এই লেখাটি লিখব-লিখব করছি অন্তত গত ৪ বছর ধরে। স্বভাবসুলভ আলস্যবশত আমার হারিয়ে-থাকা লেখাগুলির ভিড়ে এটিও এতদিন ছিল। এটাকে হারিয়ে যেতে দিতে পারিনি বলে আজ এই সংকল্প করে লিখতে শুরু করলাম যে, যত কষ্টই হোক, এটা শেষ না করে চেয়ার ছাড়ছি না। লেখা সময়মত লিখতে না পারার বিপত্তি হচ্ছে, সেসময়ের আবেগ এবং উৎসাহটা হারিয়ে যায়, এবং লেখাটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না অনেকসময়ই। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে প্রচুর। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড় ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে অপূর্ব সুন্দর বিজন বনএলাকা পালামৌতে বেশ কিছুকাল কাজ করেছিলেন। এর বহু বছর পর তিনি তাঁর স্মৃতিতর্পণমূলক লেখা ‘পালামৌ’ লেখেন। যারা এখনও ‘পালামৌ’ পড়েননি, তাদেরকে লেখাটি কেমন, সেটা বোঝানোর জন্য একটা কথাই বলব: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশনা কাজ যখন শুরু হয়, তখন বিশ্বসাহিত্যের এত-এত সেরা বইয়ের মধ্যে কোনটা প্রথমেই ছাপানো যায়, এটা নিয়ে কেন্দ্রের সবাই ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলেন। তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত প্রথম বই হবে ‘পালামৌ’। যা-ই হোক, যে কথায় ছিলাম। কেন লিখি-লিখি করেও লেখা হয়ে ওঠে না, সে কথা নিয়ে বলতে গেলে নিজের এবং অন্যদের প্রতি অনেক অবিচার করা হবে। তাই সে আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে এই লেখার ক্ষেত্রে শুধু এইটুকুই বলব, জীবনের অন্যতম অবিশ্বাস্য ঘটনাটির বর্ণনা লিখতে উত্তেজনায় হাত কাঁপে, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে, সমস্ত শরীরমনে এই ভয় এসে ভর করে—-সেদিনের সবকিছু অন্যরকমভাবে ঘটলে আজকের দিনটা কেমন হত? মনে হতে থাকে, আজকের এই দিনটা কিছুতেই আজকের মতো হত না। আজ আমি থাকতাম অন্যকেউ। আশেপাশের সবকিছুকেই মনে হত অন্যরকমের অন্যকিছু। আসলে আমরা জীবনটা যেভাবে যাবে ভাবি, সেভাবে যায় না। জীবন যায় জীবনের মতোই। জীবনের রঙ কল্পনাতে একভাবে ধরা দেয়, কিন্তু আসল রঙটা অন্যরকম। জীবনটাকে নিয়ে খেলতে খেলতেই জীবনটা পার করে দেবো, এটা ভাবলেই যে ওরকম ভাবেই জীবনটা কেটে যাবে, তেমনও নয়। কী হবে, কী হবে না, এর সবকিছুই আগে থেকেই ঠিকঠাক করা। আমাদের কাজ শুধু এই রঙ্গমঞ্চে নিজের মতো করে চমৎকার অভিনয় করে যাওয়া। যার অভিনয় যত নিপুণ, সে তত ঘনিষ্ঠভাবে জীবনের স্বাদ পায়।
২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২৩ জানুয়ারি ৩০তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। ১২ তারিখ বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র ওয়েবসাইটে দেখলাম, যারা-যারা ৪৫ ব্যাচের এমবিএ প্রোগ্রামের ভর্তি পরীক্ষায় রিটেনে পাস করেছে, আমিও তাদের মধ্যে আছি। কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে রিটেনে পাস-করা ক্যান্ডিডেটদের ইন্টারভিউ নেয়া হবে এবং আমি যে গ্রুপের, সেটির ইন্টারভিউর সময়সূচী ১৭ তারিখ সোমবার সকাল ১০টায় আইবিএ’তে। আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামের ক্যান্ডিডেটদের জন্য পিএসসি নির্ধারিত পরীক্ষার সেন্টার হল ওমর গনি এমইএস কলেজ। আইবিএ’র ইন্টারভিউর দিনেই আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর পরীক্ষা সকাল ১০টা থেকেই। একইসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষা দেয়াটা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। আইবিএ’তে কেউ অতো চান্সটান্স পায় না বলেই জানতাম। সেখানে চান্স পেয়ে যাওয়ার পর সেটাকে মিস করব, নিজেকে এতটা বেকুব আর উদার মনের ভাবতে পারিনি কখনওই। পরেরদিনের বাংলাদেশ বিষয়াবলী ১ম পত্রের পড়াশোনা না করে আইবিএ’তে পড়াশোনা করে কিংবা করেছে, এরকম পরিচিত সবাইকে ফোন করা শুরু করলাম। সেসময়ের প্রবল উত্তেজনার কথা এখনও মনে পড়ে। এমনকিছু যা আপনি খুব করে চাইছেন নিজের করে পেতে, ওটা হাতের কাছে এসেও গেছে, কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, ওটা আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে, এরকম একটা মুহূর্তে স্থির থাকাটা কঠিন। ফোনে যাদের সাথেই কথা বললাম, সবাই একটা কথাই বলল, “তুমি একই সাথে দুটো ভাল জিনিস পাবে না। যেকোনও একটার মায়া ছাড়তে হবে। দুই নৌকায় পা দিলে কোনটাই হবে না। তাছাড়া তুমি বিসিএস পরীক্ষা যেমন আরও দিতে পারবে, আইবিএ’তে ভর্তি পরীক্ষাও আরও দিতে পারবে। যেকোনও একটাকে ছেড়ে দাও।” যাদের কাছে কর্পোরেট সেক্টর অনেক বড় কিছু, তারা বলছিল, বিসিএস ছেড়ে দাও। যাদের কাছে সিভিল সেক্টর অনেক বড় কিছু, তারা বলছিল, আইবিএ’তে পরে পড়ো। কারও কাছ থেকেই কোন বুদ্ধিতে দুটোকেই ম্যানেজ করা যায়, তা পাইনি। ওই মুহূর্তে আমার কাছে কোনওটাই বড় কিংবা ছোট, এমন কিছুই ছিল না, মাথা পুরোপুরি ব্ল্যাংক হয়ে গিয়েছিল, আর মনে হচ্ছিল, লাইফ আমাকে নিয়ে সাপলুডু খেলছে এই মুহূর্তে। লুডুর গুটিতে এমনই সংখ্যামান আসবে যে আমি সাপের পেটেই যাব, এমনটা তো নাও হতে পারে। এমনও তো হয়, যে সংখ্যামান এল, তাতে আমি মই বেয়ে অনেক উপরে উঠে গেলাম। লাইফের সাপলুডুর বোর্ডে তো শুধু সাপই থাকে না, মইও থাকে! এই মুহূর্তের দানে ওই মইয়ে ওঠার সংখ্যাটি আসবে না, এটা কে বলল? লাইফটা সাপলুডুর মতোই, সর্বোচ্চ মানেই সবচাইতে ভাল, এমনটা নাও হতে পারে। হয়তো দুই দুইবার ৬, এরপর ৫ পড়ল, মোট ১৭, অর্থাৎ আমি লুডুখেলায় সবচাইতে বেশিটাই পেলাম, অথচ চলে গেলাম ইয়া লম্বা এক সাপের পেটে, এমনও তো হয়! আবার এমনও তো হয়, কোনও এক দানে সবচাইতে কমটি, মানে ১ পড়ল, আর আমি মই বেয়ে তরতর করে উঠে গেলাম অনেক উঁচুতে। কমের খেলা বোঝাটাই সবচাইতে কঠিন! সবচাইতে বেশিটাই সবচাইতে ভাল, এমনটা নাও হতে পারে। দেখতে হবে, সেটা আদৌ কতটুকু দরকার! অনেক আয়, অনেক নরকযন্ত্রণা; তবে সেই বড় সংখ্যামানের আয়ের কী দরকার? জীবনের সাথে মিলিয়ে ঠিক সংখ্যাটি বেছে নিতে জানাটা অনেক বড় একটি আর্ট!
