অচ্যুত পদের খোঁজে

মা, তোমার অন্তঃপুরে এসে, এই আত্মদর্শনের স্থানে বসে, তোমাকে আত্মারূপে দেখা, তোমাকে বিশ্বাধার, বিশ্বাত্মা, বিশ্বরূপে উপলব্ধি করা, আর তোমার দর্শনরহিত হয়ে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো, তোমার সম্বন্ধে নানা ভাবের কথা শোনা, নানা কল্পনা-জল্পনা করা, এ দুইয়ে কত তফাৎ! এই যে তোমাকে নিজ আত্মারূপে দেখছি, বিশ্বাত্মা রূপে দেখছি, এতে তো একেবারে সমস্ত সংশয় ছিন্ন হয়ে গেল, তোমাতে আমাতে সব তফাৎ চলে গেল, সব দুঃখ দূর হলো, সুখের উৎস খুলল।




যখন‌ই এই ভেতরকার ঘর ছেড়ে, তোমার দিকে পেছন ফিরে, সাংসারিক জীবনে যাই, তখন সংসার কেমন দেখায়, তোমার সম্বন্ধে আমার মনের ভাব কীরকম হয়, তা তো তোমাকে অসংখ্য বার বলেছি। এই দুই ভাবের সংগ্রাম শেষ করে দিতে হবে। না দিলে আর তোমার সাধনা, তোমার সেবা, আমাকে দিয়ে চলবে না।




তোমার কাছে বসে তো দেখি, সবই তুমি, তুমিছাড়া আর কিছুই নেই। “তুমি আর আমি, মাঝে কেউই নাই।” সমুদয় আলো তোমার চোখের জ্যোতি, সমুদয় শব্দ তোমার বাণী, সমুদয় স্পর্শ তোমারই স্পর্শ, সমুদয় ঘ্রাণ তোমার গায়ের গন্ধ, সমুদয় স্বাদ তোমারই আস্বাদন, সমুদয় চিন্তা তোমার অনুপ্রাণন, সমুদায় কাজ তোমার নিত্য ব্যস্ততা। এ দেখে তো আর হৃদয় শুকনো থাকতে পারে না, আপনাআপনিই প্রেমে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।




এই অবস্থায় যদি আমাকে সর্বদা রাখো, তবে আমার আর কোনও দুঃখ থাকে না, অভিযোগ থাকে না, সংগ্রাম থাকে না, বিনা আয়াসে, প্রসন্ন চিত্তে, তোমার সমুদয় আদেশ পালন করি। কিন্তু আমাকে তো বেশিক্ষণ এই অবস্থায় থাকতে দাও না। তোমার কাছ থেকে আমার চোখ ফিরে যায়, সংসারটাকে অবিশ্বাসী অধার্মিক লোক যেমন তুমিশূন্য মনে করে, আমারও প্রায় তেমন মনে হয়। তোমার কাছে থাকতে জগতকে যেমন দেখেছিলাম, তার অস্পষ্ট স্মরণমাত্র মাঝে মাঝে হয়৷ আমার প্রেমস্রোত শুকিয়ে যায়। আমার কাজ নীরস, আয়াসসাধ্য, এমনকী ক্লেশকর হয়ে যায়। এইভাবে, এই দোটানায়, এই ওঠা-নামায় তো জীবন শেষ হয়ে এল।




তোমার অচ্যুত পদের কথা, ব্রাহ্মী স্থিতি, ব্রহ্মসংস্থার কথা, যোগময় জীবনের কথা, যা প্রথম বয়সেই শুনিয়েছিলে, যার কথা জীবনে কত বার বলেছি, তা তো এখনও পেলাম না। পেলাম না, অথচ পাবো না, এমন কথা তো মনে হয় না। জীবনের এই সন্ধ্যাকালেও মনে হয়, সেই অচ্যুত পদ পাবার সময় এখনও আছে। মনে হয়, সে পদ বেঁচে থাকতে থাকতেই পাবো, নিজের মনকে আর জগতের লোককে দেখিয়ে যাব যে, ধর্ম সত্য, ধর্ম সুখের উৎস, বলের উৎস, সর্বপ্রকার কল্যাণ-চেষ্টার সুদৃঢ় ভিত্তি।




আজ থেকে আবার নতুন চেষ্টা আরম্ভ হোক, তোমার নিত্য ক্রিয়াশীলা কৃপাকে নতুন ভাবে দেখি, সে কৃপাকে সম্বল করে তোমার সঙ্গে নিত্য যোগ সাধনে প্রবৃত্ত হই। তুমি তো আমাকে তোমার কাছে বসে থাকতেই বলছ। তোমাকে ছেড়ে যোগবিতান ভক্তিবিহীন হয়ে কাজ করতে তুমি তো বার বার নিষেধই করছ। অসংখ্য নিষ্ফল চেষ্টার পরেও সফলতায় প্রেরণা দিচ্ছ। এমনকী, নিষ্ফল চেষ্টাগুলি সফলতাকে খুব কাছে এনেছে, এই আশ্বাসও দিচ্ছ। 




তবে মা আলো দাও। তোমার কৃপাস্রোত আমাকে ভাসিয়ে তোমার কাছে পৌঁছে দেবে, তোমার কৃপা ব্যর্থ হবে না, সার্থক হবে, জীবন ধন্য হবে, এই ভরসা দাও।