ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১৬)

মানুষের অন্তরস্থিত বোধ হতে যে-সত্যের উৎপন্ন হয়েছে, সেই সত্য মানুষের অন্তঃপ্রকৃতির সাথে গভীরভাবে জড়িত। মানবসমাজ সমূলে বিনষ্ট না হলে এই সত্যের উচ্ছেদ করা কখনোই সম্ভব নয়। এই সত্য কেবল একটা ভাব, একটা চিন্তা, একটা দর্শন। এর হাত-পা কিছুই নেই, অথচ যেসব ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই সত্যকে জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাঁদেরকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে বাঁচতে হয়েছিল। সত্যের প্রচার করার জন্য তাঁরা পৃথিবীর মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন। মানুষ মহৎ ব্যক্তিদের অভিনব সত্যকে যতটা বিশ্বাস করে, তার চাইতে বেশি বিশ্বাস করে তার বাড়ির পাশের অশিক্ষিত মুদি দোকানদারের মনগড়া মিথ্যাগুলিকে; অথচ এ ধরনের লক্ষ লক্ষ মূর্খ ব্যক্তির চাইতে একজন জ্ঞানী ব্যক্তির শক্তি অনেক অনেক বেশি। জ্ঞানী ব্যক্তিকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তাঁর সত্যকে হত্যা করা অসম্ভব। সত্য মাত্রেই পরমেশ্বরের স্বর্গীয় শৃঙ্খলার অংশ। যে কেউ যখন এই সত্যকে মানুষের সমাজের কোনো অংশে কোনো মহৎ কাজে সংযুক্ত করে দেয়, তখন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অনুগ্রহ এসে তার সেই কাজটি সহজেই সম্পাদন করে দেয়। ঈশ্বর যখন নিজেই কোনো বিষয় নিয়ে কাজ করেন, তখন কার সাধ্য তাকে প্রতিরোধ করে?




এই সত্যের বিশ্বাসী ঈশ্বরের যে-ভৃত্য, তাঁর মুখে যেন সত্যের আভা ফুটে ওঠে, তাঁর প্রশস্ত কপালে বুদ্ধিগত ভগবদ্‌প্রীতির সমস্ত চিহ্ন যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; নিজের জীবনের বিভিন্ন কর্তব্যসাধন করতে করতে এই সত্যের আভাস পেয়ে তিনি যেন নিজের জীবনগতিকে আরও বাড়িয়ে তোলেন, শরীর ও মনের সমস্ত শক্তিকে নিজের আত্মার অভিমুখী করে অন্তরের এই সত্যকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। হায়, আকাশের বিদ্যুতের মতোই, স্বর্গের এই আলো যেন সহজে মানুষের হাতে ধরা পড়তে চায় না! তাই যে-সত্য একবার সাধকের প্রাণে এসে নিজের পুণ্যপ্রসন্ন মুক্তি দেখাচ্ছে, পরমুহূর্তেই সেই সত্য যেন কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সাধকের মুখে একমুহূর্তে হাসির রেখা ফুটে উঠছে, আবার পরমুহূর্তেই গভীর সংশয়ে তিনি ডুবে যাচ্ছেন।




সত্যের সৌন্দর্যের বিমোহিত হয়ে এবং তার সংস্পর্শে এসে, এই পৃথিবীতে কী চমৎকার শোভা চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ও বিকশিত হচ্ছে, তা কল্পনা করে সাধক আনন্দে ভাসছেন, কিন্তু ক্রমেই এই হাসি বিষাদের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে; আর সত্যকে দেখার দায়িত্ব তাঁর অন্তরে আবারও জেগে উঠছে। নিজের প্রাণ ও রক্ত দিয়ে সত্যের এই যাত্রার পুষ্টিসাধন করতে না পারলে, বৃক্ষ যেমনি এই পৃথিবীর শুকনো ভূমিতে বাঁচতে পারে না, ঠিক তেমনি সত্য‌ও আন্তরিক চেষ্টা ছাড়া সাধকের প্রাণে জাগ্রত থাকতে পারে না। এই বোধ সাধকের হৃদয়ে এসে উপস্থিত হয় এবং নতুন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে কত ঘাম ও রক্ত খরচ হবে, কত সাধনার প্রয়োজন হবে, কত পরিশ্রম করতে হবে, কত আত্মত্যাগ করতে হবে, এ সমস্ত ভাবনা সাধককে ক্রমেই বিচলিত করে দেয়। তাই সত্যসেবকের মুখে কখনো কখনো আশার আলো দূরে গিয়ে বিষাদের গাঢ় অন্ধকার এসে পড়ে। তিনি অন্যের কাছে নিজের হৃদয়লব্ধ সত্যকে ধীরে ধীরে প্রদর্শন করতে চান এবং তার শুরুটা সাধক করে থাকেন নিজের পরিবার ও পরিজনের বলয় থেকেই। এভাবে দিন কাটে, সত্যের বয়স ধীরে ধীরে বাড়ে এবং জনসমাজে নিজের স্বাভাবিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে ক্রমশ সে অগ্রসর হতে থাকে।




