ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১৪)

কোনো বিশেষ ব্যক্তির জীবনে বিশেষ কোনো কারণে কখনো কখনো একটা বিশেষ সত্য গভীরভাবে প্রভুত্ব বিস্তার করতে পারে। ধর্মজগতের ইতিহাসে এর অনেক দৃষ্টান্ত দেখা যায়। জন্মপরিচয়ের কারণে কেউ ভাবতে পারে, সে বোধ হয় অন্য কারও তুলনায় ঈশ্বরের কাছে অধিক প্রিয় বা অপ্রিয় এবং এই ভাবনাটাই তার প্রার্থনাসত্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এনে দেয়। নিজের ধর্মের সত্যকে যাঁরা শ্রেষ্ঠ দাবি করে বসেন, তাদের মাথায় এটা আসে না যে, অন্য অনেক সত্য এ পৃথিবীতে আছে, যেগুলির অনুগামী হয়েও ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই নিজের সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করা একধরনের ধর্মীয় মূর্খামি ছাড়া আর কিছু নয়। মজার ব্যাপার, এমন গোঁয়ার্তুমির পেছনে চারপাশের অনুকূল পরিবেশ অনেকটাই দায়ী। পরিস্থিতির সমর্থন না পেলে মানুষ তখন চুপ করে থাকে, কেননা গায়ের জোরে নিজের ধর্মসত্যকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রচার করার জন্য যে খুঁটির জোরটা দরকার, আশেপাশের কোথাও সে তা পায় না। বিশ্বাস যখন মেধা ও কাণ্ডজ্ঞানের ধার ধারে না, তখন তাকে মানসিক অন্ধত্ব বলা হয়। অন্ধ হয়ে নিরাপদে ও আরামে বাঁচতে চাইলে অন্ধদের রাজ্যে বাস করাটা জরুরি। এক্ষেত্রে ধর্ম নিজে অন্ধত্বের দীক্ষা দেয় না, বরং দীক্ষিত ব্যক্তিরাই ধর্মকে অন্ধ হিসেবে দেখায়।




যে-সম্প্রদায় নিজেদেরকে ঈশ্বরের কাছের বলে মনে করে এবং যে-সম্প্রদায় নিজেদেরকে ঈশ্বরের দূরের বলে মনে করে, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই এমন কয়েকজন ব্যক্তি থাকেন, যাঁরা সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধ-সত্যে নয় বরং জগতের সার্বভৌমিক সত্যে বিশ্বাসী। তাঁরা সত্যের সার্বভৌমিক রূপের পূজারী। সত্যকে কেবল সত্য বলেই গ্রহণ করতে তাঁরা সবসময়ই প্রস্তুত। তাঁর সম্প্রদায়ের সত্যের সাথে নিজের বিবেকের সত্যের সংঘাত অনিবার্য, এটা জেনেও তিনি নিজের বিবেকের সত্যের প্রতি অবিচল থাকেন এবং দেখা যায়, কপট সংকটের সময়ে সম্প্রদায়ের পক্ষে অবস্থান না করে তিনি সত্যের পক্ষে অবস্থান করেন। এতে করে পৃথিবীতে সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি যে-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, সেই সম্প্রদায় শক্তিশালী কিংবা দুর্বল যা-ই হোক না কেন, এক্ষেত্রে সম্প্রদায়ের সত্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ঈশ্বরের সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।




মানুষ যেমনি করে নিজের কল্পনায় বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যদান করে দেবতাদের সৃষ্টি করেছে এবং সৃষ্ট দেবতাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সংঘাতের উৎপাদন তথা রচনা করেছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন সংশয় তৈরি হয়েছে। যখন একাধিক দেবতা আদর্শগত দিক থেকে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন তার ফলশ্রুতিতে ওই সকল দেবতার উপাসকদের মধ্যেও একধরনের বিভেদ দেখা যায়। ঈশ্বরের বাণী কখনোই এমন শিক্ষা দিতে পারে না। এক্ষেত্রে মানুষে মানুষে যে-সংঘাতের তৈরি হয়, তার জন্য ঈশ্বর কিংবা ধর্ম দায়ী নয়, বরং কিছু মূর্খ লোকের কল্পনা বা ভ্রম‌ই দায়ী। ধর্মের নামে এই ধরনের বিভেদ তৈরি করার কারণে পৃথিবীতে যুগে যুগে বিভিন্ন জাতির মধ্যে চরম বিদ্বেষ ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ওসব রক্তপাত ও খুনোখুনি নিশ্চয়ই ঈশ্বরের নির্দেশ ছিল না। এর জন্য ধর্মগুরুরাই প্রধানত দায়ী। ওঁরাই মানুষকে নিজেদের সুবিধামতো ধর্মের ভুলভাল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভ্রান্ত করেন। ধর্ম মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করে না, বরং ধর্ম নিয়ে যারা ব্যাবসা করে কিংবা সংঘাত ঘটায়, তারাই এ ধরনের দূরত্বের জন্য দায়ী।




