ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১৩)

বিভিন্ন দার্শনিক পণ্ডিত ধর্মের বিকাশে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁদের চেষ্টা না থাকলে মানুষের ধর্মপ্রবৃত্তির বর্তমান সুস্থ রূপটি আনা অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ত। ধ্বংস করার যে-কোনো কাজ‌ই সবসময় কষ্টদায়ক ও অপ্রীতিকর। প্রাচীন ভগ্নপ্রায় ঘরে যদি অগ্নিসংযোগ করা হয়, তাহলে সেই ঘরের কতটা যে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তার কিছুই বলা যায় না। ঠিক সেরকম, প্রাচীন কোনো ধর্মের অসত্য ও অসাধুতাকে সংহার করার জন্য একবার মানুষের শুভবুদ্ধি জেগে উঠলে সেই ধর্মের মধ্যে যা সত্য ও সার আছে, তারও কতটা যে অপ্রয়োজনীয় জিনিসের সাথে নষ্ট হয়ে যাবে, আর কতটা যে থেকে যাবে, এটা কেউ বলতে পারে না।




পুরোহিতদের গোঁয়ার্তুমি ও অজ্ঞানতার প্রাবল্যের কারণেই বিভিন্ন প্রকারের বিপরীতমুখী দর্শনের প্রবর্তন করার প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল। পুরোহিতের অজ্ঞানতার সাহায্যে পণ্ডিতের জ্ঞানের প্রতিবাদ করা যায় না। অপ্রীতিকর যুক্তির শক্তি, মূর্খতার সাথে থেকে গেলে কখনোই তা নষ্ট হতে পারে না। সুঁইয়ের ছিদ্রের মধ্যে কখনো কি বিশাল ব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করা যায়? তাহলে বুদ্ধির সংকীর্ণতার মধ্যে কীভাবে উদার ও বিশ্বজনীন ধর্মভাবকে ধারণ করা যাবে? ধর্মের জন্য অপরিমেয় জ্ঞানের প্রয়োজন। ধর্মশাস্ত্র, ধর্মসমাজ, ধর্মসাধন, ঈশ্বর ও মানুষ, এ সকল বিষয়ে মানুষের চিন্তার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা লাভ করা বিশেষ প্রয়োজন।




মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষের উপরে অনেকটাই তার ধর্মের শক্তি ও শুদ্ধতা নির্ভর করে। নির্বোধ ব্যক্তি কখনোই জ্ঞানসমৃদ্ধ ভক্তি লাভ করতে পারে না। মানুষ মাত্রেই নিজের স্বভাবের প্রেরণায় ও তাড়নায় সত্যকে ভালোবেসে থাকে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ সাধিত হলে মানুষ সহজেই সত্য দেখতে পায়, সত্য জানতে পারে এবং সত্যের সমাদরও করে। বর্তমান সময়ে জগতের সব জায়গাতেই ধর্মযাজক ও ধর্মপ্রচারকগণের জন্য মানসিক উৎকর্ষ লাভ করা একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ধর্ম-উপদেষ্টাগণের অনেকেরই এই উৎকর্ষ নেই বলে ধর্মের বাহ্যিক ক্রিয়াকাণ্ড ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তাশীল লোকেরা ধর্ম-উপদেষ্টা বা ধার্মিক মানুষের মতামতের তোয়াক্কাই করেন না। ধর্মের বাহ্যিক ক্রিয়াকাণ্ড পালন করতে এবং সেগুলি সম্পর্কে জানতে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের তেমন কোনো দরকার নেই, তাই ওসব নিয়ে চিন্তাশীল মানুষের উৎসাহ বরাবরই কম। এই সমাজচিত্রের কারণে এখন পর্যন্ত জনসমাজের তেমন কিছু অনিষ্টসাধন হয়নি, কিন্তু ভবিষ্যতে এর দ্বারা গুরুতর সর্বনাশ এসে উপস্থিত হতে পারে, যা দূর করার জন্য এখনই যত্নবান হওয়া খুবই দরকার।




মানুষ নানা উপায়ে অনন্ত পরমেশ্বরের সঙ্গে ধ্যানযোগে যুক্ত হয়ে থাকে। জ্ঞান ও মার্জিত বুদ্ধিবৃত্তিও ভগবদ্‌ধ্যানের একটি ভালো উপায়। পরমেশ্বর কেবল বিবেক, হৃদয় বা আত্মার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে তাঁর নিজের ঐশীনির্দেশ প্রেরণ করেন না, বরং বিচারশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং ধারণাশক্তি…মানুষের মনের এ সকল শক্তির মধ্য দিয়েও মানুষ ঈশ্বরের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। মানুষের মানসিক প্রকৃতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে অলৌকিকরূপে বা খামখেয়ালিভাবে ঈশ্বর কেবলই বুদ্ধির মধ্য দিয়ে কাউকে অনুপ্রাণিত করেন না, বরং এই অনুপ্রাণন প্রক্রিয়া পৃথিবীর অন্তর্নিহিত শক্তি কিংবা পৃথিবীর বিভিন্ন পদার্থের মধ্যকার রাসায়নিক আকর্ষণের মতো অবিচল এবং তা সনাতন সত্য-অনুগামী নিয়মের সাহায্যেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।




