ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১২)

জ্ঞান পার্থিব জগতে ব্যবহারের উপযোগী অনেক কিছুই তাৎক্ষণিক উৎপন্ন করতে পারে বিধায় জ্ঞানের আদরযত্ন সবার কাছেই অনেক বেশি। একটা কাজের যন্ত্রের মতো আমরা সুবিধা অনুযায়ী জ্ঞানের আলোচনা ও ব্যবহার করি যখন-তখন। জ্ঞানকে আমরা ভৃত্যের মতন আমাদের সেবাতে নিযুক্ত করি, প্রিয় বন্ধু ভেবে আলিঙ্গন করে বুকে টেনে নিই না। দুইটি কারণে বর্তমান সভ্য জগতে জ্ঞানের মহিমা ম্লান হয়ে গেছে। দুইটি কারণে মানুষ সম্পূর্ণরূপে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি বিশ্বাসই ঠিক থাকতে পারছে না। একটি কারণ এই যে, মানুষ এখনও আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপানে নিম্নস্তরে অবস্থান করছে এবং মানুষের বিকাশবিধানে জড়বস্তু সবসময় আত্মার আগে, বাহ্যিক বৃত্তিসমূহ সবসময় অভ্যন্তরীণ বৃত্তির আগে বিকশিত হয়ে আসছে।




জড় হতে অজড়ে, ইন্দ্রিয় হতে অতীন্দ্রিয়ে, স্থূল হতে সূক্ষ্মে, দেহ হতে আত্মাতে, এরকমই মানুষের মূল প্রকৃতির স্বাভাবিক গতি, অথচ যার উলটোটা ঘটতেই বেশি দেখা যায়। অন্য কারণটি এই, এখনো মানুষ এত দরিদ্র আছে যে, এখনো তার পার্থিব অভাব এত অপূর্ণ রয়েছে যে, বুদ্ধির নির্মল আনন্দ ভোগ করার শক্তি বা অবসর কিছুই তার নেই। যতদিন পর্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুন্দর অনুভূতি এবং মৌলিক চাহিদাসমূহ মানুষের আয়ত্তে আসবে না, ততদিন পর্যন্ত মানুষ আত্মিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ভাবনা ও সময় খরচ করতে চাইবে না।




বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো মানুষ অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সমাজে এখনো অনেক মানুষ জ্ঞানের পার্থিব সুফল ভোগ করতে পারছে না। এমন অস্থির জনসাধারণকে জ্ঞানের পরমাত্মিক সৌন্দর্যে আনন্দিত হবার জন্য নিষ্কামভাবে জ্ঞানসাধনা করার পরামর্শ দিলেও তারা তা শুনবে কেন? আমরা যত যা-ই কিছু বলি না কেন, মানুষের সাধারণ চাহিদাগুলি না মেটা পর্যন্ত মানুষ কিছুতেই অসাধারণ চাহিদাগুলো নিয়ে ভাববে না।




পার্থিব ভোগলালসাই যে কেবল জ্ঞানের পথে বাধার সৃষ্টি করে, তা নয়; এই পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মতত্ত্বগুলিও সাধারণ মানুষের চোখে জ্ঞানচর্চাকে নিকৃষ্ট করে রেখেছে। প্রচলিত ধর্মের প্রচারকগণ পাণ্ডিত্যকে মূর্খতা ও নাস্তিকতা, বুদ্ধিকে কামপ্রবৃত্তি বলে ভিন্নরূপে প্রচার করেন এবং বিজ্ঞানের নাম শুনলেও ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। এঁদের মনে বড়ো ভয়, ঈশ্বরের বিষয়ে, ঈশ্বরের সৃষ্টির বিষয়ে বা ঈশ্বরের প্রবর্তিত নিয়মাবলির বিষয়ে জ্ঞানলাভের সাহায্যে তাঁর পূজার বিষম ব্যাঘাত যদি ঘটে যায়, তখন? এ পৃথিবীতে পুরোহিতের ধর্মাভিমান পণ্ডিতের জ্ঞানাভিমানের নিন্দা করে। জ্ঞানের গর্ব পরিহার করতে আমাদের বলা হয়, কিন্তু যারা এই উপদেশ দিয়ে থাকে, তারা নিজেদের অজ্ঞানতাকে ঢাকার জন্যই মূলত এমন কথাবার্তা বলে। তারা মনে করে, যদি অন্যদের জ্ঞানের প্রকাশ সামনে চলে আসে, তবে তাদের অজ্ঞানতার যে পালাবারও কোনো রাস্তা থাকবে না! জ্ঞানের প্রকাশকে যারা ভয় পায়, তারাই জ্ঞানের গর্বকে দূরে রাখতে বলে। তবে আরেক শ্রেণীর মানুষও এখানে আছে, যারা জ্ঞানের চর্চায় এত বেশি নিমগ্ন থাকে যে, তা নিয়ে গর্ব করার সময়ই পায় না।




