অসম্পর্কের অব্যাকরণ/ শেষ পর্ব

 
- এখন আমি কিছু কথা বলি, তুই মন দিয়ে শোন। তোর কিন্তু বাবা নাই। তুই সম্পূর্ণ তোর ভাইয়ের খরচে চলিস। তোর বাবা তোদের জন্য এমন কোনও কিছু রেখেও যান নাই যেটা নিয়ে তুই বিয়ে না করে বাকি জীবন একাই পার করে দিবি। এদিকে তুই মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস। পড়াশোনা তেমন জানিস না, অন্য কোনও কাজও জানিস না যে সেই কাজটা করে চলবি। আবার তুই যেনতেন কাজও করতে চাস না। এর আগে কিন্তু তোর বাসা থেকে তোকে দুইবার চাকরি দিসে, একবার একটা হাসপাতালে, আবার দ্বিতীয়বারে একটা শোরুমে রিসিপশনিস্টের চাকরি। যেভাবেই হোক ঠিক তো করে দিসে, তুই তাও সেটা ১ মাসও করিস নাই, ছেড়ে দিয়ে চলে আসছিস। তুই তোর ভাইয়ের সংসারে থাকিস। যেখানে তোর ভাবি তোর মা ঘুম থেকে ওঠে সকাল ছয়টায়, সেখানে তুই আর তোর মেয়ে কখনও সকাল দশটার আগে উঠিস না। জীবনে বাসার কাজ আজ পর্যন্ত কিছু ধরেও দেখিস নাই। আমি আজ পর্যন্ত তোকে তোর নিজের চা-টুকু বানানো ছাড়া আর তোর নিজের বিছানা আর নিজের রুম গোছানো ছাড়া আর কিছুই তেমন করতে দেখি নাই। তোর বাসায় মেহমান আসুক আর যে-ই আসুক, তুই তোর মতো সবার সামনে রুমে বসে বসে মোবাইলে সারাদিন কথা বলতেই থাকিস, কোনও মুরুব্বি মানিস না, এমনকি নিজের বাসায় মেহমান আসলে যে ‘কেমন আছেন’টুকু বলতে হয়, সেটাও অনেক সময় ভুলে যাস। আচ্ছা বল তো, আজকে তুই যদি কারও বাসায় বেড়াতে যাস, আর সেই বাসার মানুষ যদি তোর সাথে ঠিকমতো কথা না বলে, তোকে পাত্তা না দেয়, তা হলে দ্বিতীয়বার সেই বাসায় তুই আর যাবি? এই যে তুই সবার সামনেও মোবাইলে অনবরত কথা বলতেই থাকিস, এটা যে একটা বেয়াদবি, এটাও তুই বুঝিস না।
বাসার একটা কাজও নিজের ইচ্ছায় ধরেও দেখিস না। বাসার কারও সাথেই কখনও বসে কথা বলিস না। তোর নিজের মেয়ে কখন খাচ্ছে, কখন ঘুমাচ্ছে, কখন পড়তেসে কিংবা আদৌ পড়তেসে কি না, কখন তোর মেয়ের স্যার আসলো, স্যার কী পড়াচ্ছেন বা ঠিকমতো পড়াচ্ছেন কি না, তোর মেয়ে ঠিকমতো স্যারের পড়া করতেসে কি না, এইসব খোঁজ রাখিস কখনও? আচ্ছা, বল তো তোর মেয়ে এখন কোন ক্লাসে পড়ে? দেখি, জানিস কি না? তোর ভাইটা অন্য দেশে থাকে, সে কেমন আছে তার চাকরি কেমন চলতেসে, অথবা তার কোনও সমস্যা চলতেসে কি না, তোর বড় একটা বোন আছে, তাদের কী অবস্থা এসব কিছুই কিন্তু তুই কখনও খোঁজ রাখিস না। এদিকে তুই বলতেসিস যে তুই সারাদিন দুশ্চিন্তায় থাকিস! তুই দুশ্চিন্তা করে এই কয় বছর কী করসিস, বল তো? তোর জীবন কি কোনও কিছুর জন্য থেমে আছে? কোনও কিছুর অভাব আছে তোর? অথবা অভাব কী, সেটাও কি বুঝিস তুই? তোর ভাইয়ের যে আর্থিক কিছু সমস্যা যাচ্ছে, এটা কি তুই জানিস? আজকে প্রায় এক বছর সে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না, তোদের সংসারের খরচ তোর মা আর তোর ভাই কীভাবে এদিক সেদিক করে করে চালাচ্ছে, জানিস? আর এখন যদি ভাইয়া দেশে চলে আসতে চায়, তাও তো পারবে না, কারণ পেট চলুক আর না চলুক প্রতিমাসে এই বাড়ির লোনের চল্লিশ হাজার টাকা তার শোধ করতেই হবে। এখনও তার পনেরো লাখ টাকা লোন। তুই জানিস না এসব?
