ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ৩)

অনেকেই ন্যায় ও মঙ্গলকে ধারণ করেই বেঁচে থাকেন। কেন ওরকম করে বাঁচেন? ওরকম করে বাঁচলে নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে, এই কারণে নয়, বরং অন্য কোনো উপায়ে বাঁচতে তাঁদের বিবেক বাধা-প্রদান করে বলেই তাঁরা ওরকম করে বাঁচেন। তাঁদের জীবনাচরণ নিষ্কাম ও স্বার্থশূন্য। ন্যায় ও মঙ্গলের জন্য তাঁরা হাসিমুখে সব ধরনের ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে থাকেন, কিন্তু এঁরাই আবার ধর্মের নাম শুনলেও গভীর ঘৃণা প্রকাশ করেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন এবং ঈশ্বরের নামে বিভিন্ন অপ্রীতিকর কথাবার্তা বলে থাকেন।




আমরা যেটাকে ঐশীশক্তি হিসেবে উপাসনা করি, তাঁরা সেটাকে মূর্খের পাগলামি হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁদের কাজ ও আচরণ কোনোটাই ধর্মের বিপক্ষে কখনোই যায় না, তাই এই ধরনের ব্যক্তিরা নিজের অজান্তে মূলত ধর্মেরই পথে চলেন, ধর্মপ্রবৃত্তির প্রতিটি শর্ত তাঁরা পালন করেন, তাঁদের প্রাণে ন্যায় ও মঙ্গলের প্রতি ভক্তিভাব সবসময়ই জাগ্রত থাকে এবং এভাবেই তাঁদের চরিত্রে নীতিশক্তি ও ঈশ্বরভক্তি স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়। তাঁরা ন্যায়ের পথে চলেন, মঙ্গলের কাজ করেন, সত্যের প্রচার করেন এবং এভাবেই নিজের জীবনকে ধর্মপথে পরিচালিত করেন, যদিও তাঁরা নিজেরা সেটা স্বীকার করেন না, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে যা যা করা দরকার, সেগুলি তথা ধর্মের কাজগুলি করার মাধ্যমে তাঁরা পরমেশ্বরের প্রিয়পাত্র হয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন। অধর্ম কখনও গায়ের জোরে হয় না, কর্মের জোরে হয়।




মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করেন, এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা কখনও ভক্তির ধার ধারেন না, ভক্ত হতেও চান না। তাঁরা বলেন, ভক্তি কেবলই চাঁদের আলোর মতো কল্পনা এবং তা মনের কোমল ভাবকে পরিতৃপ্ত করে, কিন্তু দিনের আলোর মতো জীবনে উত্তাপ দিতে পারে না। মানুষের প্রেমে তাঁরা উন্মত্ত হয়ে ওঠেন, মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন, মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, অন্যের উপকার করতে গিয়ে নিজেকে বিপন্ন পর্যন্ত করে ফেলেন, কিন্তু ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, ঈশ্বরপ্রেম হৃদয়ে ধারণ করেন বলে স্বীকার করেন না, ঈশ্বরপ্রীতি কাকে বলে…সেই জ্ঞান পর্যন্ত তাঁদের নেই। অথচ মানুষের প্রয়োজনে তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ এবং এই মানবপ্রেমের প্রবৃত্তি তাঁদের হৃদয়ে অন্তঃসলিলের মতো সতত প্রবাহিত হয়ে থাকে। এঁরা প্রেমের স্থানিক প্রকাশই কেবল জেনেছেন, বৈশ্বিক প্রকাশ এখনও জানতে পারেননি; সান্ত প্রেমবস্তুর প্রতি অনুরক্ত থেকেছেন, অনন্ত প্রেমের সন্ধান এখনও আস্বাদন করতে পারেননি। এইসব মহাত্মাগণ নিজেরা না জানলেও এঁদের মধ্যে ভগবদ্‌ভক্তির চরম প্রকাশ বিরাজমান।




এক ব্যক্তি আছেন, যাঁর প্রাণে এই পৃথিবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রেম আছে, কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি কোনো অনুভূতিই নেই। তিনি এই পৃথিবীতে ছড়ানো সৌন্দর্য ও সত্যকে ভালোবাসেন, ন্যায় ও মঙ্গলের ভাবকে নিজের অন্তরে ধারণ করেন এবং এই যে অনন্ত প্রেমের স্রোত এই পৃথিবীর সব জায়গায় প্রবাহিত হয়ে সকল প্রাণীকে সুখী করছে, তা দেখে অসীম আনন্দ অনুভব করেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এ পৃথিবীর কোথাও, পৃথিবীর যিনি নিয়ন্তা, তাঁর কোনো পরিচয় খুঁজে পান না। যাঁর মাধ্যমে সেই ব্যক্তির বুদ্ধিতে সত্য ও সৌন্দর্য, বিবেকে ন্যায় ও মঙ্গল এবং হৃদয়ে প্রীতি ও প্রাণে শক্তি সঞ্চারিত হয়, তাঁকে তিনি কেবল এক অলীক কল্পনা বলে মনে করেন, কখনোই তাঁকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করার চিন্তাও সেই ব্যক্তির মাথায় আসে না। এই ব্যক্তির অন্তরে পূর্ণাঙ্গ ভক্তির সকল লক্ষণই প্রকাশিত রয়েছে, কিন্তু সজ্ঞান ভক্তিতে যেরকম ভক্তির সমস্ত অঙ্গ জ্ঞানের ভূমিতে একত্রিত ও পুঞ্জিভূত হয়ে পরম মনোহর সত্তায় পরিণত হয়, এই ব্যক্তির অন্তরে ওরকম কোনো ব্যবস্থা তৈরিই হতে পারেনি।




এমন অজ্ঞান ভক্তি শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক। সাধারণত শৈশবেই এ ধরনের ভক্তি অপরিহার্য। শিশুরা ভক্তির চর্চা করে, কিন্তু এই সত্যটা তারা নিজেরাই জানে না। এ থেকেই শৈশবজীবনের সরল মাধুরী উৎপন্ন হয়। ঊষাকালের রক্তাভ আলোকরেখা যেমনি মধ্যাহ্ন সূর্যের পূর্বাভাস প্রদান করে, ঠিক তেমনি শৈশবের এই অজ্ঞান ভক্তি পরিণত বয়সের পূর্ণ ভক্তিভাবের পূর্বলক্ষণ হিসেবে প্রকাশিত হয়। বয়স বাড়তে বাড়তে এই ভাবটি ক্রমশ প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হয়। জীবনের অভিজ্ঞতায় আত্মদৃষ্টি ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয় এবং শৈশবের এমন অজ্ঞান ভক্তিভাব ক্রমশ জ্ঞানের ভূমিতে এসে চমৎকারভাবে আলো ছড়াতে থাকে। মানুষের কর্তব্য হলো: শিক্ষা ও সাধনার সাহায্যে, আত্মজ্ঞানের আলোর সংস্পর্শে শৈশবের এই স্বাভাবিক ভক্তিভাবকে সতেজ ও সুন্দর করা; বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় ও আত্মা, এই চারটি বৃত্তির যথাযথ বিকাশসাধন করে ভক্তিভাবের পূর্ণতা সম্পাদন করা।




অজ্ঞানতার চাইতে আত্মজ্ঞান উত্তম, পরিণত বয়সের বিচারশক্তি শৈশবের সহজবুদ্ধির স্বাভাবিক প্রেরণার চাইতে উত্তম; ঠিক সেরকম, কোমলমতি বালকের স্বাভাবিক ও সহজ বুদ্ধিজাত অজ্ঞান ভক্তি নয়, বরং পরিপক্ব বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সজ্ঞান ভক্তিই আত্মার উন্নত অবস্থার পরিচায়ক। তাই বলা যায়, যে পণ্ডিত ব্যক্তি কেবল সত্য বলেই সত্যকে ভালোবাসেন, কিন্তু নিজের বুদ্ধির সাহায্যে সত্যস্বরূপ ঈশ্বরকে অনুভব করতে পারেন না, তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বাভাবিক বিকাশ কিছুটা হলেও ঈশ্বরজ্ঞানের অভাবে ব্যাহত হয়। যিনি সত্যকে ভালোবাসেন এবং সত্যকে ভালোবেসে পৃথিবীর সমস্ত সত্যের উৎস ও আধার ঈশ্বরকেই ভালোবাসছেন, এই সহজ কথাটি বুঝতে পারেন না, তার ফলে বুদ্ধিশক্তির প্রধান একটা দিক অকর্মণ্য ও অবহেলিত থেকে যায়, তাঁর মনের পূর্ণ ও স্বাভাবিক বিকাশ এর কারণেই ব্যাহত হয়।




যে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে নিষ্কাম পথে থেকে ন্যায় ও মঙ্গলকে হৃদয়ে ধারণ করেন, পৃথিবীর সমস্ত সম্পত্তির লোভেও যিনি চুল পরিমাণও ন্যায়ের সরল সত্য পথ থেকে বিচলিত হন না, এমনকি যাঁকে পারলৌকিক নরকের ভয় বা স্বর্গের লালসাও সত্য ও মঙ্গলের পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না, তিনি মূলত মঙ্গলকে হৃদয়ে ধারণ করে ঈশ্বরকেই হৃদয়ে ধারণ করে আছেন—এই পরম সত্যটি প্রাণে অনুভব করতে না পারলে তাঁর বিবেকে ও জীবনে ন্যায় ও মঙ্গলের শক্তি কখনোই নিজের স্বাভাবিক বিকাশ করতে পারে না। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেও ঈশ্বরের পথে না চলার চাইতে ঈশ্বরের বিশ্বাস না করেই ঈশ্বরের পথে চলা উত্তম, তবে সবচাইতে উত্তম হলো: ঈশ্বরে বিশ্বাস করে ঈশ্বরের পথে চলা। এতে সবদিক বিচারেই জীবন পূর্ণতা পায়।




যে প্রেমিক পুরুষ প্রাণের টানে প্রেমের আধারকে কাছে টানেন, যাঁর মানবপ্রেম প্রবাদপ্রতিম, মানুষের কল্যাণে সমস্ত শক্তি, সামর্থ্য, ধনসম্পদ ও জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে যিনি সর্বদাই প্রস্তুত, মানুষের প্রতি তাঁর এই গভীর প্রেম যে পরমপুরুষের প্রতি হৃদয়ের স্বাভাবিক প্রেমভাবের আংশিক প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়, এই সত্যটি উপলব্ধি না করলে তাঁর হৃদয়ের এই গভীর প্রেমশক্তি ও মানবপ্রেমের গভীরতা সঠিক পথে পৌঁছতে সক্ষম হয় না; তাই তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টা একসময় তাঁকে সংশয়ে ডুবিয়ে দিতে পারে। যে-ব্যক্তির প্রাণ এই পৃথিবীর প্রতি গভীর প্রেমে উচ্ছ্বসিত, পৃথিবীতে ছড়ানো জ্ঞান, সৌন্দর্য, ন্যায় ও মঙ্গলভাব উপলব্ধি করে যাঁর অন্তর বিস্ময়ে পরিপূর্ণ, সামান্য ফুলের হৃদয়নিহিত সুগন্ধ-মাধুর্যে যাঁর হৃদয় প্রেমে বিভোর—যে-বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞান, মঙ্গল, প্রেম ও সৌন্দর্যে তিনি বিমোহিত; সত্য, জ্ঞান, মঙ্গল ও প্রেমের আধাররূপে যে বিশ্বশক্তি ও বিশ্বরূপ তাঁর কাছে সতত সমাদৃত ও পূজিত, তা যে এক মহান অনন্ত পুরুষের অনন্ত সত্য-মঙ্গল-প্রেমভাবের কণামাত্র নিয়ে তৈরি, একথা না জানলে তাঁর মনুষ্যত্ব কখনোই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে পারে না।




যখন এ সকল অজ্ঞান ভক্ত প্রকৃত আত্মদৃষ্টি লাভ করেন, তাঁদের অন্তরাত্মার মধ্যে যখন ব্রহ্মজ্ঞান প্রস্ফুটিত হয়; বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় এবং আত্মার দ্বারা এতকাল অজ্ঞাতসারে সত্য-মঙ্গল-প্রেমময় যে-পূর্ণব্রহ্মকে নিজের অজ্ঞাতেই উপাসনা করছিলেন, তিনি যখন ভুবনমোহনরূপে তাঁদের জ্ঞানের ভুমিতে এসে দাঁড়ান, তখন এ সকল পণ্ডিত নীতিবান প্রেমিক ও জ্ঞানী ব্যক্তির অন্তরের অতীতের বিশেষ বিশেষ প্রতিভা পরম প্রেমময় ঈশ্বরের চরণের সংস্পর্শে শতগুণে বর্ধিত হয়ে ওঠে। তখন তাঁরা বুঝতে পারেন, আগে নিজের অন্তরে যে-ভক্তিভাব ছিল, তা অপূর্ণ ছিল এবং এই বোধের তাড়নায় তাঁরা আগেকার সেই অভাবটুকু পূরণ করে ভক্তিভাবের পূর্ণতা সাধনে প্রবৃত্ত হয়ে পড়েন। এই প্রক্রিয়ায় একেক মানুষ একেক পথে চলেন। সত্যের প্রতি যাঁর অনুরাগ গভীর, কিন্তু ন্যায় ও প্রেমভাব যাঁর অন্তরে বিকশিত হয়নি, তিনি নীতি ও প্রেমসাধনের পথে হাঁটেন। যাঁর ন্যায়ের প্রতি গভীর প্রীতি আছে, কিন্তু জ্ঞান ও প্রেমের প্রতি প্রাণের টান সেই অর্থে নেই, তিনি বুদ্ধি ও হৃদয়ের পরিচালনা করে যাত্রা শুরু করেন। যাঁর হৃদয়ে প্রেমের টান প্রবল, কিন্তু জ্ঞান ও মঙ্গলভাব নিষ্প্রভ, তিনি এই দুইকে জাগ্রত করেন। যাঁর বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয় সবই সতেজ, কিন্তু অন্তরে ধর্মের প্রাণস্বরূপ প্রকৃত বিনয় ও শ্রদ্ধাভাবের অভাব রয়েছে, তিনি ব্রহ্মজ্ঞান লাভের দ্বারা ক্রমশ নিজের ভক্তিভাবের অপূর্ণতা দূর করে পুরোপুরি সুন্দর চরিত্র লাভ করে থাকেন।