প্রাচীনকালের ধর্ম-উপদেষ্টাগণ প্রায়ই অহেতুকভাবে জ্ঞানগৌরবের নিন্দা করে গেছেন। বর্তমানেও মানুষ অনেকসময় চাইলেও জ্ঞানের উচ্চস্তরসমূহের চর্চা করতে পারে না, তাই কেবলই নিম্নস্তরের বুদ্ধিচর্চাই করে থাকে; এ কারণে প্রকৃত জ্ঞান ও সত্য লাভ সবার ভাগ্যে জোটে না। বুদ্ধিমান অনেক মানুষই জ্ঞানী ধার্মিকের সরল বিশ্বাস ও আচরণকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে ছাড়েন না। এমন বিভিন্ন কারণে ধর্মের সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধির একটা বৈরীভাব জন্মে গেছে। অতএব এ আশ্চর্যের কিছুই নয় যে, এমন অবস্থায় অনেক উদারমনা ধার্মিক ব্যক্তিও বিভিন্ন সময়ে জ্ঞানের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করে গেছেন। আমাদের মধ্যে এখনো ধার্মিক মানুষের প্রাণে বুদ্ধি ও বিচারশক্তির নামে বরং আতঙ্ক এসে উপস্থিত হয়। এই কারণেই মানুষকে ধার্মিকেরা স্বাধীনচিন্তা হতে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।




এর অর্থ আর কিছুই নয়, কেবল তারা নিজেরা যেভাবে যে-বিষয়ের চিন্তা ও আলোচনা করেন, ঠিক সেভাবেই তার চিন্তা ও আলোচনা না করলে লোকে অবিশ্বাসী ও নাস্তিক হয়ে যায় বলে এঁদের ধারণা। মানুষের সহজ বুদ্ধিকেও এরা ভয় করেন। এজন্য কোনো চিন্তাশীল ও প্রতিভাশালী ব্যক্তি ধর্ম-উপদেষ্টার পদে অধিষ্ঠিত হলে অন্যান্য ধর্মগুরু প্রচণ্ড ভয়ে অস্থির হয়ে পড়েন এবং সেই নতুন অভিষিক্ত ধর্ম-উপদেষ্টার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। দেখা যায়, ধর্মযাজকগণ প্রতিভা দেখলে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁদের ধারণা, ধর্মে কেবলই বিশ্বাসের স্থান, প্রতিভার কোনো স্থান নেই। এ ধরনের ভয় সত্যিই অমূলক। বুদ্ধি আমাদের আত্মাকে আবৃত করে রাখবে এবং ভগবান সম্পর্কিত জ্ঞানের দ্বারা তাঁর প্রতি অন্তরের প্রেমভাব নষ্ট হয়ে যাবে, এরকম ধারণার সত্যিই কোনো ভিত্তি নেই। অনেক সরল বিশ্বাসী ব্যক্তিও সবসময়ই এই ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকেন।




ধারণা, কল্পনা ও বিচারশক্তির বিকাশ না ঘটলে মানুষের মনের উৎকর্ষ কখনোই ঘটবে না। অতি প্রতিভাবান মানুষ মানসিক উন্নতির অতি উচ্চ অবস্থা লাভ করার পর বেশিরভাগ সময়ে ধর্মের পথ পরিত্যাগ করেন। এঁদের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, ধর্মের নামে যে-সকল মতামত প্রচার করা হয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, কিন্তু এ ধরনের লোকের সংখ্যা সব জায়গাতেই খুব অল্প। তাঁরা কি সত্যি সত্যিই ধর্ম সম্পর্কিত সকল সত্যের বিরোধী? কোনোভাবেই না। অধিকাংশ স্থলে, ধর্ম-উপদেষ্টাগণ সত্যের নামে যে-অসত্য শিক্ষা দিয়ে থাকেন, এ সকল পণ্ডিত ব্যক্তি কেবল ওইটুকুরই প্রতিবাদ করেন।




ধার্মিক ব্যক্তিগণের সংকীর্ণতাতে পৃথিবীতে ধর্মের নামে লোকে পরস্পরের উপরে যে অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছে যুগে যুগে, এক ধর্মের অনুসারীগণ অপর ধর্মের অনুসারীগণের সাথে যে ঘোরতর শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করেছে, এ সব কিছু মিলে ধর্মকে সভ্য মানুষের চোখে যতটা হেয় এবং ঘৃণ্য করে তুলেছে, তার সামান্যটুকুও চার্বাক হতে আরম্ভ করে বর্তমান সময়ের জড়বাদী দার্শনিকগণ, নিরীশ্বরবাদী পণ্ডিতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ধর্মের বিষয়ে অশ্রদ্ধাশীল কথাবার্তা প্রচার করেও, করতে পারেননি।‌ ধর্মের নামে যে-সকল মতামত প্রচার করা হয় এবং ধার্মিকতার ছদ্মবেশে যে অমানুষেরা ধর্মের বাণী প্রচার করে, এসব দেখলে ধর্মের প্রতি অনুরাগ তো দূরে থাক, বিরক্তিই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। এঁরা ঈশ্বরকে যে-আকারে মানুষের সামনে তুলে ধরেন, ইহজীবনে ও পরলোকে মানবতার সাথে পরমাত্মার যেমন সম্পর্ক প্রচার করেন, যে-সকল কুসংস্কার ও নাবালকত্বকে মানুষের সাথে ঈশ্বরের লীলা বলে নির্দেশ করেন, আর যেভাবে ধর্মীয় আচারের নামে পাপাচার ছড়িয়ে দেন, এসব দেখে যে-কোনো সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ধর্মের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।




