ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৫)

এমন বিশ্বাস ও ধারণাই ধর্মজগতে সকল অনর্থের মূল এবং তা ভক্তির যে-শক্তি, সেটিকে ক্রমশ ক্ষয় করতে করতে শেষ করে দিচ্ছে। মানুষের মনের যে-শক্তি ঈশ্বরের জগতে অশেষ প্রকারের মানবকল্যাণমূলক কাজে নিযুক্ত হতে পারত, তাকে কেবল নিজের অভ্যন্তরীণ ভুল বিশ্বাস ও ভাবকে প্রশ্রয় দেবার কাজে নিযুক্ত করে তার সমস্ত ধরনের মঙ্গলপ্রভাব ক্ষীণ করে দিচ্ছে মানুষ নিজেই। অন্তরের ক্ষমতাকে প্রদীপ্ত করাই ভক্তির স্বাভাবিক ও একমাত্র লক্ষ্য বলে পরিগণিত। তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের সর্বপ্রধান ভক্তের কথা বলতে পৃথিবীর যে-কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের গুরু ও নেতাকে যদি অনুরোধ করেন, তাহলে দেখবেন, যে-ব্যক্তি সবচাইতে বেশি কর্মক্ষম ও সৎ, শ্রমশীল শ্রমজীবী, ভালো ব্যবসায়ী, কৌশলী কৃষক; যাঁর বুদ্ধি তীক্ষ্ণ, বিবেক উজ্জ্বল, প্রেম উদার, যাঁর সমস্ত জীবন চারটি ভক্তিসাধনের দ্বারা বিকাশ লাভ করেছে, তাঁর নাম সেই গুরু ভুল করেও উচ্চারণ করবেন না। তবে তিনি কার নাম উচ্চারণ করবেন?




আপনি অবাক হয়ে দেখবেন, যে-ব্যক্তি কেবলই অবিরত নিজের আত্মার কথা নিয়ে হা-হুতাশ করতে থাকে, যে বারবারই ধর্মজীবনের পথে চলতে গিয়ে শৈশবকালের দুঃখ নিয়ে বলতে থাকে এবং বর্তমানের দুঃখ ভুলতে অতীতের সুখের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে, নিজের অন্তরের ভালোত্ব দেখাবার জন্য ধর্মালয়ে গিয়ে সারাক্ষণই "আমি ঘোর পাপী! হে প্রভু, আমাকে উদ্ধার করো!" এই জাতীয় কথাবার্তা চিৎকার করে বলে বলে কেবলই কাঁদতে থাকে; সর্বোপরি সেই গুরুর শরণাপন্ন হয়ে তাঁকে সব প্রকারে খুশি করার চেষ্টায় অনুগত হয়ে, ঈশ্বরের নয়, বরং গুরুর পায়ের কাছে পড়ে থাকে, তাকেই তিনি ভক্তশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা দেবেন।




যদি কেউ সত্যি সত্যি নিজেকে ঘোর অপরাধী বলে মনে করেন, তবে সেই অপরাধের অভ্যাস এখনই চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করে সারাজীবনের জন্য এই হা-হুতাশ থেকে মুক্ত হওয়া তাঁর পবিত্র কর্তব্য। বারবার 'আমি অপরাধী, আমি অপরাধী' বলে বলে চিৎকার করলে এবং কাঁদলে আত্মার ঘোরতর অকল্যাণ হয়ে থাকে; একইসাথে আত্মার শক্তিও কমতে থাকে। ভক্তি প্রদর্শনের বস্তু নয়, কাজে লাগানোর বস্তু।




পৃথিবীতে অনেক সম্প্রদায় নিজেদের প্রাচীন ও অসার কর্মকাণ্ড ও ধর্মমতকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে, সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলিকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য কোনো ধরনের চেষ্টাই করে না। এর ফলে সম্প্রদায়গুলি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়ে এবং তাদের ভ্রান্তির মায়াজাল আরও সুবিস্তৃত ও সুগভীর হতে থাকে। ধর্মবিজ্ঞানের উন্নতি ও ধর্মসাধনের নতুন নতুন পন্থা সম্পর্কে খোঁজখবর না রাখলে যে-কোনো সম্প্রদায় পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাচীনত্ব প্রাসঙ্গিকতা হারালে তা পরিত্যাগ করাই প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তির কাজ। সময়ের বিবেচনায় অপ্রাসঙ্গিক জীর্ণ ও শীর্ণ ধর্মমতকে সম্মান দেখানো যায়, কিন্তু তা নিয়ে পথ চলা যায় না।




যে-সকল মত ও পথ একসময় মানবতার বিকাশে অপরিসীম সহায়তা করেছিল এবং যে-সকল প্রণালীর মধ্য দিয়ে মানুষের ভক্তিভাব বিশেষভাবে বিকাশলাভ করেছিল, কিন্তু সময়ের পালাবদলে যা এখন অকেজো ও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, সেগুলিকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলে জগতের উন্নতিসাধন কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের কল্যাণের দিকে না তাকিয়ে কেবল নিজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার করতে ব্যস্ত থাকে যে-ধর্মমত, তা গোঁড়ামির নামান্তর মাত্র। পুরো মানবজাতির কল্যাণ ও শান্তি কামনা না করে কেবল নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের কল্যাণ ও শান্তি কামনা করতে শিক্ষা দেয় যে-ধর্ম, তা সার্বভৌমিক সত্যের অনুগামী নয়, অতএব ভ্রান্ত।




আশ্চর্যের বিষয় হলো, সকল সমাজের ও সম্প্রদায়ের মানুষই অল্পবিস্তর এ ধরনের ভ্রান্তিতে ডুবে রয়েছেন এবং বিজ্ঞান ও যুক্তি অকাট্য প্রমাণের সাহায্যে যে-সমস্ত বিষয়ের অসত্যতা প্রমাণ করছে, নিজ নিজ বুদ্ধিশক্তিকে নিজের হাতে হত্যা করে সে-সকল প্রাচীন বিশ্বাসকেই প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। তবে এ ধরনের ভুল করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যে-পথ অবলম্বন করে একবার মানুষ উপকৃত হয়, একই পথ পুনরায় অবলম্বন করাটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে দেশ, কাল, পাত্র ও ফলাফল বিচার না করেই চিরকাল অন্ধের মত একই পথ ধরেই চলতে হবে, এর কোনো মানে নেই। বিশেষ কোনো কারণে যদি এমন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের আর কাজ না করে, যা একসময় কাজ করত, তাহলে অন্ধের মতো তা গ্রহণ না করে ওষুধ বদলানোই সুবিবেচকের কাজ। এই কাজটি সময়মতো করতে না পারলে মৃত্যু অবধারিত।




ধর্মের পথে অন্ধত্বের অবলম্বন আরও অনেক ধরনের ক্ষতিসাধন করে থাকে। এর ফলে যে কেবল ভক্তির কার্যকারিতা নষ্ট এবং মনের শক্তি বাজে কাজে খরচ হয়, তা নয়, এতে ভক্তির বিকাশের সমস্ত সম্ভাবনার দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের কোলে শুয়ে স্তন্যপান করা, মায়ের কোলে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে ভ্রমণ করা, পাড়ায় পাড়ায় ছুটে বেড়ানো, শৈশবের নানান ছড়া আবৃত্তি করা, পাখিদের কিচিরমিচির শুনে তৃপ্তি লাভ করা, এ সবই একটি শিশুর শরীরের ও মনের বিকাশে সাহায্য করে বটে, কিন্তু বড়ো হবার পর সেই একই জায়গায় পড়ে থাকলে তখন মনের শক্তি বিকশিত আর হয় কী করে? আশেপাশের সবাই পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে বিধায় আপনিও যদি অন্ধের মতন তা-ই করতে থাকেন, তাহলে আপনার সম্ভাবনার বিকাশ আর কী করে ঘটবে? দশ জনের মতন করে চললে দশ জনের মতনই হওয়া যায়, ভিন্ন কিছু আর হওয়া যায় না। আত্মবিকাশের প্রধান শর্ত হচ্ছে ভিন্নতা।




পৃথিবীর ইতিহাস বলে, যে-জাতি সময়ের সাথে সাথে নিজেদের বদলে নেয় না, তারা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে থাকে। এগোতে চাইলে এগিয়ে যাবার কাজ করতে হবে। যে-ব্যক্তি দশ বছর ধরে একই কাজ করে যায়, সে কী করে আশা করে, আজকের দিনে এসেও দশ বছর আগের সময়ে সে পড়ে থাকবে না? উলটো এমন আশঙ্কা থেকে যায়, আজকের দিনে এসে বেচারা পনেরো বছর পিছিয়ে গেল! সে তো এগিয়ে যেতে পারবেই না, বরং দশ বছর আগের অবস্থান থেকে পিছিয়ে না গেলে সেটাই তার জন্য যথেষ্ট প্রাপ্তি! ছোটোবেলার স্যান্ডেল কি আর বড়োবেলায় পায়ে ধরে? আপনি যদি আপনার সন্তানকে চিরকালই রূপকথার গল্প শোনাতে থাকেন, কিংবা সে বড়ো হবার পর শ্রেষ্ঠতম শিশুসাহিত্য‌ও তার সামনে উপস্থাপন করতে থাকেন, তাহলে তার বুদ্ধি বিকশিত হবে কী করে?