আমি ভাবলাম, হেরে যাওয়ার আগেই হারব কেন? আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব। বাসায় বাবা-মা’ও বলছিল, যেকোনও একটা ছেড়ে দাও। আমার মন বলছিল, আমি ছাড়ব না, কিছুতেই না! জীবনের সাথে এইবেলা একটু জুয়া খেলে দেখিই না কী হয়! মনের কথা শুনতে হয়। এমবিএ প্রোগ্রাম অফিসে ফোন করলাম। সেখানের দায়িত্বে ছিলেন জাকির ভাই। উনি বললেন, “আইবিএ’র শিডিউল কারওর জন্যই বদলায় না। আপনার শিডিউল বদলান।” আমি বললাম, “এটা তো সম্ভব নয়। আপনাদের তো কয়েকটা স্লট আছে। বিসিএস-এর স্লট তো একটাই।” উনি এরপরও বললেন, “কোনওভাবেই সম্ভব নয়। আমরা সরি!” এটা বলেই উনি ফোনটা রেখে দিলে জেদ আরও চেপে বসল। পরেরদিনের পরীক্ষার পড়াশোনা শিকেয় তুলে রাখলাম। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, আইবিএ’র এমবিএ’র সেসময়ের প্রোগ্রাম চেয়ারম্যান রাহী স্যার। একমাত্র উনি চাইলেই আমার ইন্টারভিউ’র স্লট চেঞ্জ করা সম্ভব। রাহী স্যার অসম্ভব রাগী একজন মানুষ। আইবিএ’র মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মধ্যে সেরা। সে ডিপার্টমেন্টের বেস্ট ফ্যাকাল্টি রাহী স্যার। স্যারের নাম্বার নিলাম। যার কাছ থেকে নাম্বারটা নিলাম, উনি জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি সত্যিসত্যি রাহী স্যারকে ফোন করবে নাকি?” “হ্যাঁ। কেন?” “আমরা স্টুডেন্টরাই স্যারকে কখনও ফোন করার সাহস করি না। আর তুমি এই কাজে স্যারকে ফোন করবে?” “আমি করব। আমাকে করতেই হবে। আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে।” “God bless you, man! You better think twice.” আমি বললাম, “Sometimes life doesn’t give you the opportunity to think twice. It’s the first and the only chance! I must grab it before it’s too late! আমি ফোন করবই। আমি আমার চেষ্টা করব, হলে হবে, নাহলে নাই। চেষ্টা না করলে তো হবেই না। Thank you, ভাইয়া!” উনার সাথে কথা শেষ করেই কোনও চিন্তাভাবনা না করে দিলাম রাহী স্যারকে ফোন। খুবই গম্ভীর কণ্ঠস্বরের একজন মানুষ। কথা বলতেই ভয় লাগে। কিন্তু আমার তো আর হারানোর কিছু নেই। আমি শুধু এটা জানি, আমি আইবিএ’তে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছি এবং আমার ইন্টারভিউ আইবিএ’কে নিতে হবে। আমি সত্যিই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি এক নিঃশ্বাসে আমার সমস্যাটি বলে ফেললাম। রাহী স্যার বললেন, “You silly kid! You’ve dared to call Rahi Sir for this! Did you think I am your friend? It’s not my business whether you can attend the viva board or not. You have only 2 choices: Leave IBA, or, Leave BCS.” অসীম বিস্ময়ে আমি নিজেকে বলতে শুনলাম, “Sir, I have called you to hear about the third choice. If you don’t have that, please make it for me. I know I’ll be at IBA.” স্যার প্রচণ্ড উচ্চস্বরে ফোনে বললেন, “You are a stupid little boy. You just know nothing about the things here! Don’t waste my time. I am busy!” “Sir, please give me a chance. I am………” স্যারকে আর শোনাতে পারলাম না, এর আগেই ফোনটা কেটে দিলেন। আমি বুঝে উঠতে পারিনি, কী হয়েছে, শুধু এটা আরও শক্তভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল, আমি আইবিএ’তে পড়বই। বিসিএস’কে সেই মুহূর্তে কিছু সময়ের জন্য ম্লান মনে হল। কালকে পরীক্ষায় যা হয় হবে। এখন আগে আইবিএ’র ব্যবস্থাটা করতে হবে। দিলাম ফোন প্রোগ্রাম অফিসে। জিজ্ঞেস করলাম, “রাহী স্যারকে কখন আসলে পাওয়া যাবে?” “মানে?” “স্যার আমাকে দেখা করতে বলেছেন।” “স্যারকে জিজ্ঞেস করে নেন, কখন আসলে উনার দেখা পাবেন।” (সাহস করে মিথ্যে বলে ফেললাম….) “স্যার বললেন, প্রোগ্রাম অফিসে ফোন করে জেনে নিতে।” “আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে বলেছেন? কী বলেন! আচ্ছা লাইনে থাকেন, স্যারের ক্লাস শিডিউলটা দেখি।” আমাকে জাকির ভাই জানালেন নেক্সট ফ্রাইডে’তে সন্ধ্যায় এলে স্যারকে পাওয়া যাবে। ‘থ্যাংকয়্যু ভেরি মাচ’ বলে ফোনটা রেখেই সাথেসাথে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম বাসের টিকেট কাটতে। চট্টগ্রামের গরীবুল্লাহ্ শাহর মাজারের ওখান থেকে ইউনিকের ননএসি বাসে বৃহস্পতিবার রাতের জন্য ঢাকার টিকেট কাটলাম। পরদিন প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে বাংলাদেশ বিষয়াবলী ১ম পত্র পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষার হলেও মাথায় ঘুরছিল, “রাহী স্যার আমার কথা রাখবেন তো?” পরীক্ষার খাতায় ভুলে কয়েকবার ‘রাহী’ শব্দটা লিখে ফেলেছিলাম, পরে অবশ্য কেটেও দিয়েছি।
ফ্রাইডে’তে বিকেলের আগেই আইবিএ’তে হাজির হয়ে গেলাম। এমবিএ প্রোগ্রাম অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। জাকির ভাই সেসময় ছিলেন না, ২ ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় এলেন। গিয়ে পরিচয় দিলাম। “ও আচ্ছা, আপনি চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন। রাহী স্যার ইন্টারভিউ’র শিডিউল চেঞ্জ করার ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলবেন বলেছেন? আসলেই??” “জ্বি, আমাকে দেখা করতে বললেন তো!” আমরা কথা বলছিলাম, একটু পরেই রাহী স্যার এলেন। প্রোগ্রাম অফিস হয়েই উনার রুমে ঢুকলেন। সৌম্যদর্শন গম্ভীর প্রকৃতির একজন মানুষ। স্যারের বসার রুমটি প্রোগ্রাম অফিসের ঠিক পাশেই। জাকির ভাই বললেন, “আপনি সোফায় বসেন, আমি স্যারকে জিজ্ঞেস করে দেখি, এখন ফ্রি আছেন কি না।” স্যারকে “চট্টগ্রাম থেকে সুশান্ত পাল নামে একজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন, আপনি আসতে বলেছিলেন” বলাতে স্যার সাথে সাথেই অনেকটা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আমি কাউকে আমার সাথে দেখা করতে আসতে বলিনি। ওকে চলে যেতে বল। ডিসগাস্টিং!” জাকির ভাই আমাকে বললেন, “স্যার দেখা করবেন না, আপনি চলে যান।” “আমি চলে যাব, তবে স্যারের সাথে দেখা করে তারপরই যাব। ভাই, আমি ফিরে যেতে আসিনি। আমাকে দেখা করতেই হবে।” অনেকটা জোর করেই স্যারের রুমে অনুমতি না নিয়েই ঢুকে গেলাম। আমি খুবই বিনীতভাবে “আসসালামুয়ালাইকুম স্যার” বলার পর সালামের উত্তর দিয়ে স্যার বললেন, “কী চাই?” তখন রুমে আরও কয়েকজন স্টুডেন্ট ছিল যারা বিভিন্ন কাজে স্যারের কাছে এসেছিল। “স্যার, আমি আপনাকে পরশু সন্ধ্যায় ফোন করেছিলাম।” “Is it my duty to remember your call? Get out!” কিছুই না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। Get out! কথাটি আমার মাথায় কাজ করেনি, সেসময় আমি শুধু এইটুকুই জানতাম যে, আমি রাহী স্যারের সাথে শিডিউল চেঞ্জ করার ব্যাপারে কথা বলব, এবং স্যার নিশ্চয়ই তা করতে রাজি হবেন। এভাবে করে প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর স্যার বললেন, “Why are you standing here like a statue?” টাইমস্লট চেঞ্জ করার বিষয়ে একটা অ্যাপ্লিকেশন স্যারের টেবিলের সামনে ভয়ে-ভয়ে রেখে বলতে শুরু করলাম, “স্যার, আমি গত পরশু আপনার সাথে ফোনে কথা……..” “Speak in the language I am using now.” “Sir, my interview has been scheduled on the next Monday at 10 in the morning. I am appearing at the 30th BCS written exam. I have an exam at the same time. So, I request you to shift my schedule to another convenient time-slot.” “Sorry, we cannot.” “Please Sir! Otherwise, my dream to be here will be shattered.” “Let it be. Just go for BCS. You will do better being a civil servant.” “But Sir, it’s uncertain.” “Is being here certain for you?” “No Sir, that’s why I cannot leave any of these 2 opportunities. Please Sir, give me a chance. Do me a favour. I will be ever grateful, Sir.” “তোমার একজাম কয়টায়?” “১০টায়, স্যার।” “কতক্ষণের?” “৩ ঘণ্টার, স্যার।” “ওকে ঠিক আছে, একজাম দিয়েই চলে এস। ১:৩০টার মধ্যে আসতে পারবে তো?” বুঝলাম, স্যার ভুলেই গেছেন যে আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। “স্যার, আমি চট্টগ্রাম থেকে পরীক্ষা দিচ্ছি।” “Stupid! We cannot change our schedule for you! Are you Mr President?” “No Sir, I just want to be your student! I will do anything you tell me to do. Please give me a chance, Sir!” “ভাই দেখ, তুমি এমনিতেই ১টায় পরীক্ষা শেষ করে চট্টগ্রাম থেকে এসে পরীক্ষা দিতে পারবে না। রাত ১০টায় নিলেও পারবে না। রাস্তার অবস্থা তো ভাল না, প্রচুর জ্যাম থাকে। বিসিএস’টা ভালভাবে দাও। এমবিএ পরেও করতে পারবে।” “স্যার, আমি সন্ধ্যায় আসতে পারব।” “কীভাবে? প্লেনে?” “জ্বি স্যার। আমাকে একটা সুযোগ দিন, স্যার।” “আচ্ছা। পরেরদিন একজাম নাই তোমার?” “আছে স্যার। আমি ম্যানেজ করতে পারব। রিটার্ন টিকেট কেটে ফেলব।” “কয়টার মধ্যে আসতে পারবে?” “স্যার, আপনি বলেন।” “তোমার একজাম শেষ হবে ১টায়। হুম……. ওকে, তাহলে তুমি ৩টার বোর্ডটাতে আসতে পারবে?” “জ্বি স্যার, আমি ৩টায় আসতে পারব।” “তুমি কি জানো ওইসময়ে ফ্লাইট আছে?” “জানি না, স্যার। জেনে নেবো।” “৩টার দিকে একটা ফ্লাইট আছে বোধ হয়।” “কয়টায় আসতে পারবে?” “৪টায়, স্যার?” “বোকা ছেলে! তোমার মাথা কাজ করছে না। চট্টগ্রাম থেকে ৩টায় প্লেনে উঠে ৪টায় কীভাবে এয়ারপোর্ট থেকে আইবিএ’তে আসবে? ঢাকা শহর সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণাই নাই। ওকে, তুমি ঠিক সোয়া ৫টার মধ্যে চলে আসবে। You will be last person in that board. এরপরে আসলে কিন্তু কিছুই করা যাবে না। সন্ধ্যার বোর্ডটা এক্জিকিউটিভ এমবিএ’র। ওখানে তোমার ভাইভা নেয়া সম্ভব নয়। ওকে?” “থ্যাংকয়্যু, স্যার।” “Youngman, you have decided to play with your life! Best of luck!” “প্রার্থনা করবেন, স্যার। আমি পারব!” আমার চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছিল। বুঝলাম, এই মানুষটার বাইরেরটা অনেক কঠিন হলেও ভেতরটা অনেক নরোম। স্যারের জন্য অনেক প্রার্থনা করে আইবিএ থেকে চলে এলাম। আজিজে গিয়ে কিছু বই কিনলাম। এরপর ফকিরাপুল গিয়ে রাত ১০টার দিকে ইউনিকের ননএসি বাসে সকালে চট্টগ্রামে এসে পৌঁছলাম।
আপনাদের সাথে অ্যাপ্লিকেশনটা শেয়ার করছি:
15 January 2011
The Program Director, MBA Program
Institute of Business Administration
University of Dhaka
Dhaka
Subject: Prayer for changing the time slot of the interview schedule of the MBA Program Admission
Sir,
This letter expresses my earnest request to change my interview schedule of the MBA Program Admission 2010-2011. I am a candidate for Full-Time Course, my admit number is 2745 and I am on Interview Board 6 scheduled to be conducted at the 10:00 am to 1:00 pm time slot on January 17, 2011. I am appearing at the 30th BCS written examination and my Examination Centre is at Chittagong. I have an examination on January 17, 2011, coincided with the same time slot of the interview and so it is not possible for me to come from Chittagong and attend the interview at 10:00 am.
