ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১৫)

সত্যের শক্তি যে কেবল ব্যক্তিজীবনেই প্রকটভাবে ফুটে ওঠে, তা নয়। ব্যক্তির সমষ্টি যে সমাজ, সেটিও অবনত মস্তকে সত্যের প্রভুত্ব স্বীকার করে থাকে। প্রথমে, কোনো বিশেষ ব্যক্তি সত্যকে দেখতে পান। কিন্তু কিছুকাল পর্যন্ত তিনি নিজেও কেমন একটা আবছায়ার মতন করে সত্যকে দেখেন। ধীরে ধীরে স্পষ্টতর অবয়বে সত্যের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাঁর চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয় এবং এই সত্য প্রবলভাবে তাঁর প্রাণে জ্বলতে থাকে। তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারেন না; একে-ওকে যাকেই পান, তাকেই তিনি এই সত্যের সন্ধান দিতে থাকেন এবং মানুষের সামনে যতই সত্যের প্রকৃতি বর্ণনা করেন, ততই তাঁর হৃদয়ের সত্য আরও স্ফুলিঙ্গের মতন জ্বলে উঠে উজ্জ্বল হতে থাকে। তাঁর আশেপাশের মানুষও ক্রমেই অতিক্ষীণভাবে আলো-আঁধারিতে এই নতুন সত্য দেখতে আরম্ভ করে। এই সত্য ক্রমশ লোকের মনে সত্যের প্রতি একধরনের প্রীতিভাব উৎপন্ন করে দেয়। তারপর আরও দু-চারজন ব্যক্তি আংশিকভাবে এই সত্য গ্রহণ করেন।




তখন, জলের উপর সূর্যের আলো এসে পড়লে যেভাবে করে সূর্যের প্রতিবিম্ব জলের উপর কাঁপতে থাকে এবং কাঁপতে কাঁপতে এক ঢেউ থেকে পাশের ঢেউ গিয়ে পতিত হয়, আর সে ঢেউকে আলোকিত করে, ঠিক সেভাবেই সত্য এক প্রাণ হতে অন্যান্য প্রাণেও ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হতে থাকে। একসময় একই ধরনের চিন্তাভাবনাসম্পন্ন লোকেরা একত্রিত হয়ে পরস্পরের সহানুভূতি, সহায়তা ও সাধনার সাহায্যে এই নবজাত সত্যকে আরও বিকশিত করার চেষ্টা করতে শুরু করেন। তাঁরা সবাই মিলে একটি দল গঠন করেন, যেখানকার সবাই একটি অভিন্ন সত্যে বিশ্বাস করেন এবং পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে এই নতুন সত্যে ওঁরা দীক্ষালাভ করেন। সত্যের এই সেবকদল ক্রমশই বড়ো হতে থাকে। অপরদিকে, জনসমাজ তখন নতুন সত্যের তীব্র বিরোধিতা করতে আরম্ভ করে। মানুষ সাধারণত নতুন কিছুকে প্রথম অবস্থায় গ্রহণ করতে পারে না কিংবা চায় না।




কখনো কখনো সেই জনসাধারণ রাজশক্তির সাহায্যে নতুন সত্যকে বিনাশ করতে অগ্রসর হয়। কখনোবা নিজের বুদ্ধিশক্তি প্রয়োগ করে যুক্তিতর্কের সাহায্যে ওই সত্যকে উচ্ছেদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কখনোবা অশেষ নৈপুণ্যের সাহায্যে গোপনে সত্যকে বিনষ্ট করতে চায়, কখনোবা প্রকাশ্যে অত্যন্ত নগ্নভাবে সত্যের গতিরোধ করতে উদ্যত হয়। এভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ামাত্রই সত্য কীরকম জানি একটু ক্রুদ্ধভাব ধারণ করে; সত্যের মুখপাত্রগণ এই সময়ে সত্যকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞানের দ্বারা আরও বেশি আয়ত্ত করে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলেন এবং পৃথিবীর সাথে সত্যের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক সগৌরবে নির্ধারণ করেন। এ সকল বিঘ্নবাধাতে সত্যের শক্তিসামর্থ্য উলটো আরও বেশি বিকশিত হয়। তখন নতুন সত্যের নতুন শিষ্যগণ শান্তসমাহিত হয়ে বিচার ও আলোচনার সাহায্যে এই সত্যের প্রকৃত তথ্য সম্পর্কে অবগত হবার চেষ্টা করতে করতে একসময় সত্যের দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজেদের বাক্‌শক্তিকে বিকশিত করেন, মানুষের সামনে সত্যকে উপস্থিত করার বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করেন এবং এই সত্যকে কোনো এক বাহ্যিক আকারে স্বীকৃত করার জন্য পরিশ্রম ও যত্ন সহকারে চেষ্টা করেন।




