে অনাগত কর্তব্যের সন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। আগে ভক্ত মঙ্গলকাজ সাধনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন, এখন মঙ্গলকাজ না করলে যেন তাঁর দিন‌ই কাটে না। ভক্ত আগে চোখের সামনে যে-মঙ্গলকাজ এসে পড়ত, তা-ই সাধন করতেন, আর এখন মঙ্গলকাজের খোঁজে নিজেকে রীতিমতো পথে নামিয়ে দেন! তাই তিনি নিজের চরিত্রলব্ধ সত্য, মঙ্গলভাব, প্রেম ও ভক্তিকে সমগ্র জগতে প্রচারিত করার জন্য অত্যধিক পরিশ্রম করতে থাকেন। এভাবেই সজ্ঞান ভক্তি ভক্তের দৈনন্দিন জীবনে অবিশ্রান্ত জনহিতকর চেষ্টাতে স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়ে থাকে।




ভক্তির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি এরকমই। সহজভাবে বলতে গেলে, আপনাআপনি বিকশিত হবার বেলায় ভক্তি ঠিক এরকম আকারই ধারণ করে। বসন্তে বিভিন্ন রঙের ফুল ফোটে, কোকিল ডাকে, এই ব্যাপারটি যেমন সহজ ও স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি প্রকৃত ভক্তিমান ব্যক্তির পক্ষে মঙ্গলকর ও অনিন্দ্যসুন্দর চরিত্র লাভ করাও সহজ ও স্বাভাবিক। অনন্ত প্রস্রবিণী ঝরনা হতে উৎসরিত নদী যেমনি শস্যক্ষেত্রের শ্যামলিমা বৃদ্ধি করে তাকে শস্যে শস্যে সুশোভিত করে, ঠিক সেরকম অনন্তে প্রবাহিত ভক্তিস্রোত ভক্তের অন্তরের প্রেমশক্তি বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর জীবনক্ষেত্রকে অশেষ প্রকারের কল্যাণকর কাজের দ্বারা সুসজ্জিত করে থাকে। এভাবেই ভক্তি নিজেই নিজের ঈশ্বরপ্রীতিমূলক কর্তব্যকর্ম সাধন করে।




ভক্ত তখন আর নিজের আত্মার কী হবে ভেবে ভেবে বিকৃত মুখে ও বিষণ্ন অন্তরে হা-হুতাশ করে কালক্ষয় করেন না, বরং নির্ভয়ে নিজের জীবনের গুরুতর কর্তব্যপালনে নিযুক্ত হয়ে যান। তাঁর প্রাণমন যদি কোনো অজ্ঞানকৃত অপরাধ বা জ্ঞানকৃত পাপে কলঙ্কিত হয়ে শুকনো ও কঠোর হয়ে যায়, তবে তিনি সরল অনুতাপের অশ্রুর সাহায্যে নিজেকে সিক্ত ও সরস করে তাতেই নতুন জীবনের বীজ বপন করে দেন এবং ঈশ্বরের কৃপায় অতি শীঘ্রই সেই বহুকালের নীরস ও অনুর্বর ক্ষেত্রে স্বর্গের ফুল মহাসমারোহে বিকশিত হতে আরম্ভ করে।




এভাবে ক্রমশ তাঁর আধ্যাত্মিক জীবন নিরবচ্ছিন্ন স্বাধীনতা লাভ করে এবং ভক্ত নিজেকে আর কোনো প্রকারের প্রচলিত ও প্রণালীবদ্ধ চিন্তা, কাজ বা ভাবের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে পারেন না। তাঁর নিজের মন যা সত্য বলে স্থির করে, নিজের বিবেক যা মঙ্গল বলে নির্ধারণ করে, নিজের হৃদয় যা মনোরম বলে আলিঙ্গন করতে চায় এবং তাঁর নিজের আত্মাতে যা-কিছুই পবিত্র বলে অনুভূত হয়, তিনি তা-ই গ্রহণ করেন এবং অন্যান্য সকল বস্তু ও বিষয়কে মন থেকেই দূরে নিক্ষেপ করেন। পৃথিবীর সমস্ত সনাতন ও স্বীকৃত শাস্ত্র, এমনকি, সাধুদের আদেশেও তিনি কারও কাছে মাথা নত করেন না, কিন্তু নিজের আত্মার প্রেরণায় স্থান বুঝে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতও করে থাকেন। তাঁর ভক্তি তাঁকে মানুষের দাসত্বে নিযুক্ত করে না, বরং ঈশ্বরের কাছে তাঁকে স্বাধীনতা প্রদান করে। তিনি ঈশ্বরজ্ঞানেই জীবের সেবা করেন। ধর্মজগতের খেলনা ও রূপকথাকে তিনি খেলনা ও রূপকথা হিসেবেই মনে করে থাকেন, তাতে অতিরিক্ত কোনো অর্থ বা সামর্থ্য আছে বলে তিনি কখনোই বিশ্বাস করেন না। তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা সংযত, চালচলন দৃষ্টির পক্ষে আরামদায়ক এবং তিনি কখনোই এমন কিছু করেন না, যা দেখে লোকে হাসাহাসি করে।




এভাবে নিজের স্বাভাবিক ও সরল পথ অনুসরণ করতে পারলে ভক্তি আপনাআপনিই উন্নতি লাভ করে। জীবনের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের কাজ সম্পাদন করে মানুষ যেমনি আর সেগুলি নিয়ে বাড়তি কিছু ভাবে না বা কোনো ঝামেলা তৈরি করে না, ভক্ত‌ও সেরকম নিজের জীবনের কর্তব্যকর্ম সাধনে নিজেকে নিযুক্ত করে আত্মা ও ধর্মের কথা নিয়ে বৃথা হা-হুতাশ করে সময় এবং শক্তি নষ্ট করেন না, অথচ তাঁর আত্মা অশ্বত্থ গাছের মতো নীরবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি ক্রমাগতই সত্যে ও মঙ্গলে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হন।




তাঁর ঈশ্বরপ্রীতি ও লোকপ্রীতি দুটোই ক্রমশ প্রবল ও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে এবং তাঁর প্রত্যেকটি অন্তর্নিহিত বৃত্তিই দিনদিন আরও উন্নত ও বিকশিত হতে থাকে। তাঁর বুদ্ধি সবসময়ই সত্যের সার্বভৌমিক বিধান মেনে চলে, তাঁর বিবেক সবসময়ই মঙ্গলের সার্বভৌমিক নিয়মের অনুগামী হয়, তাঁর হৃদয় ও আত্মা নিজ নিজ সার্বভৌমিক লক্ষ্যসাধনে নিযুক্ত হয় এবং এভাবেই ভক্ত এই চার ধরনের বৃত্তির স্ব স্ব প্রণালীর মধ্য দিয়ে বিধাতার সত্য, মঙ্গল, প্রেম ও পবিত্রতা লাভ করে ঐশীশক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। ভক্তের কাজ নিজেই সেবা করা, অন্যকে সেবা করতে বাধ্য করা নয়।