অসীমে মেশার ব্যাকুলতা

তোমার জন্যে ব্যস্ত হব বলেছিলাম, ব্যস্ত হলাম আর ক‌ই? ছোটো ছেলের মতো তোমার কাছে এক এক বার আসি, একটু দেখি, একটু প্রেম অনুভব করি, তারপর খেলা করতে ছুটে যাই। তোমার কাজটা যদি তোমার কাজ বলে করতাম, তবে আর তা করতে গিয়ে তোমায় ভুলতাম না। কাজটা আমার আমোদ হয়ে পড়েছে, আমোদে পড়ে তোমায় ভুলি। তুমিও যেন আমার আমোদে আমোদ পাও, তা না হলে আমায় বার বার ডেকে নাও না কেন?




তুমি হয়তো বলছ যে এ কথা ঠিক নয়। তুমি আমাকে বার বার তোমার কাছে ডাকো, আমি শুনিনে। কেন শুনিনে? এখনও মা বলে চিনতে পারিনি। ... এই তো চিনছি, এই তো তোমার কোলে আমি। শয়নে-স্বপনে, জাগরণে, জ্ঞানে, মোহে, যে-কোন‌ও অবস্থায় হোক, তোমার কোল ছাড়া আর কোথাও নই। রহস্যটাও যেন পরিষ্কার হয়ে আছে। তোমায় ছেড়ে, তোমাকে বাদ দিয়ে, আমি কখনও আমায় দেখব না। সে দেখার ইচ্ছা আমার বৃথা। এ তো আর মানুষের সন্তান নয় যে মাকে ছেড়ে থাকবে। আমি তোমার ভেতর, তোমার বাইরে নই, তুমি ছাড়া নই, আমার সব তোমার; অথচ আমি তোমায় জানছি, তোমায় দেখছি, তোমায় খুঁজছি, তোমায় পাচ্ছি, তোমায় ভালোবাসছি।




আমি তোমার, তুমি আমার। কী অদ্ভুত সম্বন্ধ! আমার বোধ হয়, আমি বুঝেছি। আমার যতটুকু দরকার, ততটুকু বুঝেছি, আর যাকে তুমি এই জায়গায় নিয়ে আসবে, যে জায়গায় আমি এসেছি, তাকে আমি বোঝাতে পারব। বোঝাতে যদি না-ও পারি, আমার বুঝলেই হলো। এইটুকু বুঝতে চাই, যতটুকুতে তোমার উপর আমার ভালোবাসা হয়। ভালোবাসাটা হতে গেলে কিন্তু তোমার ভালোবাসাটা আমার বোঝা চাই। তোমার ভালোবাসা আমি এখনও ভালো করে বুঝিনি। তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, তা তো ঠিক দেখছি। তা না হলে তোমার অত ঐশ্বর্য থাকতে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে না।




কিন্তু কেন ভালোবাসো? আমাতে তোমার ভালোবাসার যোগ্য কী আছে? তোমার জবাব কি এ-ই শুনছি যে ভালোবাসার যোগ্য সবই আছে? আমি এখন যা, তা দেখে মনে হয়, আমাতে তোমার ভালোবাসার যোগ্য কিছুই নেই। কিন্তু তুমি তো আমার কেবল বর্তমান নয়, তুমি আমার ভবিষ্যৎও দেখছ। আমি তোমার ঐশ্বর্য, সৌন্দর্য, মাধুৰ্য পেয়ে যা এককালে হব, তুমি তা-ও দেখছ। তা দেখেই বুঝি ভালোবাসছ? কী অদ্ভুত কথা! আমার সে-রূপ, তোমাতে আমার যে-রূপ, তোমার অনন্ত জ্ঞানের কাছে আমার যে-রূপ, তা তো আমি দেখি না, কোনও মানুষই দেখে না, কিন্তু তুমি দেখো। সে-রূপ দেখেই তুমি মুগ্ধ! আমার আর কী বলবার আছে? কেবল বলি, তুমি তো আমার রূপ দেখে মুগ্ধ, আমাকে তোমার রূপ কিছু কিছু না দেখালে আমি তোমাকে কেমন করে ভালোবাসব?




আমাকে দেখাও, আমাকে দেখাও, আমাকে দেখাও। এই দুরন্ত শিশুকে ধূলিখেলা ছাড়াও, তোমার কাছে স্থির করে বসাও, তোমাতে চক্ষু স্থির করাও, তোমার বাণী কানে কানে শোনাও। তুমি যে আমাকে ভালোবাসো, তুমি যে আমার জন্যে ব্যস্ত, আমার কাছে প্রকাশিত হবার জন্যে ব্যস্ত, এইটুকু আমাকে বোঝালেই আমি স্থির হয়ে যাই, তোমার কাছে বার বার আসি, তোমার দিকে টান বাড়ে, একটু গাঢ় ভালোবাসার আস্বাদন পাই। এইটুকু না দিলে আর চলছে না। এ আমার প্রতিদিনের আহার হোক, প্রতিদিন অন্তত চার বেলার। মোহের শেকল বেঁধে কাজ করালে আর চলবে না, ভালোবাসার সেবা শেখাও, সেই সেবার আস্বাদন দাও।