আমাদের মনে রাখতে হবে, সত্য মাত্রেরই একটি বাহ্যিক আকার প্রয়োজন। মানুষের প্রত্যেকটি মানসিক চিন্তা এবং ভাব কেবল ভাবরূপে থাকতে পারে না, বরং সারাক্ষণই বস্তুরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। তখন এই নতুন সত্যের উপদেষ্টাগণ স্পষ্টতররূপে ও সর্বাঙ্গসুন্দরভাবে নিজেদের হৃদয়জাত সত্যের প্রচার করতে সমর্থ হন এবং এর ফলে যে-সমস্ত সমালোচনা এসে উপস্থিত হয়, সেগুলির অন্তর্নিহিত সত্যের আঘাতে, নতুন সত্যের মধ্যে যদি কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে থাকে, তা দূর হয়। এমনি করে এই নতুন সত্য সব ধরনের জাতীয় বা ব্যক্তিগত সংকীর্ণ ভাব ও সংস্কার হতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করে বিশ্বজয় করতে বেরিয়ে পড়ে। এভাবেই ধর্মবিষয়ক বা জনহিতকর মহান সত্যগুলো জগতে প্রচারিত হয়ে নিজেদের নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করে থাকে।




ধর্ম বা নীতি সম্পর্কিত প্রত্যেক নতুন সত্যই প্রাচীন সংস্কারের সঙ্গে বিরোধিতা করে এবং প্রথমেই যাঁরা সেই সত্যকে গ্রহণ করেন, তাঁদের মস্তিষ্কে নবসত্যটি এক অভিনব ভার স্থাপন করে দেয়, আর তা হলো, প্রাচীন সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে, জনগণের নিন্দা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের স্নেহমমতা-সমর্থন হতে বঞ্চিত থেকে, ধৈর্য ধরে কাজ করে যাওয়া। নতুন সত্যের প্রতিষ্ঠাতাদের সবসময় সব জায়গাতেই সমাজে হেয় ও হীন প্রতিপন্ন হতে হয়। প্রাচীনকালে সত্যধর্মের প্রচারকগণকে অসংখ্য অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। সত্যের উপাসকগণ এ সকল অত্যাচার-নির্যাতন হাসিমুখে সহ্য করেছেন এবং তাতেই সত্য অপ্রতিরোধ্য গতিতে পৃথিবীতে প্রচারিত হতে থাকে। ক্রমেই জ্ঞানী লোকেরা এসে নতুন সত্যের দর্শন, বিজ্ঞান ও কাঠামো আবিষ্কার করেন, সেই সত্যকে বিভিন্ন প্রান্তরে বিবৃত ও প্রচার করেন এবং বাহ্যিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করে সত্যকে বাহ্যিক রূপ দান করেন। তখন সত্য এক নতুন শক্তিরূপে জগতে অবতীর্ণ হয়। কিছুতেই এই সত্যকে নিজের স্থানভ্রষ্ট বা এর গতিরোধ করা সম্ভব হয় না। এভাবেই জগতে বিভিন্ন মহান ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্যের প্রচারকগণ হাজার হাজার বাধাবিপত্তি সহ্য করেও সত্যকে জগতে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত করতে সক্ষম হয়েছেন।




সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মসম্পর্কিত বিধিবিধানের উপর মানুষের যে সম্পূর্ণ প্রভুত্ব আছে, এই সমস্ত বিধিবিধান মানুষের কোনো একটা স্বার্থসিদ্ধির উপায় ছাড়া আর কিছু নয়, এবং মানুষ চাইলেই যে-কোনো সময় যে-কোনো উপায়ে এই নিয়মগুলির পরিবর্তন, পরিবর্ধন, এমনকি পরিবর্জন করতে পারে—এই সহজ সত্যটা আজ থেকে পাঁচ-ছয়'শো বছর আগে মানুষের মনে প্রথম উদিত হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে ধর্মসম্পর্কিত এই সত্যটা যে-কোনো বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই জানে।