এত কিছুর পরও কি একদিন একবেলা না খেয়ে থাকসিস কখনও, অথবা কোনও একদিন একবেলা তোর চা-খাওয়া মিস গেছে? তোর ভাইটা যে দিনের পর দিন শুধু তোদের সবার জন্য চাইলেও দেশে আসতে পারে না, সবাইকে ছেড়ে, নিজের পরিবার, নিজের বউ-সন্তান ছেড়ে দিনের পর দিন বিদেশে পড়ে আছে, এটা বুঝিস? আর তুই যে বললি ওরা তোকে খাওয়ানোর খোঁটা দেয়, একজন মানুষকে যদি শুধু ডাল-ভাত আর আলুভর্তা দিয়েও খাওয়ানো হয়, তা হলে মাসে কত টাকা খরচ হয়, জানিস? একদিনও বাসার বাজার করসিস কখনও? সেখানে একটু চিন্তা করে দেখ তো কখনও মাছ ছাড়া ভাত খাস কি না? তো এই টাকাটা কোথা থেকে আসে? তোদের বাসার যাবতীয় সব খরচ কিন্তু তোর ভাই একা চালায়। আর তোর ভাই তোদের ভালো না রেখে নিজে একা একা ভালো আছে, এমন কি কিছু? আর তারা যদি এখন এমন বলেও থাকে, তা হলে কেন বলতেসে? নিশ্চয়ই তার আর্থিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না এজন্য, এটা তুই ঘরের মানুষ হলে অন্তত বুঝবি।
সে ভাবিকে একটা শাড়ি কিনে দিলে তোদের দুই বোনকে কখনও বাদ দিসে? তোকে তো আমি মাঝে মাঝেই দেখি, তুই খাবার নিয়ে বাসায় ঝামেলা করিস, তুই এটা খাবি না সেটা খাবি না, তোর পছন্দসই তরকারি না হলে খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যাস, তুই নিজে কয় বেলা রান্না করিস, বল তো? তোর ভাবি চা বানালে চা একটু পাতলা হলে তুই সেই চা খাস না। তোর মেয়ে ঠিক তোর মতোই প্রতিদিন প্রতিবেলায় খাবার খাওয়ার সময় ঝামেলা করে। মা-মেয়ে মিলে সারাদিন এটা সেটা নিয়ে চ্যাঁচামেচি করতেই থাকিস, বাসায় যে আরও মানুষ আছে, আর তাদেরও যে কাজ-বাজ আছে, সেদিকে তোর খেয়াল নাই। তুই পড়াশোনা করিস না, তোর মেয়েরও পড়াশোনা নাই, ঠিক আছে, না করলি, অসুবিধা নাই। কিন্তু তোর ভাবি তো পড়াশোনা করে, সে সারাদিন ঘরের কাজ শেষে সন্ধ্যায় একটু পড়তে বসে, আর অমনি তোরা বাসার ভেতর অহেতুক ছোটখাট বিষয় নিয়ে চ্যাঁচামেচি করিস। এখন তুই-ই বল, সারাদিন কাজ করার পর মানুষ এসব কতক্ষণ সহ্য করে?
তোকে বাসা থেকে বিয়ে করতে বলে, তুই কোনও ছেলেকেই একদম পছন্দ করিস না, এখানেও তোর এত এত সমস্যা! একবার নিজের দিকে তাকায়ে দেখ তো তুই কী? দেখিস কখনও? তোর তো একটা মেয়ে আছে, আর তোকে একটা সিঙ্গেল তাও আবার আনম্যারিড ছেলে কেন বিয়ে করবে, বল? ওহ্‌ তুই তো সুন্দরী, তাই না? তোর গায়ের রং ফর্সা, তুই দেখতে সুন্দর, আর কি লাগে? আচ্ছা, একটু চিন্তা করে দেখ তো, তোর যে সমস্যা, সেটা কি একজন আনম্যারিড ছেলে কখনও বুঝবে? তুই কীসের মধ্যে দিয়ে গেছিস, সেটা যেহেতু তুই একটা ম্যারিড মেয়ে, তা হলে নিশ্চয়ই অন্য একটা ম্যারিড ছেলেই সেই সমস্যার জায়গাগুলা বুঝতে পারবে, তাই না? আর তুই কি দিনদিন ছোট হচ্ছিস, না বড় হচ্ছিস? তোর মেয়ে এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে, আর কিছুদিন পর তোর মেয়েকেই তোর বিয়ে দিতে হবে, আর তুই নিজেই এখন বাচ্চা সেজে বসে আছিস? অমুক কী করল, অমুক তমুক কীভাবে চলে, তোর সেটাই চাই, তুই কি অমুক-তমুকের মতো নাকি? একটা সিঙ্গেল মেয়ে আর একটা সিঙ্গেল মা, এই দুইটার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। আর তুই এই যে বারবার শাহরিয়ার শাহরিয়ার করতেসিস, শাহরিয়ার এই শাহরিয়ার সেই, শাহরিয়ারের সাথে কয় দিন সংসার করসিস তুই? তোর কয়টা খরচ শাহরিয়ার চালায়?
শোন নীলু, তুই কিন্তু এখনও শাহরিয়ারের খরচে চলিস না, ওর সাথে থাকিস না। যখন তুই ওর সাথে থাকবি, ও যখন তোর পুরাপুরি খরচ চালাবে, তোকে টেককেয়ার করবে, তখন তুই বুঝবি শাহরিয়ার আসলে কী। দূর থেকে একজন মানুষকে কখনও চেনা যায় না। শাহরিয়ার তোর সমব্যথী হতে পারে। যদি পেটে ভাত না থাকে, কেবলমাত্র মানসিক সাপোর্ট নিয়ে তুই কত দিন বাঁচবি, বল? আর তুই কি ভাবিস সব কিছু একেবারে পানির মতো সোজা? তোর মেয়ে আর ওর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তুই দিব্যি সুখের সংসার করবি, তাই না? তুই তো ওকে ভালোবাসিস, সুতরাং ওর সন্তানদের মেনে নিতে তোর বিন্দুমাত্রও অমত নাই, তাই তো?