চিন্তাহীন ব্যক্তিকে চিন্ময় পরমপুরুষ কখনোই নিজের সত্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত করেন না। ঈর্ষাপ্রবণ মানুষের প্রাণেও তিনি নিজের প্রেমের শক্তি ঢেলে দেন না। ঈশ্বর প্রাচীনকালের সাধুদেরকে জ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত করেছিলেন। বিশিষ্ট সাধুদের প্রশস্ত হৃদয়কে তিনি জ্ঞানের দ্বারা পরিপূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু কেবল যে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের সাধুগণ ঈশ্বরের এই অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন, তা নয়। গ্রিসের, রোমের, জার্মানির, ফরাসির, ইংল্যান্ডের, আমেরিকার, ভারতের-সহ জগতের সকল দেশের, সকল সম্প্রদায়ের, সকল কালের সিদ্ধপুরুষ সাধুগণই ঈশ্বরের দ্বারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত। এ কারণেই 'একমাত্র সত্যপথ' বলে কিছু নেই।




মানবসন্তান মাত্রেই বিশ্বজননীর বিশাল বুকে বেঁচে থেকে তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। পৃথিবী কোনো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের প্রতি যেমন পক্ষপাতিত্ব করে না, ঠিক তেমনি ঈশ্বর কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে অনুগ্রহপ্রাপ্ত রেখে অন্য কোনো সম্প্রদায়কে অনুগ্রহবঞ্চিত করে রাখেন না। কেউ যদি দাবি করে বসেন, তিনি যে-ঈশ্বরের উপাসনা করেন, সেই ঈশ্বর বাদে অন্য সকলের ঈশ্বর ভ্রান্ত, তবে তিনি উন্মাদ বড়োজোর, ঈশ্বরপ্রেমিক কিছুতেই নন। ঈশ্বরের বিষয়ে বুদ্ধিগত অনুপ্রেরণা সত্যের আকারে মানুষের অন্তরে প্রবাহিত হয়, কিন্তু অনুপ্রাণিত ব্যক্তির আত্মজ্ঞানের পরিমাণ অনুযায়ী তাঁর প্রাণে ব্রহ্মজ্ঞান সঞ্চালিত হতে পারে। ভাবনা ধারণ করার ক্ষমতা যার অল্প, তার হৃদয় ঈশ্বরের সত্য দ্বারা যতটুকু পূর্ণ হয়, ভাবনা ধারণ করার ক্ষমতা যার সমুদ্রের সমান, তার হৃদয় কি ঈশ্বরের সত্যের সাহায্যে ততটুকুই পূর্ণ হবে? নিশ্চয়ই নয়, তাই না? যার হৃদয়ের ধারণক্ষমতা যত বড়ো, ঈশ্বরের সত্য ধারণের ক্ষমতা তার তত বেশি। তাই আমরা আমাদের মনকে যে-পরিমাণে প্রশস্ত ও উন্নত করব, সেই পরিমাণেই আমরা বিধাতার সত্যের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হব।




মানুষের মনের সান্নিধ্যে এসে মানুষের ভোগের জন্য মানুষের দ্বারা গৃহীত হবার অপেক্ষায় অনন্ত সত্য এই মধুর আকাশ-বাতাসকে সারাক্ষণই পরিপূর্ণ করে রেখেছে। প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ মনের পাত্রের পরিমাপে এই সত্য লাভ করে। যার মনপাত্র ছোটো, সে কেবল সামান্য সত্যই লাভ করতে সক্ষম হয় এবং তার বৃহৎ মনের প্রতিবেশী যদি বেশি সত্য লাভ করে, তাহলে সেজন্য মন খারাপ না করে এবং ঈর্ষান্বিত না হয়ে বরং সেই প্রতিবেশী কীভাবে তার হৃদয়কে ঈশ্বরের অনুগ্রহ ধারণ করার জন্য যথেষ্ট বড়ো করতে সক্ষম হয়েছে, সে-বিষয়ে ভাবা উচিত।




