আর্টের প্রাণ



যে-কোনও ধরনের আর্টের সৃষ্টির ব্যাপারটা পুরোপুরিই একাকী একটা যাত্রা। হ্যাঁ, আর্টিস্টের বন্ধুবান্ধব থাকে, কাছের লোকজন থাকে, যাদের কাছাকাছি থাকলে আর্টিস্টের কিছু সময় ভালো কাটে, মনের কিছু ক্ষত সেরে যায়। তবে সৃষ্টির সময়টাতে আর্টিস্টের প্রথম কাজই হচ্ছে, নিজেকে বাকি সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া। নিজের সাথে নিজে থাকতে না পারলে, দীর্ঘসময় ধরে নিজের মনের সাথে গল্প করার সুযোগ না পেলে আর্টের সৃষ্টি অনেকটাই অসম্ভব। আর্টিস্ট যখন সৃষ্টিতে ডুবে থাকেন, তখন তিনি এমন একটা দেশে চলে যান, যে দেশটা কেউ চেনে না, এমনকী আর্টিস্ট নিজেও চেনেন না। সে দেশের পথেঘাটে হাঁটার কোনও ম্যাপ নেই, কোনও শর্টকাট নেই। আর্টিস্টের রাস্তাটি ভয়ের, নিঃসঙ্গতার, শব্দহীনতার, যন্ত্রণার। সে রাস্তা নিয়ে বাকিদের কোনও ধারণা নেই। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া খুব কঠিন, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়ার ভয় পদে পদে, তবু কিছুতেই সে রাস্তা থেকে আর্টিস্ট নিজেকে সরিয়ে আনতে পারেন না।


আর্টিস্টের রাস্তা কখনও ফুরোয় না। রাস্তার এক বাঁকের শেষে পৌঁছামাত্রই অন্য বাঁকের শুরু হয়ে যায়। আর্টিস্ট থামতে পারেন না। আর্টের রাজ্যে থেমে যাওয়ার নামই মৃত্যু। বাকিরা যেখানে কিছুই দেখতে পায় না, আর্টিস্ট সেখানেই সৃষ্টির উপকরণ দেখতে পান। পুরনোকে আঁকড়ে ধরে তৃপ্ত হয়ে বসে থাকার নাম সাধারণত্ব। আর্টিস্টরা সাধারণ নন। নতুনের দিকে তাঁদের এ যাত্রা সবসময়ই চলতে থাকে। এক আর্টের সমাপ্তিতে আরেক আর্টের সূচনা হয়। শ্রেষ্ঠ আর্ট বলে কিছু নেই। আর্টিস্টের চোখে তাঁর প্রতিটি আর্টই স্বতন্ত্র গুরুত্ব বহন করে। ‘এ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর সৃষ্টিটি এই মুহূর্তে আমার হাতে!’ এমন অনুভূতিই আর্টিস্টকে সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। আর্টিস্টের চোখে চলমান আর্টের প্রতি মুগ্ধতা থাকে, আর্টিস্টের হৃদয়ে সমাপ্ত আর্টের ব্যাপারে অহংকার থাকে, আর্টিস্টের মনের পরবর্তী আর্টের জন্য ক্ষুধা থাকে।


যেখানে এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের চিন্তাভাবনা মেলে না, সেখানে একজন আর্টিস্টের সাথে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের দূরতম মিল খোঁজার চেষ্টা করাও মূর্খতা। একেক মানুষ একেক পথে বাঁচে। প্রতিটি বাঁচাই সঠিক বাঁচা। একটা জিনিস সব দৃষ্টিকোণ থেকে কখনওই গ্রহণযোগ্য হয় না। যে যে-পথে বাঁচে, যদি সে সে-পথে বাঁচতে গিয়ে কোনও অসুবিধের সম্মুখীন না হয় এবং সে-পথ অন্য কারও পথে কখনও বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, তবে সে-পথ নিশ্চয়ই অভ্রান্ত। তা নিয়ে কোনও রায় বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকারই কারও নেই। আর্টিস্ট অনেকের পথ নিজের মনের চোখ দিয়ে ধরে ফেলতে পারেন। তাই তাঁর ভাবার, বলার, চলার, করার, এককথায়, বাঁচার ধরন অন্য দশটা লোকের সাথে কিছুতেই মিলবে না। এটা সহজভাবে নিলে ভালো। এতে অনেক মানুষ উপকৃত হয়।


আর্টিস্টের জন্য একাকিত্ব পরম-আশীর্বাদের মতো। কোলাহলে মহৎ আর্টের সৃষ্টি তেমন হয় না। আর্ট জিনিসটাই খুব উঁচুদরের। সেই উচ্চতায় পৌঁছোতে চাইলে জনারণ্য থেকে সরে জনান্তিকে চলে যেতে হয়। আর্টের উচ্চতার পাশে মানুষের সাধারণত্ব ধূলি হিসেবে বিবেচনারও অযোগ্য। মানুষ যে অবস্থায় নিজের মনের সাথে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, সে অবস্থার নাম নির্জনতা। মানুষের মধ্যে এই নির্জনতার ব্যাপারটা একাকী থাকলেও আসতে পারে, কিংবা এমন কারও সংস্পর্শেও আসতে পারে, যে মানুষটা একেবারেই মনের মতো। অনেক ভাগ্যে এমন মানুষের দেখা মেলে, যে মানুষ হয়ে ওঠে নিজের মনের এক বিশ্বস্ত দর্পণ। সে মানুষের সাথে সমস্ত যোগাযোগই তখন হয়ে ওঠে নিজের মনের সাথেই যোগাযোগ।


মনের নৈঃশব্দ্য ও নৈঃসঙ্গ ছাড়া আর্টের একান্ত যাপন অসম্ভব! সৃষ্টি করতে চাইলে নিজের আত্মার সাথে নিরবচ্ছিন্ন আলাপচারিতায় সময় কাটাতে হয়, যা অহেতুক কোলাহলে কিছুতেই হয়ে ওঠে না। আর্টিস্ট হতে চাইলে নির্জনতাকে আলিঙ্গন করতে শিখতে হয়। নির্জনতার পর আসে নিঃসঙ্গতা, নিঃসঙ্গতার পর আসে নির্লিপ্ততা, নির্লিপ্ততার পর আসে বেদনা, বেদনার পরই আসে সৃষ্টি। তখন আর্টিস্টের মনে যে তৃপ্তিটা আসে, তা সকল যন্ত্রণা ও শ্রমকে ছাপিয়ে যায়। একটা সফল আর্টের সৃষ্টিতে যে চরমানন্দ হয়, তার সাথে তুলনা চলে একমাত্র বিশুদ্ধ রতিতৃপ্তির ইউফোরিয়ার। তবে এখানে মাথায় রাখতে হবে, ভালো আর্টের মায়ের নাম কষ্ট।


প্রতিভার সৃষ্টি হয় শ্রমে, ভাবনায়, চর্চায়, অভিজ্ঞতায়, বিশ্বাসে, আর কিছুটা দৈবপ্রেরণায়। একজন আর্টিস্ট যা সৃষ্টি করতে চান, তা ঠিক তার নিজের মনের মতো করে সৃষ্টি করতে পারার আগ পর্যন্ত তাঁকে পরিশ্রম করে যেতে হয়, আলস্যের সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে দিতে হয় দীর্ঘসময়, যা সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হয়। আর্টের বেলায়, সাধারণত একবারে কিছু হয় না, বার বার সৃষ্টি ও পুনর্সৃষ্টির মধ্য দিয়েই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছনো যায়। আর্টিস্ট যা আর্ট সৃষ্টি করেন, তা যদি আন্তরিকভাবে অনুভব করেন এবং সে অনুভূতির সাথে তাঁর নিজের জ্ঞান, বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার ফিউশনটা ঠিকভাবে ঘটে, তবেই সেই আর্ট মানুষের হৃদয়ে পৌঁছায়। তখন আর্টিস্টের অনুভূতি ও অন্যদের অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মানুষকে চিনতে হলে সেই মানুষ কোন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে এবং কোন পরিবেশে থেকে কোন ধরনের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা মনে-মস্তিষ্কে ধারণ করে সে বেঁচে আছে, তা আগে বুঝতে হবে। বোধের এই উন্মেষ ছাড়া মানুষ চেনা যায় না। আর্টিস্টরা এই কাজটা কোনও এক ঐশী ক্ষমতার বলে করে ফেলতে পারেন।


আর্টের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অতিভাবনায় ডুবে গেলে আর্টের সৃষ্টি হয় না। কোনও একটা বিষয়কে মাথায় রেখে সেটার আনুষঙ্গিক নানান কিছুকে আর্টের ভাষায় তুলে ধরে আর্টিস্ট এগোতে থাকেন। এই যেমন ধরুন, সমুদ্র, বাতাস, আলো, পাহাড়, আঁধার, এককথায়, প্রকৃতির নানান দিকগুলি একটা নির্দিষ্ট সময়ে যেমন আছে, তেমনই থাকে। সেখান থেকে সৌন্দর্য কিংবা কদর্যতা দুই-ই বের করে নিয়ে আসা যায়, আবার এসব নিয়ে নিঃস্পৃহও থাকা যায়। সাধারণের চোখ আর আর্টিস্টের চোখ এখানেই দু-রকমের দেখে। যা নিয়ে বাকিদের কিছুই বলার থাকে না, তা নিয়েও আর্টিস্টের অনেক কিছুই বলার থাকে। বাকিরা যা-কিছু নিজেদের চোখে দেখেই তৃপ্ত থাকে, তা-কিছুকে নিজের চোখে সৃষ্টি করে সেটা বাকিদের চোখে পৌঁছে দেওয়াই আর্টিস্টের ধর্ম। আর্টিস্টের সৃষ্টিই বাকিদের দৃষ্টি গঠন ও পুনর্গঠন করে। আর্টিস্ট যা দেখান, তা যারা আগে দেখেছে কিংবা আগে দেখেইনি, দুই দলই অনেকটা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট দৃষ্টিতে তা দেখতে পান। এই দেখা যদি আনন্দের কিংবা বিষাদের অনুরণন জাগায়, তবেই আর্টিস্ট সার্থক। আর্টের সাবজেক্ট সম্পর্কে নিরাসক্তি আর্টিস্টের সাময়িক ব্যর্থতা প্রকাশ করে। যদি এই নিরাসক্তি কালের পরিক্রমায় আর কখনওই আসক্তির জন্ম দিতে না পারে, তবে তখন আর্টের চিরস্থায়ী মৃত্যু ঘটে।


প্রকৃত আর্টিস্ট নিজের বিশ্বাসে আবদ্ধ না থেকে আর্টের যে সাবজেক্ট, সেটার সত্যে অচল থাকবেন। বাকিরা কী দেখতে চায়, শুনতে চায়, পড়তে চায়, অনুভব করতে চায়, সেসব নিয়ে উদ্‌বিগ্ন না হয়ে সত্যের সন্ধানে অবিচল থাকাই আর্টিস্টের মূল কাজ। নিজের বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতার প্রতি আর্টিস্টের গোঁয়ার্তুমি কিংবা অন্ধতা আর্টকেই লক্ষ্যচ্যুত করে দেয়। ভালো আর্টের সৃষ্টি তখনই হয়, যখন আর্টিস্ট তাঁর সৃষ্টির কথা মন দিয়ে শোনেন, যে পথে সৃষ্টি চলতে চায় সে পথেই চলেন, সৃষ্টির স্বাভাবিকতায় নিজের মতামত ও বিশ্বাসকে চাপিয়ে দেওয়ার লোভটা সামলাতে পারেন। আর্টের কনটেন্ট সম্পর্কে সচেতন না থাকলে আর্টিস্ট নিজের অজান্তেই ব্যক্তিগত জীবনদর্শন অযাচিতভাবে আর্টের পরতে পরতে মিশিয়ে ফেলেন। এভাবে সৃষ্টির নৈর্ব্যক্তিকতা হারিয়ে গেলে আর্টের আবেদনটাই হারিয়ে যায়।


কোনও কিছুর মূলে প্রবেশ করতে চাইলে সবার আগে নিজের সকল ইগোকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। আর্টিস্ট মাত্রই সবসময়ই মাথায় রাখেন, ‘আমি যা সৃষ্টি করছি, তার নিজস্ব একটা গতি আছে, যে গতি আমার মনের গতির অনুরূপ না-ও হতে পারে। দিনশেষে, আমি আমার আর্টের মতো না-ও হতে পারি, আমার আর্ট আমার মতো না-ও হয়ে উঠতে পারে।’ আর্টের নিজের একটা জীবন আছে, সে জীবনটা আর্টিস্টের জীবনের মতো প্রায়ই হয় না, হওয়ার কথাও নয়। আর্ট উপভোগ করে যারা, তারা প্রকৃতপক্ষে আর্টের ভাষায় আর্টকে অনুভব করতে চায়, আর্টিস্টের ব্যক্তিজীবন সে ভাষায় কিছুটা প্রভাব ফেলে বটে, তবে কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে না। আর্টের স্বচ্ছন্দ বিচরণে আর্টিস্টের হাত তেমন একটা নেই। তিনি কেবল সেই বিচরণ-পথটাই দেখান, সেই পথের স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ আর্টিস্টের কাজ নয়।


নিজের হৃদয় ও আত্মার সাথে কথোপকথন থেকে এই যে আর্টের সৃষ্টি, তার প্রক্রিয়ায় আর্টিস্ট নিজেকে বাহ্যিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, নিজের মধ্যে যে ঈশ্বর বাস করেন, তার সাথেই নির্জনে গল্প করতে থাকেন। সৃষ্টির এই দায় বড়ো পবিত্র, বড়ো সুন্দর, বড়ো স্বস্তিকর। ক্রোধ, ঈর্ষা, অহম্‌ ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে একপাশে সরিয়ে রেখে নিজের অভ্যন্তরীণ পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে আর্টিস্ট সুখ খুঁজে বেড়ান, স্বস্তি বিতরণ করে বেড়ান। হৃদয়ের এই নিবিড় পর্যটনই আর্টের প্রাণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আর্টিস্টকে আহত করা যায়, রক্তাক্ত করা যায়, খুনও করে ফেলা যায়, তবে কখনও ধ্বংস করা যায় না। মানুষের নির্বিচার হিংস্রতায় আর্টিস্টের যে কষ্টটা সহ্য করতে হয়, সে কষ্টই পরবর্তীতে আর্টের জন্ম দেয়। আর্টিস্ট যে সময়ে আইডিয়া ও আর্টের জন্ম দিয়ে চলেন, ঠিক একই সময়ে সৃষ্টি-নপুংসকের দল ঈর্ষা ও ক্রোধের জন্ম দিয়ে চলে। আর্টিস্টকে খুন করে আর্টিস্ট হওয়া যায় না, খুনি হওয়া যায়। যেত যদি, তবে আমরা পৃথিবীর বর্বর মানুষগুলিকেই আর্টিস্ট হিসেবে চিনতাম।