I will be highly obliged if you kindly permit me to attend the interview at the 6:00 pm to 8:30 pm time slot scheduled for Evening Board 3 and Evening Board 4 on January 17, 2011.
Yours faithfully
Sushanta Paul
আমি এর আগে কখনওই প্লেনে চড়িনি। আমি ভেবেছিলাম, যেখানেই যাই না কেন, প্লেনে চড়লেই বুঝি পাসপোর্ট লাগে। বড় ভাই পাসপোর্টের কাজ করে এমন এক বন্ধুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ঢাকায় যাওয়ার ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট করতে কী কী লাগে? ও তো হেসেই খুন! বলল, “দোস্তো, পাসপোর্ট দিয়ে কী করবি? প্লেন আর বাস একই জিনিস। একটা আকাশে ওড়ে, আরেকটা রাস্তায় দৌড়ায়। এই আরকি! তুই জাস্ট একটা টিকেট কিনে ফেল। ব্যস! কোনটা ভাল? জিএমজি’তে যেতে পারিস। ওটা ভালই।” আমি জানতাম না যে প্লেনের টিকেট কাটতে এয়ারপোর্টে ছুটতেই হয় না। টিকেটের দাম জানতাম না। সকালে বাস থেকে নেমেই ডাচবাংলা ব্যাংকের বুথে গিয়ে ১০ হাজার টাকা তুললাম। এরপর একটা সিএনজি’তে চেপে এয়ারপোর্টে ছুটলাম। জিএমজি এয়ারলাইন্সের কাউন্টার থেকে ১৭ তারিখ সোমবারের ৩:২০টার ফ্লাইটের একটা টিকেট কিনলাম। দুপুরে ওটাই চট্টগ্রাম-ঢাকা’র প্রথম ফ্লাইট। রিটার্ন টিকেট করলাম একই দিনের রাত পৌনে আটটার ফ্লাইটে। মনে হচ্ছিল, চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আমি আইবিএ’তে ক্লাস করছি! অদ্ভুত একটা দৃশ্যকল্প! অনেকটা যুদ্ধজয়ের আনন্দে হাসিমুখে বাসায় ফিরলাম। যেন আমি আইবিএ’তে চান্স পেয়েই গেছি! রাতে আইবিএ’র ভাইভা’তে কী কী জিজ্ঞেস করতে পারে, সে সম্পর্কে বিভিন্ন গাইড আর ইন্টারনেট থেকে প্রিপারেশন নেয়ার চেষ্টা করলাম। ৪-৫ ঘণ্টা ওটাই পড়লাম। একই সময়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম: How much time does it take to reach Dhaka University from Dhaka International Airport? Is it possible to reach in 40 minutes? Friends, any suggestion, please? সত্যিই খুবই সরল ধরনের মানুষ ছিলাম সেসময়। পৃথিবীটাকে খুব সহজভাবে দেখতাম। ঢাকা শহরে খুব একটা আসা হয়নি বলে ২০১১ সালে এয়ারপোর্ট থেকে শাহবাগে যে ৪০ মিনিটে পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেটা জানতাম না। সবাই বলছিল, এয়ারপোর্ট থেকে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছতে বিকেলে মিনিমাম ২ ঘণ্টা সময় লাগবে। স্ট্যাটাসের রিপ্লাইয়ে বিচিত্র ধরনের সব কমেন্ট এসেছিল। অনেকেই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করা শুরু করে দিল। বন্ধুদের কিছু-কিছু সাজেশন শেয়ার করছি: “দৌড়ালে সম্ভব।” “খুব ভাল হয়, যদি তুমি জগিং করে করে ভার্সিটিতে যাও। বিকেলের ব্যায়ামটাও হয়ে যাবে!” “খামাকা প্লেনের টিকেট করলে! ওই টাকা দিয়ে আমাদেরকে একটা পার্টি দিয়ে দিলে আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করতাম আর তোমার বিসিএস’টা হয়ে যেত! হাহাহাহা…..” “ইয়াংম্যান! তোমার বয়স কম, প্লেন থেকে নেমেই একটা দৌড় দিয়ো! দেখবে, সময়ের আগেই পৌঁছে গেছ!” “শোনো, অমুক বাস অমুক-অমুক রুটে চলে। তুমি ঝুলতে-ঝুলতে ঘুমাতে-ঘুমাতে ঠিকই আইবিএ’তে পৌঁছে যাবে!” এরকম অনেক উদ্ভট সব কমেন্ট পেলাম। আমি তখন ঢাকার একেবারে কিছুই চিনি না। কাদায় পড়েছি, সবাই একটু লাথি না মারলে হয় নাকি? মনে হতে লাগল, জীবনটা এমনই! লোকে টেনে তুলতে হাত বাড়াতে পারে না, লাথি মেরে ফেলে দিতে পা ঠিকই বাড়াতে পারে! কারওর কোনও কথাতেই বিন্দুমাত্রও হতাশ না হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম, কেউ ভাল কোনও বুদ্ধি দেয় কি না দেখার জন্য। কারওর কোন রিপ্লাইয়েই বিন্দুমাত্রও রিঅ্যাক্ট করিনি সেদিন। মানুষ বিপদে পড়লে কেমন অসহায় শান্ত হয়ে যায়। আমি শুধু এইটুকুই জানতাম, “আমি ১৭ তারিখ আইবিএ’তে ইন্টারভিউ দিচ্ছি।” একজন লিখল, “আপনি বাইকে যেতে পারেন। এর চাইতে দ্রুত কোনওভাবেই ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছানো সম্ভব নয়।” কেউ-কেউ সেই বুদ্ধিটাকে সাপোর্টও করল। দুএকজন ট্যাক্সি ক্যাবের কথা বলল। বাইকের পক্ষেই সমর্থন বেশি ছিল। আমি এর আগ পর্যন্ত লাইফে বাইকে চড়েছিলাম গুনেগুনে বড়োজোর ২-৩ বার। ঢাকায় থাকে, বাইক আছে, এমন কাউকেও তেমন একটা চিনি না, কিংবা চিনলেও তখন মাথা একটুও কাজ করছিল না। এখন মাঝেমাঝে ভাবি, হায়! একটা বাইক ম্যানেজ করার মতো সাধ্যও আমার সেসময় ছিল না। লিখলাম, “My flight is scheduled to land at Dhaka Airport at 4.10 pm on 17 January. I must reach Dhaka University at or before 5.15 pm. I’ve an interview at IBA at that time. . . . Can’t I do it? Is it not possible? I need to do it at any cost. As I don’t know about the routes of Dhaka City, I’m asking for your help. Dhaka City is an unknown city to me. Can a taxi cab help me reach there in 1 hour? I can’t be late, otherwise I’ll miss the interview schedule. I’ve managed that schedule today through an application. . . Can a bike be a better solution? Or, something else? I’m in great trouble. . . . ” এটা দেয়ার পর আবারও লোকজনের ঠাট্টা, হাসি-তামাশা শুরু হল। যে বিখ্যাত ভদ্রলোক (উনি বাংলাদেশের শীর্ষ সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন) আমাকে জগিং করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাকে রিপ্লাই দিলাম, “Thank you Sir for you ‘jogging’ suggestion. I was also seriously thinking of this option. Yes, I’ll surely manage to reach in time by vehicles, on foot, again by vehicles, again on foot . . . . And, I’ll go. I’ll be there in time by any means.” একজন বললেন, “শিডিউলটা আরও একবার বদলাও।” আমি লিখলাম, “The schedule can’t be changed! Hopefully, there will happen some miracle and I’ll manage to avail the schedule in time.” এক ছোটভাই লিখল, “দাদা, আপনি ট্যাক্সিক্যাবেই যান। তবুও একবার বাসে ট্রাই করতে পারেন। ঢাকার বাস ভালই দৌড়ায়!” উত্তর দিলাম, “Brother, I’m not surely making any attempt of getting on a bus! That’ll be horrible, you know. I was just seeking for a suggestion as I don’t know about the route. Thanks for the suggestion. I think a CNG powered taxi can help me in this regard. A taxi-cab is prone to getting stuck up in the congestion forever. A bike could be a better solution. But, I can’t manage it.”
জোহরা বিবি ইরা নামের একজন অত্যন্ত অভিজাত ভদ্রমহিলা কমেন্ট করলেন, “আপনার একটা বাইক দরকার?” “হলে ভাল হত।” “আচ্ছা, দেখছি।” উনি ছিলেন ওয়ান ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রিতে পড়াশোনা শেষে এমবিএ করেছিলেন আইবিএ’তে। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করেন, কিন্তু উনাকে চেনেন না, এমন লোক খুব বেশি নেই। আমার এক দিদি আছেন। উনার নাম শারমিন মুইজ খান। সেসময় আমার মতো একেবারে নগণ্য একজনকেও তেমন কোনও কারণ ছাড়াই অনেক অনেকবেশি ভালোবাসেন, আদর করেন, এরকম দুএকজন মানুষের মধ্যে উনি একজন। উনি ছিলেন প্রায় আমার মায়ের বয়সি, কিন্তু আমি উনাকে ‘তুমি’ করে ডাকতাম আর উনি আমাকে ‘তুই’ বলে ডাকতেন। উনি পড়াশোনা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। আমার লেখা বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। উনি ছিলেন একজন বিজনেস ম্যাগনেট এবং অনেক বড়-বড় মানুষজনের সাথে উনার সখ্যতা ছিল। উনার মতন অভিজাত, রুচিশীল, মার্জিত, নিপাট ভদ্রমহিলা আমি খুব বেশি দেখিনি। উনি কমেন্ট করলেন, “বাপ্পি, তোকে ধরে একটা মার লাগানো দরকার। সবাইকে ডেকে-ডেকে কনফিউসড হতে খুব ভাল লাগছে কি? Please stop wasting your time browsing Facebook and concentrate on tomorrow’s exam. Otherwise, you’re calling for another disaster. There is a saying: ‘Que sera, sera’ meaning: Whatever will be, will be. So, pray and try your best. I have given this opinion after a lot of serious thoughts. Please follow it. তুই এখনই যাবি এখান থেকে। তোকে যেন আর একটাও কমেন্ট করতে না দেখি! MIRACLES HAPPEN IF YOU BELIEVE IN YOURSELF!” আমি রিপ্লাই দিলাম, “Didi, things are that they’re. Things will be that they will be. And, between this two there lie some miracles that we’re never aware of. And, miracles are often stranger than facts. Facts are because they’re. Miracles are because we or someone else wants them to be. That’s the truth!” উনি ফোন করলেন জোহরা ম্যাডামকে। বললেন, “দেখ ইরা, আমার ভাইটি একটু বিপদে পড়ে গেছে। বেচারা বোকাসোকা মানুষ, আমাদের কিছু একটা করা উচিত ওর জন্য। তুমি ওকে একটা বাইক ম্যানেজ করে দিতে পার না?” এর একটু পরেই আমার ইনবক্সে জোহরা ম্যাডামের একটা মেসেজ দেখলাম, “Please give me your contact number. Regards” সাথে-সাথেই দিলাম। কল এল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। পরিচয় দিয়ে বললেন, “আপনার তো সোমবার বিকেল ৪টায় একটা বাইক দরকার, রাইট?” “হলে খুব ভাল হত।” “OK, a bike will be there for you at 4. My colleague Romel will pick you. Alright?” “আমি সত্যিই অনেক-অনেক কৃতজ্ঞ। অনেক-অনেক থ্যাংকস!” “কাজটা আগে হোক, এরপর ধন্যবাদ দেবেন। আমি আপনাকে রোমেলের নাম্বারটা টেক্সট করছি। ভাল থাকবেন।” বলেই ফোন রেখে দিলেন। উনাকে লিখে পাঠালাম, “Life is stranger than fiction, I repeat. From myself, I’ve got much less than I truly deserve. From others, I’ve got much more than I truly deserve. Is it the thing that they call miracle? I don’t know and never try to know. I let miracles happen and thankfully they always happen . . . . . . . Thank you for your generous approach. This really means a lot to me.” আমি আমারটা লিখলাম। জানি না, উনি এটা আদৌ পড়েছেন কিংবা পড়ার সময় পেয়েছেন কি না। মহৎ মানুষেরা ধন্যবাদের অপেক্ষায় থাকেন না। তার উপর উনি সত্যিই অনেক অনেকবেশি ব্যস্ত থাকেন। ওয়ান ব্যাংকের ক্রেডিট সেকশনের ইনচার্জ উনি। উনার আমার মতো নোবডিকে চেনার কোনও কারণ নেই, তবুও চিনতেন আমার লেখার মাধ্যমে। নাহলে উনার সাথে সরাসরি কথা বলার সৌভাগ্য আমার হওয়ার কথা না। আর শারমিন দিদি আমার জন্য উনাকে বলেছিলেন, এটাও একটা বড় ব্যাপার ছিল। পরেরদিন বাংলাদেশ বিষয়াবলী ২য় পত্রের পরীক্ষা। আমি তার কিছুই না দেখে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন পরীক্ষার হল থেকে সরাসরি প্রবর্তকের মোড়ে ওয়েস্টেক্সের শোরুমে গেলাম। আমার লাইফের প্রথম ইন্টারভিউ। অনেক বেশি এক্সাইটেড ছিলাম! ঠিক করেছিলাম, একেবারে নতুন সবকিছু পরেই ভাইভা বোর্ডে যাব। ফর্মাল হোয়াইট শার্ট, ব্ল্যাক প্যান্ট, ব্ল্যাক টাই, ব্ল্যাক বেল্ট, ব্ল্যাক সকস্, হোয়াইট গেঞ্জি, ব্রাউন ‘ইয়ে’ কিনলাম। পরে গ্যালারি অ্যাপেক্স থেকে ফর্মাল অক্সফোর্ড শু আর টাইম জোন থেকে টাইটানের রিষ্ট ওয়াচ কিনে বিকেলের পর বাসায় ফিরলাম। মা আমার কাণ্ড দেখে হাসছিলেন। “মা, হাসছ কেন?” “এমনি বাবা।” মজার ব্যাপার হল, মা আমার সাথে প্রতিদিনই পরীক্ষার হলে যেতেন। একেবারে বাচ্চাদের মতোই সবসময়ই আগলে-আগলে রাখতেন। মা বললেন, “আমি কালকে তোর সাথে এয়ারপোর্টে যাব।” গিয়েছিলেনও; আমার নিষেধ সত্ত্বেও।
১৭ তারিখ, সোমবার। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর পরীক্ষা। টেনশনে পরীক্ষার পুরো সময়টা হলে থাকলাম না। আমার তো আর গাড়ি নেই, যদি সিএনজি’তে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়! যদি ফ্লাইট মিস করে ফেলি! ৩:২০টায় ফ্লাইট। আর ওমর গনি এমইএস কলেজ থেকে দুপুর ১টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা লাগার কথা। আমাদের লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল শীতকালে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাতের আঙুলগুলি জমে যেত। তবুও বারবার দুইহাতের তালু ঘষেঘষে গরম করে, মুখ থেকে গরম হাওয়া দুইহাতের খোপের ভেতর চালিয়ে দিয়ে লিখলাম নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। ১টার পরিবর্তে ১২:৩০টায় পরীক্ষা শেষ করে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হল থেকে বের হয়ে গেইটে আসার পর সবাই ভাবছিল, আমি বোধ হয় এক্সপেল্ড হয়ে গেছি! প্রচণ্ড টেনশনের ছাপ মুখের উপরেই ফুটে উঠেছিল। অনেকেই আমাকে সহানুভূতি দেখালেন, দুঃখ করতে নিষেধ করলেন, পরের বিসিএস’টা ভাল করে দিতে বললেন। আমার উত্তর দেয়ার সময় ছিল না। উত্তর দেবো কী, ওইসময়ে জীবনটাই ছিল আমার কাছে বিশাল একটা প্রশ্ন! মায়ের শরীরে কী শক্তি ভর করেছিল, আমি জানি না। মা আমার চাইতে দ্বিগুণ গতিতে অনেকটা দৌড়ে কলেজপ্রাঙ্গন থেকে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। একটা সিএনজি’তে দরাদরি না করে প্রায় দেড়গুণ ভাড়ায় উঠে গেলাম। উনাকে বললাম, আপনি যেভাবেই পারেন, দুই ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন, প্রয়োজনে আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো। তখন ঘড়িতে ১২:৫০টা। সিএনজি ছুটতে লাগল। মা টিফিনবক্স খুলে খিচুড়ি, মাংস আর ডিমভাজি খাইয়ে দিলেন। আমার মাথায় একটা ব্যাপারই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, “প্লেন ধরতে পারব তো? জ্যামে আটকে গেলে তো সব শেষ!” আমি গায়ের সোয়েটারটা খুলে ফেললাম। ভাইভার ড্রেস শুধু টাই ছাড়া বাকিটা পরেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম। ২বার ছোটখাটো জ্যাম থেকে ছুটে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন ৩টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। নেমেই মাকে আর মাসিকে প্রণাম করে (আমার দূরসম্পর্কের এক মাসি আমাদের সাথে এসেছিলেন, মা তো আর একা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরতে পারবেন না, তাই) দৌড়ে কাউন্টারে ছুটে গেলাম। গিয়ে শুনি, ঘন কুয়াশার কারণে ১ ঘণ্টা ফ্লাইট ডিলে। ভাবলাম, ওইসময়ে প্লেন ছাড়লে তো আইবিএ’তে কোনভাবেই ৫:১৫টার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কাউন্টারের ওদেরকে জানালাম এটা। ওরা বলল, কিছুই করার নেই, ওরা খুব দুঃখিত। খবর নিয়ে জানলাম, ওইসময়ে অন্যকোনও ফ্লাইটও ছাড়ছে না। সেই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল, শুধুই কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কেউ নেই, আমার কেউ নেই! কাউন্টারে-কাউন্টারে ঘুরতে লাগলাম। জানতে পারলাম, বাংলাদেশ বিমানের একটা ফ্লাইট আছে যেটা ৩:৪৫টায় ছাড়বে। এর আগে আর কোনও ফ্লাইটই নেই। ওটা বড় প্লেন, পৌঁছতে লাগে ৩০ মিনিট, অন্য প্লেনের যেখানে লাগে অন্তত ৪০ মিনিট। মানে, আমি সোয়া ৪টার মধ্যেই ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাব! তখনই টিকেট কিনে ফেললাম। মনের মধ্যে বড় আশা, যদি এটা ঠিক সময়েই ছাড়ে, তবে আর চিন্তা নেই। এয়ারপোর্টের রেস্টরুমে গিয়ে দ্রুত টাইটা পরে ফেললাম। শার্টের ইনটা আরও একবার ঠিক করে নিলাম। লুকিং গ্লাস দেখে হাত দিয়ে চুলগুলি ঠিক করে নিলাম। ৩:৪৫টা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা ৪টা ছুঁল। কুয়াশার জন্য প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে। আমরা সবাই সোয়া ৪টায় প্লেনে উঠে বসলাম। জীবনে প্রথমবারের মত প্লেনে উঠেছি। বারবারই মনে হচ্ছিল, কখন ছাড়বে, কখন ছাড়বে! প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছিল একেকটা ঘণ্টা! টেনশনে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তবু প্লেন ছাড়ে না। মনে হচ্ছিল, ইসস! যদি নিজের সবটুকু শক্তি খরচ করে হলেও প্লেনটাকে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারতাম! রুমালটা চোখের উপর চেপে ধরে কান্না লুকালাম। অবশেষে প্লেন ছাড়ল। ঘড়িতে তখন ৪:৩৭টা। ভাবছিলাম, ইসস! প্লেনটা যদি ট্যাক্সিং না করেই সরাসরি উড়ে যেতে পারত! দুএক মিনিট অন্তত বেঁচে যেত! ঢাকার রানওয়েতে প্লেন নামল ৫:১৩টায়।
ডোমেস্টিক টার্মিনাল দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে বের হয়ে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে দেখলাম একটা মোটরসাইকেল ঠিক আমার সামনে এসে থামল। “আপনি সুশান্ত, রাইট? পিছনে বসুন!” কালো হেলমেট-পরা যুবকটির সাথে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি ব্ল্যাকগ্লাভস-পরা ডান হাতের পাঞ্জাটি হ্যান্ডশেক করার জন্য ওঠালেন না। “সময় নষ্ট হচ্ছে, ভাই! প্লিজ উঠুন! কুইক!” আর কথা বাড়ালাম না। “আপনি বোধ হয় বাইকে চড়তে অভ্যস্ত না, ঠিক না?” “হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?” “ভাই, আমি বাইক চালাই গত ১৮-২০ বছর ধরে। আমি বুঝতে পারছি।” “আচ্ছা।” “সামনের দিকে ঝুঁকে আমার পিঠে আপনার বুকটা শক্ত করে লাগিয়ে বসুন! আমাকে জড়িয়ে ধরেও বসতে পারেন, নাহলে ছিটকে পড়ে যাবেন। শিওর! আমি জোরে চালাবো।” বাইকটা এয়ারপোর্ট থেকে যেভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেকথা আজ আমার ভাবতেও সাহস হয় না। স্বাভাবিক অবস্থায় হলে আমি হয়তোবা ভয়ে চিৎকার করে উনাকে থামাতে বলতাম কিংবা সত্যিই ছিটকে পড়ে যেতাম। কিন্তু সেসময় আমি জানতাম, এই মুহূর্তে ভয় পাওয়াটা যতটা জরুরি, তার চাইতে অনেকবেশি জরুরি জীবিত অবস্থায় আইবিএ’তে পৌঁছানো। ১৫০ সিসি বাইকের চাকা সেদিন সত্যি-সত্যি মাটি ছুঁয়েছিল কি না জানি না, তবে আমি এটা জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো বুঝতে পারলাম, স্বপ্নছোঁওয়ার জন্য যে জীবনবাজি রাখে, তাকে ভয় দেখানো সম্ভব নয়। কোনও বাইক ওরকম রেকলেসভাবে রাস্তায় ছুটতে পারে, এটা আমি শুধু মুভিতেই দেখেছি। আক্ষরিক অর্থেই বাতাসের শোঁশোঁ শব্দকে কাটিয়ে-কাটিয়ে বাইক যেন হাওয়ায় ছুটে যাচ্ছিল! “আচ্ছা ভাই, আপনি কি অনেক বড় কেউ?” “মানে?” “না, ম্যাডাম বললেন, উনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন বন্ধুকে যে করেই হোক, আধা ঘণ্টায় এয়ারপোর্ট থেকে আইবিএ’তে পৌঁছে দিতে হবে। এটা উনার অর্ডার! আপনি কে ভাই? হাহাহাহা………” “আমি ম্যাডামের ফেসবুক ফ্রেন্ড।” “কন কী মিয়া? ক্যাম্নে কী! আমি তো আরও ভাবলাম….. মানে উনার সাথে আপনার কোনওদিনও দেখা হয়নি?” “না ভাইয়া। কেন?” (সামনে একটা রেললাইন। ব্যারিয়ারটা নামছে।) “ভাই, মাথাটা একটু নিচু করেন।” বলেই উনি সিগন্যাল না মেনেই দ্রুত ব্যারিয়ারের নিচ দিয়ে বাইক চালিয়ে নিলেন। পেছন থেকে অনেকেই চিৎকার করে থামতে বলছিলেন। “ভাই, আপনি জাস্ট ভয় পাবেন না। কিছুই হবে না। চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন চাইলে।” ঠিক ওইসময়ে দুটো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে-থাকা ট্রাকের মাঝখান দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “একটু ছোট হয়ে বসেন, ভাই!” এর কিছুদূর পরেই বিশাল সিগন্যালের জ্যাম! রোমেল ভাই বাইক তুলে দিলেন ফুটপাথের উপরে। “ভাই, প্লিজ একটু সাইড দেন, একটু সাইড দেন।” বলে-বলে সামনের দিকে ছুটছিলেন। এরকম কয়েকবারই করতে হয়েছে উনাকে। কখনও-কখনও রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের উপরে বাইক তুলে ছোটার সময়ে ট্রাফিক পুলিশ এসে ধরলে কাঁদো-কাঁদো স্বরে “স্যার, আমার খালা মেডিক্যালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। আমি রক্ত দিতে যাচ্ছি। ও-নেগেটিভ রক্ত, পাওয়া যাচ্ছে না। সময়মত পৌঁছাতে না পারলে খালাকে বাঁচানো যাবে না, স্যার!” বলেই পুলিশকে ম্যানেজ করে আবার সেই গতিতে ছুট! যখনই রাস্তায় জ্যাম লেগে যাচ্ছিল, তখনই রাস্তা বদলে অন্য রাস্তা। সেদিন বুঝলাম, রাস্তায় বাধা আসা মানেই কিন্তু রাস্তা নেই, তা নয়। বরং এর মানে, অন্য রাস্তা ধরতে হবে! এখুনিই!! ওরকম দুর্ধর্ষ বাইকিং আমি শুধু হলিউডের অ্যাকশন মুভিতে দেখেছি। বাইকের মিররে আমার চুলগুলি দেখে মনে হচ্ছিল, যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে গেছে! চোখেমুখে রাজ্যের ধুলোবালি। প্রচণ্ড হাওয়ায় গলার টাইটা ওপরে উঠে শূন্যে উড়ছে পেছন দিকে। অফিসছুটির সময়ে ঢাকার রাস্তায় এরকম রেকলেসলি বাইক চলতে কেউ কখনও দেখেছে কি না, আমি জানি না। তবে আমি, কেন জানি না, সত্যিই একটুও ভয় পাইনি। বারবারই মনে হচ্ছিল, “কতটা কম দেরি করে আইবিএ’তে পৌঁছানো যায়!” রোমেল ভাই ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ব্যাংকে জয়েন করেছিলেন। উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ব্যাংকে আপনার ডেজিগনেশনটা কী?” উনি মজা করে বলেছিলেন, “বেশি না, আর মাত্র ১৪টা প্রমোশন পেলেই আমি জোহরা ম্যাডামের চেয়ারে বসতে পারব। হাহাহাহা…….”
যখন আইবিএ’র সামনে এসে পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে ৫:৫২। নেমেই দেখলাম আইবিএ’র সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটভাই পাপ্পু আর ওর ফ্রেন্ড আরেফিন। তখন আমার গিফটশপ ‘দোভানা’ ছিল। পাপ্পু আর আরেফিন ছিল আমার ওয়ার্কিং পার্টনার। ওরা পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে দোকানের জন্য পাইকারি দরে মালামাল কিনতে প্রায়ই ঢাকায় আসত। আমি বিসিএস পরীক্ষার জন্য দোকান থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম। ওরাই সবকিছু চালাত। দোকানের মালামাল কেনার কাজে আগে থেকেই ওরা ঢাকায় ছিল। ওদেরকে বলেছিলাম, আইবিএ’র এমবিএ প্রোগ্রাম অফিসের সামনে গিয়ে আমাকে একটু পরপর ফোনে আপডেট জানাতে ভাইভা বোর্ডের কী অবস্থা। ওদের সাথে বারবার কথা বলে-বলে জেনে নিচ্ছিলাম, ইন্টারভিউ বোর্ড এখনও আছে কি না, প্রোগ্রাম অফিসে গিয়ে যেন বলে, আমি ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় ঠিক সময়ে আসতে পারছি না, রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমি নামামাত্র ওরা জানাল, “দাদা ৪-৫ মিনিট আগে বোর্ড উঠে গেছে। এখন শুধু এক্জিকিউটিভ এমবিএ’র ভাইভা বাকি।” রোমেল ভাইকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমি দৌড়ে দোতলায় এমবিএ প্রোগ্রাম অফিসে গেলাম। আমাকে দেখেই ওখানকার সবাই কাজ ছেড়ে একবার আমার দিকে তাকালেন। রাহী স্যারকে দেখলাম কী একটা যেন কাজে ব্যস্ত, আমার সালামের উত্তর দিলেন না। “স্যার, আমার আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারিনি। আমি……..” আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি অনেকটা চিৎকার করে বললেন, “You Idiot! Get out!” “স্যার, আমি………” “I said, Get out! Out! Out!! আমি খুব ভাল করেই জানতাম, তুমি ঠিক সময়ে আসতে পারবে না। চিটাগাং থেকে একটা একজাম দিয়ে ঢাকায় এসে আরেকটা একজাম দেয়া যায় নাকি? এত সহজ? শুধু-শুধু আমার সময় নষ্ট করলে! সবাইকে বলে রেখেছিলাম, চিটাগাং থেকে একটা ছেলে সোয়া ৫টায় আসবে, ওর ভাইভা নিতে হবে। Did you think I am a joker?” “স্যার, আমি অনেক কষ্ট করে এসেছি। ফ্লাইট ডিলে করেছে, রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। আমি আসলেই……..” “It’s none of my business! Get out! যেখান থেকে এসেছ, সেখানে চলে যাও।” “স্যার, আমার অনেক স্বপ্ন ছিল আইবিএ’তে পড়ার।” “ওরকম স্বপ্ন রাস্তাঘাটের সবারও থাকে। I gave you a chance but you missed it. That’s all! বেরিয়ে যাও এখান থেকে।” “স্যার, একটু দয়া করেন……..” (ইচ্ছে করছিল, স্যারের পায়ে পড়ে কেঁদে ফেলি……) পাশেই স্যারের চাইতে অনেক কম বয়সি একজন সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক বসেছিলেন। উনি বললেন, “স্যার, উনার সম্পর্কে আমি শুনেছি। উনার ছোটভাই বারবার আমাদের প্রোগ্রাম অফিসে আসছিলেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে ওরা অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। উনার ফ্লাইট আসলেই ডিলে করেছে। আর আজকে ঢাকার রাস্তায়ও অনেক জ্যাম। আমার এক বন্ধু কিছুক্ষণ আগে আমার রুমে এল এয়ারপোর্ট থেকে; ওরও আসতে অনেকক্ষণ লেগেছে। উনাকে একটা সুযোগ দিন, স্যার। এতদূর থেকে এত কষ্ট করে রিস্ক নিয়ে এসেছে! কালকেও নাকি একটা রিটেন একজাম আছে। বেচারাকে আজকেই আবার চট্টগ্রামে ফিরতে হবে।” “বাবু, তোমরা জুনিয়র ফ্যাকাল্টিরা কী বল, কী ধরনের রিকোয়েস্ট কর, তোমরা নিজেরাই তা জানো না। ওর জন্য ওকালতি করছ কেন? ও কি তোমার আত্মীয় নাকি?” “না না স্যার, উনাকে তো আমি দেখলামই আজকে প্রথম। বেচারার চোখমুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, স্যার। আসলেই অনেক কষ্ট করে এই পর্যন্ত এসেছেন। একটু ফেভার করুন, স্যার।” “You have no idea what you are talking about! এক্জিকিউটিভ এমবিএ’র ভাইভা আর ওদের ভাইভা কি একইরকমের হবে নাকি? ওদের চাকরির এক্সপেরিয়েন্সই আছে ৩ বছরের, আর সে তুলনায় তো এরা শিশু! এটা পারা যাবে না, ভাই। আই অ্যাম সরি!” “স্যার, একটু হেল্প করেন বেচারাকে। অনেক আশা নিয়ে এতদূর থেকে এসেছেন!” “বাবু, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না!” আমি মাথা নিচু করে একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে উঁচু গলায় বললেন, “এই স্টুপিড! গাধার মতন দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, তিনতলায় যাও! গিয়ে একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। তোমাকে আমরা ডাকব।” আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না, এর চাইতে সুন্দর মুহূর্ত পৃথিবীতে কখনও কোথাও এসেছিল কি না! আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। বাবু স্যারের জন্য বারবার মন থেকে প্রার্থনা করলাম। রাহী স্যারকে মনে হচ্ছিল আমার পিতৃতুল্য। মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার: “স্যারদের বকায় কক্ষনো রাগ করতে নেই। স্যারদের বকা মানে, আশীর্বাদ।” প্রচণ্ড আবেগাপ্লুত হয়ে স্যারদেরকে ধন্যবাদ আর সালাম দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় রাহী স্যার পেছন থেকে বলে উঠলেন, “এই পাগল! বোর্ডে ঢোকার আগে চুলগুলি আঁচড়ে নিয়ো! বেসিনে মুখ ধুয়ে ফেলো! এত ভয় পেয়ো না! হাহাহা…….” আর কিছুই বলতে পারলাম না। স্যারের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। দুই চোখের জলে আমার গাল ভিজে গেছে। বাবু স্যার আমার কাঁধে হাতটা রেখে বললেন, “যান, যান, উপরে গিয়ে ওয়েট করুন। We are not that much bad people as you thought us to be. Sometimes even the IBA faculties are too good! ফ্রেশ হয়ে নিন, ভালভাবে ইন্টারভিউ দিন, এখন তো আর কোনও টেনশন নেই। কালকে কী পরীক্ষা?” “স্যার, গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা।” “যাবেন কীভাবে?” “স্যার, প্লেনের রিটার্ন টিকেট করা আছে।” “গুড! আরে ভাই, চোখেমুখে পানি দিয়ে চেহারা ঠিক করেন। ভাইভা দিয়ে দ্রুত এয়ারপোর্টে দৌড়ান! Good luck!” ওই মুহূর্তে ইচ্ছে করছিল, স্যারকে পা ছুঁয়ে সালাম করি। মুহূর্তের তীব্র ভালোবাসায় মানুষ ভয় পেয়ে যায়। প্রথমবারের মতো হঠাৎই মাথায় এল, “আমি যদি স্যারদের এই ভালোবাসার সম্মান রাখতে না পারি? শেষ পর্যন্ত যদি আইবিএ’তে চান্স না পাই?”
আমরা যখন বিপদে পড়ি, যদি নিয়ত ভাল থাকে, একটা উপায় বের হয়ে যায়ই! তিনতলায় ওয়াশরুমে গিয়ে চুলগুলিকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে বসিয়ে-বসিয়ে যথাসম্ভব ‘মানুষ করা’র চেষ্টা করলাম। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে নোটিসবোর্ডের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ১০ মিনিট পর আমাকে ডাকা হল। ঘড়িতে ৭টা ছুঁইছুঁই। একটা রুমে গিয়ে দেখলাম, অনেক স্যার বসে আছেন। ইন্টারভিউতে এত স্যার থাকেন, আগে জানতাম না। ভাবলাম, আইবিএ’র ইন্টারভিউ বোধ হয় এরকমই। পরে জেনেছিলাম, শুধু আমার জন্যই ওই বোর্ডটা বসানো হয়েছিল। বাবু স্যার আর রাহী স্যার ছাড়া আর কাউকেই চিনতাম না। ভর্তি হওয়ার পর বুঝেছি, ওখানে সেদিন সন্ধ্যায় যারা ছিলেন, তারা আইবিএ’র সবচাইতে সিনিয়র এবং দক্ষ ফ্যাকাল্টি। সাইফুল মজিদ স্যার, শামা-ই-জহির স্যার, মামুন স্যার, মুনির খসরু স্যার, নিয়াজ স্যার, সাইফ নোমান খান স্যার ছিলেন সেই বোর্ডে। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিরা বেশিরভাগই ভাইভা নিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিলেন, কিছু সিনিয়র স্যার নিজেদের রুমে বসেছিলেন এক্জিকিউটিভ এমবিএ’র ভাইভা নেয়ার জন্য। উনাদের কাউকে-কাউকে ডাকা হয়েছিল। ভাইভা বোর্ডে ছিলাম প্রায় ১৮-২০ মিনিট। স্যারদের অনেকেই আমার সেদিনের ব্যাপারটা জানতেন। ‘ভর করা’ বলে একটা ব্যাপার জীবনে কখনও শুনেছিলাম। মানুষ বিশেষ-বিশেষ সময়ে বিশেষ কিছু বাহ্যিক প্রভাবক কিংবা পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ করেই বিশেষ শক্তি লাভ করে। সেসময় সে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে ভিন্ন রকমের আচরণ দেখায়। ভেতরের অসীম শক্তির সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগাতে পারে। আবেগ আর ক্ষমতার আশ্চর্য সুষম সংমিশ্রণে ভেতরকার সেরা মানুষটিই বেরিয়ে আসে। আমি ভাইভা বোর্ডে ঢোকার পর থেকে খুব সম্ভবত অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম কিংবা আমার ভেতরের সবচাইতে সেরা ‘আমি’টাই সেদিন বেরিয়ে এসেছিল। সৃষ্টিকর্তার কোন ইশারায় সেদিন এমন হয়েছিল, জানি না। কোনও সংকোচ, দ্বিধা, নার্ভাসনেস, ভয়, সারাদিনের ক্লান্তি, জড়তা কিছুই কাজ করছিল না। খুবই সাবলীল আর পাখির পালকের মতোই হাল্কা বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, এখন যা বলছি, করছি, সেটাই সেরা। আমার জীবনের সেরা মুহূর্তটা এখন এই মুহূর্তে পার করছি। পূর্ণ সততা নিয়ে বলতে পারি, সেদিন