একটু আগে জিমেইলে চেপে আমেরিকা থেকে কিছু কথা উড়ে এল।
সেখানে লেখা:
বন্ধু, খুব কষ্টে আছি। একটু দোয়া করিস। এই তো সেদিনও টানা ১৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিউটি করলাম। সেলসম্যানের চাকরি খুব কষ্টের, বন্ধু, খুউব! প্রায়ই ভাবি, এখানে কেন এলাম? কত রাতের পর রাত ঘুমাতে পারি না, ট্যাক্সি চালাতে হয়। ওয়েটারের কাজও করেছি, লোকজনের কাছ থেকে হাত পেতে বকশিস নিয়েছি। দেশের কথা মনে পড়ে রে, বন্ধু। কিচ্ছু ভালো লাগে না। এখানে কেউ আমাকে চেনে না। তাই এসব কাজটাজ করে বেঁচে আছি, বন্ধু। পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে হয়, চেহারা দেখে পাশ করানোর ভার্সিটিতে ভর্তি হইনি। শেষ বার কবে আরাম করে ঘুমিয়েছি, মনে পড়ে না। এখন ভাবি, আগেই ভালো ছিলাম।
বন্ধুর মেইল পড়ে কষ্ট লাগল। আবার ঠোঁটের কোনায় নিজের অজান্তেই একটা বাঁকা হাসির রেখাও উঁকি দিয়ে গেল বোধ হয়। কেন? পুরনো একটা দিনের কথায় ফিরে যাই।
২০১০ সালের একটা বৃষ্টিস্নাত দুপুরবেলা। তখন আমি দোকানদারি করি। চট্টগ্রামের চকবাজারের গুলজার টাওয়ারের দোতলায় মুখোমুখি দুটো দোকান---আমার গিফটশপ ‘দোভানা’। আমার দোকানে একজন কর্মচারী ছিলেন; পীযূষদা। সেদিন সকালের দিকে ওঁর ছোটো মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তাই উনি দুপুরের আগেই ছুটি নিয়ে চলে যান। দোকানে আমি একা। সেদিন আমার ছোটো ভাই আর ওর বন্ধুও ছিল না। (আমি, আমার ছোটো ভাই পাপ্পু, ওর বন্ধু আরেফিন আর পীযূষদা, আমরা এই ৪ জন মিলে দোকান চালাতাম।) একা দুইটা দোকান সামলানো একটু কঠিন। যে বন্ধুটার ইমেইল পেলাম একটু আগে, আমার এ বন্ধুটা প্রায়ই আমার দোকানে আসত। গল্প করত, খাওয়াদাওয়া করত, গান শুনত, মুভি দেখত। আমার দোকানে আমি রেয়ার কিছু মুভি-মিউজিক বিক্রি করতাম।
সেদিন ওকে ফোন দিলাম। অনুরোধ করলাম, ফ্রি থাকলে যাতে একটু দোকানে আসে, আমাকে হেল্প করে। ও এল। আমি একটা দোকানে বসেছিলাম, ও আরেকটাতে। দুই দোকানের মাঝখানের প্যাসেজটাতে বসে দুজন মিলে গল্প করলাম, ডিম-পরোটা খেলাম। একটু পর একজন কাস্টমার এলেন। ও যে দোকানটাতে বসেছিল, কাস্টমার সেটাতে ঢুকলেন। ও কিছুই বলছিল না, আপনমনে ফেইসবুকিং করছিল। কাস্টমার নিজেই দেখেশুনে একটা ফ্লাওয়ার-ভেইস পছন্দ করলেন। আমার দোকান ছিল ফিক্সড প্রাইসের দোকান। মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করতে করতে যখন আমার বন্ধুকেই দোকানের মালিক ভেবে জিনিসটা প্যাকেট করে দিতে অনুরোধ করলেন, তখন ও চোখেমুখে খুউব বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বলেছিল, “কী ভাই, মানুষও চিনেন না? আমাকে দেখলে কি আপনার দোকানদার দোকানদার মনে হয়? না, না, আমি এই দোকানের কেউ না। (আমার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে) দোকানদার ওখানে বসে আছে। ওর কাছে নিয়ে যান।” কাস্টমার একটু ভড়কে গেলেন মনে হল। আমি এগিয়ে এসে বললাম, “ভাই, এদিকে আসেন। আমিই দোকানদার। আমি প্যাকেট করে দিচ্ছি।”
কাস্টমার চলে যাওয়ার পর আমার বন্ধুটি এসে বলল, “দোস্ত, তোর এখানে থাকলে দেখি মানসম্মান থাকবে না। লোকজন তো আমাকেই দোকানদার বানিয়ে দিচ্ছে। লজ্জার ব্যাপার! তুই থাক, আমি আসি।” ও চলে যাবার পর আমি একটা দোকানের শাটার নামিয়ে দিয়ে আরেকটার গ্লাসডোর বন্ধ করে ভেতরে বসে বসে ইউটিউবে গান শুনতে লাগলাম। মনে মনে খুব করে চাইছিলাম, যাতে আমার দোকানে সেদিন আর কোনও কাস্টমার না আসে। এরপর কারও সাথে কথা বলতে গেলে আমি আর চোখের পানি লুকাতে পারব না, নিশ্চিত কেঁদে ফেলব।
কথা শোনানো, এটা মানুষের সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলোর একটা। আমি এই জীবনে কখনও কাউকে কথা শুনিয়েছি বলে মনে পড়ে না। বরং লোকে কথা শুনিয়ে দিলে সেটা নীরবে হজম করেছি। নিজেকে আঘাত পেতে দিয়েছি। মনের মধ্যে জেদ চেপে গেছে, আঘাতগুলো শক্তি হিসেবে আমাকে প্রতিনিয়তই পেছন থেকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে। মানুষের পিঠ নাকি দেয়ালে ঠেকে যায়, আর আমার পিঠ দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল! আমার মা প্রায়ই বলেন, “বাবা, কখনও কাউকে নিন্দা করিস না। যে ফুল নিন্দে, সে ফুল পিন্দে।” মা খুব ঠিক বলেন। কথা শোনানোর চাইতে কথা না-শোনানোর শক্তি অনেক অনেক বেশি। আপনার কাজকে কথা শুনিয়ে দিতে দিন, আপনার মুখকে নয়। কাজের কথা শোনানোর শক্তি মুখের চাইতে হাজারগুণে বেশি।
আমার ভালোথাকার অনেকটুকু কৃতিত্ব আমার এমন কিছু অসাধারণ বন্ধুর।
আজ বুঝি, জীবনে কিছু না পাওয়ার চাইতে কষ্ট পাওয়াও ভালো।
প্রিয় বন্ধু, তোকে ধন্যবাদ। ভীষণ ভালো থাকিস।
পুনশ্চ। অনেকেই আমাকে ইনবক্সে জানতে চেয়েছেন, ‘দোভানা’ মানে কী? তাঁদের বলছি, এটা একটা লিথুয়ানিয়ান শব্দ। ওই দেশে লোকে আদর করে মেয়েদের নাম রাখে দোভানা। এর মানে উপহার। (ওই সময়টাতে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল ভাষা আর শব্দ নিয়ে খেলা। শব্দরা প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। আমি ফেইসবুকে ওদের নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে ভালোবাসতাম।)