এক ঈশ্বরের প্রেমে সবাই এক হয়ে গেলে পৃথিবীতে কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সৃষ্টি হতো না। মানুষ ওরকম এক হতে পারেনি বলেই নিজেদের মধ্যে ঈর্ষা ও দূরত্বের তৈরি করেছে। নিজের ধর্মটা অন্য কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেই যদি বুঝতে পারত, তাহলে মানুষের জীবনে এত কষ্ট আর থাকত না। ঈশ্বরের খোঁজে ধর্মালয়ে কিংবা ধর্মগুরুর কাছে না ছুটে নিজের হৃদয়ের কাছে ছুটলে তাঁকে পাওয়া সহজ হতো। এতে সময় বাঁচত এবং অহেতুক বিভ্রান্ত হতে হতো না। পৃথিবীর সব মানুষই যদি একই ঈশ্বরের সন্তান হয়ে থাকে, তাহলে কারও ঈশ্বর ভালো কিংবা কারও ঈশ্বর খারাপ, এ ধরনের চিন্তাভাবনা বাতুলতা ছাড়া আর কী?




ধর্মের প্রকৃত সুরে জীবন উন্নত হয়, মন প্রশস্ত হয়। এতে করে নিজের বিবেক বিকশিত হয়, পাপ ও মৃত্যুর বাঁধন হতে মুক্তিলাভ করা সহজ হয়। পৃথিবীর সকলকে কাছের ভেবে আলিঙ্গন করতে জানলে নিজের বুদ্ধি ও বোধ বিভিন্ন অকল্যাণচিন্তা, অনিষ্টচিন্তা এবং অপ্রয়োজনীয় চিন্তার বাধ্যতা থেকে মুক্তি পায়। তখন আমাদের অন্তরাত্মার পক্ষে পরমাত্মার কাছাকাছি পৌঁছানো আপনাআপনিই সহজ হয়ে যায়।




পৃথিবীতে যে-জাতি যত বেশি পরিমাণে সত্যের সন্ধান পেয়েছে, আমরা সে জাতিকে ততটা মহৎ হিসেবে অভিহিত করি। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে যদি কোনো সংগঠনের সৃষ্টি হয়, তবে সেখানকার কোনো সিদ্ধান্তে কোন জাতির মতামত সবার আগে বিবেচনা করতে হবে, তা নির্ধারণ করতে হলে, কোন জাতির প্রতিনিধির সংখ্যা সবচাইতে বেশি, তা নিয়ে ভাবতে হয়। কিন্তু উক্ত সংগঠনের শক্তি ও কাজের গতি সুসংহত রাখার স্বার্থে প্রতিনিধির সংখ্যা বিবেচনার পাশাপাশি, যাঁরা মতামত দিচ্ছেন, তাঁদের বুদ্ধি, বিবেক ও সত্যসন্ধানের ক্ষমতা যাচাই করাও জরুরি। মতামত প্রদানকারী প্রতিনিধিগণের চিন্তা ও ভাব, তাঁদের মধ্যকার চিন্তাশীল মানুষগণ কে কোন সত্য অর্জন ও আয়ত্ত করতে পেরেছেন, সেই সত্য কি সম্প্রদায়ের সত্য, না কি সার্বভৌমিক সত্য—এ ধরনের বিষয়গুলো মাথায় রাখা জরুরি। মানসম্পন্ন কাজের জন্য সংখ্যা নয়, বরং মানের বিবেচনাই বেশি জরুরি।




কোনো উন্নত জাতির সমস্ত লোককে হত্যা করা যেতে পারে, বর্বর লোকজন কোনো চমৎকার নগরীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে, মহৎ ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো বর্বর মূর্খ শাসক ধ্বংস করে দিতে পারে, কোনো আদর্শবান পুরুষের আদর্শে ভীত হয়ে স্বার্থান্ধ মানুষ তাঁকে খুন করতে পারে—কিন্তু এ সমস্ত ক্ষেত্রে, যে-সত্য এবং সত্যের আলো প্রতিষ্ঠিত হয়, তা কখনোই ধ্বংস করা সম্ভব নয়, বরং যুগে যুগে তা ক্রমশ বিকশিত হতে থাকে। সত্য এভাবেই পৃথিবীতে সবসময় অমর হয়ে টিকে থাকে। পৃথিবীর লোক আজও প্রাচীন জাতির পবিত্র ও সত্যময় ভগ্নাবশেষকে পুণ্যভূমিজ্ঞানে পূজা করে।