ধরুন, আপনি কোনো ব্যক্তিকে বোঝালেন, আজীবন ছোটোবেলার খেলাধুলায় সময় কাটালে এবং শিশুতোষ সাহিত্য পাঠ করে নিজেকে তৃপ্ত রাখলে কিংবা শিশুর মতন মায়ের আঁচল ধরে ঘুরলে, তার সাথে নিজের বুড়োআঙুলটি চুষতে থাকলে মানবজন্ম সার্থক হবে। যদি সে আপনার কথায় বিশ্বাস করে ফেলে, তখন তার অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এ ধরনের আজগুবি কথাবার্তায় মানুষের প্রত্যয় জন্মাতে চাইলে সবার আগে তাকে কৌশলে নির্বোধ করে ফেলতে হয়। নির্বোধ মানুষের আর যা-ই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি হোক না কেন, ধর্মপ্রাপ্তি কখনও হয় না। নির্বোধের ধর্ম বরাবরই অধর্ম। ভক্তিবিকাশের পথে নির্বুদ্ধিতাই সবচাইতে বড়ো বাধা। পৃথিবীতে যুগে যুগে এই ধরনের উৎকর্ষ ভ্রমের চক্রে পড়ে অসংখ্য সুন্দর ও সুস্থ আত্মা নির্জীব, কুৎসিত ও রুগ্ন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে।




ভক্তিসাধনের পথে এ ধরনের নানান বিকৃতিতে আরও বিভিন্ন ধরনের অনিষ্টসাধন হয়ে থাকে। সবচাইতে বড়ো ক্ষতি যা হয়, তা হলো, এসব দেখে সুশিক্ষিত ও বিজ্ঞ মানুষেরা নিজের প্রাণে ভক্তি ও সব ধরনের ধর্মভাবের প্রতি চরম বিরক্তি উৎপন্ন করে এবং ধর্ম মাত্রেই নির্বোধ লোকজনের অভয়ারণ্য, এ ধরনের ধারণা পোষণ করে। ভক্তির এমন ব্যভিচারে এবং ভক্তজীবনের এই সকল সংকীর্ণতা দেখে ধর্মের প্রতি পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন, ধর্মের কথা কোনোভাবেই আর শুনতে চান না, এমন মানুষের সংখ্যা এ কারণেই দিনদিন বাড়ছে। ধীরে ধীরে ধর্ম হয়ে উঠছে মূর্খদের পরম অবলম্বন ও অভয়ারণ্য; এবং জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় কমে যাচ্ছে।




সচরাচর ধর্মের নামে যে অর্বাচীনতা ও মূর্খতার শিক্ষা দেওয়া হয়, তাতে অনেকেই বিরক্ত হয়ে ধর্মের সাথে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন। বর্তমান সময়ের প্রধান প্রধান জ্ঞানী ব্যক্তির মধ্যে প্রচলিত ধর্মের প্রতি তেমন কোনো শ্রদ্ধা বা প্রীতি নেই বললেই চলে। ওঁদের কাছে ধর্মের মানেই অন্ধত্ব ও গোঁয়ার্তুমির আখড়া। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমরা ধর্মের নাম বেশি শুনে থাকি। কিন্তু কেন? যাঁদের মধ্যে সাধুতা ও মনুষ্যত্ব আছে, তাঁরা ধর্মের কথা উল্লেখ করে কোনো সুবিধা গ্রহণ করতে লজ্জা বোধ করে। রাজনীতি ও ব্যাবসার ক্ষেত্রে তেমনটা হতে কি আমরা দেখি? ধর্মের কথা বলে মানুষকে ভীত ও অন্ধ করে রাখার প্রক্রিয়াটি সহজ ও সুপ্রতিষ্ঠিত। ধর্মপ্রাণ মানুষ বলতে পণ্ডিত ব্যক্তিরা এখন অন্ধ, মূর্খ ও অথর্ব মানুষের একটি অবয়ব কল্পনা করে নেন।




এমনি করেই ধর্ম এমন একটা অর্বাচীন বালকত্বে করতে পরিণত হয়েছে যে, তার নাম গ্রহণ করতেও পরিপক্ববুদ্ধি মানুষের প্রবৃত্তি হয় না। তাই ধর্ম এখন আর বৃহৎ সমাজশক্তি বলেই গণ্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ধর্ম আজ টিকে আছে গায়ের জোরে, মনের জোরে নয়। এর জন্য দায়ী ধর্মের বর্মধারী ভণ্ড ও মূর্খরা। দেশের ক্ষমতাবান ও প্রভুত্বশালী লোকেরা ধর্মকে খুব একটা বেশি সম্মান করে চলেন বলে মনে হয় না। তাঁদের সামাজিক কর্মকাণ্ডে কিংবা ব্যক্তিগত চরিত্রে ধর্মের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। ধর্মকে তাঁরা কেবল স্বার্থসিদ্ধির কাজেই বাহ্যিকভাবে ব্যবহার করেন। জ্ঞানে ও সমৃদ্ধিতে যাঁরা বিশেষভাবে উন্নতি লাভ করেছেন, তাঁরা সব জায়গাতেই ধর্মভাব ও ধর্মানুষ্ঠানকে অগ্রাহ্য করে চলছেন। পদে ও ধনে যাঁরা সমৃদ্ধ, তাঁরাও ধর্মের খুব একটা ধার ধারেন না। সমাজের মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনস্রোত নিজপথে নিজেই প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু তা দ্বারা দেবালয় বা উপাসনাঘরের সোপানতল পর্যন্ত‌ও সিঞ্চিত বা বিধৌত হয় না। এমন গুরুতর ও সাংঘাতিক অধঃপতনের মূল কারণ ধর্মীয় সাধনপদ্ধতির যথেচ্ছ পরিমাণে বিকৃতি।