যে প্রকৃত সত্য, প্রকৃত সাধুতা ও প্রকৃত ভক্তি ধর্ম হিসেবে সমাদৃত ও স্বীকৃত, পণ্ডিতগণ কখনোই তার বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করেন না। তাই ধর্মের নামে যে ভ্রান্তি, অসাধুতা ও অভক্তি প্রচার করা হয়, সেগুলির উচ্ছেদে বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রত্যেকটি বিবেকসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য।




বিজ্ঞান ও ধর্ম পরস্পরের বন্ধু ও প্রকৃত সহায়। ঈশ্বর পরস্পরকে সাহায্য করার জন্যই এদেরকে সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর যে দুইয়ের মধ্যে মিল স্থাপন করেছেন, মানুষ কী করে তাদের মধ্যে ভেদাভেদ নিয়ে আসবে? বিজ্ঞান হতে ধর্মকে বা ধর্ম হতে বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলে উভয়েরই চরম অকল্যাণ হবে। বর্তমান সময়ের পণ্ডিতগণের প্রাণে সত্যের প্রতি অসীম প্রেম আছে। সত্যের অন্বেষণে এঁরা অবিশ্বাস্য রকমের পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সৎসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। সত্যের স্বার্থে এঁরা সনাতন ও সম্মানিত সকল ভুলকে ক্রমেই ধুলিসাৎ করে ফেলছেন এবং এজন্য ধর্মব্যবসায়ীরা ও ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা এঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মনের খুশিমতো নিন্দা করে চলেছেন। সংস্কারবাদী পণ্ডিতেরা, ধর্মের নামে অহেতুক যে-সকল প্রথা ও অপ্রয়োজনীয় নিয়মনীতি মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেগুলিকে সমূলে উৎপাটন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এসব দেখে মূর্খ ও স্বার্থান্বেষী ধর্মগুরুগণ সাধারণ মানুষের মনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অহেতুক ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।




আধুনিক সময়ে, বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও ভাবের ভক্তিহীনতার বিষয়ে প্রতিবাদ ও নিন্দা ছড়ানোর আগে, ধর্মকে যাঁরা প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসেন, তাঁদের একবার এই বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও ভাবের সম্পর্কে প্রকৃত তথ্যাদি ভালোভাবে জানার চেষ্টা করা পবিত্র দায়িত্ব। বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে প্রাকৃতিক জগত, মানুষের ইতিহাস এবং প্রকৃতি নিয়ে ধীরেসুস্থে আলোচনা করলে বরং ধার্মিকদের‌ই সবচাইতে বেশি মঙ্গল হবে। প্রকৃত ও সত্যদর্শনমূলক বিজ্ঞানের সাহায্যেই কেবল কাল্পনিক ও ভ্রান্তদর্শনমূলক বিজ্ঞানের ভ্রান্তি ও অমঙ্গলদায়ী শক্তিকে দূর করা যায়। গ্রিক দার্শনিক ইপিকিউরাস থেকে শুরু করে ফরাসি পণ্ডিত ক্যোঁৎ পর্যন্ত জড়বাদী দার্শনিকগণ মানুষের সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করেছেন, এবং এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ধর্মীয় অজ্ঞানতার দ্বারা, পরিমাণে এর চাইতে অনেক বেশি অকল্যাণ ঘটত।




মানুষের বুদ্ধিকে পরিহার করলে তার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরকেও পরিহার করতে হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পুরোহিতগণ মানুষের বুদ্ধিকে অবিশ্বাস করে যে-ধর্মপ্রচার করছেন, অবিশ্বাসী বিজ্ঞানী ও নাস্তিকের দর্শনের চাইতেও তা দিয়ে মানবসমাজের অনেক বেশি অনিষ্টসাধন হচ্ছে। ধর্মের নামে প্রতিষ্ঠিত এ সকল অধর্মের মন্দিরকে ভেঙে দিয়ে মানুষের আত্মাকে মুক্তি দেবার জন্য পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক পণ্ডিত ও মহৎ ব্যক্তি চেষ্টা করে গেছেন। ধর্মের এই বিকৃতি না হলে, অধর্মের বীজ ও বৃক্ষ ধ্বংস করার পেছনে ওই সকল প্রতিভাবান মানুষের শক্তি খরচ না হলে, সেই শক্তি জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আরও অনেক বেশি উন্নতিসাধন করতে পারত।