ঈশ্বরসুধা (ভাগ: ১১)

মানুষ সূক্ষ্মভাবে তার নিজের ইতিহাসের সত্য অন্বেষণ করে। বড়ো নিবিষ্ট চিত্তে লোকে অতীতের বিষাদময় কাহিনি অধ্যয়ন করে। যে-সকল জাতি বহু শতাব্দী আগেই পৃথিবী থেকে লোপ পেয়েছে, বর্তমানের মানুষ বহু ধৈর্য ও পরিশ্রম সহকারে তাদের বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করে, অথচ এসব করে গবেষকদের শারীরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিংবা ধনসম্পত্তি বাড়ে কি? সেই কবে হাজার বছর আগে রচিত 'ইলিয়াড' মহাকাব্যের কবি কে ছিলেন কিংবা সেই কবি কীভাবে এই মহাকাব্য লিখেছিলেন, এইসব সত্য জেনে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক কী লাভ হয়? অথচ আমরা দেখেছি, মানুষ বহুদিন ধরে এইসব আপাতনিরর্থক বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে চলেছে। জগতের সুবিখ্যাত পণ্ডিতগণ এমন সাহিত্যের আলোচনায় মন ও চোখের উপর দিনের পর দিন কী পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করেছেন, কত কষ্ট করে মেধা খরচ করেছেন এবং ওদিকে আবার সাধারণ মানুষ বড়ো আগ্রহভরে মূল্যবান সময় খরচ করে তাঁদের লেখা সেইসব সাহিত্য পাঠ করে আনন্দ লাভ করছে। অথচ এসবের সাহায্যে কারও ঘরে খাবার আসে না, পোশাক আসে না, ফসলের উৎপাদন বাড়ে না, রেললাইন-সেতু-রাস্তাঘাট নির্মিত হয় না, অর্থের সমাগম হয় না, পার্থিব তেমন কোনো লাভই হয় না এসব থেকে। এতে প্রমাণিত হয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হচ্ছে সত্যকে খুঁজে বের করার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করা।




রাজা যখন ছদ্মবেশেও হেঁটে যান, তখনও দেখলে বোঝা যায়, এমন কেউ হেঁটে যাচ্ছেন, যাঁর হাঁটার ধরনটা রাজার মতন। ঠিক একইভাবে, সত্য যতই চাপা থাকুক, যতই ক্ষুদ্র হোক, যতই দৃষ্টির অগোচরে থাক, পৃথিবীর সব জায়গাতেই সেই সত্যের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি আকৃষ্ট হবেই হবে।




ভৌতবিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারে বা মানুষের ইতিহাসে যে-সত্য বিধৃত রয়েছে, মানুষ তার চাইতে বেশি আকৃষ্ট হয় আত্মজ্ঞানের উচ্চতর সত্যসমূহের অনুসন্ধানের প্রতি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মনীষীগণ‌ই কেবল কঠোর মানসিক পরিশ্রম করে এ ধরনের সত্য খুঁজে পেতে সক্ষম হন, অথচ এ সকল সত্য হতে স্বর্গীয় সুখ এবং গৌরব ছাড়া আর কোনো ব্যক্তিগত বা পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধ হয় না। এতে অবশ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সামান্য বৃদ্ধি পায়, কেননা মনের সঙ্গে শরীরের যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, তা আধ্যাত্মিক জ্ঞানলাভের মাধ্যমে আরও নিবিড় হয়ে ওঠে। তবে পণ্ডিতেরা এ ধরনের আত্মজ্ঞানের সত্যকে পার্থিব কাজে ব্যবহার সাধারণত করেন না, কেননা এমন সত্যের প্রাপ্তিতে তাঁদের পরমার্থিক যে সুখ লাভ হয়, তার কাছে পার্থিব সকল সুখ অতি তুচ্ছ। নিজের আত্মাকে তন্ন তন্ন করে বিশ্লেষণ করার সময় আত্মজ্ঞান লাভে উৎসাহী ব্যক্তি নিশ্চয়ই গাড়ি-বাড়ি কেনার কথা ভাবেন না, তাই না?




