ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৪)

এমন অবস্থায় উপনীত হলে ভক্ত তখন এই বিস্তৃত পৃথিবীর সব জায়গাতে এক ব্রহ্মশক্তিরই বিচিত্র লীলা প্রত্যক্ষ করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি তখন জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করার সময় সত্যস্বরূপ পরমেশ্বরের জ্ঞানভাগ তাঁর বুদ্ধিকে এসে আলিঙ্গন ও আলোকিত করে এবং তা দেখে তিনি নিজে এবং অন্যান্যরা বিনয় ও শ্রদ্ধায় নতশির হয়ে যান। সাধু ব্যক্তিরা ন্যায় ও মঙ্গলের প্রেরণার মধ্যে মঙ্গলস্বরূপ বিধাতার অদৃশ্য সংকেত প্রত্যক্ষ করে বীরের মতো নিজের কর্তব্যপথে অগ্রসর হয়ে থাকেন। প্রেমিকপুরুষ নিজের হৃদয়ের সব ধরনের নিষ্কাম প্রেমের মধ্যে অনন্ত প্রেমময়ের অনন্ত প্রেমেরই আস্বাদন পেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেন। ভক্ত তখন এই মহান পৃথিবীর অন্তর্নিহিত শক্তির মধ্যে অনাত্মবাদী নাস্তিক বা অদৃষ্টবাদী বৈদান্তিকের মতো কেবল একটা মমতাহীন, প্রেমহীন, দৃষ্টিহীন, বিশাল শক্তির উদ্ভট খেলা প্রত্যক্ষ করেন না, বরং এক অনন্ত সত্য-জ্ঞান-প্রেম-মঙ্গলময় পুরুষের প্রেম ও মঙ্গললীলা উপভোগ করে অপার শান্তি লাভ করেন। তখন তাঁর মন সত্যস্বরূপের সত্যভাবে, বিবেক মঙ্গলময়ের মঙ্গলভাবে, হৃদয় প্রেমময়ের প্রেমভাবে পরিপূর্ণ হয়ে যায় এবং ভক্ত নিজের জীবনকে সেই বৃহৎ জীবনাধারের চরণে অর্পণ করে কৃতার্থ হয়ে যান। এভাবেই তাঁর অন্তরস্থ ভক্তির বিভিন্ন অংশ ভগবানের চরণে মিলিত হয়ে প্রতিটি বৃত্তির স্বাভাবিক স্ফুরণের দ্বারা ভক্তের পূর্ণতা সম্পাদিত হয় এবং এই পূর্ণাঙ্গ ভক্তির সংস্পর্শে তাঁর অন্তরের বৃত্তিসমূহেরও এক অভিনব ও অনন্যসাধারণ বিকাশ সাধিত হয়।




এই সার্বভৌমিক শক্তি চারটি একবার বিকশিত হয়ে আত্মজ্ঞানের ভূমিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে এবং মানুষ এই সাধনপথে কিছুদূর অগ্রসর হলে তাঁর মনে ভক্তিভাবের উদয় হয় এবং সেটি নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী একটা সহজ প্রণালীতে পরিচালিত ও স্বাভাবিক আকারে প্রকাশিত হয়; নতুবা তাঁর সমাজ-সম্প্রদায়ের সনাতন সংস্কারের আবর্তে নিপতিত ও প্রাচীন প্রণালীতে আবদ্ধ হয়ে একটা জটিল পন্থা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে সেই ভক্তিভাব একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে।