সত্যের প্রথম লড়াইটা হয় সে-সকল সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে, যাঁরা ব্যক্তিগত সত্যকে সার্বভৌম সত্যের উপরে স্থান দিয়েছেন। তাঁরা সত্যকে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, আর্থিক সুবিধা লাভ করার জন্য, জনসাধারণকে নিষ্পেষণ করার জন্য এবং নিজেদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার জন্য যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেন। তাঁদের কারণেই সমাজে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষত সারানোর একমাত্র ঔষধ হচ্ছে সত্য। তাই সত্য যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পরাক্রমশালী রাজাদের সিংহাসনচ্যুত করে দেশের সাধারণ মানুষকে আলোর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। এতে পৃথিবীর সৌভাগ্য, মানুষের উন্নতি ও সভ্যতার মঙ্গল সাধিত হয়েছে। এভাবেই মানুষ শান্তি, মঙ্গল ও প্রীতির পথে চলার জন্য মহান সত্যের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যুগে যুগে নিজের আত্ম-অনুসন্ধানের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়েছে।




তবে মানুষ এখনও ধর্মের নামে অত্যাচারের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। লোকে এখনো সত্যের পরমসুন্দর রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারেনি। অনেকেই বিশ্বাস করে, এই অসীম অন্ধকার হতে পৃথিবী কখনোই মুক্ত হবে না। তাদের মধ্যে দুইটি দল আছে। একদল সংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, আরেক দল অসহায়ত্বে নিমজ্জিত। ‌তবে তাদের মধ্যে পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তির সংখ্যা কম। নিজের বুদ্ধি ও বিবেককে যারা ব্যবহার করতে পারে, সত্যের সহজ রূপটিকে গ্রহণ করতে তাদের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে সকল ধরনের ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান সত্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। মানুষের উন্নতিতে আত্মিক এবং আর্থিক সত্যের স্থান সবার উপরে। অজ্ঞানতা, কপটতা এবং কল্পিত স্বার্থ মানুষের দৃষ্টিকে অন্ধ করে রাখলেও চিরদিন এমন অন্ধ ও মোহাবৃত হয়ে মানুষ থাকে না। একদিন-না-একদিন সে নিজের কিংবা নিজের পরিবারের কিংবা নিজের সম্প্রদায়ের মঙ্গলের জন্য হলেও ঈশ্বর কর্তৃক নির্ধারিত সত্যের আলো গ্রহণ করবেই করবে।




সত্যই মানুষের সকল বুদ্ধির বিষয় ও লক্ষ্য। মানবিক জ্ঞানের সাহায্যে আমরা ঈশ্বরের ভাব শিখি এবং তাঁর জ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হই। তবে একই আকারের ও একই ওজনের সত্য সবাই একই উপায়ে লাভ করে না। সত্যকে লাভ করার বিভিন্ন পথ ও প্রণালী রয়েছে। প্রত্যেকে নিজের অভ্যন্তরীণ ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তির সাহায্যে সত্যের অনুগামী হয়ে থাকে। সত্যের প্রতি পক্ষপাতহীন ও নিষ্কাম প্রেমই মানুষের বুদ্ধিগত ভক্তির উদাহরণ। ‌মানবধর্মের পূর্ণতা সম্পাদনের জন্য জ্ঞান আবশ্যক এবং এই জ্ঞানকে নিষ্কামভাবে তার নিজের গুণের জন্যই আদর করতে হয় ও হৃদয়ে ধারণ করতে হয়। এখনও লোকে জ্ঞানের বাহ্যিক উপযোগিতা আছে কি নেই, তা ভেবেই জ্ঞানকে আদর করে কিংবা ছুড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু যাঁরা প্রাগ্রসর, চিন্তাশীল ও মেধাবী, তাঁরা জ্ঞানকে কেবল জ্ঞানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্যই আদর করেন।