যে স্টাইলে ইংরেজিতে কথা বলছিলাম, আজকের দিন পর্যন্ত আমি আমার সারাজীবনেও কোনওদিনও অতোটা নির্ভুল আর সাবলীলভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারিনি। সেদিন বোর্ডে স্যাররা বিভিন্ন ধরনের রসিকতায় মেতে উঠেছিলেন। আমাকে নিয়ে অনেক মজা করছিলেন। খুব সম্ভবত, স্যাররা চাইছিলেন, আমাকে কোনও না কোনওভাবে ‘নাড়িয়ে দিতে’। কেন জানি না, কার ইশারায় জানি না, আমি সেদিন খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখেই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম একএক করে। সেদিনের পুরো ঘটনা, এবং এর আগের ফেসবুকের বিষয়গুলি বর্ণনা করা থেকে শুরু করে, নানান বিচিত্র বিষয়ের উপর স্যাররা ইংরেজিতে ইন্টারভিউ নিয়েছেন। (আইবিএ’তে অবশ্য বাংলায় ইন্টারভিউ দেয়ার বিন্দুমাত্রও সুযোগ নেই।) আমি কেন এমবিএ’টা করতে চাইছি, সরকারি চাকরির পরীক্ষাই যদি দেবো তবে আইবিএ’তে কেন, আমার দুর্বল দিকগুলি, কখনও প্রেম করেছি কি না, অবসর কীভাবে কাটাই, বইপড়া নিয়ে কিছু কথা, বাংলাদেশের নানান অর্থনৈতিক বিষয়, আমার কিছু ব্যক্তিগত আর পারিবারিক ব্যাপার, আমার ভবিষ্যতের প্ল্যান, রুদ্ধশ্বাস মোটরবাইক জার্নি নিয়ে এ-টু-জেড, বিসিএস পরীক্ষাপদ্ধতি, ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলাম, কেন দেরিতে অনার্স করলাম, ঠিকমতো পড়াশোনা করিনি কেন, সিজিপিএ এত কম কেন, কী খেতে ভালোবাসি, কোন ধরনের ব্যক্তিত্বের মানুষ পছন্দ করি, আইবিএ সম্পর্কে কী কী জানি, কিছু সাম্প্রতিক বিষয়সহ আরও কিছু প্রশ্ন। খুব দ্রুত শুদ্ধ ইংরেজিতে উত্তর করছিলাম। এটার তারিফও স্যাররা করেছিলেন। খুবই সহজসরল অকপট ভঙ্গিতে একটা ভাইভা দিলাম। একটা বর্ণও মিথ্যে বলিনি সেদিন। ভেবেটেবে কিছুই বলতে হয়নি, মাথায় যা এসেছে, তা-ই বলেছি, তাই বানিয়ে মিথ্যে বলার সুযোগও পাইনি। শেষে একটা গান গাইতে বললেন। আমি যখন বললাম, “I can’t, Sir.” তখন বাবু স্যার আমাকে আমার ইনফো-ফরম দেখিয়ে হেসে বললেন, “But you’ve claimed so.” আমি প্রিয় শখের জায়গায় লিখেছিলাম, Reading, Writing, Singing……… সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমি আমার জীবনের সেরা দিনটি আজকে কাটালাম। গাইলাম, “আজ এই দিনটাকে……..” “I see, we’re getting a singer for our cultural program!” সাইফুল মজিদ স্যার এই কথাটি বলার সময় বাবু স্যার বললেন, “স্যার, উনার কালকেও একটা পরীক্ষা আছে। উনি বোধ হয় আজকেই রাতের ফ্লাইটে চট্টগ্রামে ফিরবেন।” তখন তিন-চার জন স্যার একসাথেই বলে উঠলেন, “বল কী! ও এখনই চিটাগাং ফিরবে? আচ্ছা, তুমি দৌড়াও, দৌড়াও! নিচে গিয়ে দেখ তোমার সুপারম্যান বাইকার আছে কি না! হাহাহা………” আসার সময় যখন সালাম দিয়ে বের হয়ে আসছিলাম, তখন স্যাররা বলছিলেন, “Best of luck for your tomorrow’s exam.” আমার বারবারই মনে হচ্ছিল, আমার হবে, আমার হবে! (বিসিএস ভাইভা দেয়ার পরও আমার অতটা ভাল লাগেনি।)
আমি যখন আইবিএ থেকে বের হই, তখন ঘড়িতে সাড়ে ৭টা। আমি জানতাম, আমি কোনভাবেই ৭:৪৫টার ফ্লাইট ধরতে পারব না। আমি এও জানতাম, আমি জানি না, কীভাবে আজকে রাতে চট্টগ্রামে যাব। ওটা নিয়ে ভাবতেও ইচ্ছে করছিল না। একটা ভাল পরীক্ষা দেয়ার প্রচণ্ড ভাললাগার ফুরফুরে অনুভূতি কাজ করছিল শুধু। পাপ্পু আর আরেফিন মধুর ক্যান্টিনে আমার জন্য ওয়েট করে ছিল। ওদেরকে সাথে নিয়ে ঢাকা ভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে গিয়ে আয়েশ করে সবজি পাকোড়া আর চা খেতে লাগলাম। আমার অনেক স্টুডেন্টই ঢাকা ভার্সিটির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে পড়ত। অনেকেই দেখা করতে এল। ইন্টারভিউতে কী কী জিজ্ঞেস করল, সেসব জিজ্ঞেস করছিল। সারাদিনের অবিশ্বাস্য সব অভিজ্ঞতার পর আমার মাথা প্রায় পুরোটাই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, কেন চট্টগ্রামে ফেরার জন্য আমি বিন্দুমাত্রও তাগিদ অনুভব করছি না। পাপ্পু জিজ্ঞেস করল, “দাদা, রাতের বাসে যাবি?” আমি বললাম, “হ্যাঁ, যাওয়া যায়।” (এখন ভাবলেই মজা লাগে, আমি অতটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ‘যাওয়া যায়’ বলেছিলাম!) তখন রাস্তার অবস্থাও ভাল না, জ্যাম লেগেই থাকে। আমার মাথাতেই নেই, যদি কালকে ১০টার আগে পৌঁছতে না পারি, তাহলে কী হবে? চট্টগ্রামে বাসা, এমন এক প্রিয় ছোটভাই এবং আমার এক্স-স্টুডেন্ট রিপন বলল, “দাদা, আমার কাছে একটা ট্রেনের ননএসি টিকেট আছে; তূর্ণা নিশীথার, আজকে রাতে ছাড়বে। আজকে চট্টগ্রামে না গেলেও আমার চলবে। দাদা, আপনি যান।” “আচ্ছা, ঠিক আছে।” বলে সেই টিকেটটি নিয়ে আমি কমলাপুর স্টেশনের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম। সে রাতে ট্রেন ছাড়ল প্রায় দেড় ঘণ্টা লেট করে। আমি ভাবতেও চাইছিলাম না, কী ঘটতে যাচ্ছে! নিজেকে এর অনেক আগেই ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করে দিয়েছি। মনেমনে শুধু এটাই বারবার বলছিলাম, যা হওয়ার তা-ই হবে। আমি চাইলেও হবে, না চাইলেও হবে। এবং যা হচ্ছে, নিশ্চয়ই ভালর জন্যই হচ্ছে, যা হবে, তাও নিশ্চয়ই ভালর জন্যই হবে। দেখা যাক! সারাদিনের ক্লান্তি শেষে খুব শান্তির একটা ঘুম হল। হঠাৎ আশেপাশের হৈচৈ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন কুমিল্লায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনে নাকি কী একটা সমস্যা হয়েছে। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা সেখানে দেরি হল। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার কেন কোনও ধরনের দুশ্চিন্তা হচ্ছে না! আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। পৃথিবীর একমাত্র বিশ্বস্ত প্রেমিকা হল ঘুম। যখনই চাই, কাছে পাই। কখনওই, কোনও অবস্থাতেই ছেড়ে যায় না। ঘুমকে ভালোবাসার মতন নিখাদ ভালোবাসা আর হয় না।
পরেরদিন ট্রেন যখন চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে পৌঁছল, তখন সকাল পৌনে ১০টা। আমার পরীক্ষা ১০টা থেকে। স্টেশন থেকে আমার বাসায় যেতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে। বাসায় গিয়ে দেখি, মা আমার পেন্সিল বক্স, বোর্ড, স্কেল, কলম, ক্যালকুলেটর, অ্যাডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন কার্ড সবকিছু রেডি করে হাতে নিয়ে বসে আছেন। বাসায় বাবা-মা খুব টেনশন করছিল। রাত দেড়টার পর থেকে বাসায় আর কথা বলতে পারিনি। মোবাইলে চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। (তখন আমি সস্তা দামের নোকিয়া ১১০০ মোবাইল সেটটা ব্যবহার করতাম। ওটাকে সবাই বলত, জাতীয় সেট! সেটটা খুব মজবুত ছিল বলে অনেকে বলতো, দোস্তো, তোর সেট দিয়ে তো কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া যাবে! বন্ধুদের মধ্যে যারা দামি মোবাইল ব্যবহার করতো, তাদেরকে মজা করে বলতাম, আমার মোবাইলটার মডেল ‘এন ইলেভেন জিরো জিরো’!) মা আমাকে দেখেই বললেন, “বাবা, কেমন আছিস? আজকের পরীক্ষা দিবি?” আমি অনুভূতিশূন্য বোধ করছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি এই মুহূর্তে একটা পালকের চাইতেও হাল্কা, কী এক নেশায় এদিকওদিক উড়ে বেড়াচ্ছি! হেসে বললাম, “মা, আমি খুব ভাল আছি। পরীক্ষা দেবো।” এটা বলে মায়ের হাত থেকে গোছানো শপিং ব্যাগটা নিয়ে ওই অবস্থাতেই বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। তখন ঘড়িতে ১০:০৫টা। আমাদের বাসা থেকে পরীক্ষার সেন্টারে যেতে সিএনজি’তে অফিস আওয়ারে অন্তত ৩০ মিনিট লাগে। যখন কলেজ গেইটে পৌঁছলাম, তখন ১০:৪৩টা। সেদিন গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা। প্রথম ২ ঘণ্টা গাণিতিক যুক্তি এবং পরের ১ ঘণ্টা মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে ৪৩ মিনিট আগেই। পুলিশ স্বাভাবিকভাবেই আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমি অনেক রিকোয়েস্ট করলাম, কী হয়েছিল, বারবারই সেটা বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, তবুও ওরা কিছুই শুনতে রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু আমার মাথায় আছে, আমি তো ফিরে যাবই না, আমি ভেতরে ঢুকবই ঢুকব। ওখানে একটা ছোটখাটো জটলা বেধে গেল। জটলা দেখে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় এলেন। আমার সব কথা শুনে বললেন, হাতে তো মাত্র এক ঘণ্টা আছে। এ সময়ের মধ্যে সব অংক করে ফেলতে পারবেন? কোনও চিন্তা না করেই বললাম, “পারব, স্যার!” “ঠিক আছে, যান। Good luck!” উনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠল। উনাকে ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, মানুষ নয়, দেবতা! গেলাম, প্রশ্ন দেখলাম, পরীক্ষা দিলাম। এমনকি আমার পাশের জনকে ৩টা অংক দেখালামও। (উনি ৩০তম ব্যাচেই অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস্-এ চাকরি পেয়েছিলেন।) সেদিনের পরীক্ষায় ৯৮ পেয়েছিলাম; ম্যাথসে ৫০, মেন্টাল অ্যাবিলিটিতে ৪৮। এরপর………সবাই যেমন করে বলে আরকি—বাকিটা ইতিহাস!