মানুষ ভক্তিভাবকে নানা উপায়ে পরীক্ষা করেছে। ভক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ ও সাধন কী, এ বিষয়ে অনেক আলোচনা ও চেষ্টা যুগে যুগে করা হয়েছে। পৃথিবীর সাধুদের জীবনচরিত এই ধরনের বিবরণে পরিপূর্ণ। ঈশ্বরের অন্যান্য বিষয়ে মানুষের চেষ্টাচরিত্রের মতো ভক্তি বিষয়েও সব ধরনের চেষ্টা অবশেষে প্রায় সব জায়গাতেই ব্যর্থ হয়েছে। বারবার ধনুকে তীর নিবদ্ধ করতে করতেই শেষমেশ লক্ষ্যবিদ্ধ হয়ে থাকে। ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, মানুষের ক্রমাগত চেষ্টার এই সাধারণ নিয়মটি সেখানেও খাটে। কৃষিবিদ্যা, নৌবিদ্যা বা রাজনীতি সম্বন্ধে সঠিক ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হবার আগে মানুষকে অসংখ্য বার অসংখ্য রকমে চেষ্টাচরিত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে অসামান্য পরিশ্রম করতে হয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাস মানুষের ক্রমাগত ভুলের ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসও একই। ধর্মের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি, মানুষ ধর্ম নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিভিন্ন ভুল পথে চলতে চলতে অবশেষে সঠিক পথের সন্ধান পেয়েছে। তাই ভক্তিলাভ করার পরও যে লোকে ভক্তির বিকাশ ও প্রকাশ করতে গিয়ে অসংখ্য প্রকারের ভুলভ্রান্তি করবে, এটাই স্বাভাবিক।




ভক্তিসাধনের উপায় একেকটি সময়ে, একেকটি অঞ্চলে ও একেকটি সম্প্রদায়ে একেক রকমের। কোনো বিশেষ অনুকূল পরিস্থিতিতে শৈশবেও ভক্তিভাব বৃদ্ধি পেতে পারে। শৈশবে ভক্তিভাবের বিকাশের জন্য কিছু বিশেষ উপায় বেশ উপযোগী। আশেপাশের পরিবেশ, পরিবার এবং সামাজিকীকরণ এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। তবে ধর্মপ্রবৃত্তি মোটামুটি বিকশিত হয়ে উঠলে বাহ্যিক অনুষঙ্গসমূহের আর কোনো আবশ্যকতা বা উপযোগিতা থাকে না। তখন মানুষকে ওই সকল বাহ্যিক উপায়ের উপর নির্ভর করতে হয় না। মনের বিকাশের সাথে সাথে মনের বৃত্তিসমূহের উপযোগী বিভিন্ন উপায় নতুন করে খুঁজতে হয়।




বয়স বাড়লে পরে মানুষ শৈশবকালের মতো ধর্মীয় শ্লোক বা স্তোত্র আওড়াতে থাকে না; কাজটির প্রয়োজনীয়তা একেবারেই হারায়। এটি ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি সম্প্রদায় বা জাতি সম্পর্কেও সত্য। সমাজে শৈশবে যে-সকল মন্ত্র, তন্ত্র, বলি ও উপাসনা ভক্তিসাধনের অঙ্গ হিসেবে প্রচলিত ও পরিগণিত হয়, জ্ঞানবিকাশের পর আর সেগুলির তেমন উপযোগিতা থাকে না; কিন্তু অনেকসময় দেখা যায়, মানুষ আলস্যের কারণে বয়স এবং জ্ঞান বাড়লেও এ সকল প্রাচীনত্বকে ঘিরে চিরকাল পড়ে থাকতে চায়। এরকম আলস্যের কারণেই মানুষ নিজের সংকীর্ণ অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে থাকে, সেই কমফোর্ট-জোন থেকে বের হতে পারে না বা চায় না। যারা বের হতে পারে, তারা টিকে থাকে; যারা পারে না, তারা হারিয়ে যায়।




একটি শিশু বড়ো হবার সময়ে তার বাবা-মা তাকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। ছোট্ট শিশুকে হাঁটতে শেখাবার জন্য তাঁরা ক্রমাগত চেষ্টা করতে থাকেন। শিশুটির মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন প্রকারের খেলনা কিনে দেন। লাটিম, ঘুড়ি, সাইকেল ইত্যাদি কিনে দিয়ে শিশুটির শারীরিক ব্যায়ামের ব্যবস্থাও করে দেন। তার বুদ্ধির বিকাশের জন্য নানা রকমের উপায় অবলম্বন করেন; বুদ্ধিবিকাশে সহায়তা করে, এমন ধরনের বিভিন্ন খেলনা কিনে শিশুটিকে ব্যস্ত রাখেন। শিশুটির বর্ণজ্ঞান লাভের জন্য বিভিন্ন ছবির বই, ছড়ার বই, গল্পের বই থেকে শুরু করে নানান রকমের শিক্ষামূলক খেলনাসামগ্রী এনে দেন। তার মানসিক স্থিরতা সাধন এবং কোমল বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা সম্পাদনের জন্য বর্ণপরিচয়, বিবিধ তথ্যসম্বলিত বই, শিশুদের উপযোগী করে লেখা নানান জ্ঞানগর্ভ শিক্ষা উপকরণ জোগাড় করে দেন। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রদানের জন্য নানান নিয়মরীতি শেখানো এবং সাধুত্বের গল্প বলা, শিশুটিকে বিভিন্ন কায়দায় যোগ-বিয়োগ শেখানো, নানান অক্ষর চেনানো ও হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা, আকাশের তারা-নক্ষত্র চেনানো, এরকম অসংখ্য উপায় শিশুটির মানসিক বিকাশের জন্য বাবা-মা অবলম্বন করে থাকেন।




এরকম বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শিশুটি যখন একদিন বড়ো হয়ে সাবালকত্বপ্রাপ্ত হয়, তার দেহের ও মনের গঠন যখন পরিপুষ্ট ও পরিপক্ব হয়, তখন সে আর কাঠের পুতুল নিয়ে খেলে না, বরং সমাজের আর দশটা মানুষের মতো বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়ে থাকে। বহুদিন ধরে এভাবে কোনো চাকরি বা ব্যাবসায় নিয়োজিত থেকে তার শক্তিমত্তা ও কর্মক্ষমতা দুটোই পরিপূর্ণতা লাভ করে। আবার তার বুদ্ধি পরিপক্বতা লাভ করলে সেটাও সমাজের সেবাতেই নিযুক্ত হয় এবং তা দ্বারা মানুষ নিজের পরিবারের ও দেশের বিভিন্ন সেবা করতে পারে। বহুকাল পর্যন্ত এভাবে পরিচালিত ও ব্যবহৃত হয়ে বুদ্ধিবৃত্তি নতুন নতুন শক্তি ও জ্ঞান লাভ করে থাকে।




এসব ক্ষেত্রে মানুষের শারীরিক বা মানসিক শক্তিসামর্থ্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিজের দায়িত্ববোধ অনুযায়ী নানান কাজ সম্পাদন করে। শৈশবের যে-সকল বস্তু ও বিষয়ে মানুষের আনন্দ হতো এবং যে-সকল উপায়ে সে জ্ঞান লাভ করত, বয়স বাড়ার ফলে তার প্রত্যেকটিই অনুপযোগী ও অব্যবহার্য হিসেবে পরিগণিত হয় এবং মানুষ তা সহজেই পরিত্যাগ করে। মানুষের পাণ্ডিত্য যখন বেড়ে যায়, তখন কেউই আশা করে না যে, সে তখন বসে বসে বর্ণপরিচয় পাঠ করবে, কিংবা ব্যাকরণের প্রাথমিক নিয়মগুলি পুনরাবৃত্ত করবে, কিংবা নামতার নিয়ম শিখতে বসবে। এর কারণ, এই ধরনের কাজে সময় খরচ করা একজন পরিণত বয়স্ক মানুষের পরিপক্বতার সাথে যায় না এবং তার বুদ্ধিশক্তি রক্ষা বা বৃদ্ধি করার জন্য কোনো বিবেচনাতেই উপযোগী বলে মনে হয় না।




একজন গণিতবিদকে যদি বলি, আপনি গণিতচর্চা থেকে দূরে সরে শৈশবে ফিরে যান এবং দোলনায় দুলে দুলে বিশ্রাম নিন, তাহলে এই পরামর্শ মানলে সেটি তাঁর গণিতচর্চায় কোনো কাজে আসবে না। তিনি যদি লাটিম বা ঘুড়ি নিয়ে খেলা না করেন, মায়ের কোলে চড়ে সারাদিন না কাটান, কিংবা পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলা করে না বেড়ান, তাহলে তাঁর গণিতে দক্ষতা রক্ষিত বা বর্ধিত হবে না, এ ধরনের পাগলের প্রলাপও কেউ বকে না। তবে হ্যাঁ, এ সকল কাজ একসময় তাঁর কাজে এসেছিল নিজেকে তৈরি করতে, কিন্তু এখন সেগুলির আর প্রয়োজন নেই। মানুষ জীবনপথে যত অগ্রসর হয়, একসময়ে যা অত্যন্ত চমৎকার ও উপযোগী ছিল, এমন অনেক বিষয় ও বস্তু ততই সে পেছনে ফেলে আসে এবং তাদের ব্যবহার‌ও ক্রমশ সে ভুলতে থাকে।




এখন আসি ধর্মের বিষয়ে। কোনো ব্যক্তি ঈশ্বরের কৃপায় পরিস্ফুট ও পূর্ণাঙ্গ ভক্তি লাভ করলেও, দেখা যায়, লোকে তাঁকে শৈশবের সাধনপ্রণালী অবলম্বন করে চিরদিনই ধর্মের ক-খ অধ্যয়ন ও ভক্তির রূপকথা শুনতে উপদেশ দিয়ে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যে-ব্যক্তি ঈশ্বরের অনুগ্রহপ্রাপ্ত, তাঁকেও চারপাশের লোকজন ধরেবেঁধে ধর্মের গ্রাম্য পাঠশালায় পাঠিয়ে দেয়, জোর করে যোগ-বিয়োগ ও নামতা পড়তে শেখায়, নতুবা সবাই মিলে বলতে থাকে যে, তাঁর আত্মা সুস্থ নেই, তিনি পাগল হয়ে গেছেন, তাঁর অন্তরে কোনো ভক্তিভাব নেই এবং তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। নীরবে যিনি ঈশ্বরের পথে চলেন, তাঁকেও কিনা ধার্মিকতার প্রমাণ দিতে হয় কিছু নির্বোধের সামনে! যাঁর বিচরণ অনন্ত আকাশে, পরমেশ্বরের পদপ্রান্তে, তাঁকেও সেখান থেকে জোর করে টেনে নামিয়ে ভূপাতিত করে সকলের মনোরঞ্জনের জন্য সকলের বোঝার উপযোগী করে ধর্মের নানান পরীক্ষায় পাশ করতে হয়।




লোকের মনোরঞ্জনে ব্যর্থ হলে তাঁকে ঈশ্বরবিদ্বেষী নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ধর্মের জগতেই আমরা কেবল একথা শুনতে পাই: একবার যে শিক্ষা, পথ বা সাধনা ধর্মজীবন গঠনে সাহায্য করেছে, বারবারই সেটিকে অনুসরণ করতে হবে। সেই পথ সব জায়গায় সকল কালেই প্রশংসনীয় ও প্রয়োজনীয়। এর বাইরে আর কোনো পথ নেই, এর বাইরে কেউ কোনো পথ অনুসরণ করলে তাঁকে অবশ্যই নিন্দা করতে হবে। মানুষের মাথায় ঢুকে গেছে যে, সে নিজে যে-মতে বিশ্বাস করে এবং যে-পথে চলে, তার বাইরে আর কিছু নেই। তার বাইরে যে আছে, সে ধর্মদ্রোহী এবং নাস্তিক। চলতে হবে এবং গন্তব্যে পৌঁছতে হবে; কিন্তু নির্দিষ্ট একটা পথেই চলতে হবে, বাকি সব পথ‌ই ভুল—এমন দাবি কেবল মূর্খরাই করে।