সাধারণ মেয়ের গল্প

দ্য নৈঋত!

জানেন, আমি না আপনার দুইটা নোট পড়লাম আর কৃতজ্ঞ হলাম। কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই আপনাকে লেখা। আপনি অনেক বেশী পরিণত। কীভাবে হলেন? আপনাকে আমার জিনের মত লাগসে। জিন বোঝেন তো? ইসলামিক চেতনায় বিশ্বাসী এক প্রকার সত্তা, যাদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে। দাদিমা বলে, ওরা নাকি মানুষের বাড়িতে ঢিল ছোড়ে আর মিষ্টি খেতে চায়। মজার না? ওদের এই ব্যাপারটা কিন্তু আমার খুব পছন্দ হইসে। আমিও ছোটোবেলায় মানুষের টিনের চালে ঢিল মারতাম। আপনি মারসেন কখনও? মেরে দেখবেন, মজা আছে। হিহি….. আপনাকে জিন বলা ভুল হইসে, আপনি হলেন জিনের বাদশা। এইবার ঠিকাসে।

আমার কথা বলি? আমার নিজের কথা বলা নিষেধ আছে। নিষেধ মানে, আমি নিজেনিজে ঠিক করসি, নিয়ম বানাইসি, এইটা বলা নিষেধ; তবুও বলি। সবাইকে বলতে ইচ্ছা করে, হালকা হতে ইচ্ছা করে। কথা জমিয়ে রাখা কী যে কষ্ট! তবুও বলতে পারিনা। যদি সবাই ঘিন্যা করে! (ঘিন্যা মানে ভদ্রলোকেরা, মানে আপনারা যেটাকে ঘৃণা বলেন।) যদি এই লেখাটা পড়েন, আপনিও ঘিন্যা কইরেন, অসুবিধা নাই। খালি হাসাহাসি কইরেন না, আপ্নের পিলিচ লাগে। আমি প্রয়োজনে ঘৃণাও সহ্য করতে পারি, কিন্তু উপহাস একদমই নয়। অবশ্য, এইটা আপনার ইচ্ছা, আমি তো আর জানতে যাব না। (আপনিও আমাকে জানাবেন না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, এটা শুনতে-শুনতে আমি এখন ক্লান্ত। আমি জানি, আমাকে ভালোবাসার কিস্যু নাই। কেউ বললেও জানি, না বললেও জানি। ওটা আর শুনতে চাই না, এবার একটু বিশ্রাম চাই।)

আমি আপনার একটা দিক দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এই যে আপনি, এত ব্যস্ত মানুষ, আপনার কী ঠ্যাকা যে আপনি কষ্ট করে ছেলেপেলেদের জন্য লিখবেন? তাই না? কিন্তু লিখসেন তো! কতো কষ্ট করে সেমিনার নেন, কতো মানুষকে মোটিভেট করেন, হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেন, স্বপ্ন বুনতে শেখান। এটা অনেক বড় কাজ। আপনি নিজেও জানেন না, আপনার কথাগুলো কতো মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়, বাঁচিয়ে রাখে, বাঁচতে স্বপ্ন দেখায়। এর জন্যে কারও-কারও ঈর্ষা ছাড়া তো আর কিছুই পান না। দোয়া পান, ভাল কথা। কিন্তু সেটাও বা কতোটা দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে কাজে লাগে আপনার? হয়তো ওইটাতেই আপনার তৃপ্তি, আনন্দ, সুখ, শান্তি। কিছু কথা পড়লাম, যেগুলো আপনি আপনার ভাইয়ের জন্য লিখসেন, তবুও পড়ার সময় আমি ধরেই নিসিলাম, সব কথাই আপনি আমার জন্যে কষ্ট করে লিখসেন। (আপনার লেখা নিয়ে নিচ্ছি না, শুধু ধরে নিসি। আপনি আপনার লেখা চুরি হয়ে যাওয়াকে এতো ভয় পান কেনো? আপনি না লেখক হবেন? এই সংকীর্ণতাটা আপনাকে মানায় না। ওরা করুক না চুরি! কতো করবে? যারা পারে, তারা তো করে। কিন্তু যারা পারে না, ওরা কী করবে তাহলে?)

আপনার ভাই কত্তো লাকি! আপনার মত একটা ভাই আছে তার! আমাকে দেখেন— আমি ছাড়া কেউ ছিল না আমার। কত সুন্দর-সুন্দর করে কথা বলেন! এসব শোনা তো দূরে থাক, স্বাভাবিক কথাই শুনতে পাই নাই কখনও। পাবই বা কেন, আমি যে খারাপ মেয়ে ছিলাম। আমি যে কত খারাপ, কতটা খারাপ, এসব বলতে চাই, সত্যিই চাই, কিন্তু কেউ দেয় না বলতে। আমাকে সবাই কিন্তু খুব ভাল ভাবে, এটা আমাকে দিনদিন অপরাধী করে ফেলতেসে। আমি যেটার যোগ্য না, সেটা নিতে খুব খারাপ লাগে। আমাকে খারাপ বললে আমি কিছু মনে করি না। ভাবি, ওরকম হতে চাইলেই তো হয়ে যেতে পারবো। কিন্তু আমাকে নিয়ে কেউ ভাল কিছু বললেই টেনশনে পড়ে যাই। ভাল হওয়াটা কঠিন তো! লোকে ভাল হতে চায়, আবার ভাল যারা তাদের ভাল কাজগুলাকে সহ্য করতে পারে না, হিংসা করে। পাবলিক বড়ই অদ্ভুত জিনিস! আমি নিজেও পাবলিক, একেবারে ম্যাঙ্গো পাবলিক। যখন কেউ আমাকেও হিংসা করে, আমার খুব হাসি পায়। জানেন, আমাকে সবাই লুতুপুতু করে, পাগলি বেটি বা সহজসরল আর সতীসাবিত্রী ভেবে মাথায় করে রাখে, কিন্তু আমি আসলে যে কত্তো বড় ক্রিমিনাল তা শুধু আমিই জানি। সবাইকে গলা ফাটায়ে বলতে ইচ্ছা করে, আমি আসলে কী!

সবকিছু ভুলেই গেসিলাম, আগের লাইফে চলে গেসিলাম। গতকাল রাতে আপনার লেখা পড়ে আবার মনে পড়ে গেল। আপনি একসময় কষ্ট পেতেন না? ভীষণরকমের কান্না-চেপে-রাখা কষ্ট? আমিও পাইসি। লাল-নীল-বেগুনী-সবুজ-ধূসর রঙের কষ্ট, মাল্টিকালারের কষ্ট। ও আচ্ছা, মিথ্যা বলসি এইমাত্র, কষ্টের রঙ হয় না। কষ্ট কালারলেস, আমি বানায়ে-বানায়ে কষ্টের কালার দিসি। আপনি লিখসেন, আপনার সাথে আপনার পরিবার ছিল। আর আমার সাথে শুধু আমি ছিলাম। আল্লাহও ছিল না। যে আল্লাহর কাছে রোদ চাইলে রোদ পাইসি, বৃষ্টি চাইলে বৃষ্টি পাইসি, ছায়া চাইলে ছায়া পাইসি, স্কুলের স্যার-ম্যাডামের আর আব্বুর মারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেসি, সেই আল্লাহ কেন আমার ভাগ্যটাকে এমন হতে দিসিলো? উনি তো সব জানেন, সব বোঝেন। তবুও কেন আমাকে বুদ্ধি দ্যান নাই? আপনি লিখসেন, “আল্লাহ মাঝে-মাঝে আমাদের প্রার্থনা কবুল করেন আমাদের প্রার্থনা কবুল না করার মাধ্যমে।” কিন্তু একটু ভাবেন তো, প্রার্থনা করার বুদ্ধিই যখন মাথায় আসে না, তখন সেটা কার দোষ? আমি কীভাবে বুঝবো, খুব ভাল আছি, এইরকম অনুভূতিও মিথ্যা আর তা থেকে বের হয়ে আসার জন্যে প্রার্থনা করতে হবে? আপনিই বলেন, কেউ কি সেটা বোঝে আদৌ? কেউ যখন ভাবছে, সে ভাল আছে, তখন সে যে আসলে ভাল নেই, তা তার মাথায় আসবে কী করে? আমার মনে ছাঁকনি আছে, আমি সবার কাছ থেকে শুধু ভালটা নেবার ক্ষমতা রাখি। তুমি যা তা-ই দেখাবা, সৎ থাকবা, সত্য বলবা, সব মানুষ সমান, বড় হতে চাইলে ছোট হবা, অহংকার করবা না, লোভ করবা না, লোকদেখানো কাজ করবা না, বড়দের সম্মান করবা, কাউকে কষ্ট দিবা না, প্রতিযোগিতা করবা না, ফুটানি মারবা না—এই যে এইসমস্ত বুকিশ কথা ছোটোবেলা থেকেই কতজনের কাছে শুনসিলাম আর মনের মধ্যে গেঁথে ফেলসিলাম। মোটামুটি আদর্শ বাচ্চা ছিলাম। যত্তোসব! কী ফালতু একঘেঁয়ে ক্লান্তিকর স্মৃতিহীন শৈশব! কোনও মানে হয়, বলেন? তারপর কী হল? ওরে বাবা! কী যে হল!

জানেন, আমার সাথে আমার আব্বু প্রায় দুই বছর কথা বলে নাই? আমার মা আর আমার বোন কথা বলতো, তবে তাদের মত করে। কাছের কেউ দূরদূর ঢঙে কথা বললে কেমন লাগে দেখসেন কখনও? আমার যে ভাইয়াটা আমেরিকায় থাকে, ওকে পর্যন্ত আমার হিংসা হতো। ও তো চাইলেই ফোন করে বাপমা’র সাথে কথা বলতে পারতো, আমি তো বাসায় থেকেও কখনওই তা পারতাম না। পারবো কীভাবে? আমি যে ওর চাইতেও দূরে থাকতাম! দূরে থাকার ব্যাপারটা দূরত্বে মাপা যায় না। ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর দুই বছর আমি বাড়িতে থাকিনি যেন, আমি থেকেছি আমার ঘরে, আমার বাথরুমে, আর মাঝেমধ্যে ছাদে। আমার ঘরটাকে কেউ বাড়ির মধ্যের কিছু ভাবতো না। ওটাতে তো আমি থাকতাম, তাই ওটা বাড়ির বাইরে। সবার খাওয়া শেষ হলে, আমি খাবার নিজের ঘরে এনে খাইসি। কারওর চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। প্রথমদিকে লজ্জায়, পরে সংকোচে, আরও পরে ভয়ে। ঈদে কাপড় পাই নাই, টাকা পাইসি, যা লাগবে তা যেন কিনি। ঈদের টাকাকে পর্যন্ত অসহ্য লাগতো। কিন্তু এগুলা সব ঘরের কথা, বাইরের কেউ জানে না। মেহমানরা আসছে, সবাইকে হাসিমুখে পরিচিত করাইসে—আমাদের আদরের ছোটো মেয়ে। আমি হাসিমুখে পরিচিত হই, কথা বলি। সবাই ভাবতো, কী আহ্লাদেই না আছি। কী সুখ! আহা! আপনি তো সুইসাইড করতে চাইসিলেন, না? বাইরের দুনিয়ার কাছে অস্তিত্বের সংকটে। ভেতরের দুনিয়ায় অনস্তিত্বের সংকট যে কতোটা তীব্র হতে পারে, এর কোনও আইডিয়া আছে আপনার? আমার মতো অতো সুখে মরতে চাইসেন কখনও? পৃথিবীতেই পৃথিবীর বাইরের পৃথিবীতে থাকতে কেমন লাগে জানেন? আমি ওইসময়ে কতোটা ভালোবাসার কাঙাল হয়ে দিন কাটাইসি, এটা আপনি ভাবতেও পারবেন না। কারওর চোখের একটু মিষ্টি চাহনিকেও মনে হতো সুখের আশ্রয়! যাকে এই পৃথিবীতে কেউই চায় না, সে বাঁচে কীভাবে, বলতে পারেন?

তখন আমি কাঁদতে পারতাম না, সবাই যদি বলে ঢং, এই ভয়ে আর সংকোচে। আমার বেশিরভাগ সময় বাথরুমে কাটসে। অন্যের সামনে কাঁদতে আত্মসম্মানে বাধতো। আমার আবার সম্মান! হুহ্‌! তবুও। রাস্তার কুকুরও কিন্তু ভালোবাসা বোঝে। একটু আদর পেলে খাওয়ার কথা ভুলে লেজ নাড়াতে থাকে। এটা দেখসেন কখনও? কুকুরও যদি খাওয়া ভুলে ভালোবাসায় সাড়া দেয়, ভালোবাসা চায়, তবে আমি কেন চাইবো না? আমি কি কুকুরের চাইতেও নিম্ন অনুভূতিসম্পন্ন? আচ্ছা ভাল কথা, আমি কিন্তু করসে খাইসে এভাবে বলিনা, লিখতে সুবিধা হচ্ছে তাই লিখতেসি। আমার ঘরের দরোজা ভিড়ানো, মানে ভেজানো থাকতো। খাবারঘরের কথা মাঝেমাঝে আমার কানে আসতো। মানুষ কখনও-কখনও নিজের সম্পর্কে কে কী মন্দ কথা বলে, সেটাও কান পেতে শোনে। অদ্ভুত সাইকোলজি, না? হাত পেতে কষ্ট নেয়া! নির্লজ্জ মেয়ে, বেহায়া মেয়ে, চরিত্রহীন মেয়ে এইসব শুনতাম আর খুশি হতাম। হুঁ, আমি তো এইসব অপবাদই ডিজার্ভ করি। অসুবিধা কী? আমি চাইতাম, আমাকে সবাই ইচ্ছামত গালি দিক, ঠাসঠাস করে থাপ্পড় মারুক, লাত্থি মারুক, কিলঘুষি মেরে হাড্ডি গুঁড়াগুঁড়া করে দিক, চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলুক। তবে, যখন মাঝেমধ্যে আব্বুর কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম তখন বুকের ভেতর কেমন জানি হাহাকার করে উঠতো। আল্লাহকে বলতাম, আল্লাহ, তুমি আমাকে প্রয়োজনে নিয়ে যাও। তবু সেইটা যেন আর না শুনি। আমার তখন কাজ ছিল একটাই, শুয়ে-শুয়ে আল্লাহর সাথে কথা বলা। আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকেই তো কথা বলার জন্যে পেতাম না। শুধু আমি আর আল্লাহ ওই ঘরের ভেতরে কোনও এক বাইরের ঘরে থাকতাম। আর কেউ না, কেউ না! বাকিরা সবাই ঘরে থাকতে পারতো। আমি লিখতে পারছি না, তবুও লিখছি। আপনি, হুঁ, আপনি আমার চোখে পানি এনেছেন; বহুদিন পর আবারো। আপনার লেখাগুলো সব আমি পুড়ায়ে ফেলবো একদম।

আপনি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দিরে গেছেন? না গেলে একবার যাবেন। তবে অনেক কষ্ট করতে হবে কিন্তু! ১১৫৬টা ঢাউস-ঢাউস সিঁড়ি পার করতে হবে। খুব কষ্ট। খুউব! আমি গেছি। কাঁধে হ্যাভারশেক, কেডস পরে; হাতুড়িবাঁটলা আর সেইরকম ভাব নিয়ে। পাহাড়ে ওঠার সময় সব পাহাড়কেই মনে হয় এভারেস্ট। নিজেকে সেয়ানা-সেয়ানা লাগে। শেষের দিকে হল কী, নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা ঘুরে হাতপা কাঁপতে লাগলো। সবাই সে কী হাসাহাসি! ভালই হল, আমার ব্যাগট্যাগ অন্য ছেলেপুলেদের কাছে চলে গেল আর আমাদের হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং, গমগম করে কথা-বলা আর সিরাম ভাব নেওয়া স্যার আমার হাত ধরে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে বলে বাকি পথ পার করালেন। স্যারের গা দিয়ে এত সুন্দর গন্ধ! উফফ! ছেলেদের গায়ের গন্ধ এতো পাগল-করা হয়! (আসলে ওইটা ছিল পারফিউমের গন্ধ!) আমার তো পুরাই মাতাল-মাতাল লাগতেসিল। একটুএকটু প্রেমেও পড়ে গেসিলাম। ওই স্যার কিন্তু ঠিকমতো ক্লাস নেয়না, ব্যাটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়, বিদেশে যায় আর টাকা কামানোর ধান্দায় থাকে, তাই একটুএকটু ঘিন্যাও করতাম। বাদ দিন স্যারের কথা। এখন ভাবি, উনি তো অনেক খারাপ মানুষের চাইতে অনেক-অনেক ভাল। আপনি ওই পাহাড়ে যাবেন কিন্তু! আপনি যাবেন, চূড়ায় উঠে দেখবেন, ছোট্টো ট্রেন যাচ্ছে আর নিচের পাহাড়শ্রেণীতে মেঘের ধূসর ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় পাহাড়ের আর মেঘের ছায়া দেখতে ছোট পাহাড়গুলিতে। এই ছবি দুনিয়ার কোনও ল্যুভর মিউজিয়ামে মিলবে না। এই ছবি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহান আর্টিস্টের আঁকা। খোদার কসম, পাগল হয়ে যাবেন। অনেককিছু লিখেটিখেও ফেলতে পারবেন। ও হ্যাঁ, যেটা বলতেসিলাম, স্যাররা বলেন, আমার নাকি উচ্চতাভীতি আছে। (স্যাররা ইংলিশে বলেন। আমি ওটার ইংলিশটা ভুলে গেসি।) আমিও তা-ই জানতাম। কিন্তু আপনিই বলেন, তা-ই যদি হয়, আমি প্রায়ই ছাদের কার্নিসে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতাম কী করে? বসেবসে পা দোলাতাম আর শুধু ভাবতাম, শুধু ভাবতাম, দেই লাফ, দেই লাফ? উফফ! লাফ দিলে কী হবে? মনেমনে বাপমা’র কান্নার কথা ভাবতাম, আর হিহি হাসি পেত; মনে হতে থাকতো ঐটা-ই তো খেলা! অবশ্য না মরে হাত-পা ভেঙে লুলা হয়ে যাবার একটা ভয়ও ছিল। ও আচ্ছা, একটা কথা বলা হয়নি, ঐ পাহাড়ে নাড্ডু মাথা, কমলা রঙের কাপড়-পরা কিছু লোক ছিল, আমাকে মা বলে ডাকসে! মেজাজটা খারাপ হয়ে গেসিলো, কিন্ত আমার বয়েসি একটা ছেলে আমাকে বলল, মা, তোমার কষ্ট হচ্ছে। বলেই তার লাঠিটা আমাকে জোর করে ধরায়ে দিল। এটাতে একটু পটে গেসিলাম। আমাকে মা বললে ছেলেদের আব্বু বলবে, এই প্রস্তুতি নিয়ে যাবেন না যেন! যদিও ওরকমই বলার কথা ছিল। কিন্তু ওরা তা বলে না। দুনিয়ায় মেয়েরা যত সহজে মা হয়, ছেলেরা তত সহজে আব্বু হয় না—এইজন্যই বোধ হয়। তিন পায়ে পাহাড়ে উঠছি পাহাড়ে উঠছি; হঠাৎ, দূর্বা, তোর লাঠিটা দে তো একটু, বলেই এক বান্ধবী কেড়ে নিয়ে নিসিল, লজ্জায় পরে চাইনি আর। তবে কষ্ট হচ্ছিল খুব। শুধু নিজের পায়ে ভর করেই মানুষ সব উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে না।

দূর্বা ইসলাম কেন মরতে পারে নাই, জানেন? আমি জানি যে, আমি সেরকম কিছু করলে আমার বাপমা ভাবতো, ওদের কারণে মরসি, কারণ রাগের মাথায় ওরা প্রায়ই বলতো আমি কেন হবার পর মারা যাই নাই, কেন জন্মাইসি, কেন ওরা আমাকে বড় করতে গেসিলো—এইসব, এইসব। কিন্তু আমার আল্লাহ জানেন, সত্য এই যে, কষ্ট করে যতটুকু বাঁচতে চাইসি, ওদের জন্যেই। ওরা যাতে অপরাধবোধে না ভুগে, সেইজন্য। ওরা আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ায়ে দিতে পারতো, লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে পারতো, কিন্তু ওসবের কিসুই করে নাই। আশ্রয় দিসে, খাবার দিসে, কাপড় দিসে, খরচ দিসে, সব, সব দিসে। মানুষ কিন্তু কখনও-কখনও এইসবেও বাঁচে, মানে স্রেফ খাওয়া-পরায়। আমি তো বেঁচে ছিলাম। আমি মরলে অন্য একটা শুয়োরের জন্য মরতাম। সে চেষ্টাও করসি কিন্তু! আপনি যেমন মরতে পারেন নাই সাহসের অভাবে আর আপনার মায়ের কথা ভেবে, আমি মরতে পারি নাই ওই শুয়োরের কাছে কোনওদিনও হেরে যাবো না, নিজের কাছে নিজের এই শপথ থেকে। আপনি লিখসেন, “আমি দেখেছি, শুধু বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়৷ হারিয়ে গেলে, খুব কাছের মানুষ ছাড়া কারওরই কিছু এসে যায় না৷ তাই, বেঁচে থাকুন। আপনার মৃত্যু কিছু লোককে দারুণ অস্বস্তিতে ফেলে দেবে, যারা আপনার মৃত্যুকামনা করে স্বস্তি পায়। অন্তত তাদের কথা ভেবে হলেও . . . . . . . বাঁচুন! বেঁচে থাকাটাই সবচে’ বড় প্রতিশোধ। তাই, অন্তত নিজের কথা ভেবে হলেও . . . . . . . বাঁচুন! বাঁচুন, নিজের জন্যে। বাঁচুন, অন্যের জন্যে।” আপনি কীভাবে লিখে ফেললেন এইসব কথা? আপনাকে এইগুলা কে লিখা শিখাইসে? এইসব কথা পড়ার পর আপনাকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করসে। আপনি মানুষ তো? এইভাবে, এত সুন্দর করে, আমাকে কেউ কখনও বলে নাই কেন? আপনার ভাইয়ের কি আমার চাইতেও খারাপ অবস্থা ছিল? আমারও তো বড় বোন ছিল! ও কেন বলে নাই? কেন? আমার পাশে কেউ ছিল না। কেউ না, কেউ না! আমার বান্ধবীরা এসবের কিসুই জানতো না। আমার বান্ধবী মানে, আমার স্কুলফ্রেন্ড। ভার্সিটির বান্ধবী আছে, ওদের সাথে কেমন জানি ফর্মাল ভদ্রতার সম্পর্ক। আমাকে ওদের মন থেকে পছন্দ হয় না, ওদেরকেও আমার পছন্দ হয়না, ন্যাকামো করে, সারাক্ষণ বাট, সো, শিট, সরি, থ্যাঙ্কয়্যু দিয়ে কথা বলা, ঢং করে কথা বলা আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার অভিনয় দেখে আমার বমি চলে আসে। হাসতেসেন, এইতো? হাসেন ভাই, হাসেন।

শোনেন, আমি কিন্তু খুব খ্যাত আছি। আমি বাঁচি আমার দাদার যুগে। দাদার চাবিদেওয়া ঘড়ি, বাপের জংধরা রোদচশমা, পাড়ের শাড়ি (মানে মায়ের শাড়ি), দাদীর শাড়ি, তাদের স্টাইল, তাদের কথা আমার বড়ো ভাল লাগে, আপন-আপন লাগে। কিন্তু আল্লাহ এমন দুখান পা দিয়া দুনিয়ায় পাঠাইসে যে দাদীর শাড়ি পরতে পারিনা, হাঁটুর কাছে চলে যায়। আমার দাদু কিন্তু গ্রেটার রাজশাহীর (রাজশাহী, পাবনা, নবাবগঞ্জ ইত্যাদি) একজন হিরো। এই হিরো সেই হিরো না, এইটা আদর্শের হিরো, শুনলে মনে হবে রূপকথা। এখনও শোনা যায় তাঁর সাহস, সততা আর বীরত্বের গল্প। তাঁর সব ছেলেমেয়েরা হয়তো তাঁর চেয়েও বড়-বড় পজিশনে গেসে কিন্তু তাঁর মত এত সম্মান আর ভক্তি কেউ পায়নি। পাবেও না কখনওই। আমি আমাদের নানা আর দাদা দুই গুষ্ঠি নিয়েই গর্ব করি, তাই বলে নিজেকে ওদের পরিচয়ে হারাতে ইচ্ছা করেনা। আমি নিজের পরিচয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। কিন্তু ভাবি, আমার কী করার আছে? কিছু করতে হলে কতোকিছুই তো মনে রাখতে হয়। (আপনি মানুষকে বানায়ে-বানায়ে বলেন যে আপনার কিছু মনে থাকে না। এটা আমি বিশ্বাস করি না।) আমার কিছু মনে থাকে না যে! আমার বোধহয় বয়স হয়ে গেসে! কারওর নাম মনে থাকে না, চেহারা মনে থাকেনা, কিসুই মনে থাকেনা। আমাকে কেন সবাই বিদেশে চলে যেতে বলে? বলেন তো, আমি নিজের দেশ থাকতে পরের দেশে কেন যাব? ঠিক আছে, অপরাধ করসি। শাস্তি দাও। পালাবো কেনো? আমাকে বের করে দিবে কেনো? এর চেয়ে বড় বড় অপরাধ করে লোকজন দিব্যি দেশে আছে। আমি যাবো কেনো? আমাকেই চলে কেন যেতে হবে? আমি এই দেশ ছেড়ে কোত্থাও যাবো না। গেলে বেড়াতে যাব, এরপর আবার ফিরে আসবো। (আপনি এরকম করে বলেন না?) অথবা, এতো বেশি যদি কষ্ট হয় যে একেবারেই থাকা যাচ্ছে না, তখন যাবো। এর আগে কক্ষনো না, মরে গেলেও না। দেশের বড় ক্ষতি করেও কত লোক দেশে সম্মানের সাথে বাস করে, আর আমি নাহয় আমার পরিবারের একটু ক্ষতি করসি, এর জন্যই আমাকে দেশ ছাড়তে হবে?

“পৃথিবীতে নোবডি হয়ে থাকাটা সুখের নয়৷ যে যা-ই বলুক, এটা নিশ্চিত, নোবডি’দের জন্যে এই পৃথিবীতে শুধু নাথিংই বরাদ্দ থাকে৷” আচ্ছা, আপনি এটা লিখলেন কেনো? আমি তো একজন নোবডি! তাহলে, আমার জন্য কি শুধু নাথিংই বরাদ্দ? ভয় লাগতেসে। মশাই, আপনি শুধু সাহসই দেন না, ভয়ও পাইয়ে দেন। কেন, আমি যদি নোবডি হয়ে সুখে থাকতে চাই, পারব না? আমি আমার মত থাকবো, ওইসব হাতিঘোড়া টাইপের কোনও কিছু হতে পারবো না, ছোট মানুষ হয়ে বেঁচে ছোট্ট জীবনটা কাটায়ে দেবো। অসুবিধা কোথায়? “আফসোস ছাড়া বেঁচে থাকাটাই সাফল্য।” আপনারই তো কথা। এটা আগেরটার সাথে কনট্রাডিক্টরি না? আপনিই বলেন, এখন আমি কোনটা নিব? পরের কথাটাই আমি নিব। আমার ইচ্ছা, আমি নোবডি হয়েই থাকবো। কার কী? আপনার মতোই, আমার কোনওদিনও কোন স্বপ্ন ছিল না, এখনও নাই। তাহলে কি আমি নিম্নশ্রেণীর মানুষ? আপনি তো নিম্নশ্রেণীর নন। আমি কি সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে আপনাকে দেখায়ে দিবো? আমি যদি নিম্নশ্রেণীরই হয়ে থাকি, তাহলেও বা আপনার কী? আপনাকে একটা ফ্যাক্ট বলি। কুকুর নাকি নিম্নশ্রেণীর জীব! আমাদের বাসায় মন্টু ঠিকমত খাবার না খেলে আমার আদরের বড় আপু দুঃখে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয়! আর আমি খেলাম কি খেলাম না, এটা নিয়ে ওর এক ফোঁটাও মাথাব্যথা নাই। কখনওই আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, আমার কী লাগবে, আমি খাইসি কি না, আমার শরীর কেমন। সেদিন দেখসি, আপু মন্টুকে দেখে পিৎজা খেতে দিসে। দেখে আমারও খুব লোভ লাগসে— পিৎজা খাওয়ার লোভ না, ভালোবাসা পাওয়ার লোভ। আমি খুব লোভী, বুঝসেন? হিহিহি……… মন্টুকে চিনেন নাই, এইতো? মন্টু আমাদের বাড়ির কুকুরের নাম। এখন আপনিই বলেন, আমি কোন শ্রেণীর জীব?

আপনার লেখায় পড়লাম, আপনার দোকানের, অন্য ব্যবসার, আর শেয়ার মার্কেটের লাখলাখ টাকা জলে গেসে। তাতে আমার কিসুই হয় নাই, কিন্তু আপনার চোখের পানির কথাটা শুনে কেমন জানি একটু মায়ামায়া লাগসে। আমার তো কিসুই করার নাই মায়া লাগানো বাদে! আমি কিন্তু সবার জন্যই মায়া লাগাই। সবার জন্যে মানে, যাদেরকে আমার ভাল লাগে, তাদের জন্যে। এটা কেন বলে দিসি, জানেন? বসে দিসি, যাতে আপনি এটা না ভাবেন যে আমি আপনার প্রেমেটেমে পড়ে গেসি। টাকা গেলে আবার চলেও আসে। রোজ আমার টাকা হারায়। (তাই বলে আপনার মতো অত না!) আচ্ছা, আপনি তখন অতটুকুন ছোটো মানুষ এত টাকা কোথায় পাইসিলেন? কোচিং থেকে? ওরে বাবা! এই পড়া কে কবে কোথায় পড়াইতে পারসে? আপ্নে তো দেখতেসি মহান বড়লোক মাস্টার! হিহি……..

“পরিবার পাশে থাকলে মনের জোর অনেকটাই বেড়ে যায়৷” আপনার কী সৌভাগ্য! আমি যখন প্রিলি দেই, আমার আত্মীয়রা হাসতে-হাসতে মরে! বলে, দূর্বা পাগলি পরীক্ষা দিবে? এমনকি পরে চাকরি হইসে শুনে খুশি হলেও হাসতে-হাসতে মরে! আজকেও মাংস দিতে গিয়ে কতবার শুনতে হল যে তুই কিন্তু বসের সামনে এই বলিসনা ঐ বলিসনা, এই করিসনা তা করিসনা, কলিগদের সামনে ভাব নিয়ে থাকবি, নিজেকে হাল্কাভাবে দেখাবি না, তুই কীভাবে চাকরি করবি রে! এইসব এইসব আরও কতো কথা! আপনি বলসেন না, “কাইন্ড ওয়ার্ডস আর হেলদিয়ার দ্যান অ্যা বৌল অব চিকেন স্যুপ”? আপনিই বলেন, এই কথাগুলাকে কীসের স্যুপ বলবেন আপনি? মরিচের? আমার বিসিএস দেবার গল্প বলি? আমি পচা সাবজেক্টে পড়সি। বিএসসি ২০০৮’য়ে পাস করার কথা, পাস করসি ২০১০’এর মার্চে। আর এমএসসি ২০০৯’য়ে কমপ্লিট করার কথা, আর আমি বের হইসি ২০১২’এর ডিসেম্বরে। মানে ৩ বছর জট! এক বছর অবশ্য থিসিসের কারণে। শোনেন, আপনি আপনার নেক্সট সেমিনারে খুব ভালভাবে জোর দিয়ে বলে দিয়েন, গাধাদেরও বিসিএস হয়। আমি কত গাধা, একটা উদাহরণ দেই? আমি রচনা বাদে একটারও পুরা উত্তর দিতে পারি নাই। আন্তর্জাতিকে ৩০ মার্কস বাদ দিসি। বানায়ে-বানায়ে যে সবাইকে লিখতে বলেন, আমি না জানতাম ন্যাম কী, না চিনতাম মুন চাচারে। আপনিই বলেন, ক্যামনে কী? আমার জ্ঞানের লিমিট বুঝতে পারসেন নিশ্চয়। আমি তো নিজে জানি, কত খারাপ পরীক্ষা দিসি। প্রিলি দিবার আগে আল্লাহকে বললাম, আল্লাহ দাওনা একটু মিলায়ে, ঐ বিজ্ঞান আর ম্যাথ দিয়ে কোনরকমে মিলায়ে দাও না। লিখিত দিয়েও জানি কিছুই হবে না, তবু বললাম, আল্লাহ মানসম্মান রেখো গো! কী আশ্চর্য! আল্লাহ রাখলোও। ভাইভাতে ব্যক্তিগত প্রশ্ন বাদে আর কিছুই ধরে নাই। নিশ্চিতভাবেই জানতাম, কিসুই পাবো না। তবুও বললাম, আল্লাহ আমি জানি আমার হবে না, তবু শেষের দিকের কোনও ক্যাডারও যদি দিতা! আমার জন্মদিনে বিনা দাওয়াতে চাকরিওয়ালা বান্ধবীরা হাজির। একেকজনের কতো কথা! কতো ফরিয়াদ! যার পা নাই, তার কাছে আইসা দামি জুতা না থাকার দুখে কান্দে! মুখে হাহাহিহি করলেও মন খুব খারাপ ছিল। সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। বান্ধবীরা চলে গেলে আমি গোসলটোসল, ওযুটজু করে জায়নামাজে বসলাম; নামাজ পড়ি নাই অবশ্য, আল্লাহর কাছে খুব করে কাঁদলাম; বললাম, আল্লাহ, আর কত? হয় চাকরি দাও, নয় তুলে নাও। তারপর ফেসবুক খুলে দেখি বিসিএস ৩৩ গ্রুপে ছেলেপেলেরা বলতেসে যে, রেজাল্ট দিসে। আমি ছেলেদের নাম দিয়ে ফেসবুক চালাই, কারণ, মেয়েদের নাম দেখলে ছেলেপেলেরা ফাজলামো করে। আমার কমেন্টে সবাই ব্রাদার বলে এ্যাড্রেস করতো। আমি হাসতে-হাসতে মরে যেতাম। আমি ফেসবুক ইউজ করতাম বিসিএস’এর খোঁজে, আপনাদের মতো রথী-মহারথীরা দয়া করে আমাদের জন্যে ভাল-ভাল কথা লিখেন, এইজন্য। আসলে আমি চাকরির খবরের পর আমার ফ্রেন্ডদের একটুএকটু করে রিকোয়েস্ট পাঠাইসি, ছবিটবি দিসি; তার আগে আমার বোন বাদে আর তেমন কেউ আমার আইডি’র কথা জানতো না। আমার এক বন্ধু আমাকে রোল দিয়ে রাখসিলো, ওর রোল দেখতে গিয়ে দেখি—ওমা! আমার রোল!! একেবারে শেষের দিকে, তবুও, আছে তো!! তাও আবার আমার সাবজেক্টে! প্রফেশনাল চাকরি!! কীভাবে সম্ভব?? আপনি বলেন না, আল্লাহ কাউকেই চিরদিন অসম্মানিত করে রাখেন না। আমি নিজেই এর সবচে’ বড় প্রমাণ। জানি, আপনারটার মত আমারটা অত বড় বার্থডে গিফট না, মানে, আমার জন্মদিনে আমার বিসিএস-এর রেজাল্ট দেয় নাই। তো কী হইসে, আমার কাছে অনেক অনেক বড় গিফট। ততোদিনে অবশ্য বাড়িতে আমি স্বাভাবিক অবস্থায় আসছি; এই ধরেন, লিখিত’র পর থেকেই। আর এমনিতেও আব্বু হজ্ব করে এসে একটু পাগলা কিসিমের হয়ে গেসিলেন, আর ওইসময়ে আমার একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হওয়ায় সবাই আমার প্রতি একটু সফট হইসে। দেখসেন, অসুখের সুবিধা? কারও কাছ থেকে ভালোবাসা না পাওয়ার চাইতে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে অসুখ পাওয়া অনেক ভাল। আব্বু আমাকে মাফ করে দিক; আমি ভালোবাসা চাই না, শুধু মাফ চাই; আমি গালির যোগ্য, ঘিন্যার যোগ্য, ভালোবাসার না। আল্লাহর কাছে আমি কখনওই মাফ চাইনি, তবু আল্লাহ ঐ টা ফ্রি গিফট দিসে। আল্লাহ মহান বলেই হয়তো। মন থেকে চাইলে আল্লাহ মিলায়ে দেয়।

সাফল্যের জন্যে আত্মবিশ্বাস জরুরী, নাকি আত্মবিশ্বাসের জন্যে সাফল্য জরুরী— আপনার এই কথাটার একটুএকটু প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু কথাটা কোথায় জানি শুনসি-শুনসি মনে হচ্ছে। আপনি কি বলসেন অন্য কোথাও? নাকি কারও কাছ থেকে ডাইরেক্ট কপিপেস্ট মেরে দিসেন? হিহিহি……… আমি তো আপনার অনেক স্ট্যাটাসই পড়সি। নাকি কোনও এক স্ট্যাটাসে আগেও একবার পড়সি? মনে নাই। আমার তো আর কোচিংফোচিং করার জন্য অত টাকা চাইতে পারার মত অবস্থা ছিলনা। নিজে নিজেই পড়সি; কাঁদতে-কাঁদতে পড়াশোনা। লিখিত পরীক্ষা দেয়ার সময় খাতার পেজ ভিজে যেতো। রুমাল দিয়ে মুছে আবার লিখসি। পেজ ছিঁড়েও গেসে কয়েকবার। স্যারের কাছেও ধরা খাইসি দুইবার। এক স্যার বলসে, “কী সমস্যা তোমার? একজাম দিতে আসছ, নাকি ঢং করতে আসছ?” খুব কষ্ট লাগসিলো শুনে। প্রিপারেশন নেয়ার সময় রুমের দরোজা লাগায়ে পড়তাম, যাতে কেউ আমাকে কাঁদতে দেখে না ফেলে। আমার তো কোটা ছিল না, আবার প্রিপারেশনও তেমন ছিল না, তাই সারাক্ষণই খালি টেনশন হতো। আমার কাছে কারওর কোনও এক্সপেকটেশন ছিল না। আমি কিসু করলেও যা, না করলেও তা। আপনি কতোকতো পোলাপানকে ক্যারিয়ার গঠন করা শিখান, উৎসাহ দেন, সাহস জোগান; আমাকে কেউ কোনওদিনও বলে নাই, আমারও ক্যারিয়ার বলে কিসু থাকতে পারে। খেয়েপরে বেঁচে যে আছি, এইটাই তো বেশি! ক্যারিয়ার কী আবার? আমি তো দুখে থাকার সুখে পড়সি। মজার না? আপনার মজা লাগবে না, আপনিও বোধ হয় ওই স্টাইলে পড়সেন। অবশ্য আমার ডিপার্টমেন্টের পরীক্ষা ছিল সামনে, তাই বিসিএস’এর পড়া সিরিয়াসলি পড়তামও না। তবে কনফিডেন্সের একটাই ফ্রি ক্লাস করসিলাম, তাও পুরাটা না, অর্ধেক! কারণ, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল, আমার বাসায় নিয়ম হল, সন্ধ্যার পর কেউ ঢুকতে পারবে না। তাছাড়া আমি তো আর বাসায় থাকতাম না, আমাকে ওরা দয়া করে থাকতে দিত। কেন জানি মনে হচ্ছে আপনার কিছু কথা আমি ওই সেমিনারে শুনসি, এক পুলিশ ভাইয়ের কাছে। সে আবার আপনার মহাভক্ত। হয়তো সেও শুনসে আপনার কাছ থেকে। সিংহ মামা আমাকে ক্লাস শেষ করার আগে চলে যেতে দেখে বলসিলেন, তুই তো ক্যাডার হচ্ছিস, কোথায় যাস? আমি বললাম, আমি তো কিছুই পড়ি নাই, কীভাবে হব? তার উত্তরে উনি বলসিলেন, তোর না হলে কারওরই হবে না। আমি বুঝসিলাম, এটা একটা বুদ্ধি, স্টুডেন্ট ভর্তি করানোর ধান্দা, আমার বাদে সবার হবে; কিন্তু বিশ্বাস করেন, ঐ কথাটাই আমাকে সম্মোহিত করে রাখসিলো কয়েকদিন। (হয়তো সবাইকেই উনি ওইরম বলেন, কিংবা ঐটাই ট্রিক; তাও।)

এই যে আপনি সবাইকে কীভাবে যেন ম্যাজিক দিয়ে বিশ্বাস করায়ে দেন, যেকোনও স্বপ্ন দেখবার এবং স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলবার অধিকার সবারই আছে, এটা আমার ভাল লাগে। মানুষ বাঁচে স্বপ্নে, আবেগে, সাহসে। আপনি ওইটাই দিয়ে দেন। পচা স্টুডেন্টরা পচাই থাকে ওদের কেউ ভাল বলে না, তাই। কেউ ওদের উৎসাহ দেয় না, দেখতে পারে না, জীবন নিয়ে ভাবতে শেখায় না। আপনি সবার ভেতরের আত্মসম্মানবোধটা জাগায়ে তুলতে পারেন। শুধু এইজন্যেই সবাই আপনাকে ভালোবাসে। স্রেফ ওদের নিজেদের জন্যেই, আপনার জন্য না। এইটা আপনি বুঝবেন, যদি কোনওদিন আপনি বিপদে পড়েন, সেদিন। যেটা বলতেসিলাম, সিংহ মামাকে ঐটাই প্রথম দেখা, ঐটাই শেষ। উনি আবার আমাকে দেখে ব্লাড গ্রুপও বলে দিসেন! উনি এটা বলে দিতে পারতেন, উনার এই ক্ষমতাটা ছিল। (ভাইবেন না যে উনি সবাইকেই ধইরা বি পজিটিভ বানায়ে দিতেন।) উনি মারা যাওয়ায় আমার খুব খারাপ লাগসিল। যা-ই কিছু হোক, ওই একটা মানুষই তো আমাকে বলসিল, আমি কিছু করতে পারবো। উনার জন্যে আমি দোয়া করি। প্রায়ই ভাবতাম, আচ্ছা, আমার কি আর বিসিএস দেওয়া উচিত? আমি কিন্তু থার্মোডাইনামিক্স নিয়ে থিসিস করসি, ঐটা আমার প্রিয় সাবজেক্ট। আমি কি ফিজিক্সেই থাকবো, নাকি জেনারেল ক্যাডার হবার স্বপ্ন দেখবো? আমি কি আদৌ পারবো? আমি সাধারণ জ্ঞান, বাংলা, ইংরেজী কিসুই পারি না যে! ভাল কথা, আমাকে বেশি গাধা ভাইবেন না যেন! (একটু গাধা ভাবতে পারেন, নো প্রবলেম।) আমি একাই ছিলাম যে পুরা ক্লাসকে ফ্ল্যুয়িডসের অংক বুঝাইসি। ২দিন তো স্যার ছেলেপুলেদের উপর এতই চটেছিল যে আমাকে ক্লাস নেবার দায়িত্ব দিয়ে চলে গেসিলো। জ্বি, এই গাধীটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইসে! হিহি…… আমাকে নিয়ে স্যারদের কত গোপন প্রশংসা কানে আসছে! তখন বুঝি নাই, এখন বুঝি, স্যার আসলে আমার ক্লাসমেটদের অপমান করার জন্য আমাকে ব্যবহার করসে, এই কারণে থার্ড ইয়ারের পর থেকে যখন আমার ধ্বস নামলো, সবাই আরও বেশিবেশি গুজব ছড়াতো, হাসাহাসি করতো, খুশি হতো, আমাকে নিয়ে কত মিথ্যা কথা আমি শুনসি। আপনার একটা ডায়লগ আছে না, “বন্ধু রেজাল্ট খারাপ করলে মন খারাপ হয়, আর বন্ধু আমার চাইতে ভাল করলে মেজাজ খারাপ হয়!” ওদেরই বা কী দোষ? ওরা তো আমার জন্যই স্যারদের গালমন্দ শুনসে। আমিই তো ওদের খ্যাপায়ে দিসি! নিজের সাফাই দেবার চেয়ে বড় আপমান আমার কাছে আর কিছু নাই। খুব বিপদে না পড়লে সাফাই দেই না। ওদের উপর আমার কোনও রাগ নাই অবশ্য। উল্টা এখন ভাবতেসি ওদেরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাব কিনা? ওরা কিন্তু রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট নাও করতে পারে! আপনারা ভাবেন, বিসিএস ক্যাডার হইলে বুঝি খালি রিকোয়েস্ট ইগনোর করা যায়। আপনাদেরকেও ইগনোর করা যায়। কোনও ব্যাপারই না! আপনার রিকোয়েস্ট ইগনোর করলে আপনার কেমন লাগে? আমাকে কেউ ইগনোর করলে আমার তো রীতিমতো গা-জ্বালা করে! তাই আমি অনেক ভেবেটেবে ওদেরকে রিকোয়েস্ট পাঠাই না। থাকগা। ফেসবুকের ফ্রেন্ডশিপের তো এক পয়সাও দাম নাই, তাই না, বলেন?

আচ্ছা, সব গল্পই তো করলাম, শুধু কার কারণে এইসব কিসু হইসিল তা তো বলি নাই! প্রথমত, আমার নিজের কারণে। কারণ আমার বুদ্ধিসুদ্ধি কম ছিল, ঐটাই আমার দোষ। আমি সবসময়, সব কিছুতে নিজের দোষ খুঁজে পাই। (আপনার লেখায় দেখসি, আপনি লিখসেন, ছোটোবেলায় আপনার ভাই খেলনা ভেঙে ফেলার পর যখন মা’র কাছে আপনার দোষ দিত আর আপনি দোষ না করেও মাইর খাইতেন, তখনও আপনি কখনওই বলতেন না যে ওটা আসলে আপনার দোষ না। তখন হয়তো গাধা ছিলেন, কিন্তু এটা প্র্যাকটিস হয়ে যাওয়াতে পরবর্তীতে আপনি বলতে পারসেন, আমি শুধু নিজের দোষ ছাড়া এই পৃথিবীতে সবার দোষ ক্ষমা করে দিতে পারি। এই কথা বলতে শক্তি লাগে, প্রচণ্ড সাহস লাগে। আপনার লাইফ অব পেন্যান্স থিওরিটা আমার অনেক পছন্দ হইসে! আমি নিজেও এইটার মধ্য দিয়ে গেসি।) আর দ্বিতীয়ত, একটা শুয়োরের কারণে। বিস্তারিত লিখবো না, আপনার যা মন চায়, বুঝে নেন। আমি অন্য মানুষের ‘যা মন চায় বুঝে নেয়া’র ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে গেসি। কে কী বুঝলো, সেটা তার সমস্যা, আমার না। তাছাড়া ভাই, মানুষের কলঙ্কের কথা শুনে কী আর হবে? কলঙ্কের রূপ কমবেশি একইরকমের। আল্লাহর দুনিয়ায় খালি এই জিনিসটাতেই বৈচিত্র্য কম। আর সমস্যা হল, আপনাকে লিখতে-লিখতে আমার মনটা আবার ভালও হয়ে গেছে। পুরনো কথা আবার তুললে আবার মন খারাপ হয়ে যাবে। কী দরকার? “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!” অতএব, খোঁড়াখুঁড়ি ইশটপ! অনেকবেশি কাঁদতে-কাঁদতে আমি একটা সময়ে কাঁদতেও ভুলে গেসিলাম। আর মানুষের কষ্ট তো আর কান্নার চাইতে আপন না। তাই, আমার কান্নাটাকে আমি ভুলেও গেসি। দুনিয়ায় সবাই হাত ছেড়ে দেয়, একমাত্র কষ্টই কখনও হাত ছাড়ে না। “কোনওকিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভাল” আপনার এই কথাটা আমি মানি। আমার কষ্ট আমার নিজের কাছে অনেকবেশি দামি। এটা আমি কখনওই সস্তায় বিকোই না। আমি যে কষ্টে গড়া মানুষ! আপনি ভাবতেও পারবেন না আমি কত অন্যায় কত অত্যাচার সহ্য করসি। আমি এখন সবাইকে বলি, মুগ্ধ হও, প্রশংসা কর, প্রয়োজনে প্রেমও কর, যা করতে মনে চায় তা-ই করো, কিন্তু কখনওই কাউকে ভালোটালোবেসে ফেলো না। (ভালোবাসা কথাটা শুনলেই কেন জানি ঘেন্না লাগে, বমি চলে আসে।)

আপনি লিখসেন, কারওর প্রচণ্ড ভালোবাসা সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নাই। আমি বলি, নিজের প্রচণ্ড ভালোবাসার অনুভূতি সহ্য করার ক্ষমতাও মানুষের নাই। নিজের প্রচণ্ড ভালোবাসার কাছে ভালোবাসার মানুষটার করুণাকে পর্যন্ত ভালোবাসার মতোই মোহনীয় মনে হয়। আমি একটা ট্র্যাপে পড়সিলাম; ভালোবাসার ট্র্যাপ। এর চাইতে জঘন্য ট্র্যাপ দুনিয়ায় নাই। মা এখন বলে, তুই কীভাবে সহ্য করে ছিলি! আমি নিজেও অবাক হয়ে যাই। এখন মাঝেমাঝে ভাবি, কীভাবে? কীভাবে? আমার তো পাগল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল! কিন্তু হই নাই। সুস্থ আর স্বাভাবিক আছি। মানুষ চাইলেই পাগল হয়ে যেতে পারে না। পাগল হওয়ার যোগ্যতাও সবার থাকে না। পাগল হওয়াটা কঠিন ব্যাপার। এখন কিন্তু সত্যিই আমি অনেক সুখে আছি। আমি তখন ভয় পেতাম, যদি সবাই জেনে যায়! যদি সবাই জেনে যায়! আমি সেটা কীভাবে ফেস করবো? সবাই মানে আমার পুরা পরিবার, পুরা পরিবার মানে আমার গুষ্ঠির সবাই। বাইরের লোককে আমি পাত্তা দেয়া ছেড়ে দিসি অনেকদিন হল। বড় মামা জানতে পারলে তো পুরাই জবাই করে দিবে। আব্বু এতকিছু জানে না, জানলে ছেলেটাকে ভর্তা করে ফেলতে পারবে। একবার রাজশাহীর একটা ছেলে আমাকে প্রেমপত্র দিসিলো। এরপর ওই ছেলের পুরা গ্যাংরে ধইরা আমার বাপ-চাচারা যে মাইর দিসে! তাইলে, ওর অবস্থা কী হবে! আমার বাপের লাঠিয়াল বাহিনী ছিল। নাটকে যেরকম দেখেন, ওরকম। অনেক মানুষকে উনার বাহিনী জমিজমা দখল নিয়ে পিটাইসে। মানে, আমার আব্বু অন্য মানুষের জমি জোর করে দখল করে ফেলতেন। এটা তো অন্যায়। ন্যাচারাল জাস্টিস মানুষ এই দুনিয়াতেই পায়। আপনি সেদিন লিখসেন না, “হোয়াট গৌস অ্যারাউন্ড কামস অ্যারাউন্ড। এভরি ম্যান ইজ পেইড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েন।” আমি পড়ে অবাক হয়ে গেসি। ভাবসি, এই ব্যাটা এইটা জানলো ক্যামনে! আল্লাহ হয়তো আমার বাপের শাস্তি আমাকেই দিসে। মানুষ কৃতকর্মের ফল ভোগ নিজে না করলেও নিজের ছেলেমেয়েকে তা ভোগ করতে দেখে। ওইটা তো আরও বেশি কষ্টের! আমার বাপ-মা ভাল থাকুক, তাতেই হবে, আমি তাদের সব অন্যায় আর অহংকারের শাস্তি না হয় পেলাম। এখন আর আমার কিসু হয় না, আমার সবকিসুই সয়ে যায়। আমার ফ্যামিলি থেকে এসব বলাও আসলে নিষেধ আছে। আমি নিষেধ শুনি না কিন্তু মা, পূর্বা, মানে আমার বড় বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের খোটার দোহাই দিয়ে আমার মুখ বন্ধ রাখসে। তাও আমি বলবোই, সব বলে দিবো সবাইকে। জয়েন করলাম মাত্র, এখন আর ভয় নাই। যে মানুষের হারানোর কিসুই নাই, তার আবার হারানোর ভয় কীসের? তবে আমারও ভয় আছে, পাওয়ার ভয়, পেতে চাওয়ার ভয়। আমি যা না, আমাকে লোকে সেটা ভেবে আমাকে সতীসাবিত্রী জানবে, ভাববে দূর্বা একটা অসাধারণ মেয়ে, ওর মতো মেয়ে হয়ই না, আমি সেই লোড নিতে পারি না। আমি যতোটা খারাপ, তার চেয়ে বেশি খারাপ ভাবুক, অসুবিধা নাই, তবু ভাল ভেবে কেউ আমাকে ভালোবাসা দিলে সেই ভালোবাসাটা আমার কাছে একটা মহাপেইন। আচ্ছা, আপনাকে কত পাবলিক ভালোবাসে! আপনি এত ভালোবাসার ঠ্যালা সামলান ক্যাম্নে? বিরক্ত লাগে না? সবচেয়ে খারাপ লাগে কখন জানেন? আমি আমার ছোটো বোনদের মানে কাজিনদের কোনওকিছু করতে ‘না’ বলতে পারি না, এই ভয়ে, যদি তারা বলে বসে, আমরা যা-ই করি না কেন, তোমার মতো খারাপ তো আর না! তাদের শুধু আদর করি, শাসন করতে পারি না। কাউকে শাসনহীন সোহাগ করা আমার কাছে শাস্তির মত।

আমার এক সুন্দরী (যদিও আমি বিশ্বাস করি মানুষের সৌন্দর্য থাকে মনের ভিতরে, মাথার খুলির ভিতরে। ‘সুন্দরী’ বলতে আপনাদের দৃষ্টিতে যেমন বোঝায় তেমনভাবেই বললাম।) বান্ধবীর যুক্তিটা অবশ্য মনে ধরেছে, সে বলসে, দূর্বা, তুই যা বললি সব ঠিক আছে, তুই নাহয় গরগর করে সবাইকে সবকিছু বলে দিয়ে নিজে হাল্কা হয়ে গেলি, কিন্তু তাতে কী হবে? ছেলেপেলেরা তোকে অন্য নজরে দেখা শুরু করবে; ভাববে, এই মেয়েটা তো সস্তা। এই মেয়েটাকে পটায়ে বিছানায় নিয়ে যাওয়া যাবে। এরপর? এরপর ভাবসি, তাইতো, এই বুদ্ধি মাথায় আগে কেন আসে নাই? আমি যাব কোনদিকে? তবে আপনাকে এই ফাঁকে বলে রাখি, ঐ ছুকরির কপালে দুখ আছে, বুঝলেন? ধাক্কা খাইসি তো, তাই আমি অনেককিছু বুঝতে পারি। এক ছেলের দুই প্রেমিকা, এইটা শুনসেন; কিন্তু এক মেয়ের একসাথে দুই প্রেমিক, এইটা শুনসেন কি কখনও? আবার দুইজনই জানে সব! এবং দুইজনই বাজে ছেলে। কেউ কাউকে দেখতে পারেনা। ছেলেরা শরীরের কাঙাল, আর মেয়েরা ভালোবাসার। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, মেয়েরা ভালোবাসার গন্ধ পেলেও ফাঁদে পা দিতেও রাজি! কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা মরীচিকা, সেটা ওরা কিছুতেই বোঝে না। ওরা মিষ্টি কথার বশ। এমনকি একটু ডোজেও চলে! ছেলেরা পারেও! আমি আমার বান্ধবীকে ফেরানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, সে নিজেও বুঝে সব। শুনেন, মেয়েরা কিন্তু বোকা না, অথচ কী এক অদ্ভুত কারণে বোকা হতে আপত্তিও করে না! আমি ওকে বলেছি সবকিছু বাদ দিয়ে চলে আয়, নতুন করে জীবন শুরু কর। নিরাপত্তা বাদে মেয়েদের জীবনে আমি তো ছেলেদের দরকার খুঁজে পাই না। জানি অন্যান্যকিছুও আছে। ওইসব তো নিরাপত্তার সাথে প্যাকেজ হিসেবেই চলে আসে। ওকে আমি এটাও বলসি, আমি চাকরি পেলে তুই ওদের কাছ থেকে গিফট হিসেবে যা যা নিসিস সব টুকটুক করে শোধ করে দিব। আমাকে কিছুই দিতে হবে না, শুধু তুই ভাল থাক। ও কী বলে শোনেন, ওরা নাকি ওকে তাবিজ করসে। আপনি বলেন, ধরে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছা করে না? শালার এইরকম একটা তাবিজ আমার দরকার, টম ক্রুজের নাম লিখে পাহাড়ের চূড়ায় কচু গাছের সাথে বেঁধে রাখবো ঠিক করসি।

আমার বাপের কপালেও দুখ আছে। আমি বুঝতে পারি। কারণ, আমি ঠিক করে রাখসিলাম, আমি চাকরি পেলে রাজশাহীতে আর আসবোই না। (জানি, ঠিকই আসবো। না এসে উপায় কী? আমারই তো মা-বাপ!) আচ্ছা, আপনার কপালে আছে কী? একটা সত্যি কথা বলি? রোমান্টিক কিসু ভেবে বইসেন না আবার, ঠিক আছে? ওইসব রোমান্সটোমান্সকে আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমি আপনাকে চিনি না, চ্যাটিংয়ে বলতে গেলে আপনি আমাকে হাতেখড়ি দিসেন, আবার উচিত শিক্ষাও দিসেন, রিপ্লাই করেন না, ঘাড়ত্যাড়া কথা বলেন, মেজাজ খারাপ করে দেন; কিন্তু আল্লাহর কসম, আমার আপনার জন্য চিন্তা হয়। চাকরিটাকরি করা শুরু করসি, হয়তো একসময় আপনাকে ভুলেও যাব। (মিথ্যা বললাম, আমি কিসুই ভুলি না, তাই আমার যন্ত্রণাও বেশি।) কিন্তু এখন তেমন কোনও কাজ নাই, তাই আপনার জন্য ভাবি। আমি আসলে সবার জন্যই ভাবি। আপনি মানে আপনি না, যারা ভাল বলে আমার কাছে মনে হয় তারা সবাই। আমি কারওর খারাপ চাই না, এমনকি আমার শত্রুরও না। আমি এতোই গাধা যে, আমি এখনও ওই শুয়োরটার জন্যে দোয়া করি। আমি আপনাকে নিয়ে ভয় পাই যে, আপনি উন্নাসিক কি না, অন্যদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন কি না, কারওর মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলেন কি না, অহংকার দেখান কি না, বিরক্তি দেখান কি না, নিজেকে অনেক বড় ভাবেন কি না, লোকজনকে অসম্মান করে কথা বলেন কি না………. ভুরু কুঁচকাবেন না প্লিজ, এগুলো আমার সন্দেহ না, প্রশ্নও না হয়তো; এগুলো আমার ভয়। এইসব প্রবৃত্তি মানুষকে অনেক নিচে নামিয়ে দেয়। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, আপনি একজন ভাল মানুষ। তাই অনুরোধ করছি, যত দূরেই যান না কেন, এইসব কখনওই করবেন না। প্রকৃতির মার অনেক কঠিন ভাই, আমি জানি। আমি চাই না, কেউ কষ্ট পাক। আপনাকে সেইদিন জিজ্ঞেস করসিলাম, “সবাই ভাল অবস্থানে গিয়ে, সাফল্য পেয়ে সেটাকে নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়…..এটাই নিয়ম হয়তো। কিন্তু আপনি সেটাকে নিজের কাছে ধরে রাখতেসেন না, সবার চোখে মুঠোমুঠো স্বপ্ন ছড়াচ্ছেন। এটা কেন করতেসেন? এতে আপনার কী লাভ?” আপনার উত্তরটা আমার মনে লাগসে। আপনি লিখসেন, “ওরে বাবা! আমার স্বপ্ন শেয়ার করতে ভাল লাগে, হেল্প করতে ভাল লাগে, কেউ মন খারাপ করে থাকলে কষ্ট পাই, (আমি তো জানি মন খারাপ থাকলে কী যে ভীষণ কষ্ট হয়!) কেউ জীবনে কিছু করতে পারবে না ভাবলে আমার নিজেরই টেনশন হয়, (আমাকে নিয়েও সবাই ওরকম ভাবতো কিনা!) সবাই ভাল থাকুক, এটা ভাবতেও ভাল লাগে, আমার কথা শুনে যখন কারওর চোখে হাসি খেলা করে, সেটা দেখতে ভাল লাগে……. আমি যা কিছুই করি না কেন, আমি নিজে ভাল থাকার জন্যেই করি, আর কিছু না। এতে কারওর ভাল হলে আমার ভাললাগা তো আরও বাড়বে, কমবে না। ……. বুঝসো?” আমি বলি কী, আপনি এইভাবেই থাকবেন। সবাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করেন (আমি বাদে, আমার জন্যে আমি আছি, আমার এখন আর কাউকেই লাগে না), আপনি যা, তাই তো থাকবেন, দ্য নৈঋত’র কিসু হবে না, মানুষও খুশি থাকবে। আপনি মাঝেমাঝে ফেসবুকে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করেন। এটা করবেন না প্লিজ। (আমি কি বেশিবেশি দালালি করতেসি?) আমি ভয় পাই, যদি কখনও মানুষ আপনাকে পচায়, অসম্মান করে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে! তখন কী হবে! তখন আপনারও আমার মতন মরতে ইচ্ছা হয় যদি! ইনশাল্লাহ এমন হবে না, তবুও, যদি হয়, যদি হয়! যদি হয়-ই সত্যিসত্যি, একবার আমার সাথে কথা বলবেন প্লিজ। এটা আমার অনুরোধ। ঠিকাসে? আমি আপনাকে এমন বুদ্ধি দিব, আপনি বিনা ব্যথায় নিশ্চিতভাবে মরতে তো পারবেনই, আবার কেউই বুঝতেও পারবে না যে আপনি আত্মহত্যা করসেন। এটা সত্যি বললাম কিন্তু! আমি কিন্তু ‘হেমলক সোসাইটি’ দেখি নাই। একদম কসম, বলতেসি!

আমি আপনার জন্যে দোয়া করবো। আর আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। জানি না কীসের, তবে করবেন। ঠিক আছে?

আচ্ছা, বিদায়!

পুনশ্চ।

পায়ে পড়ি তোমার, একটা গল্প লেখো তুমি শরৎবাবু,

নিতান্তই সাধারণ মেয়ের গল্প–

যে দুর্ভাগিনীকে দূরের থেকে পাল্লা দিতে হয়

অন্তত পাঁচ-সাতজন অসামান্যার সঙ্গে–

অর্থাৎ, সপ্তরথিনীর মার।

বুঝে নিয়েছি আমার কপাল ভেঙেছে,

হার হয়েছে আমার।

কিন্তু তুমি যার কথা লিখবে

তাকে জিতিয়ে দিয়ো আমার হয়ে,

পড়তে পড়তে বুক যেন ওঠে ফুলে।

ফুলচন্দন পড়ুক তোমার কলমের মুখে।

তাকে নাম দিয়ো মালতী।

ওই নামটা আমার।

ধরা পড়বার ভয় নেই।

এমন অনেক মালতী আছে বাংলাদেশে,

তারা সবাই সামান্য মেয়ে।

তারা ফরাসি জর্মান জানে না,

কাঁদতে জানে।

রবি ঠাকুরের সেই সাধারণ মেয়ের গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। স্রেফ বেঁচে থাকলেও অনেককিছু হয়। আমার গল্পের নায়িকা শুধু কোনওরকমে বেঁচেবর্তে ছিল। ওর বেঁচে থাকার মানে ছিল, স্রেফ মরে না যাওয়া। আর কিছুই না। ও এভাবেই বেঁচে ছিল। একেবারেই চাওয়াপাওয়ার প্রত্যাশাহীনভাবে বেঁচে-থাকা। পাওয়া অবশ্য একটা ছিল। সবাই দয়া করে ওকে ভাতকাপড় দিয়েছে। মানুষ হয়তো কখনও-কখনও স্রেফ ভাতকাপড়েও বাঁচে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছে, মৃত্যুর অবিরত ইশারাকে তোয়াক্কা না করেই। জীবন মানেই তো এমন নিরাবেগ বোঝাপড়া, তাই না? এই যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্যে থেকেও সে বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে, নিজের মেধার জোরেই ক্যাডার হয়েছে। মনের ইচ্ছা সৎ থাকলে আর সাথে আন্তরিক চেষ্টা থাকলে মহান আল্লাহ কাউকেই খালি হাতে ফেরান না। ও এখন একটা সরকারী কলেজে পদার্থবিজ্ঞান পড়ায়। আমরা ধরে নিচ্ছি, গল্পটা স্রেফ গল্পই, কিংবা গল্প হলেও সত্যি। এই গল্প ওর একার নয়, এই গল্প আরও দশজন সাধারণ মেয়ের, যারা হারিয়ে যায়নি। ওরা জীবনের কোনও একটা সময় এই পৃথিবীতে স্রেফ টিকে ছিল বলেই এখন প্রচণ্ডভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।