অনুব্রত, ভালো আছ? ভাবছ, বোকার মতন প্রশ্ন করছি, ইদের দিন কে না ভালো থাকে!
আজ ইদ। হ্যাঁ, আমাদের সপ্তম ইদ! শুভ সাত! তোমাকে ইদের শুভেচ্ছা জানাতে খুব করে মন চাইছে; এর জন্য প্রতীক্ষায় ছিলাম গত তিরিশটা দিন! জানো, প্রথম ইদের স্মৃতি শিশিরভেজা বকুলের মতো এখনও বেশ টাটকা আমার স্মৃতির বাক্সে। কেমন একটা ভেজা ভেজা সবুজ গন্ধ পাই! প্রথম যখন শুভেচ্ছা পেয়েছিলাম, ইদ-ভোরটা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় জন্মের মতন করে। ভোরের প্রথম পাখিটা জেগে ওঠার আগেই আমি-তুমি জেগে উঠেছিলাম! তুমি লিখেছিলে, ইদের প্রীতিসম্ভাষণ। তখন মনে হয়েছিল, আমার জীবনে এর আগে বুঝি ইদ আসেইনি!
আচ্ছা, নিজে নিজে হেসে ওঠার মানে কী হয়, জানো? আর একা একা সুখের অনুভূতি কেমন হয়, সেটা? চাইলেও নিজের চোখে-মুখে লজ্জার প্রতিরূপ ঠেকাতে না পারার অর্থ কী হয়, খুৃঁজেছ?
জানতে, আমিও জানতাম...ঠিক তখন থেকেই জেনেছি! উত্তরগুলো আমার মতো তুমিও খুঁজে পেয়েছিলে; তবেই তো তুমি "ভালোবাসি" না বললেও ভালোবাসাটা ঠিক ঠিক বুঝেছিলাম...বুঝেছিলে তুমিও! সেই দিনজুড়ে তুমি মিশেছিলে, ক্ষণে ক্ষণে ডেকেছিলে! আমার ব্যক্তিগত একটা মুঠোফোন ছিল না বলে দেখতে পাওনি আমায়!
বলেছিলে, বড়ো খালার বাড়ি চলে আসো, তোমাকে দূর থেকে ছায়ার মায়ায় দেখব। কতটুক ছিলাম আমি তখন! এই এট্টুক ছানাপোনা দলের একজন আর কি! কিন্তু ঠিকই সবাইকে রাজি করিয়ে ফেললাম! ভালোবাসলে মুখচোরা ভীতু মানুষটাও আদায় করে নিতে শেখে! অবাক হচ্ছ, মুখচোরা ভীতু বলাতে?! আহা, ভুল কোরো না, ওটা পড়াশোনা নয়...অভিনীত সুযোগ বলে ওটাকে!
দেখলে, তোমায় ভালোবাসতে গিয়ে ইউক্লিডকে পাশে রেখেই কত-কী শিখেছি আমি এই জীবনে! উহুঁ ভুলে যাইনি, আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে বহু বহু নিয়ম সাঁতরেছ তুমিও! একআকাশ বিস্ময় নিয়ে দেখতাম, এত ধরাবাঁধা চিন্তার মানুষটা অবিশ্রান্ত সাঁতরে চলেছে! কখনও রোদ, কখনওবা ফুল, নদী, পাহাড়, রাস্তায় কান্নারত বালিকা, হাঁক ডেকে-যাওয়া ফেরিওয়ালা, এক ঝাঁক বুনো অথচ সামাজিক শকুনের প্রশ্ন, কিংবা বইয়ের পাতায় ইউক্লিড, সবার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে এক অসময়ী প্রেমিক!
একটা শব্দই তো ছিল, অক্ষরও মোটে চারটা...ভালোবাসা! তা-ও কতখানি শক্তি ধরে নিজের গর্ভে! তাই না? পাশে থাকার মানুষ বলতে এক আমি। কখনও তোমাকে এতটা শক্তি জুগিয়েছি যে ভাবতে গেলে কান্নারা সব দলা পাকিয়ে যায়!
কতটা ভালোবাসা দিলে মানুষ চোখের জলেই দাঁড় বায়! ভাবতে পারো? অনুব্রত, কতখানি ছোঁয়া মেশালে পরে অনুভূতি অতটা ঘন হয়? কতটা আড়ালে গেলে দূরত্বও ধৈর্য হারায়? কতখানি জমালে কথা অভিমান বাষ্পীভূত হয়? কতটা পাগল হলে কেউ অঙ্কের সূত্রে, জ্যামিতির দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে তোমাকে হাতড়ায়? পুরোনো খাতায় তোমার হাতের লেখায় লেখায় তোমাকে ছুঁতে চায়...অস্থিরতার কোন সীমায়? শব্দহীনতার কত নম্বর ধাপে ব্যথা গলে জল হয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার চাই না, অনুব্রত; এসব তোমার জন্যেই তোলা থাক।
জানো, সব কিছুতে এখনও তুমি মিশে আছ! হাওয়ায় হাওয়ায় মেহেদি ফুলের গন্ধ তোমাকে মনে করিয়ে দেয়...সেই যে টানা-বারান্দায় একটা মেহেদিগাছ ছিল! মাইকে বাজানো কত গানের সুর তোমাকে কাছে টেনে আনে, মায়ের রান্নায় নানান পদে তোমার স্বাদ লেগে আছে। আতরের শিশি, পাঞ্জাবির ভাঁজ, বাইরে শিশুদের গুঞ্জন, একান্তে কোনও এক প্রেমিকের দেওয়া কানের দুল, চাঁদরাতে চাঁদ দেখে একদল ছেলেমেয়ের উল্লাস, গ্রামের মাঠে অবাধ্য পুটলুর বাজিতে মেশানো আনন্দ---ওরা সবাই তোমার কথা বলে! ঠিক সেই ভোরের মতন ভালোবাসতে বলে আমাকে! বলে, ভালোবাসতে বাসতে দেউলে হয়ে যাও! একজীবনে এত পয়সা জমিয়ে করেছটা কী!
আজ আমার নিজের একটা ফোন হয়েছে, নিজের একটা ঘরও আছে! একান্ত কিছু সময় পেয়েছি, দু-চারটে কলম কিনেছি, দুটো মিষ্টি ডায়েরি, একটা জলঘড়ি, একটা কম্পাস, বেশকিছু খালি পাতা আর ওই তো...তার সঙ্গে খুচরো কিছু শব্দ! অথচ তুমি...! দেখতেই চাও না তো আর! ছায়ায় দাঁড়িয়ে মায়া লাগাতে আসো না তো একটা বারও! ভালোবাসতে হলে বুঝি সময়ের প্রতিকূলতা, পরিস্থিতির অসংগতি, অসম প্রেম, সুযোগের অপ্রতুলতা এসব অযাচিত মেহমানকে দু-বেলা রোজ সয়ে যেতে হয়?
অনুব্রত, আগের মতন অমন আগুনরাঙা শক্তি আমি আর পাই না ! আমার শক্তি হয়ে ওঠো না আবার, প্লিজ! তুমি না চাইতেই তোমার কুঞ্চিত কপালের ভাঁজে ভাঁজে আমার হাতের রেখা লেপটে থাকুক! হাওয়ায় অবিন্যস্ত চুলের গভীরে হোক আমার আঙুলের ঘরবাড়ি ! নাকের নিচে আর ওষ্ঠের উপরের ছোট্ট জায়গায় বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে...'অনেকখানি আমি' জমে থাকি! ছিঁড়ে-যাওয়া বোতামের সুতোয় গেঁথে যাক আমার দৃষ্টি! খাতা-কলমের ব্যস্ততায় ভরা রাতে কফির মগে আমার হাসি বাষ্প হয়ে উড়ুক! আমি তোমার 'আঠারো বছর বয়স'...কবি সুকান্তবাবুর! বলে ফেলতে যদি, এসব অনুভূতিই আমার নতুন ভোরে জেগে ওঠার তাড়না! ঠিক তাড়না নয়; তুমি আমার নবায়িত শক্তি গো, নীলা!
অনুব্রত, তবে আমার বেলায় অমন থমকে গেলে কেন? হয়তো এর জবাবটা আমার অজানা নয়, সব জানতে যে আমি চাইনি ভুলেও! বেলাশেষে একদিন কথায় কথায় বলেছিলে, যখন বয়েসটা বেড়ে জানান দেবে রোদের কাছে, নীলা খোঁপায় ফুল গুঁজে সাজতে জানে, ঠিক তখন... কেউ তো আসবে সেই ফুলবাগানের মালি হতে! তখন আমি না-ইবা রইলাম কাছে; আমি যে দেয়াল হতে চাইনে ফুল আর ভ্রমরের প্রেমে! রাখবেও না তখন এই আমাকে হৃদয়গহীনে!
রোজই একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে তোমার চোখের দৃষ্টি, আর একটু একটু করে বুড়িয়ে যাচ্ছি আমি! না...নীলা, এ বয়েস নয়! এ শুধুই ভয়; এক অসময়ী প্রেমিকের ভয়! তবে কি এই ভয়ই তোমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে সেই গভীর গর্ভে, যেখানে অগভীর অনুভূতি পৌঁছুতেই পারে না দিনের অস্বচ্ছতায়! অনুব্রত, নিজহাতে গড়া ভালোবাসা কার হাতে রেখেছ বন্ধক? না কি তুমি দান করে দিয়ে গেছ তা? এক ভালোবাসাই পারে অমন নিঃশর্ত দান করে দিতে! এ জগতে ভালোবাসতে এক মন বাদে কিছুই লাগে না! অথচ দেখো, হাতটা ধরতে...রাজ্যের সব দেনা-পাওনার হিসেব নিয়ে বোশেখ আসার আগেই হালখাতা জমা দিতে হয়!
ভালোবাসা মানেই সকল প্রেমিক-প্রেমিকার দগদগে এক লুকোনো ক্ষত! পাখিতে, জলে, মৃত ঘাসে, রাস্তার টোকাই দলের ক্ষুধার্ত চোখে আমি ভালোবাসার অসুখ দেখতে পাই! ঘুণেধরা বইয়ের মলাটে আমি আবেগের অভিযোগ শুনি শত শত! সন্ন্যাসীর ধ্যানে প্রেমের মাংসপোড়া গন্ধ নিয়েছি টেনে অহরহ! চোখে-ঠোঁটে পাতা সংসারে শুধুই বৈরাগ্য বিরাজ করে চলেছে বছরের পর বছর... প্রেমহীন ঠোঁটে ভেজা হাসি ফুটবে কেমন করে, তুমিই বলো!
আমি দেখেছি, দোয়েলের সাথে, বটবৃক্ষের নিচে, পার্কের শূন্যতায় বিছানো বেঞ্চে, জলসার আসরে, সোহরাওয়ার্দীর ময়দানে, রমজান চাচার সিগারেটের ধোঁয়ায়, বন্ধুদের আড্ডায় একা বসে থাকা চুপচাপ ছেলেটার অসহায় দৃষ্টিতে, স্কুলশেষে ঝালমুড়ির প্যাকেটে প্যাকেটে, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় হেরে-যাওয়া পঙ্ক্তির কান্নায়, গ্রীষ্মের দুপুরে মুড়ি-কাঁঠালের মাখামাখিতে কিংবা শরতে পাতার আগুনে আলুপোড়ায় কতশত প্রেমিকের চোখের জল অবহেলায় মিশে আছে, ধুয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিশোধিত জলে...
কে বলে, অনুব্রত, বৃষ্টি শুধু প্রেম হয়েই নামে? ঘোরলাগা উষ্ণতায় প্রেমিকযুগলের মন ভেজাতেই কেবল বৃষ্টি ঝরে? বৃষ্টিতে চোখে, ঠোঁটে, চুলে অবাধ্য প্রেম জাগে? দু-চারটে কাব্য লিখতেই কেবল কবির মনে বৃষ্টি হানা দেয়? এসব আমার জানা প্রয়োজন। এসব আমার অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন তোমার কাছে, ভালোবাসার কাছে, কবিতার কবির কাছে, বুনো হাঁস ও সন্ধ্যার আকাশের কাছে, প্রতীক্ষিত প্রতিটি ভোরের কাছে, আমার একান্ত সাতটি ইদের কাছে, অনুভূতি এবং মেঘের কাছে!
আমি বড্ড ক্লান্ত সংক্ষিপ্ত আবেগের দীর্ঘ প্রকাশে! তোমার ওই গানটা এক বার গাইবে? বহুদিন শুনিনি... আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে খরা চলছে...একটু কাটবে! তোমার দেওয়া কলমটা এখনও আছে তোমার একটুকরো অস্তিত্ব হয়ে! অনুব্রত, তোমার জানলায় আমার পাঠানো ফিনিক্স পাখিটা আসে? আমার হয়ে রোজ তোমাকে ঠিক নুনের মতন ভালোবাসে?