ঈশ্বর কখনও একটি জাতিকে বেশি বাৎসল্য দেখিয়ে অন্য কোনো জাতিকে কম বাৎসল্য দেখান না। তিনি সভ্য ও অসভ্য, জ্ঞানী ও অজ্ঞান, সকল জাতিকেই সমানভাবে সত্যের সন্ধান দেন। কিন্তু সবাই তা একইভাবে নিতে পারে না, আর এখানেই তৈরি হয় জাতিতে জাতিতে গুণগত পার্থক্য। ঈশ্বর নয়, বরং আমরাই এই সত্য বা জ্ঞানসম্পত্তি দ্বারা বিভিন্ন জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে থাকি এবং এই সত্যকে অবলম্বন করেই কিছু মানুষ বিভিন্ন জাতির মধ্য হতে অমরত্ব লাভ করে। পৃথিবীর মানুষ কোনো জাতিকে চিনে নেয় সেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কৃতিত্বের সাহায্যে।




সত্য এতটাই মহান যে, সমস্ত মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থকেও সে নিজের বাহনরূপে গ্রহণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। মরুভূমির উটের পিঠে যেমন সত্য পরিভ্রমণ করে, তেমনি সমুদ্রের বুকে জাহাজের শরীরেও সত্য বিচরণ করে। কেউ কেউ সত্য অপেক্ষা সত্যের বাহনকেই বেশি গুরুত্ব দেয় এবং সত্যের জড়তম প্রকাশকেও আলিঙ্গন করে বুকে জড়িয়ে নেয়। এভাবেই সমাজনীতি বা রাজনীতির মহান সত্য, সকল ধর্মপ্রেম বা বিশ্বজনীন ভক্তির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হবার আগে, তার পার্থিব উপযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রচারিত ও বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজনীতির মহান সত্য যা-কিছু আছে, সেগুলি নিজের গুণে নয়, বরং ভয়ভীতি কিংবা অন্য কোনো পার্থিব ফলাফলের হিসেবি চিন্তার কারণেই মানুষের জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মানবসমাজ কখনো কখনো নিজেদের এই সকল মানসপুত্রকে তাদের বাহ্যিক উপযোগিতার কারণেই স্নেহের সাথে আলিঙ্গন করে ঘরে রেখে দেয়। ঈশ্বরও এক্ষেত্রে, যে-জাতি যে-সত্যকে যে-আকারে গ্রহণ করতে পারে, সেই সত্যকে সেই আকারেই সেই জাতির কাছে পাঠিয়ে থাকেন। কাউকে সরাসরি বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়, কাউকেবা খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলা হয়। মৃত্যুর আগেই কেউ তার মৃত্যুর সম্পর্কে জেনে যায়, আবার কেউবা জানতেই পারে না যে, কিছুক্ষণ পর সে মারা যাবে। তবে দুই ক্ষেত্রেই গন্তব্য কিন্তু একই।




আমরা যে সবসময় কেবল স্বার্থের কারণেই সত্যকে আদর করি, তা কিন্তু নয়। শারীরিক ও মানসিক বৃত্তিগুলিকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করার অধিকার মানুষের জন্মগত, এই সহজ সত্যটি কেউ কেউ বুঝতে পারে না। নির্দোষ মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা যে গুরুতর অন্যায় এবং কোনো ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন তৈরি করে এমন অন্যায়-অবিচার'কে বৈধতা দেওয়া, তা যে আরও বড়ো অন্যায়—এই সহজ সত্যটি বুঝতে কেবল বুদ্ধি ও বিবেক থাকলেই চলে, এর জন্য কোনো আইনের দরকার হয় না। সত্যের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এসে উপস্থিত হলে তখন মানুষ হৃদয়ের ভক্তির গুণে মনের শক্তিকে সর্বোচ্চ পরিমাণে বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় এবং এই সার্বভৌমিক সত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মানুষ তখন লড়াই করতে থাকে। এতে করে সমাজের বিভিন্ন গুরুতর অনিয়ম ও পাপ ধীরে ধীরে অপনোদিত হয়। এখানেই সত্যের জয়।