আর তোর মেয়ে? ওকেও শাহরিয়ার ভালোবেসে মেনে নিবে, তাই না? তার পর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তোরা সুখের সংসার করবি। তার পর যখন তোদের সন্তানদের মধ্যে রেষারেষি হবে, তখন?
যখন শাহরিয়ার ওর ছেলেরটা একটু বেশি দেখবে, তোর মেয়েরটা দেখবে না, তখন তো শাহরিয়ার খারাপ হয়ে যাবে, তোদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাবে, তাই না? আর তিন তিনটা বাচ্চা মানুষ করা আজকালকার দিনে কত খরচের ব্যাপার, জানিস তো? ওদের খাওয়া খরচ? পড়াশোনা? জামাকাপড়? তার পর এত কাজ কে করবে? তুই করবি? বাপের বাড়িতে একগ্লাস পানিও তো ঢেলে খাস না! এখন পর্যন্ত অন্তত এই অবস্থায় আছিস। আর তুই একসাথে তিনটা বাচ্চা পালবি! আচ্ছা বল তো, শেষ কত দিন আগে তুই তোর নিজের মেয়েকে নিজের হাতে খাবার খাওয়াইসিস? আমার কিন্তু মনে পড়তেসে না, উল্টা তোর মেয়ে স্কুল থেকে এসে তোর কাছে খাবার চাইলে তুই তাকে খাবার টেবিল দেখায়ে দিস। মেয়ে ঠিকমতো খাচ্ছে কি না, একটু দেখারও সময় পর্যন্ত হয় না তোর। সারাদিনই তো মোবাইল গুঁতাস! কখনও একবার বোঝার চেষ্টা করিস, এতটুকু বাচ্চা মেয়ে কীভাবে প্রতিদিন মায়ের যত্ন না পেয়ে পেয়ে অবহেলায় বড় হচ্ছে? ওর মনের উপর কতটা চাপ আসতে পারে, বুঝিস? বাবা-মাকে ছোটবেলা থেকে সে কখনও একসাথে পায় নাই, এটা ওকে ভেতরে ভেতরে কষ্ট দেয় না, ভাবসিস? শেষ কবে মেয়েকে কাছে বসায়ে ওর স্কুলের গল্প শুনসিস, বল তো? ও সামান্য একটা কিছু বললেই তো তুই ওকে ধমক দিয়ে কথা বলিস, আর সেই তুই চার মাসের বাচ্চা সামলাবি, তাও আবার অন্যের! মোট তিনটা বাচ্চা তুই একা পালবি! আর এর ভেতর তোদের ঘরেরও তো বাচ্চাকাচ্চা হবে, না কি? না কি তোরা সারাজীবন একে অপরের বাচ্চার পরিপূরক হয়েই কাটিয়ে দিবি, নতুন করে তোদের আর দরকার নাই? তুই তো দশভুজারে, দেবীদুর্গাসহ সব সুপারম্যান আর ওম্যানকে হার মানায়ে ফেলবি দেখতেসি!
ওহ্‌ আর একটু আছে, শাহরিয়ারের তো কোমরের হাড়ের সমস্যার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, চেকআপ করাতে হয়, আর তোরও থাইরয়েডের সমস্যা। তোরও প্রতি মাসে শুধু ওষুধের পেছেনেই চার হাজার টাকা করে লাগে এবং এই খরচটা দিনদিন বাড়বে, কেননা থাইরয়েডের সমস্যা একটা জীবনব্যাপী সমস্যা, এটার ওষুধ একবার শুরু হলে সারাজীবনই চালায়ে যেতে হয় একেবারে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। আর আমি যতদূর জানি, এখন পর্যন্ত তোর এই খরচটাও তোর বাসার মানুষ চালাচ্ছে। এই যে এত এত খরচ, এগুলা তোদের বিয়ের পর কে করবে? শাহরিয়ার? শাহরিয়ার কী করে? আমি যতদূর জানি, একটা তৃতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরি সে সবেমাত্র পেয়েছে, কিন্তু এখনও নিয়োগই হয় নাই! আর শাহরিয়ারের আজকে হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা হলেও সেটা সামলানোর মত গচ্ছিত কোনও টাকাপয়সা তার নাই। আর তোরা দুজনেই তো তোদের যার যার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিস, তা হলে তাদের কাছে থেকে কোনও ধরনের সাপোর্ট পাওয়ার কোনও আশাই নাই। আচ্ছা বুঝতে পারলাম, শাহরিয়ারের ভালোবাসা পেলে তুই সব কিছু করতে পারবি, সব চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে পারবি, তাই তো? বিশাল ব্যাপার-স্যাপার! আর সারাদিন দুজন এত কাজ-বাজ করে যখন দুজন মিলে একা একটু সময় কাটাতে পারবি না, একা কোথাও যেতে পারবি না, (এখন যেমন একা একা দুজন বিন্দাজ-মুডে বনে-বাদারে ঘুরে বেড়াস, সেজন্যই বলা) তখন মানতে পারবি তো? আবার এই যে এতগুলা সংসার, এতগুলা পরিবারের মানুষকে কষ্ট দিয়ে, বাসায় প্রতিনিয়ত অশান্তি করে, এতগুলা মানুষের অভিশাপ নিয়ে তোরা সংসার করবি, সেটাও সুখের হবে, এমন আশা করিস! আমি আসলেই অবাক হতে হতে মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থায় আছি, বিশ্বাস কর! ভালোবাসার আসলেই অনেক অনেক শক্তি এখন বুঝতে পারতেসি! শোন, তুই বিয়ের আগে আর যা-ই করিস না কেন, অন্তত একটা ভালো মানসিক ডাক্তারের কাছে যা। আমার সত্যিই মনে হচ্ছে, তুই মানসিকভাবে পুরাপুরি অসুস্থ!
- না, আমি যদি এখন বিয়ে করি, তা হলে বিন্তিকে ওর বাবা, ওর দাদাবাড়ির সবাই আমার কাছে আর রাখবে না। ওরা ওকে নিয়ে নিবে। যদিও আমি মনে মনে ভেবে রাখসি, যখন সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, তখন আমি বিন্তিকে আমার কাছে নিয়ে আসব। আর শাহরিয়ারের ছেলে-মেয়েও ওর বউ রাখবে। আমি ওর বউয়ের কাছে থেকে ওদের আলাদা করব না। মায়ের কাছ থেকে সন্তান আলাদা করা উচিত না। শাহরিয়ার ওদের যা খরচ লাগে, মাসে মাসে সেটা পাঠায়ে দিবে। আর শাহরিয়ার তো এবার বিসিএস রিটেন দিয়ে আসছে, এবার না হলেও সামনের বার যদি বিসিএসটা ওর হয়ে যায়, তা হলে তো টাকাপয়সার দিক দিয়ে আরও একটু সচ্ছলটা আসবে। এবার অবশ্য ওর পরীক্ষাটা বেশি ভালো হয় নাই। এবার ও নাকি পাস নাও করতে পারে, তা-ই বলল। আর আমি সেদিন রিনির সাথে কথা বলসি, ওর হাজব্যান্ড লইয়ার। রিনি বলসে, সে তার হাজব্যান্ডের কাছে আমাদের সমস্যার কথা খুলে বলবে। কীভাবে কী করা যায় দেখি তার পর।
- ও আচ্ছা, তা হলে তো রাস্তা মোটামুটি ক্লিয়ার করেই ফেলসিস! আর এই যে তুই বললি না যে তুই ওর মায়ের কাছ থেকে ওর সন্তানদের আলাদা করতে চাস না এজন্য রাখবি না, এসব কথা না অন্তত আমাকে বোঝাতে আসিস না। তুই যে ওর বাচ্চাদের কেন রাখবি না, সেটা অন্তত আর কেউ না হোক আমি সম্পূর্ণ বুঝতে পারি। আর পরীক্ষা ভালো হবে কী রে? ওকে তো সারাক্ষণ তোর সাথেই পড়ে থাকতে দেখি, আমি যতবার কোনও কাজে বের হইসি, ততবারই তো তোদের একসাথে বাইরে ঘুরাঘুরি করতে দেখসি। ও এত ঘুরলে পড়ে কখন? ওর মতো ছেলেরা রাস্তাঘাটে ঘুরে ঘুরেই জীবন কাটায়ে দেয়, ভালো চাকরি আর পায় না। অনেক দেখসি এমন। ওদের এমনই হওয়া উচিত, ঠিকই আছে! আর ওর রিটেন পরীক্ষার দুদিন আগেও তো ওকে তোর সাথে দেখলাম, ওই সময় তো বাথরুম করারও সময় পাওয়া যায় না যে এত রিভিশনের চাপ থাকে, সেখানে ও আমতলা-জামতলা দিয়ে তোকে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়। ও আসলেই পরীক্ষা দিসে? না কি সবই ভুয়া? জানিস কিছু ঠিকঠাক? আদৌ কি ওর থার্ড-ক্লাস জবটাও হইসে আসলে? আমি তো ওর কাছে এর আগে বিসিএস প্রিলির কয়টা বইয়ের নাম দিতে বললাম, ও তো সেগুলাই ঠিকমতো বলতে পারল না। ও আমাকে যেগুলার নাম বলল, বিসিএস নিয়ে যা যা বলল, সেগুলা তো আরও দশ বছর আগের কাহিনি। শোন, তুই না আগে ওর সম্পর্কে ঠিকঠাক খোঁজ খবর নে।
আর তুই তো দুনিয়ার সব সংসার তছনছ করে দিবি দেখতেসি! আবার রিনিকে এর মধ্যে টানতেসিস কেন? রিনি কী বলবে ওর জামাইকে? বলবে যে ওর এক বান্ধবী একটা বিবাহিত দুই বাচ্চার বাপের সাথে প্রেম করতেসে, আর তার সাথেই ঘর করতে চায়, কিন্তু ওই ছেলে তার বউ ছেলেমেয়েকে ছাড়তে পারতেসে না, তুমি একটু ছাড়ায়ে দাও! এই তো? তার পর রিনির জামাইয়ের কাছে রিনির সম্মানটা কই গিয়ে দাঁড়াবে? রিনি কেমন মেয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ রাখে যে একজনের ঘর ভেঙে নিজের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে? রিনির কয় বাচ্চা যেন? দুই মেয়ে না? রিনির জামাই তোকে হেল্প করবে কী, ওই লোক তো নিজেই নিজের সংসার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে! হা হা হা। আর তুই কেন আর একজনের সংসার ভাঙার জন্য লইয়ার ডাকতে যাবি! যার এত ইচ্ছা সে নিজে যাক না, যার সমস্যা সে কেন সমাধান করে না? তার পর তো পরে সে বলে বসবে, আমি আমার সাজানো সংসার ভাঙতে চাইনি, এই কুটনি মহিলা ষড়যন্ত্র করে, নিজে নিজে উকিল ঠিক করে আমাকে আমার সংসার ভাঙতে বাধ্য করসে, ঠিক যেমন এখন সব দোষ বউকে দেয়। ওর বউকে ও বিয়ে করতে চায় নাই, ওর বউ ওকে জোর করে পিস্তল ঠেকায়ে বিয়ে করসে! যে লোক তার বউয়ের এত দোষ দেখে, সে লোক তোকে বিয়ে করলে তোর বেলাতেও একই কাহিনি হবে, খালি তোর দোষ দেখবে। তুই দেখে নিস! হা হা হা…
- আমি আসলে ওর সাথে এত জড়ায়ে পড়সি যে আমি ওকে ছাড়া এখন আর কিছু ভাবতে পারতেসি না। আমি চাইতেসি ওর কাছ থেকে সরে আসতে, কিন্তু ওকে ছাড়া আমি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমি সারাদিন এত দুশ্চিন্তায় থাকি ওকে নিয়ে, কীভাবে কী করব এসব নিয়ে, অথচ ওদিকে সে আজকে সকালে তার বউকে নিয়ে তার এক ফ্রেন্ডের বাসায় দাওয়াত খেতে গেছে। ওর ফ্রেন্ড নাকি ওকে দাওয়াত দিসে, আর ওর ফ্রেন্ডের বউ নাকি ওর বউকে বারে বারে ফোন করে যেতে বলসে, এজন্য ও ওর বউকে সাথে না নিয়ে পারে নাই।
- হুম, খুবই ভালো কাজ করসে। ও তো এইসবই বলবে। ও তো ওর জায়গায় ঠিক আছে। ও তোকে ক্লিয়ার করে কিছু বলসে, বল তো? ও তোকে কি বলসে যে সত্যিই ও তোকে বিয়ে করবে?
- ও বলসে। ও আমাকে সত্যিই ভালোবাসে, ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু ওর ছেলেমেয়েকে ফেলে এভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক আছে কি না, এটা নিয়ে ও একটু কনফিউজড। এজন্য আমিই ওকে বলসি আর একটু সময় নিয়ে ভাবতে।
- এই, তুই তো পুরাই গাধী দেখতেসি। এত দিন প্রেম-ভালোবাসা করে, বিয়ের কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলসে, আর এখন সে বলতেসে সে কনফিউজড! একটা চড় লাগায়ে দিলি না কেন…হা হা হা। যেকোনও সম্পর্কে কনফিউশন আসার মানে বুঝিস? যখন একটা মানুষ তিন সেকেন্ডের মধ্যে কোনও প্রশ্নের উত্তর করতে না পারে, তখন বুঝতে হবে সে ওটা নিয়ে কনফিউশনে আছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন উত্তর সাধারণত ভুল উত্তর হয়। আর ও এখানে জীবনের এত বড় একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এতদূর এসে এখনও সে বলতেসে সে কনফিউজড! আর তুই দিব্যি বলেই যাচ্ছিস যে ও তোকে ভালোবাসে! তুই বুঝিস, ভালোবাসা কী? ভালোবাসা হচ্ছে যেখানে দুজনের কারও কোনও প্রকার কনফিউশন থাকবে না। যখন থেকে দুজন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, আমরা একটা সম্পর্কে জড়াতে যাচ্ছি, তখন থেকে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত তারা এটা অন্তত শিওর থাকে যে আমি এই মানুষটাকেই ভালোবাসি এবং তার জন্য, তার ভালোর জন্য, এই মানুষটার শান্তির জন্য আমার যা যা করার, সবই করব। আর তুই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত একটা কনফিউশনের উপর নিজে নিজেই এত কিছু ভেবে সব কিছু ঠিক করে বসে আছিস! আর শোন, মানুষ অনেক কিছুই করতে চায়, তার পরও সে যা করবে বলে ঠিক করে, সে শুধু সেটুকুই করে। সুতরাং করতে চাই আর করব, এই দুইয়ের পার্থক্য নিশ্চয়ই তোকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝায়ে দেওয়া লাগবে না, তাই না? তোরা দুজনের কেউই নিজের অবস্থানে ঠিক নাই। আগে নিজেদের সম্পর্কের ভিত্তিটা ঠিক কর, নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা কর, তোরা আসলে একে অপরের কাছে কী চাস, তার পর অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা চিন্তা করিস। আর তুই এখন কোন অবস্থানে আছিস, সেটা কিন্তু আমি তোকে বলসি, তুই কিন্তু খুব বেশি সময় পাবি না। আর আমার মনে হয়, খুব বেশি সময় নেওয়া তোর জন্য ভালোও হবে না।
- আমি তো বুঝতে পারতেসি। আমি সরতে চাচ্ছি, কিন্তু আমি নিজের সাথে পারতেসি না। আমি কীভাবে সরব? এদিক থেকে কীভাবে আমার মনোযোগ সরাব? বেশি সময় নেওয়া যাবে না, এইটা আমিও বুঝতে পারতেসি। কারণ নূপুর আন্টি ওই আমেরিকান ছেলেকে বিয়ের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত বাসায় বারবার জানাতে বলতেসে।
- হুম। আমেরিকার ওই ছেলে তো ভালোই মনে হচ্ছে। সে এখন সিঙ্গেল আছে। আর ওই ছেলে তো অনেস্টলি বলসে যে তার এর আগে একটা সম্পর্ক ছিল, সেই মেয়েকে সে লেখাপড়া করার খরচ দিসে, কিন্তু মেয়েটা পড়াশোনা করে এস্টাবলিশমেন্টের পর অন্য আর একজনকে বিয়ে করে নিসে। সে এটা নিয়ে এখনও ডিপ্রেশনে আছে। এত দিন ওই ছেলে ডিপ্রেশনে ছিল, কিন্তু ছেলেটা এখন ঠিক করসে, সে এখন নতুন করে সম্পর্কে জড়াতে চায়। সে এবার বিয়ে করবে। তা হলে এর চেয়ে আর কত ক্লিয়ার হওয়া যায়, বল! আর ওই ছেলে তো ফুপির কাছে বলসেই সে তোকে তোর মেয়েসহ নেবে। ছেলের তো বয়সও কম, তা হলে আর কী জানতে চাস তুই? আর কী চাস তুই?
- ওই ছেলে যদি কনট্রাক্ট ম্যারেজ করতে চাইত এক বছর বা এর কম কিছু দিনের জন্য, তা হলে আমি করতাম। কিন্তু এই ছেলে তো তা করবে না, এই ছেলে সারাজীবনের জন্যই বিয়ে করতে চায়। তা হলে কীভাবে করব? আমি ভাবসিলাম এই ছেলে যদি এক বছরের কনট্রাক্ট ম্যারেজ করে, তা হলে আমি আমেরিকায় গিয়ে গ্রিনকার্ড পাওয়ার পর শাহরিয়ারকে সেখানে নিয়ে যাব। কিন্তু এইখানে তো সেটাও করতে পারব না। আর বিয়ে করে যদি পরে আমি গ্রিনকার্ড পাওয়ার পর ওকে ছেড়ে দিই, তা হলে ছেলেটা তো কষ্ট পাবে। বলবে, দেখো, আমি যাকেই বিশ্বাস করলাম, সেই আমাকে ব্যবহার করল। এটা তো আবার খারাপ দেখা যায়, এজন্য এটা করতে চাচ্ছি না। আর শাহরিয়ার আমাকে বলসে যে, আমেরিকার এই ছেলের যেহেতু আগে একটা রিলেশন ছিল, আর এত দিন যেহেতু সে ওই মেয়ের জন্য ডিপ্রেশনে ছিল, তা হলে ওই মেয়ে যদি ভবিষ্যতে আবার কোনও দিন আসে, তা হলে এই ছেলে তো তোমাকে ছেড়ে ওই মেয়ের কাছেই আবার চলে যাবে, এদিকে কিন্তু একটা ভয় আছে। আমি ভেবে দেখসি, এই কথাটাও তো ঠিক! আমি ঠিক করসি, আমি শাহরিয়ারকে আরও কিছু দিন সময় দিব। যদি দেখি, ও আমাকে নেওয়ার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারসে, তা হলে ঠিক আছে, কিন্তু যদি দেখি, ও কিছুই করতেসে না, শুধু সময়ই নিচ্ছে, তা হলে আমি আমেরিকার এই ছেলেকে বিয়ে করে ফেলব। আমি দেশে থাকলে ওকে এড়াতে পারব না। ও বারে বারে আমার সামনে আসবে, তার পর ভালোবাসার দোহাই দিবে, কিন্তু আসলে সে কিছুই করতে পারবে না। এটাও আমি বুঝতে পারসি।
- এইই…তুই তো দেখতেসি পুরাই শাহরিয়ারের মুরিদ হয়ে গেসিস! তুই কি শাহরিয়ারকে পীর ধরসস নাকি রে? ও তো দেখতেসি তোর ব্রেইন পুরাপুরি ওয়াশ করে দিসে! খালি শাহরিয়ার আর শাহরিয়ার! আর আমেরিকার গ্রিনকার্ড পেতে কত দিন লাগে জানিস? মিনিমাম সাড়ে চার বছর। এই সাড়ে চার বছর আবার কাকে নিয়ে থাকবি? হা হা হা। শোন, চাইলেই ভুলে যাওয়া না গেলেও কিন্তু চাইলেই ভুলে থাকা যায়, সব সময়ই যায়। আচ্ছা, তুই বল তো, আজকে যদি বিন্তির বাবা, মানে রিমন তোকে অন্তত একটু হলেও ভালো রাখত, আই মিন অত মারধোর না করত, তা হলে কি তুই রিমনকে ছাড়তি? নিশ্চয়ই না! তা হলে শাহরিয়ারের বউ যদি ওকে একটু শান্তিতে রাখত, তা হলেও কি শাহরিয়ার তোর কাছে আসত? নিশ্চয়ই না! তা হলে তখন তোরা থাকতি কী করে, বল? তোদের যার যার ঘরে যদি শান্তি থাকত, তা হলে নিশ্চয়ই এভাবে আগাতি না, তাই না? তা হলে আজকে শাহরিয়ারের জায়গায় যদি অন্য কেউ ভালো রাখে তোকে, তা হলে কেন তার সাথে থাকতে পারবি না? তুই চেষ্টা কর, তা হলেই পারবি। দেখ, এতগুলা জীবন নিয়ে কিন্তু ছেলেখেলা করা যায় না। তোরা নিজেরা তো শেষ হবিই, সেই সাথে আরও কয়েকটা জীবন নষ্ট করবি। আর একটা ব্যাপার চিন্তা করে দেখবি, তোর যতই কষ্ট লাগুক না কেন, শাহরিয়ারের কিন্তু কষ্ট লাগার সময় থাকবে না। কারণ ওর ঘরে ওর বউ আছে। আর ওর বউ যখন বিষয়টা জানতে পারসে, তখন ওর বউ চাইবে ওকে সব সময় সাপোর্ট দিতে, কেননা শত হলেও ও কিন্তু শাহরিয়ারের বউ। সুতরাং শাহরিয়ারের একা একা লাগার কোনও স্কোপই নাই, এদিকে তুই থাকবি একা একা, এজন্য তোর বেশি খারাপ লাগবে, এটাই স্বাভাবিক।
তুই ভেবে দেখ তো তুই কি একদিনে রিমনকে ছাড়তে পারসিস? দশ বছরের সংসার জীবনে তুই মিনিমাম একশোবার সব ছেড়ে চলে আসসিস, আবার গেসিস। লাস্টে যখন আর পারিসই নাই, তখন একেবারে চলে আসছিস। তা হলে এই সম্পর্ক থেকে কী করে তুই একবারে এত অল্প সময়ে সব ভুলে যাবি? এটার জন্য সময় লাগবে, সময় নে। নিজেকে যত খুশি সময় দে, দেখবি, সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া যখন অন্য আর একটা রিলেশনে যাবি, তখন তো ওদিকেরও আরও অনেক দায়িত্ব থাকবে। দেখবি, আস্তে আস্তে সবই না চাইলেও ভুলতে বাধ্য হয়ে যাবি। তুই আজ পর্যন্ত এই দুইটা ছেলেকেই দেখসিস, এজন্য তোর মনে হয়, রিমনের মতো বাজে লোক পৃথিবীতে আর একটাও নাই এবং শাহরিয়ারের মত ভালো ছেলেও আর একটাও হয় না। আসলে পৃথিবীতে সবাই ভালো, কিন্তু সবাই সবার জন্য ভালো না। একেক জন একেক জনের জন্য ভালো। তোকে একটা কথা বলি, এই যে তুই বলতেসিস, শাহরিয়ার যদি তোকে বিয়ে না করে তা হলে তুই আমেরিকার ওই ছেলেকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলে দিবি, এতেও কিন্তু প্রমাণ হয় যে শাহরিয়ারের ব্যাপারে তুইও সিরিয়াস না, অথবা তুই ওর উপর পুরাপুরি ভরসা করতে পারিস না। তা হলে তুই-ই বল, অযথা ওর জন্য আরও কিছুদিন তোর এই সময়গুলা নষ্ট করার কি কোনও প্রয়োজন আছে?
তোরা আসলে কেউ কাউকে ভালোবাসিস না। তোরা দুজনেই যার যার যায়গায় কষ্টে ছিলি, অশান্তিতে ছিলি, এজন্য দুজনের মধ্যে কিছু ফাঁকা জায়গা তৈরি হইসিল, আর ওই ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করতেই তোরা কিছু সময়ের জন্য একজন আর একজনের কাছে আসছিলি। একে ভালোবাসা বলে না, একে বলে চাহিদাপূরণ। ভালোবাসা হচ্ছে একটা মানুষকে প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করতে পারা, ভালোবাসার মানুষের সুস্থতা, মানসিক প্রশান্তি, যেকোনও বিপদাপদ থেকে মানুষটা যেন সব সময় সব পরিস্থিতিতে শঙ্কামুক্ত থাকে সেই প্রার্থনা করা এবং যেকোনও পরিস্থিতিতে ছায়ার মতো মানুষটার পাশে থাকা। আমি যাকে ভালোবাসি, সেই মানুষটা যেন ভেতর থেকে ফিল করতে পারে যে আমি তাকে ভালোবাসি। এটাকেই ভালোবাসা বলে। ভালোবাসাটা সব সময় সুখ না দিতে পারলেও শান্তি ঠিকই এনে দিতে পারে। সুখ হইতেসে শারীরিক বিষয়, আর শান্তি হইতেসে সম্পূর্ণ মানসিক বিষয়। সুখ পাওয়ার পর ধীরে ধীরে এটার চাহিদা কমে যেতে পারে, কিন্তু যার কাছে শান্তি আছে, সে সব সময়ই সুখী। একটাসময় পর মানুষ সুখের দিক দিয়ে যখন তৃপ্ত হয়, তখন সে শান্তির খোঁজ করে, যে তাকে সুখী করে, কিন্তু শান্তি দিতে পারে না, তাকে ওই মানুষটা অপ্রয়োজনীয় মনে করে বসে, আর তার প্রতি একটাসময় বিরক্তি আর বিতৃষ্ণা এসে যায়। আচ্ছা শোন, অনেক রাত হয়ে গেছে আমি বাসায় যাই।
- তুই কেমন আছিস? তোর কী অবস্থা?
- আরে, আমার যা অবস্থা, আর বলিস না।
- কেন? কী হইসে?
- আব্বু-আম্মু হজ্বে যাবার সময় আমার বাসায় রাতে থাকার জন্য এক খালাকে রেখে গেছে। প্রথম দিন সে গেস্টরুমে ছিল। পর দিন সে বলতেসে, গেস্টরুমে সে একা একা ভয় পায়, সে আমার বিছানায় ঘুমাবে। আমি পড়লাম মহাঝামেলায়, আমি তো কারও সাথেই ঘুমাইতে পারি না, এখন কী আর করব, ঠ্যালায় পড়ে তাকে আমার বিছানায় ঘুমাতে দিলাম। ঘুমানোর পাঁচ মিনিটের মাথায় সে গভীর ঘুমে যাওয়ার সাথে সাথে বিকট শব্দে নাকডাকা শুরু করল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার আজকের ঘুম মোটামুটি এখানেই সমাপ্ত! ওই দিন তো সারারাতই জেগে ছিলাম। উনি সকালে বাসা থেকে যাবার পর ঘুমাইসি। তার পর দিন বলসিলাম, আপনার আর আসার দরকার নাই, আর লাগবে না। তো পরদিন সুইটি নানুরে বলসি রাতে আমার বাসায় ঘুমানোর জন্য, কারণ শত হলেও আব্বু যাবার আগে বারবার বলে গেছে খালি বাসায় রাতে একা না ঘুমাতে। এখন পর দিন সুইটি নানু আমার আম্মুর রুমে ঘুমাইসে। এখন কিছুক্ষণ পর শুনি, আর এক বিকট শব্দ! আমি তো বুঝলাম, আমার আজকের ঘুমও…এটাই চলতেসে! চার-পাঁচ দিন ধরে নিশাচর প্রাণী হয়েই আছি, আর কী করব!
- হো হো হো। তা হলে তুই আমাকে ডাকলেই তো পারতি!
- আরেএএএএ…তুই হাসতেসিস! দেখ, এতক্ষণ তোকে এত ভালো ভালো কথা বললাম, আর সেই তুই এখনই আমার এই সামান্য ঘুমে ব্যাঘাতজনিত সমস্যার কথা শুনে হাসতেসিস। নাহ্‌ মানুষের উপকার করে আসলে লাভ নাই! যাই যাই, না হলে বেশি রাত হয়ে গেলে আবার আমাকে রাস্তায় ভূতে ধরতে পারে, বুঝছিস? আমার শরীরে আবার হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ তো, এজন্য ভূত শুধু আমাকে জড়ায়ে ধরতে চায়! হি হি হি!


প্রতিদিন কিছু সম্পর্ক যেমন একটু একটু করে শিথিল হতে থাকে, ঘুণপোকা কাটতে কাটতে ভেতরটা ফাঁপা করে দেয়, আবার বিপরীত দিকে কোথাও যেন ধীরে ধীরে একটু একটু করে কিছু সম্পর্ক শক্তপোক্ত হতে থাকে। ভাঙাচোরা মন নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দিব্যি কেটে যায় জীবন! কখনও-বা ক্লান্তশ্রান্ত বিষণ্ণবিস্রস্ত পথিক নিজ থেকেই সমস্তটা ঝেড়েঝুড়ে হালকা করে নেয় একটু স্বস্তির আশ্রয়ে বাঁচতে। যাক না…যা খুশি হয়ে যায় তো যাক না, তবু জীবন তো চলুক, সবটা পেয়েছে কে কোথায় কবে! ভীষণ জব্দ-করা শত নিয়মের ফাঁকে কিছু অনিয়ম যখন নিয়ম হতে থাকে একটু একটু করে, কিছু বদঅভ্যাসের দায় যখন দৈনন্দিনের কিছু অভ্যাস ভুলিয়ে দেয়, তখন আর জীবন নিয়ে অত ঠেলাঠেলি কীসের? অত দায় বহন করে বেড়ানোর কী আছে? যাক না জীবন যেমন যায়! প্রতিদিন অজস্র সম্পর্ক নড়বড়ে হতে থাকে, কখনও-বা দুম্‌ করে ভেঙেও যায়। সম্পর্কগুলি যখন শুরু হয়, তখন কেবলই গড়ার নেশায় থাকি বলেই বোধহয় ভাঙনে এত মায়া জাগে, ভয় হয়! কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে যায় সকল কোলাহল। বর্ষার প্রথম প্রবল ঢলে ধুয়ে যায় সমস্ত জমাট রক্ত। নতুন ওষ্ঠে সাজে নতুন এক আমি। রাতের গভীর আর্তনাদে গিয়ে ঠেকে যায় মায়া কি ভ্রান্তি! নিজেকেই শুদ্ধস্বরে শুধাই---আমি কি করেছি তবে ভুল কিছু? আমি দূর থেকে দেখি, আমি কিছু গড়তে পারি না, আমি কিছু বাঁধতে জানি না, আমি জোড়া লাগাতেও পারি না ওদের মতো করে। আমি কেবলই কিছু বোধের বোঝা ঘাড়ে করে নিঃশব্দে পথ চলি। আমি প্রত্যহই করে যাই কেবল ভুল আর ভুলই! আমি তবু প্রত্যুত্তরে গড়ে দিই এক মায়ার কায়া! আমি আমারই ভেতরটা ভেঙেচুরে সাথে রাখি শুধুই ছায়া!