মানুষ দুই ধরনের সত্যকে ভীষণ ভালোবাসে: সহজ এবং বিচারলব্ধ। বাইরের ও ভেতরের জগতের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য মানুষ সবসময়ই চেষ্টা করতে থাকে এবং এই ব্যাপারটাতে মানুষ এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়ে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই পৃথিবীর সমস্ত কিছুকে তার নিজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় সে নিয়ে আসতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার এই আত্মিক অনুসন্ধান চলতেই থাকে। কেবল বিশেষ বিশেষ সত্যের প্রতি নয়, বরং সামগ্রিক সত্যের প্রতি আমাদের অন্তরে খুব সহজেই এমন শক্তিশালী একধরনের প্রেম সঞ্চারিত হয়ে যায়। যতদিন আমরা নিজের অন্তর্স্থিত প্রবৃত্তির দ্বারা এই বাহ্যিক জড়জগতের সব বিষয় সম্যকভাবে আয়ত্ত করতে না পারি, ততদিন পর্যন্ত মনন, বিয়োজন এবং সংযোজন, এই তিন ধরনের দার্শনিক প্রক্রিয়ার কোনো বিশ্রাম নেই।




আত্মতত্ত্ব এবং জগৎতত্ত্ব, এই দুই ধরনের তত্ত্ব আলোচনার তিনটি প্রক্রিয়া আছে: প্রথমটি মনন, অর্থাৎ কোনো বস্তু বা ঘটনাকে বিশেষভাবে লক্ষ করা। দ্বিতীয়টি বিয়োজন, অর্থাৎ সে বস্তু বা ঘটনার বিভিন্ন অংশকে পৃথক করে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক অংশের গুণাগুণ বিচার করা। তৃতীয়টি সংযোজন, অর্থাৎ এই সকল পৃথক্‌কৃত অংশকে আবার একত্রিত করলে আগের সেই মূলবস্তু বা ঘটনা ফিরে পাওয়া যায় কি না, তা পরীক্ষা করা। এই প্রক্রিয়াটি খুবই মজার; যে-কোনো বিষয় বা ধারণা নিয়ে এই পরীক্ষাটি করে দেখলে বিস্মিত হতে হয়। প্রায়ই দেখা যায়, প্রথমে যা নিয়ে আমরা শুরু করি, শেষে এসে তা বদলে যায়।




সত্যকে খুঁজে বের করতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের উপায় বের করেছে। ছোটোকে বড়ো করে দেখানোর জন্য এবং দূরের জিনিসকে চোখের কাছে আনার জন্য মানুষ যে কেবল বিভিন্ন উপায় এবং যন্ত্রের আবিষ্কার করেছে, তা-ই নয়; একইসাথে, সত্যের অন্বেষণ করার জন্য মানুষ অসংখ্য অদৃশ্য ও অতীন্দ্রিয় উপায়ও বের করে ফেলেছে। গণিতবিদ্যা এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক বিষয় আবিষ্কার করে এদের সাহায্যে আমরা সত্যের খনন করে চলেছি। ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে সত্যের গুণাগুণ পরীক্ষা করছি। অলংকারশাস্ত্রের সাহায্যে এই সকল সত্যকে সুন্দর রূপ প্রদান করছি। গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন, অলংকার এবং সর্বোপরি, ভাষা—অতি অদ্ভুত বাক্‌শক্তি এবং তা প্রকাশ করার ক্ষমতা, যার কিছুটা আমাদের আয়ত্তাধীন এবং বাকিটা ঈশ্বরের ঐশীক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত—এই সামগ্রিকতা থেকেও তেজ এসে আমাদেরকে অসীম মহিমার দিকে নিয়ে চলেছে। এই সব ধরনের আয়োজন মিলে সত্যের আহরণ, সত্যের সঞ্চয় এবং সত্যের প্রয়োগ করার জন্য আমাদেরকে প্রতিনিয়তই অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে।




সত্যের প্রতি এই প্রীতিই সহজ ও স্বাভাবিক মানসিক ভক্তি নামে পরিচিত। জড়পদার্থের কিংবা মানবসমাজের সব ধরনের প্রাকৃতিক সত্য অধ্যয়নে মূলত আমরা গভীরভাবে ঈশ্বরের চিন্তাই করে থাকি। এর কারণ, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সত্য মাত্রেই ঈশ্বরের বাণীরূপে আমাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। বাক্যই মানুষের ভাষার উপকরণ এবং বাহ্যিক সত্য ও আধ্যাত্মিক ভাবের ধারক ও বাহক। এইসবই ঈশ্বরের বাক্য, তাঁর সার্বভৌমিক ভাষার উপকরণ। এই ভাষায় এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে ঈশ্বর অনাদিকাল হতে অনন্তকাল পর্যন্ত জগতের সমস্ত মানুষের কাছে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। মানুষ ঈশ্বরের পুত্র, তাঁর আদর্শে সৃষ্ট হয়েছে, এবং একই আদর্শে সৃষ্টিতে মেতে ওঠে। সে নিজের পিতার ভাষাকে ভালোবাসে এবং পিতার সত্যবাণী না শোনা পর্যন্ত কিছুতেই তার প্রাণে পরিতৃপ্তি আসে না—সেই বাণী শুনলেই কেবল তার তৃপ্তি সাধিত হয়, এ কারণে বাণী বা বাক্য অর্থাৎ শব্দ বা অক্ষরকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। ব্রহ্ম বলেই শব্দ সৃষ্টি করার ক্ষমতা ধারণ করে।




বুদ্ধিগত সব ধরনের ভুলভ্রান্তি শিশুমনের অস্ফুট বাক্য মাত্র। আমরা যে-সকল সত্য লাভ করি, তার প্রত্যেকটি আমাদের ও ঈশ্বরের জ্ঞানের সাধারণ ভিত্তিরূপে আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেই সত্যতেই আমাদের মধ্যে উভয় ধরনের জ্ঞানের মিলন ঘটে। যে-পরিমাণে এই মিলন ঘটে, সেই পরিমাণে ঈশ্বরের জ্ঞান আমাদের জ্ঞানের অঙ্গীভূত হয়, সেই পরিমাণেই তাঁর সাথে আমাদের আত্মার মিলন হয়। আত্মার এমন মিলন‌ই সবচাইতে জরুরি বিষয়।




চিন্ময় পুরুষের অনন্ত জ্ঞানের মধ্যে এই বিচিত্র পৃথিবী যেভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে ও উপলব্ধ হয়েছে, যতদিন না এই জগতে লিপিবদ্ধ ঈশ্বরের বাণী মানুষ সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করে তাকে নিজের দৈনন্দিন জীবনে অধ্যয়ন ও ভাবনার বিষয় করতে পারছে, ততদিন পর্যন্ত সে কিছুতেই জীবনে সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে না।




জ্ঞান আমাদের কাছে যতটা কদর পায়, তার চাইতে অনেক বেশি কদর পায় সেইসব নিকৃষ্ট জিনিস, যা আমাদের ইন্দ্রিয়সুখ কিংবা পার্থিব উদ্দেশ্যসাধনে আমরা ব্যবহার করি। জ্ঞানের মূল উৎসের চাইতে জ্ঞানের নগদ ফলাফলকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। জ্ঞানের পার্থিব ব্যবহার যে তুচ্ছ বা মূল্যহীন, তা কিন্তু নয়। উন্নত জাতিগুলির দিকে তাকানো যাক। ইউরোপ বা আমেরিকার এই যে এত এত পার্থিব সুখ ও সম্পদ, এত চমৎকার তাদের ঘরবাড়ি, এত উন্নত তাদের কলকারখানা; জাহাজ, বন্দর, দোকানপাট, রেলপথ, রাস্তাঘাট—কী নেই তাদের? কিন্তু এত কিছু কোথা থেকে এসেছে? এসবের পুরোটাই কি তাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে তারা আহরণ করেছে? না, কোনোভাবেই তা নয়। ইংরেজের মার্জিত বুদ্ধি এবং ব্যাবহারিক জ্ঞান থেকেই এত এত সুখ ও সৌভাগ্যের উৎপন্ন হয়েছে।




পৃথিবীর অন্যান্য অনেক জায়গায় যা প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য রয়েছে, তার কিছুই ইউরোপ-আমেরিকায় নেই। আমেরিকার কী ছিল একদিন? আমেরিকার আবিষ্কারের পরে আমেরিকায় ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপন করার সময়ে আমেরিকায় কোনো ঐশ্বর্য কি ছিল? কেবল নিজের বুদ্ধিকে সম্বল করে সেই প্রাচীন ও ঔপনিবেশিকগণ আমেরিকার গভীর ও দুর্গম অরণ্যভূমিতে প্রবেশ করেছিলেন। ঈশ্বর তাঁদেরকে কেবল মস্তিষ্কের শক্তি এবং অরণ্যের ভূমি দিয়ে যেন এই আদেশ করেছিলেন: এই পৃথিবীকে তোমরা তোমাদের করায়ত্ত কর! এবং সেই নব্য আমেরিকার অধিবাসীগণ সেই অনুযায়ী কাজে নিযুক্ত হয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজের বুদ্ধি ও মেধার গুণে আমেরিকাকে আজকের অবস্থানে ধীরে ধীরে নিয়ে এসেছেন।




মানুষের বুদ্ধি একটা সার্বভৌমিক যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রের সার বা জ্ঞান মানুষের বুদ্ধিতে সঞ্চিত রয়েছে এবং সেই বুদ্ধি যখন যেমন প্রয়োজন, তেমন উপায়ে মানুষের ভূতভবিষ্যৎ এবং বর্তমানের উপযোগী বিভিন্ন উপায় তৈরি করে দেয়।