অদেখা থেকে দেখায়

তুমি তো আমাকে সময়ে সময়ে বলেছ, যুক্তিতর্ক করতেও যেন আমি তোমার সঙ্গেই করি, তুমি আমাকে যা শিখিয়েছ, তা ভুলে যেন বৃথা তর্ক আমি না করি।




তুমি যখন আমাকে দেখা দিয়েছ, আর তোমার সঙ্গে কথা বলবার অধিকার দিয়েছ, তখন আর আমি অন্যের কাছে শিখতে যাই-ইবা কেন? তুমি কিন্তু আমাকে সময়ে সময়ে মানুষের কাছেও পাঠিয়ে দাও। তুমি বলো, ওই পথ দিয়ে... উপদেশ আর বই পড়ার পথ দিয়ে হেঁটে না এলে সব তত্ত্ব শিখতে পারব না। তাই তো আমি মানুষের কাছে যাই।




জানি, এ তোমার কৌশল মাত্র। কোনও মানুষ আমার মনের ভেতর আসতে পারে না, মনের ভেতর কেবলই তুমি। বই পড়ব, মানুষের কথা শুনব, কিন্তু শিক্ষাটা শেষমেশ তুমিই দেবে। এই মনকে বোঝাবে কেবল তুমি। ইদানীং কিন্তু যা পড়ালে, তাতে সুখের সঙ্গে কষ্টও পেলাম ঢের।




মানুষ তোমার তত্ত্ব জানে না, তোমাকে দেখেনি, তোমাকে দেখবার জন্যে ব্যস্তও নয়, অথচ তোমার কথা বলতে আসে ৷ পাতের পর পাত, অধ্যায়ের পর অধ্যায়, তোমার বিষয়ে বকে, তবুও কোনও কথাই পরিষ্কার করতে পারে না। স্পষ্টই স্ববিরোধী কথা বলে, বুঝেও যেন বোঝে না, জেনেশুনেই যেন অসঙ্গত কথা বলে।




কেন এমন করে ওরা? টাকার লোভে? না মানের লোভে? যে তোমায় জানে না, তোমায় বোঝে না, তোমায় ধরবার চেষ্টা পর্যন্ত করছে না, সে তোমার সম্বন্ধে অত কথা বলে কেন? বলুক, আমি যেন ওই সকল লোকের কথায় না ভুলি... তাহলেই হবে। আমার দেখা ধন সবসময়ই আমার চোখের সামনে থাক, কখনও হাতছাড়া হয়ো না। আমি তোমায় দেখে লোককে দেখাতে চাই। ধরে ধরাতে চাই, ভালোবেসে ভালোবাসাতে চাই। আমি ভাবছিলাম, আমার কাজ শেষ হয়ে আছে, তা তো দেখি নয়। আমার বোঝানোই শেষ হয়নি। তারপর দেখান, ধরান, ভালোবাসান, এখনও আরম্ভ হয়নি বললেই হয়।




আমি আগে ভালো করে দেখি, ধরি, ভালোবাসি; তারপর আর বোধ হয় বেশি বলতে হবে না। দেখে কথা বললে সে কথায় লোক তোমাকে দেখবার জন্যে ব্যস্ত হবেই। ধরে কথা বললে লোক ধরতে চাইবেই। আর ভালোবেসে কথা বললে সেই কথার মধ্যে একটা সুঘ্রাণ লোকে পাবেই।




এ সব তো আমার হয়নি। 'আমি দেখছি।' বললে লোকে ঠিক বিশ্বাস করে না যে আমি দেখছি। লোকের কী দোষ দেবো? আমার কথার মূল্য আমার কাছেই তো নেই। আমার দেখা অত কম হয়, যেন চমকমাত্র হয় যে আমি নিজেই সে দেখায় সন্তুষ্ট নই। সে দেখায় আমার মনের গতি, জীবনের গতি, বদলায় না। অথচ দেখিনি-ইবা কী করে বলি?




তুমি যে প্রাণরূপে এসে দেখা দিচ্ছ, এ তো আর আমার কল্পনা নয়। কল্পনা আর প্রকাশের তফাৎ তো অনেক দিন আগেই বুঝিয়েছ। তবে এই বিদ্যুতের ন্যায় নিমেষের চমকটি তুমি স্থায়ী করো। তুমি কেবল আকাশের বিদ্যুৎ না থেকে আমার ঘরে বিদ্যুতের স্থায়ী আলো হয়ে বসো। কেবল চোখের নিমেষে নয়, স্থির দৃষ্টিতে, কাজকর্মে, ঘরে বাইরে... অচল আলোকরূপে থাকো, তবেই আমার মনও বুঝবে, অন্য লোকেও বুঝবে।