তবে এটা ঠিক, যদি সেদিনের পরীক্ষাটা অংক না হয়ে অন্যকিছু হত, তবে আমার জাস্ট ‘খবর’ ছিল। আমি অংক পারি, কারণ বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় সেসময় যে ধরনের অংক আসত, সেগুলি না-পারাটা আমার জন্য সহজ ছিল না। ওসব অংক করতে ব্রেইনে অতো চাপ পড়ে না, আর ৩০তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় সহজ অংকই এসেছিল। খুব ভালভাবে প্রতিটি স্টেপ দেখিয়ে আর সাইড-নোট দিয়েও যদি করি, সেগুলি করতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমার লাগেওনি। তবে আগেরদিন আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর পরীক্ষা আড়াই ঘণ্টা দেয়াটা রিস্কি ছিল। আসলে পুরো ব্যাপারটা যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, সবকিছুই সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত ছিল বলেই মনে হয়। আমাদের স্বল্প বুদ্ধিতে যেটা ব্যাখ্যাতীত, সেটাই স্রষ্টার কাছে সহজ স্বাভাবিক ঘটনা। আমাদের সকল ব্যর্থতা এবং সাফল্য আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তবে সেটাতে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টাটা কিংবা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কাজটা আমাদেরকেই করতে হয়। আমার তো অনার্সই পাস করার কথা ছিল না। কিন্তু, আমি অনার্স পাস করব, বিসিএস ক্যাডার হবো, আইবিএ’তে পড়ব—-এগুলির সবকিছুই ছিল আমার নিয়তি। আমার নিয়তি অন্যকোথাও বাঁধা থাকলে আমি সেখানেই যেতাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আরও একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছিলাম—এমডিএস। সে কোর্সটি ৩ মাস কন্টিনিউ করার পর নিজের ইচ্ছেতেই ছেড়ে দিই। ওরা বলেছিল, আমি যে একই সময়ে আইবিএ’তে আরও একটা মাস্টার্স করছি, সে ব্যাপারটা অফিশিয়ালি লুকাতে হবে। আমি মিথ্যে বলতে রাজি হইনি। এটা নিয়ে অবশ্য আমার মধ্যে কোনও দুঃখও নেই। আমি মেনে নিয়েছি, আসলে সে মাস্টার্সটি করা আমার নিয়তিতে লেখা ছিল না। এটাই সত্যি, এটাই বাস্তবতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভিনিং এমবিএ কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ষষ্ঠ হয়ে ফাইন্যান্সে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখানে ক্লাস করতে হয়নি। তার আগেই আইবিএ অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট হাতে পেয়ে যাই। আমি ফাইন্যান্সেই মাস্টার্স করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই, কিন্তু ইভিনিং এমবিএ প্রোগ্রামটা আমার ভাগ্যে নির্ধারিত ছিল না, তাই মাস্টার্সটা ওখান থেকে করা হয়নি।
নদীর মাঝখানে দুই নৌকায় পা দিলে মৃত্যু নিশ্চিত। যুক্তি তো এটাই বলে। কিন্তু আমি দুই নৌকায় সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে পা দিয়েছি, ওটা করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না, অথচ দুটো নৌকাই একই সমান্তরালে একই গতিতে একই সময়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, তাই আমি পা ফসকে নৌকাদুটোর মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাইনি। এটার কী ব্যাখ্যা হতে পারে? জীবনটা যুক্তিতে চলে না, জীবন চলে স্রষ্টার ইশারায়। জীবনটা যে সবসময়ই ব্যাখ্যায় চলে, তা নয়। কখনও-কখনও জীবন চলে বিশ্বাসে। তাই কারওর ব্যক্তিগত দর্শন এবং বিশ্বাসে যাপিত জীবনটা নিয়ে কিছুই বলার নেই, যদি সে জীবন অন্য কারওর জীবনযাপনে বাধা না দেয়। কোথাও জীবনের কোন ব্যাখ্যাযোগ্য রূপ দেখা যায় না এবং জীবনটা এরকমই!
আমি স্রেফ মানসিক শক্তির জোরেই বিশ্বাস করেছিলাম, কিছু একটা মিরাকল ঘটবেই। সেটা ঘটেছিল, কারণ বিধাতার মাস্টারপ্ল্যানে সেটাই ঘটার কথা ছিল। মাঝখানের সবকিছু ছিল আমার ধৈর্য আর একাগ্রতা পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টিকর্তার কিছু খেলা কিংবা পরিকল্পনা। যে উপহারের যোগ্য আপনি নন, সে উপহার আপনাকে কখনওই দেয়া হবে না। আপনাকে পরীক্ষা করা হবে, সে পরীক্ষায় পাস করতে না পারলে আপনি স্রষ্টার অনুগ্রহ থেকে নিজের দোষেই বঞ্চিত হবেন। আইবিএ’র ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পরে আমি যে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলাম, সেটি আর সেটিতে আমার নিজের দুএকটি কমেন্ট আপনাদের সাথে শেয়ার করছি:
Friends, I’ve been finally selected for admission into the MBA Program of IBA, Dhaka University. …… feeling happy. ……. HATS OFF to Sharmeen didi, Ira madam & Romel bhai!!
# My dear friends….. Your gorgeous presence on my wall makes me think twice about the POWER of friendship & the MAGIC of love. YES……… They matter!! I just want to be with you forever. Please never say GOODBYE…. It hurts!! Your kindness and care mean a lot to me. You’ve always given me much more than I really deserve. Please accept my sincere GRATITUDE.
Happy Social Networking!!
Long live Facebook!!
My best wishes for our Friendship!!
……… Love you all ……
# (আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে) Dost, not reaching the Interview Session on 17 January at 5:30 pm was what I thought to be….. reaching there in time was what was written in my DESTINY….. And, I ended up calling it a MIRACLE, something I never believed in before…… Just have a look at the schedule of 17 January……
International Affairs Exam (BCS written exam)…. 10:00 am — 1:00 pm
The departure time of the GMG Airlines: 3:20 pm, there was a delay of about 1 hour due to fog and I availed another delayed flight of Bangladesh Biman at 4:37 pm.
The plane landed on Dhaka Airport at 5:13 pm and then I started my fight against time to meet the deadline by bike with Romel bhai!! Who managed those three saviours (Sharmeen didi, Ira madam & Romel bhai) for me? I don’t know. You better ask the Heaven! I saw such a breath-taking motor-bike driving only in English movies. Before that day, I had never thought I would experience it!!
Life is sometimes stranger than fiction . . . . Who can tell it better than I?
# (আমার এক সিনিয়র হাই-প্রোফাইল ইন্ডিয়ান ফ্রেন্ডকে) Thank you Sir for your words of felicitation. IBA of Dhaka University is considered as the most prestigious institute for doing MBA in Bangladesh. As per the rules of that Business School, the Major/Field of Specialization is allowed to be chosen at the final semester judging the academic records & intention of a candidate. I don’t have much idea about what to choose and why to choose. Please share some ideas on it as you’ve huge practical knowledge (so far as I know) about the present corporate trend.
You’ve nicely stated the trend of our careerist B-school graduates. No one really cares about their own aptitude, rather, tries to be what market wants them to be. Personally, I always like the decision-making and mainstream operational sections of giant companies. And, probably I’ll go for finance as my major when I’ve to choose it in my final semester. Yes, my semester results must be well enough to work on my advantage. That’ll be a story of one and a half years later. Till then, I’ll have to undergo the generalized curriculum as my B-school formulates. The recent economic recession worries our friends studying at the US universities. And, almost all of them suggest me not to plan of staying there. But at the same time, they suggest me completing my PhD in the US if I want to and grab that opportunity. Let’s wait and see. . . . . Are you in India now? Hope you’re quite OK along with your busy schedule. Please, sometimes give me your valuable suggestions when you’ve time and you’re here on Facebook. . . . . Thank you once again for your helpful advice. Take care.
উপরে শেয়ার-করা স্ট্যাটাসের শেষ অংশের ব্যাখ্যায় নিচের কিছু কথা লিখেছিলাম:
Let me share the Story behind the Story and elucidate the last part of my status. It would have been quite impossible for me to reach Dhaka University from Dhaka International Airport within just 50 minutes (!!) to attend the interview session of IBA in time on Jan 17, but for the cordial help of Sharmeen didi (Sharmeen Muiz) & Ira madam (Johora Bebe Ira). They’re the persons who made that miracle happen!! And, Romel bhai (Monirul Alam Romel) is the “Man with the Bike” who dared fight against time to meet the deadline!! ……. I feel honoured to express my heartfelt gratitude to these three saviours. …….. Miracles Happen When You Believe!!
লেখাটি শেষ করছি সেই স্ট্যাটাসটিতে করা শারমিন দিদির একটি অদ্ভুত সুন্দর কমেন্ট দিয়ে: আমার প্রার্থনা, শুভকামনা আর প্রার্থনা রইলো তোর জন্য। লক্ষ্মী ভাই আমার, অনেক-অনেক বড় হ। আর আমাদের (ইরা এবং আমি) প্রচেষ্টার সফল প্রতিফলন ফুটে উঠুক তোর প্রতিটি কাজে। আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব।………Heaps of hugs and love.
মানুষ কীসে বাঁচে? মানুষ বাঁচে ভালোবাসায়, প্রার্থনায়, শুভকামনায়। ওগুলি নিয়েই বেঁচে আছি, বেশ ভালভাবেই বেঁচে আছি। শুকরিয়া!
পুনশ্চ। একটা কাজের বুদ্ধি দিই। যারা বেশি বোঝেন, নিজেদেরকে অতি বুদ্ধিমান মনে করেন, কোনও প্রকারের যোগ্যতা কিংবা উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছাড়াই বড়বড় কথা বলেন, আজেবাজে মিথ্যে কথা বলে হলেও অন্য মানুষকে হেয় করার চেষ্টা করেন, না জেনেই পণ্ডিতি করেন, আপনার সাথে এমন স্টাইলে কথা বলেন যাতে আপনি আত্মবিশ্বাসহীনতা অনুভব করেন, তবে আমি পরামর্শ দেবো, এইসব মানুষকে অবশ্যই, অবশ্যই, এবং অবশ্যই এড়িয়ে চলুন। এরা নিজেরাও জীবনে তেমন বেশিদূর যেতে পারে না, আপনাকেও বেশিদূর যেতে দেবে না।
(২-৩ বছর আগে লেখা)