আশীর্বাদই কাম্য!


  
 আমরা যাদের চিনি, তাদের মধ্যে কাছের ভাবি যাদের, তাদের আমরা নিজের বিয়েতে, বউভাতে বা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে বা উপলক্ষ্যে নিমন্ত্রণ করি। আবার এইসব অনুষ্ঠানে এমন রবাহূত লোকজনও আসে, যাদের হয়তো আমরা চিনিই না, তবে আমাদের নিমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ হয়তো চেনে। মাথায় রাখতে হবে, ফ্রি’তে খাওয়ার ইচ্ছের নাম দারিদ্র্য নয়, এর নাম অভ্যাস।
  
 দুই-এক জন আমাদের মনের ভুলে বাদ পড়ে যায় আমাদের নিমন্ত্রিত অতিথিদের লিস্ট থেকে। তখন ওরা দুঃখ পান বা বিরক্ত হন। পরে আবার ওদের কাছে ক্ষমাও চাইতে হয়! স্বাভাবিক! আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব যে!
  
 আচ্ছা, আপনার নিজেকে দিয়েই ভাবুন! ভুলে নিমন্ত্রণ করেনি বলে যাদের উপর আপনি বিরক্ত হয়েছেন, কখনও কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, ওরা কেমন আছে? কখনও ওদের বিপদেআপদে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন? প্রার্থনা করার কথা বলছি না কিন্তু, একেবারে সরাসরি পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করার বা মানসিক সমর্থন দেওয়ার কথা বলছি। বলে বসবেন না যেন, পাশে দাঁড়ানোর সময় বা ক্ষমতা তো আর সবার থাকে না, তাই আমি প্রার্থনাই করেছি! ওরকম দাবি সবাই করতে পারে, এবং করেও! তার সত্যতা বা ফলপ্রসূতা নিয়ে কেউ কি আদৌ জানতে পারে কখনও? প্রার্থনার অশ্রুর চাইতে সাহায্যের হাত যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়কে অধিক সিক্ত করতে পারে।
  
 এসবের কিছুই আপনি করেননি তো? এইটুকু দায়িত্বও যার প্রতি আপনার নেই, তার উপর আপনার ওরকম ‘অধিকার’ বা প্রত্যাশা তৈরি হয় কোন যুক্তিতে? যখনই আপনার মাথায় আসবে, ‘অমুকের বিয়েতে আমাকে নিমন্ত্রণ করল না!’, তখনই এ-ও যেন মাথায় আসে, ‘অমুকের জীবনে আপনার এমন কী অবদান যে আপনাকে নিমন্ত্রণ করতেই হবে?’ বুড়োই হবেন না শুধুই, সাথে বড়োও হোন।
  
 এখন আসি যাদের আমরা আমাদের নানান অনুষ্ঠানে আসতে নিমন্ত্রণ করি, তাদের ব্যাপারে। ওরা তো আপনার জীবনে একটু হলেও বাকিদের চাইতে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত, তাই না? তো আপনার প্রয়োজনে, আপনার বিপদে বা বিষাদে ওদের মধ্যে ক-জনকে পাশে পেয়েছেন? মিলিয়ে দেখুন তো! যাকে বিপদেই পাশে পান না, সে আপনার জীবনে প্রয়োজনীয় মানুষ হয় কী করে? আমাদের অতিথিদের তালিকার শতকরা ৯৮ ভাগই আমাদের জীবনে অপ্রয়োজনীয় লোকজন।
  
 খুব দুঃখ পাবেন, যখন দেখবেন, ওই নিমন্ত্রিতদের বা রবাহূতদের কেউ কেউ আপনার বিপদের দিনে আপনাকে আরও বিপদে ফেলে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে কিংবা যাকে বা যাদের একটু বলে দিলেই আপনার বিপদটা একটু হলেও কমে, তাদের বলে দেওয়ার সময়, ইচ্ছে বা মানসিকতা ওদের নেই। যে আপনার বিপদের সময় চুপ থাকে বা মজা নেয়, সে আর যা-ই হোক, বন্ধু বা হিতাকাঙ্ক্ষী কিছুতেই নয়। হায়, আমরা এমন লোকজনকে কাছের মানুষ ভাবি, যারা আমাদের বিপদে ডুবতে দেখলে নীরব থাকে বা মজা পায়!
  
 হ্যাঁ, আমরা ওদেরও নিমন্ত্রণ করি! নিজের জীবনে অগ্রাধিকার দিই। আমাকে নিয়ে ভাববার সময়ই যার নেই, তার বেলাতেও, 'নিমন্ত্রণ না করলে কী ভাববে!', এটা নিয়ে ভাবি! কখনওবা, 'আমি কতটা খরচ করে বিয়েটা করছি এসে দেখে যাও!'...এটা দেখানোর জন্য নিমন্ত্রণ করি। আমার দেখা সবচাইতে জাঁকজমকপূর্ণ ৫টি বিয়ের ৩টিতেই ডিভোর্স হয়ে গেছে। চৌধুরি সাহেব, ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে, পয়সা ঢেলে কাচ্চি হয়তো পাবেন, কিন্তু হৃদয় পাবেন না! আবার গিফটের আশায় লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে, এমন মানুষও আমি দেখেছি! নিজের পয়সায় ঘর সাজানোর ক্ষমতা নেই যার, সে বিয়ে কেন করে আমার মাথায় আসে না। অ্যাবসার্ড অ্যান্ড মিনিংলেস! ও আচ্ছা, অনেককে নিমন্ত্রণ করতে হয় এ কারণে যে, সে-ও যে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল! খেলে যে খাওয়াতে হয়! এ এক অচ্ছেদ্য চক্র! যাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছি খাচ্ছি, নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তাদের নেমন্তন্ন না করলে চলে?
  
 ওরা আপনার বিয়েতে কেন আসে? আশীর্বাদ কিংবা দোয়া করতে? এটা মনে হয় আপনার? হাউ কিউট! হা হা হা! ওরা আপনার বিয়েতে খেতে আসে, কত পয়সা খরচ করে বিয়ে করছেন দেখতে আসে, দামি উপহার দিয়ে নিজের বিত্ত জাহির করতে আসে। ওরা বিয়েতে এসে রান্না কেমন হলো, ডেকোরেশন কেমন হলো, বর-কনে’র সাজ-পোশাকটা কেমন হলো, আপ্যায়ন ঠিক আছে কি না, এসব নিয়েই ভাবে ও কথা বলে। ওরা আসে আপনার সাথে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে ফেইসবুকে শেয়ার করবার জন্য। আপনার মঙ্গলের চাইতে ওদের কাছে একটা লাইকের অনেক দাম বেশি। মানুষের দামের চাইতে লাইকের দাম বেড়ে গেছে তো সেই কবেই!
  
 আপনি নিজেও কি কারও বিয়ে খেয়ে আসবার পর আর কখনও তাকে নিয়ে ভেবেছেন তেমন একটা? তার বিপদআপদ নিয়ে আপনার কোনও মাথাব্যথা আছে সত্যিই? তার বিয়েতে কোন ড্রেসটা পরে গিয়েছিলেন, ফেইসবুক দেখে তা বলে দিতে পারেন, বিয়ে উপলক্ষ্যে পোশাকআশাক-কেনা নিয়ে আপনার যত আগ্রহ; অথচ তার পরিবারের খোঁজ কি কখনও নিয়েছেন এক বারও? মানুষ তাকেই মনে রাখে, যে তাকে নিয়মিতই ফেইসবুকে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার উপহার দেয়; যে তাকে ভালোবাসে, তাকে মনে মানুষ রাখে না। এমন একটা বিচিত্র প্রাণীর কাছ থেকেও আপনি বন্ধুত্ব আশা করেন কীভাবে?
  
 আপনি যেমন, আমিও তেমন, অন্যরাও তেমন। বিয়েতে স্রোতের মতো পয়সা না ঢেলে সে পয়সাটা জমিয়ে রাখলে আপনার নিজের বিপদের দিনে খরচ করতে পারবেন। আপনি কাদের দেখাচ্ছেন? যাদের আপনাকে নিয়ে ভাববার সময়ই নেই, তাদের? আপনি কাদের খাওয়াচ্ছেন? আপনি মরে গেলেও যাদের কিছুই এসে যায় না, তাদের? আপনি কাদের নিমন্ত্রণ করছেন? বিয়েতে এসে যারা টেবিলে খাসির বড়ো পিসের লেগ-রোস্টটার জন্য কাড়াকাড়ি করে, তাদের? ওদের কাছেও আপনি দাম্পত্যজীবনের জন্য প্রার্থনা প্রত্যাশা করেন?
  
 আমরা অনেকেই আবার জোর করে হলেও লোকজনকে ধরে বেঁধে নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসি! ফোনের পর ফোন করতেই থাকি যাতে সে সব কাজ ফেলে হলেও এসে হাজির হয়! টেকনাফে বিয়ে হচ্ছে, তেতুলিয়ার লোকটাকে পারলে কানে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসি আর কি! অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হলেও যেন বিয়েতে আসে! ভাই রে, যে আপনার ব্যাপারে আন্তরিক, সে, যদি খুব ঝামেলা না হয়, তবে সময় ম্যানেজ করে নিশ্চয়ই আপনার অনুষ্ঠানে আসবে। তাকে অত জোর করার কী আছে? জোর করে বিয়ে হয়তো করা যায়, কিন্তু বিয়েতে অতিথি আনা যায় না। যারা চেঁচায়, ‘ভালোবাসা দিবি কি না বল! আমার বিয়েতে আসবি কি না বল!’, ওদের আমার বলতে মন চায়, ‘দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই পাগলাগারদে চল রে চল!’
  
 সবচাইতে বড়ো কথা, বিয়ে আসা না আসা দিয়ে আন্তরিকতা বা বন্ধুত্ব নির্ধারিত কখনওই হয় না। নিজের পরিবারের বাইরে, আমার বিপদের সময় পাশে পেয়েছিলাম যাদের, তাদের মধ্যে মাত্র দুই জন আমার বিয়েতে এসেছিল। কারও বিয়েতে যেতে চাইলে সময়, ইচ্ছে ও গাড়িভাড়া হলেই তো চলে, সেখানে আন্তরিকতা থাকে কি সবসময়ই? যাকে নিজের বিয়েতে দেখলাম, তাকে যদি আমার প্রতি আন্তরিক হিসেবে ধরেই নিই, তবে আমার চাইতে বেকুব আর কে আছে! বিয়েতে যাওয়াটা একটা অভ্যাস, না যাওয়াটাও একটা অভ্যাস। হাজিরা দিয়ে ভালোবাসা বিচার করার চাইতে নির্বুদ্ধিতা আর নেই!
  
 বিপদের দিনে আমরা যাদের পাশে পাই, তারা প্রায়ই সময়ই, এমন কেউ, যাদের আমাদের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করার কথা মাথায়ই আসেনি, যাদের হয়তো আমরা বন্ধু, আত্মীয়, হিতাকাঙ্ক্ষী ভাবিইনি কখনও। আত্মীয় বা বন্ধু জিনিসটা রক্তের সম্পর্ক বা সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা দিয়ে হয় না। যে বিপদের দিনে পাশে থাকে, একমাত্র সে-ই আত্মার আত্মীয়, রক্তের বন্ধু। এর বাইরে যারা, ওরা সবাই-ই দুধের মাছি, বড়োজোর পরিচিত। দুম্‌ করে কাউকে বন্ধু বলে ফেলাটা আমাদের কুৎসিত ধরনের একটি বদভ্যাস!
  
 আপনার মৃত্যুর পর শবযাত্রায় যতটা মাথা আপনি দেখতে পারবেন না, আপনার মৃত্যুর আগে সংকটযাত্রায় তার দশ শতাংশেরও কম সংখ্যক মাথা আপনি দেখতে পাবেন। যে লোকটা আপনার পুত্র-কন্যা-স্বামী-স্ত্রী-ভাই-বোন-বাবা-মা কিংবা পরিবারের লোকজনকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত আপনার মৃত্যুর পর, অথচ আপনার জীবদ্দশায় আপনার খোঁজই রাখল না কখনও, সে লোক বড়োজোর ওদের জন্য জরুরি হতে পারে, কিন্তু আপনার জন্য কোনওভাবেই জরুরি নয়।
  
 লোকে বিয়ে উপলক্ষ্যে পয়সা ওড়ায়, না কি পয়সা ওড়ানো উপলক্ষ্যে বিয়ে করে, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।