শারীরিক নিয়মগুলি প্রতিপালন করলে স্বাস্থ্য, সামর্থ্য এবং সৌন্দর্য লাভ হয়। মানুষের ইন্দ্রিয়ের চাইতে মন উচ্চতর অবস্থানে রয়েছে। তাই মানসিক বিকাশের নিয়মগুলি পালন করলে শারীরিক স্বাস্থ্য, সামর্থ্য ও সৌন্দর্যের চাইতেও উচ্চতর মানসিক স্বাস্থ্য, সামর্থ্য ও সৌন্দর্য লাভ করা যায়। মানুষ চাইলে মনের সাহায্যে তার ইন্দ্রিয়কে সংযত রাখতে পারে। মানুষের মনের বৈধ পরিচালনা হতেই সত্য প্রবাহিত হয়ে যুগে যুগে এই পৃথিবীর মহান কল্যাণ সাধন করে। বহু হাজার বছর পর বর্তমানের সভ্য জাতিগুলি যখন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে, তখন তাদের নামটুকুই কেবল বিদ্যমান থাকবে। তখনও আজ এরা যে-সকল সত্যের অনুগামী হচ্ছে, যে-সকল সত্যকে প্রচার করছে এবং যে-সকল সত্যকে ধারণ করে উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে, সেইসব সত্য‌ই পরবর্তীকালের মানুষের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ভাণ্ডারভুক্ত হয়ে যাবে। আজকের দিনেও ছয়-সাত হাজার বছর আগে সৃষ্ট উপনিষদের সুমহান বাণী যেমন সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, তেমনি আজ থেকে হাজার হাজার বছর পরও, যা যা সত্যকে আমরা খুঁজে বের করেছি এবং প্রতিষ্ঠা করেছি, সেগুলি মানুষের মনে একইভাবে আনন্দ দেবে এবং পথ দেখাবে। পৃথিবীতে শক্তি ও সৌন্দর্য বরাবরই দুর্বলতা ও মিথ্যার উপরে অবস্থান করে। আজ আমরা মনের যে-শক্তি সাধন করছি, আমাদের মৃত্যুর পর এবং আমাদের জাতি বা সমাজের বিলুপ্তির পরও তা জগতে টিকে থাকবে।




আধ্যাত্মিক জীবনে আমরা যে-জ্ঞান অর্জন করি, তা কখনও বিলুপ্ত হয় না, বরং দিনে দিনে আরও নানান সত্য এসে তাকে সমৃদ্ধ করে। ‌যে-মহাসত্যের পথে মানুষ চলে, তা অন্যদের কাছে খুব সামান্য বলে মনে হলেও তা-ই মূলত মানুষকে আত্মজ্ঞানের সন্ধান দেয়। এর কোনো ধ্বংস নেই। যে-সত্য মানুষ আবিষ্কার করে, তা জগতের অসীম রাজকোষে চিরকালের জন্য সঞ্চিত থাকে। সকলেরই এই সত্য খুঁজে পাবার এবং ভোগ করার অধিকার রয়েছে। এই সত্যের উপর কারও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অধিকার নেই, বরং মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেই এই সত্যের সন্ধানের উপর একচ্ছত্র অধিকার জন্মে যায়। যুগে যুগে পৃথিবীর লোক এই সর্বজনীন সম্পত্তি ভোগ করে এবং নিজেদের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছোতে নতুন সত্যের সাহায্যে পুরাতন সত্যকে বিকশিত করে, অনন্তকালের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের সুবিধার্থে তা রেখে যায়।




কোনো ব্যক্তি প্রথম ধান আবিষ্কার করেছিলেন, বন্য পশুকে বশীভূত করেছিলেন, ঘোড়াকে বলগা দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন, ভাষা ও বর্ণমালা সৃষ্টি করেছিলেন, জল ও আগুনকে নিজের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন, বিদ্যুৎকে করায়ক্ত করে মানবকল্যাণে কাজে লাগিয়েছিলেন, কঠিন পাথরের ফলক খোদাই করে অপূর্ব সব মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন—এ সব‌ই শিক্ষা ও সাধনার ফল। নিজ নিজ শক্তি ও নৈপুণ্য, পরিশ্রম ও কর্মকৌশল ইত্যাদি সমগ্র মানবজাতির জন্য যেমন মহৎ মানুষেরা রেখে গেছেন, তেমনি যে-ব্যক্তি নতুন কোনো সত্য প্রচার করেন, জ্ঞানের কোনো অভিনব শক্তি উদ্ভাবন ও তার বিকাশ সাধন করতে পারেন, তিনিও মানবজাতির আধ্যাত্মিক শক্তি-সম্পত্তি ও গৌরব বৃদ্ধি করে থাকেন। একটা চুল পর্যন্ত সাদা বা কালো করতে সক্ষম হন না যে-মানুষ, তিনিও সত্যের শক্তিতে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশে সাহায্য করতে পারেন।




যে-সকল পার্থিব ধনসম্পত্তি আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে লাভ করেছি, কিংবা নিজে উপার্জন করেছি, আমাদের ঘরবাড়ি, কৃষিক্ষেত্র, পথঘাট, রেলগাড়ি, কলকারখানা, রাস্তাঘাট—এ সব কিছুই আমরা পরবর্তী অসংখ্য প্রজন্মের জন্য সঞ্চিত করে রেখে যাচ্ছি। আমাদের এই অর্জনের জন্য আমাদের সন্তানসন্ততিদের জীবন অনেক সহজ হবে, কাজের ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হবে, তাদের আনন্দ ও সুখ বৃদ্ধি পাবে এবং অনেক ঝামেলা থেকে তারা মুক্তি পাবে। যে-সকল আধ্যাত্মিক সত্য আমরা শিখছি, যে-সকল বুদ্ধিগত ভক্তি আমরা লাভ করছি, সাধনার যে-সকল উপকরণ আমরা চিন্তার সাহায্যে আয়ত্ত করে জীবনে কাজে লাগাচ্ছি, তার সবই পুরুষপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে পরবর্তীকালের মানুষের ভোগের বিষয়বস্তু হবে। আমাদের আধ্যাত্মিক কর্মক্ষেত্র অন্য লোকেরা এসে অধিকার করবে। আমরা যে-সিঁড়ি নির্মাণ করছি, এতে তারা আরোহন করবে এবং তারপর নিজেরাও এই সিঁড়ির নতুন নতুন স্তর নির্মাণ করে আমাদের চাইতেও উন্নত ও সত্যের কাছাকাছি সত্তার উদ্ভাবন করে উচ্চতর আধ্যাত্মিক অবস্থানে পৌঁছে যাবে। এই ধারা চিরঅব্যাহত থাকবে।




মানবজাতির আধ্যাত্মিক জীবনে একধরনের অচ্ছেদ্য ঘন নিবিষ্টতা রয়েছে এবং আদিমানবের চিন্তার দ্বারা মানবসমাজের শেষ ব্যক্তিরও জ্ঞানবিকাশ হবেই হবে। জ্ঞানবিকাশের এমন পরম্পরাগত সহযোগিতার প্রক্রিয়া কখনোই বন্ধ হবে না। আমাদের আগে হাজার হাজার মহৎ পুরুষ এমন সব জ্ঞান ও সত্য আমাদের সামনে খুঁজে এনে দিয়েছেন, যা নিজেদের অন্তরে ধারণ করে সেগুলোকে আমরা আরও বিকশিত করেছি এবং পরবর্তী প্রজন্মের দ্বারা আরও বিকাশের জন্য রেখে যাচ্ছি।




এ পৃথিবী অতি প্রাচীন। মানুষের সৃষ্টি নতুন কিছু নয়, দীর্ঘদিন থেকেই কঠোর পরিশ্রমের সাহায্যে মানুষ অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। অথচ আমাদের হৃদয়ের ভাব ও প্রকৃতি যা চায়, তার তুলনায় মানুষের অর্জনের দীর্ঘ ইতিহাস‌ও খুব সামান্য বলে মনে হয়। অতীতে যা যা জ্ঞান আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলি আমাদের পূর্ণজ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে কিংবা আমাদের অন্তর্নিহিত পিপাসা মেটাতে সক্ষম নয় বলেই মনে হয়। ভৌতবিজ্ঞানে, ধর্মনীতিতে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে ও অধ্যাত্মতত্ত্বে, এমন সব ক্ষেত্রেই আরও অনেক নতুন নতুন সত্য আবিষ্কৃত হবে।




প্রথম যখন এই সকল সত্য প্রচারিত হয়, সেগুলোকে আমরা অভ্যর্থনা জানাইনি; কিন্তু সেই সময়ে যাঁরা সত্যকে সত্য বলে নিশ্চিতভাবে জানতে পেরেছিলেন, তাঁরা চারপাশের মানুষের আক্রমণের ভয়ে ভীত না হয়ে বরং সেই সত্য প্রচারে মনযোগী হয়েছেন। সত্যের সাহায্যে মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তি ও পার্থিব সুখ বৃদ্ধি পাবেই পাবে।




যে-ব্যক্তি সমাজের সত্যভাণ্ডারে কোনো মহান সার্বভৌমিক সত্য জমা করেছেন, পৃথিবীর কোনো পরাক্রমশালী রাজা বা সেনাপতি তাঁর মতো পৃথিবীর এমন কল্যাণ করতে পারেননি। যে-ব্যক্তি মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করেন, মানুষের মনের কোনো অভিনব ভাবকে আকারবদ্ধ করে মানুষের সেবায় নিযুক্ত করেন, তিনি পৃথিবীর ধর্মগুরুদের কাজ করে থাকেন। পরম জ্ঞানময়ের সাথে তাঁর একধরনের জ্ঞানসংযোগ ঘটে থাকে। তিনি ঈশ্বরের সহকারী বলেই মানুষের কাছে পূজা পাবার উপযুক্ত। মনুষ্যত্বের চাইতে বড়ো কোনো উপহার আমরা মানুষকে দিতে পারি না। একথা যেন আমাদের মাথায় থাকে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁদের কথাই আমরা সবচাইতে বেশি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, যাঁরা মানুষকে পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্য নয়, বরং অপার্থিব আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন।