ঘড়ির দিকে তাকান। দেড়টা বাজে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। পারবেন কীভাবে? আপনার মন তো পড়ে আছে সেই বন্ধুটার কাছে, যাকে আপনি চার দিন আগে না বুঝে কষ্ট দিয়েছেন। কীভাবে দিলেন? তাকে আপনি কিছু একটা লিখলেন। আপনি লিখলেন এক, সে বুঝল আরেক। তার কাছ থেকে শেষ যে রিপ্লাইটা এসেছিল, সেটা ছিল, 'ঠিক আছে, অসুবিধে নেই।' এই রিপ্লাইয়ের শেষে একটা মুচকিহাসির ইমোজি ছিল। সে কখনও ওই ইমোজিটা ইউজ করে না। তার মতন একজন মানুষের জন্য ওই ইমোজি ইউজ করে 'অসুবিধে নেই' লেখার মানে হলো, অসুবিধে নিশ্চয়ই আছে! এ জগতের সমস্ত 'অসুবিধে নেই'-র মধ্যে হাজার হাজার 'অসুবিধে আছে' লুকিয়ে আছে। বড়ো হয়ে গেলে এটা বুঝতে সমস্যা হয় না। আপনি তাকে কিছু-একটা লিখে পাঠানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সেদিন থেকেই। কিছুতেই পারছেন না! যা-ই লিখছেন ব্যাকস্পেস দিয়ে মুছে ফেলছেন। লিখছেন, পাঠাবেন ভাবছেন, আর অমনিই ব্যাকস্পেস! আপনি বুঝতেই পারছেন না, কী লিখে পাঠালে ভালো হয়, বন্ধুর অভিমান কমে, তাই আপনি এখনও এই ব্যাকস্পেসেই থেকে যাচ্ছেন! অবশ্য এটা আপনার জন্য স্বাভাবিক। আপনি তো সেই মানুষটা, যে কিনা কাউকে ফোন করার আগে পাঁচ মিনিট তার নম্বরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, এখন ফোন করা কি ঠিক হবে? যদি সে এখন বিজি থাকে? যদি বিরক্ত হয় আমার ফোনটা পেয়ে?...তো এরকম একজন মানুষ বন্ধুর অভিমান ভাঙাবে কী করে!? এই যে এমন বেশি বেশি ভাবেন সব কিছুতেই, এতে কী হয় জানেন? আপনি ক্রমেই খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন। কারও আচরণে সামান্যতম পরিবর্তনও আপনার চোখ এড়ায় না। আপনি ওটা নিয়ে ভাবেন আর ভাবতেই থাকেন। কে কীভাবে কথা বলে, কীভাবে হাসে, কীভাবে আপনাকে টেক্সট পাঠায়, কীভাবে হাত নাড়ায়, সব কিছুই আপনার নজরে আসে। এমন যত করতে থাকেন, ততই এটা আপনাকে পেয়ে বসে! মোটামুটি সব খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েই আপনি খুব সহজেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন! এক দিন ভুলে মাস্ক না পরেই বেরিয়ে গেলেন, আর পরের চার দিন ধরে ভাবতেই থাকলেন, এখন যদি করোনা-আক্রান্ত হই, তখন কী হবে! ফ্রিজের দরোজাটা ঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কি না দরজায় চেপে চেপে খেয়াল করেন, বাসা থেকে বেরোনোর সময় দরজায় তালাটা ঠিকভাবে লাগল কি না কয়েক বার টেনে টেনে চেক করে দেখেন, ঘুমুতে যাবার আগে দরজা-জানালা বন্ধ করলেন কি না দেখতে প্রয়োজনে আপনি সেগুলি খুলে আবার 'ভালোভাবে' বন্ধ করেন! মনের স্বস্তি যেন কিছুতেই আসে না! আপনার মনটা একধরনের ধাঁধার মতন, এবং সেখান থেকে আপনি কিছুতেই বেরোতে পারেন না। বেরোতে চান না, তা কিন্তু নয়! চান, কিন্তু পারেন না! তো যেখানে ছিলাম, সেখানে ফিরে আসি। বন্ধুটিকে টেক্সট পাঠাবেন কি পাঠাবেন না, তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরও হাজারো চিন্তা মাথায় এনে এনে ঘড়িতে চারটা পার করে ফেললেন! যা যা ঘটেইনি, আপনি নিজে নিজেই নিজের মাথায় তা তা-ও ঘটিয়ে বসে আছেন এই সময়ের মধ্যেই! সামান্য একটা টেক্সট পাঠাতে গিয়ে আপনি জীবনের নানান জটিল সমস্যা নিয়েও ভেবে ফেলেছেন ইতোমধ্যে! আপনার এখন ভীষণ অস্থির লাগছে! সমস্যা হলো, আপনার আশেপাশে যারা আপনাকে এরকম বেশি ভাবতে দেখে, ওরা প্রায়ই বলে, 'তুমি অহেতুকই বেশি চিন্তা করো!' এটা বলেই ওরা খালাস! তখন আপনার মনে হয়, আহা, ওরা যদি বুঝত, আমি ইচ্ছে করে এমন বেশি চিন্তা করি না! এই চিন্তার গাড়িতে আমি অবচেতন-মনেই উঠে পড়ি, গাড়িটার ব্রেক কীভাবে চাপতে হয়, আমি যে তা-ই জানি না! ব্যাপারটা অনেকটা মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানোর মতন! যে ভেসে বেড়ায়, তার তো আর নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণই থাকে না; সে শত চাইলেও নিজের এই ভেসে বেড়ানোর উপর নিয়ন্ত্রণটা কোনোভাবেই রাখতে পারে না! আপনার একটা বড়োসড়ো ধাক্কার খুব প্রয়োজন! আপনার এমন কাউকে লাগবে যে আপনাকে ধাক্কাটা দেবে!