প্রকৃত মানুষ মাত্রেই সত্যকে বড়ো ভালোবাসে। আমরা কোনোভাবেই সত্যকে পরিহার করতে পারি না। সত্য মানুষের মনের এমনই এক প্রিয় বস্তু যে, সত্যস্বরূপের একটিও বাণী আজ পর্যন্ত এই মোহাচ্ছন্ন চিন্তাহীন সংসার চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলেনি। একেকটা বিশেষ সত্যের একেক রকমের অলৌকিক শক্তি। কেবল শক্তিরূপে সত্যের আলোচনা করলেও অবাক হতে হয়। সত্যের শক্তি মানুষের সমাজে তুমুল মহিমায় বিরাজমান, অথচ প্রথম প্রথম এর চাইতে অক্ষম কোনো বস্তু পৃথিবীতে থাকতে পারে না, এমনটাই মনে হয়। তখন মনে হয়, এই ক্ষুদ্র ভাব, এই অসহায় অসমর্থ ক্ষুদ্র সত্য কীভাবে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে? এতে না আছে কোনো কল্যাণ, এর না আছে কোনো শক্তি! কীভাবে করে তাহলে সে একা একা সময় ও অঞ্চলকে পরিব্যাপ্ত করে বিচরণ করবে?




এই নবজাত সত্যকে দেখে মনে হয়, যে কেউই চাইলে এক তুড়িতেই সত্যকে নিষ্পেষিত ও নিঃশেষিত করে দিতে পারে। এই ক্ষুদ্র সরল সত্যরূপ শিশু যেহেতু কারও তোষামোদ করে না, কোনো মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হয় না, সেহেতু সে কখনোই কারও দাসত্বও স্বীকার করে না। তাকে দেখলে মনে হয় যেন তার মৃত্যু অতি সন্নিকটে! পরমুহূর্তেই তার জীবনলীলা শেষ হয়ে যাবে! তাকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে রাজা বা পুরোহিত নিজের বিরাট পদের সাহায্যে নিষ্পেষিত করে দেবেন একনিমিষেই। সবাই ভাবে, ক্ষুদ্রদেহী সত্য এবার বুঝি নিহত ও বিলুপ্ত হয়ে গেল।




এসব ভাবনা কখনোই সফল হয় না। আকাশের বিদ্যুৎকেও পায়ের দ্বারা পিষ্ট করা হয়তোবা সম্ভব, নিজের দাস করেও রাখা হয়তোবা সম্ভব, কিন্তু সত্যকে মেরে ফেলা কিংবা নিজের দাস করে রাখা কিছুতেই সম্ভব নয়। এই পৃথিবীর সমস্ত সত্তার মধ্যে সত্য‌ই সবচাইতে দীর্ঘজীবী। ঈশ্বরের মতো অপরাজেয় সত্য সেই আদি-অন্তহীন চিন্ময় পুরুষেরই আদি-অন্তহীন মূল খণ্ড। একে তাঁরই গুণ বা তাঁরই সত্তার সার ছাড়া আর অন্য কোনো নামে অভিহিত করা যায় না। সত্য এমনই অচ্ছেদ্য সম্পর্কে সত্যস্বরূপ ঈশ্বরের সঙ্গে আবদ্ধ যে, তাকে কিছুতেই ঈশ্বর থেকে আলাদা করা যায় না। আকাশছোঁয়া সকল কীর্তিও একদিন ধুলিসাৎ হয়ে যেতে পারে কালের প্রভাবে, একদিন সুকঠিন পাথরের সমস্ত মূর্তিও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে, অসীম প্রান্তরও একদিন অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, আকাশস্পর্শী পর্বত একদিন ধূলি হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সত্য চিরদিনই বেঁচে থাকবে। যত যা-ই কিছু হয়ে যাক, সত্য সবসময় টিকে থাকবে। মৃত্যু ও পরিবর্তনকে অতিক্রম করে অনন্তকাল পর্যন্ত সত্য এই জগতে বিরাজ করবে। পৃথিবী ও স্বর্গ সব কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সত্যের কোনো ধ্বংস নেই। একটাও সত্য কথা মানুষের সমাজে কখনোই লোপ পাবে না।




সর্বশক্তিমান নিজেই নিজের মোহরাঙ্কিত করে যে-সত্যকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, অনন্তকাল পর্যন্ত সে-সত্য মানুষের সমাজে প্রচলিত থাকবে। পৃথিবীর সমস্ত বীরপুরুষ একত্রিত হয়েও গণিতের একটাও সত্যকে বদলে ফেলতে পারে না। দুইয়ের সাথে দুই যোগ করলে চারই হবে; পাঁচ, তিন কিংবা অন্য কোনো সংখ্যা হবে না। গণিতের সত্যকে যেমন বদলে ফেলা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি ধর্ম বা রাজনীতি বা পরমাত্মাতত্ত্বের একটাও সত্যকে পরিবর্তিত বা বিচলিত করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। অসত্য প্রীতিকর হলেও সবসময়ই অসত্য, সত্য অপ্রীতিকর হলেও সবসময়ই সত্য।