একটা সময় ধর্ম মানুষের কাছে একধরনের অভিনব ও মহান সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। তখন মানুষ ভাবত, ধর্মীয় বিধিবিধান ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত এবং সেসবের পরিবর্তন করা মানুষের অসাধ্য। এর ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে একটু ভেবে দেখা যাক। ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও ধর্মের সত্য পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। মানুষের মধ্যে যাঁরা একটু মেধাবী ও প্রতিভাবান, তাঁরা মানুষের কল্যাণে অসংখ্য ধর্মীয় বিধিবিধানের রচনা করেছেন। ওই সকল বিধি হাজার হাজার মানুষকে নতুন জীবন দান করেছে।




পরবর্তীতে মানুষ ভাবল, চাইলে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাজনীতিতে, শাসনতন্ত্রে, ব্যাবসাতে ধর্মের এই সত্যের প্রয়োগ করা যায়। যদি কৌশলে ঠিকঠাকভাবে ধর্মের সত্যগুলোকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় এবং সেগুলিকে যথাযথ উপায়ে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গতভাবে লাভবান হওয়া কঠিন কিছু নয়। শুরু হয়ে গেল নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্য ধর্মকে কাজে লাগানো। তবে এর বাইরেও ধর্মের যে-সকল মানবকল্যাণমূলক দিক রয়েছে, সেগুলিকে পক্ষপাতশূন্য হয়ে কাজে লাগাতে পারলে পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।




ধর্মের এই বিপ্লবযাত্রা অমনিই ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, হল্যান্ড থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটিয়ে দিতে আরম্ভ করল। মানুষ তখন এর গতিরোধ করে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারা বিভিন্নভাবে বাধার সৃষ্টি করতে উদ্যত হলেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, প্রাচীন অপ্রয়োজনীয় বিধানের সংস্কার ও সংহার করাই সত্যের একমাত্র কাজ নয়। তাই বিভিন্ন ধরনের রাজতন্ত্র ও শাসনপ্রণালীর উচ্ছেদ করে নিজের উপযোগী ও ধর্মের অনুগামী নতুন নতুন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই সত্য আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে আমেরিকায় গিয়ে উপস্থিত হলো।




এভাবেই ধর্মের বীজ দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে গেল এবং সেই প্রাচীন সত্য থেকে রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, অর্থনীতি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন যুগসত্যের উদ্ভব হতে আরম্ভ করল। ‌মানুষ মাত্রেরই নিজের জীবনরক্ষা, মানসিক ও শারীরিক স্বাধীনতা ভোগ এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক শান্তি খোঁজ করার অধিকার আছে—এ ছিল নতুন সত্য, যা প্রাচীন সত্যেরই একটি পরিমার্জিত সংস্করণ মাত্র। এই সত্য অবলম্বন করে পৃথিবীতে সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে।




বহুকাল আগে যে-সত্য লোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল, এখন সেটি জীবনের বিভিন্ন কাজে প্রযুক্ত হয়ে তার কার্যকারিতা ও উপযোগিতা প্রমাণ করে যাচ্ছে। মানুষ সব ধরনের মানবিক বিধিবিধান মেনে নেবে এবং সেগুলিকে নিজের মতো করে পরিচালনা করবে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থের উদ্দেশ্যে তৈরি লৌকিক বিধিবিধানের দাসত্ব সে করবে না। সে নিজে নিজের মঙ্গলের জন্য এসব বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছে। এসবের দাসত্ব করার জন্য ঈশ্বর তাকে সৃষ্টি করেননি। এ সব‌ই প্রাচীন সত্য। বর্তমানে এই সত্যের প্রভাব অতীতের তুলনায় অনেক বেশি। এখন চাইলেই কেউ স্বেচ্ছাচারী হয়ে নিজের ইচ্ছেমতো নিয়মকানুন জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। ধর্মসত্যের প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে রাজসিংহাসন ধুলিসাৎ হয়েছে। নানা জায়গায় অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক যে-সমস্ত রাজস্থাপনা ছিল, তার সব কিছুই ধ্বংস করে সাধারণ নাগরিকদের কল্যাণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে।