জঙ্গল ভেঙে মঙ্গল

মেশামেশি পছন্দ করছিলাম না বলেই বুঝি ক-দিন খুব দূরে সরিয়ে রাখছিলে? দূরে থাকার সুখটা কী, তা-ই বুঝি দেখাতে চাও? সকালবেলা একটু দেখা দিয়ে অত দূরে সরে যাও যে সারাদিন আর দেখা পাইনে। দেখা দিতে যে আসো না, তা বলতে পারিনে। অবশ্য আমার মন‌ও তোমাকে দেখবার জন্যে ব্যস্ত নয়। তোমার বিষয়ে পড়ছি, তোমার প্রসঙ্গে বলছি, তোমার কাজ করছি, এতেই মনে হয়, তোমার ধ্যান করছি। কিন্তু আমার মনের ভেতরে একটা-কিছু আছে যা বলে, "এ ঠিক হচ্ছে না।" এটা আমি? না তুমি?




এটা অত ভেতরকার যে এটা আমার, তা বলতে পারিনে। এটা বুঝি তোমার টান, তোমার ডাক, আমাকে পাবার জন্যে তোমার ইচ্ছে? এই ইচ্ছেটা আরও বেশি করে প্রকাশ হয় না কেন? প্রকাশ হলেই আমার এই উড়ুউড়ু ভাবটা যায়, আমি একেবারে তোমার হয়ে যাই। কতগুলি জিনিস আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে রাখছে। সেগুলি তোমার সম্বন্ধীয় জিনিসই, অথচ তারা আমায় প্রেমে ফুটতে দিচ্ছে না। বই পড়তে গিয়েও পড়া ফেলে তোমার বিষয়ে আসক্ত হয়ে যাই। তোমার কাছে যেতে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে, আগ্রহ তেমন থাকে না। বরং তোমার বিষয়ে কথা বলতে ভালোবাসি। কথা ছেড়ে তোমায় পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কিংবা তোমার সঙ্গে কথা বলতে, ইচ্ছে ততটা হয় না।




আমি মনকে এ-ই বলে বোঝাই, তোমার প্রতি ভালোবাসা থাকাতেই তো তোমার বিষয়ের সাথে মিল রেখে বই পড়তে আমার ভালো লাগে, তোমার বিষয়ে কথা বলতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু এখন দেখছি, তা নয়। তোমার প্রতি ভালোবাসা আর তোমার প্রসঙ্গ শুনতে ও করতে ভালো লাগা, এই দুই ঠিক এক জিনিস নয়। কেন তবে সারাদিন তোমার প্রসঙ্গ নিয়ে থাকতে পারি? কিন্তু সারাদিন... সারাদিন তো নয়ই, আরও বেশিক্ষণ, আরও বেশি তোমার সঙ্গে থাকতে পারিনে? তোমার প্রকাশ এখনও খুব উজ্জ্বল হয়নি, তুমি এখনও আমার কাছে খুব মিষ্টি হওনি, তাই আমি বেশিক্ষণ তোমায় নিয়ে থাকতে পারিনে।




আমি বই পড়তে ভালোবাসি এই জন্যে যে, আশা হয়, কোনও জ্ঞানী লেখক তোমাকে আরও উজ্জ্বলরূপে দেখতে সাহায্য করবেন। আমার বই পড়ার আসক্তির মধ্যে আর কিছু আছে কি? কোনও কোনও সময় বোধ হয় কিছু জ্ঞানের অভিমান আছে। আমি বেশি জেনে লোকের কাছে জ্ঞানীর সম্মান পাব, এই লোভটাও বুঝি আছে? ঠিক বুঝতে পারিনে। আমি তো যা-তা পড়তেও ভালোবাসি না। যা-তা'র কথা বলতেও ভালবাসিনে। আমি তোমাকে জানতে চাই; আর তুমি তোমার কথা লোককে বলতে বলো, তাই বলি। আমি জ্ঞান দেখিয়ে সম্মান পাবো বলে তো জ্ঞানপ্রচার করি বলে বোধ হয় না।




হয়তো তোমার আদেশ পালন করতে গিয়ে কখনো কখনো অহংকার আর সম্মানের ইচ্ছেও হয়, তবে আমি তা তো মনে মনে পুষি না। যা আসে, তা তুমি দূর করো। আমি মানের পথে যাব না, তা তো অনেক দিন আগেই ঠিক করেছি। যদি মানের ইচ্ছে মনের কোথাও লুকিয়ে থাকে, তা তুমি টেনে বের করে এনে আমার সামনেই প্রেমের আগুনে পুড়িয়ে দাও। এই যে বইপড়ার আসক্তি, এটাও আমার যাক। কেবল যেখানে তোমার তত্ত্ব ভালো করে বোঝার আশা আছে, সেখানেই যেন যাই। কত জঙ্গল ভাঙিয়েছ, কত বৃথা পরিশ্রমের পর তোমার কথা কিছু জেনেছি! একেবারে বৃথা পরিশ্রম‌ও নয়। সে পরিশ্রমে কোনো-না-কোনো কাজ হয়েছে। কোন পথে গেলে তোমায় পাওয়া যায়, কোন পথে গেলে তোমায় পাওয়া যায় না, এ কথা যে বলতে পারছি, তা তো পারতাম না যদি না ওই পরিশ্রমটুকু করতাম।




এই বয়সে সে খাটুনির ইচ্ছে আর হয় না। এখন কেবল তোমার সম্বন্ধে ছাঁকা ছাঁকা কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু খাটুনিটা ছাড়াচ্ছ আর কই? খাঁটি কথা যেমন লোকে বলছে, তেমনি অসার কথাও তো বলছে। আর এমন সাজিয়েগুছিয়ে বলছে যে সে-সব কথাতে লোকে ভুলেও যাচ্ছে। তাদের কথার অসারতা না বুঝে তোমার সম্বন্ধে ভুল ভাবছে। তাই দেখছি, জঙ্গলভাঙার কাজ থেকেও আমাকে একেবারে অব্যাহতি দিচ্ছ না। আমি জঙ্গল ভাঙতে রাজি আছি, যদি তুমি আমার দু-চোখের অঞ্জন হয়ে... কিংবা তা-ও নয়, দৃষ্টির বিষয় হয়ে... থাকো। তোমাকে সামনে নিয়ে, তোমাকে দেখতে দেখতে, যত কঠিন কষ্টকর কাজ‌ই হোক না কেন, আমি তা করতে পারি।