জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা

একটাসময়ে হাতে হ্যান্ডচেইন, রিস্টব্যান্ড, ব্রেসলেট পরতাম। খুব বেশিদিন আগের কথা না, তখন মনে হয় অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। এখনও মনে পড়ে, একবার মা আমার দামি ম্যাগনেট ইয়াররিং জোড়া জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার সময় কতোটা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, এইসব জিনিস বস্তির মেয়েদের কানে ভালো মানায়; কেউ কুড়িয়ে পেলে খুব খুশি হবে, বাবা। আমার আর রিং পরা হয়নি। ম্যাচিং করে সানগ্লাস, জিন্স, টিশার্ট, স্নিকারস, বেল্ট, আংটি, হ্যান্ডচেইন — এসব পরে যখন আমার নিজের কোচিংয়ে পড়াতে যেতাম, তখন নিশ্চয়ই কোনও-কোনও গার্ডিয়ান ভাবতেন, এই অদ্ভুতদর্শন যুবাটি উনার ছেলে/ মেয়েকে কী শিখাইবেন! অনেকে এসে আমাকে বলতেন, আমি পলস্ কোচিং হোমের ডিরেক্টর স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি, উনাকে ডেকে দাও (আমাকে দেখে ‘দিন’ মুখে আসতো না হয়তো)।

যখন কোচিংয়ে স্টুডেন্ট বেড়ে যায়, তখন আমি বেত রাখতে শুরু করি। স্টুডেন্টরা বলতো, স্যার, আপনার অ্যাপিয়ারেন্সের সাথে মাইর-দেয়া যায় না। হিপহপ গেটাপের একটা ছেলে স্কুল মাস্টারের মত পোলাপানদের বেতাচ্ছে, ছেলে-মেয়ে কেউ বাদ নাই। কেমন না, ব্যাপারটা? এমসিকিউ’র জন্যে আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের আগাগোড়া মুখস্থ করাতাম। আমাকে সবাই বলত, অবজেক্টিভ গুরু! স্টুডেন্টদের ইংলিশের বিশাল-বিশাল ওয়ার্কশিট সলভ করাতাম। প্রায়ই ওদের চোখে নানান স্বপ্ন বুনে দিতাম, বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শেখাতাম, কখনওই কাউকে ভাবতে দিইনি যে, ও পারবে না। নিজের ভেতরের শক্তির জায়গাগুলিকে চিনতে শেখাতাম। ভাবতে খুব ভাল লাগে, ওরা এখন বড় হয়েছে, বড় হচ্ছে। এই ভাল-লাগা’টাই অনেক বেশি দামি। আমার কোচিংয়ে ছিল ক্লাস নাইন থেকে অনার্স পর্যন্ত। ওই সময়টাতে প্রচুর পড়তাম, স্টুডেন্টদের সামনে পারি না বলতে কেমন যেন লাগে। আমার অনেক ডায়লগ এখনও মাঝেমাঝে স্টুডেন্টদের সাথে দেখা হলে বলে। স্যার, আপনি আমাকে এটা বলতেন, আপনি ওটা বলতেন। দু’একটা শেয়ার করি।

# আমি যেভাবে অংকটা করিয়েছি, ঠিক সেইভাবে করবে; দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন সহ। (প্রয়াস মনে করিয়ে দিলো)

# পড়তে ইচ্ছা না করলে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও। ….. পেমেন্ট নিয়ে আসবে নেক্সট দিন। (সুলতান মনে করিয়ে দিলো)

# এই কী? সমস্যা কী তোমার? ……. মাইর চিনো, মাইর? (রাতুল মনে করিয়ে দিলো)

# কোয়েশ্চেন ইজি-হার্ড কোনওটাই না, কোয়েশ্চেন স্ট্যান্ডার্ড হইসে। (প্রান্ত মনে করিয়ে দিলো)

# সবকিছুর মধ্যেই কনসেপ্টের একটা ব্যাপার আছে। (তানভীর মনে করিয়ে দিলো)

# প্রত্যেকটা সাইডনোট দিতে হবে। (সৌম্য মনে করিয়ে দিলো)

# ক্লাসে কথা বললে স্মার্টনেস বাড়ে নাতো! (জেভিন মনে করিয়ে দিলো)

# বাঁশ দেয়ার পর আপনি বলতেন, “ও! লজ্জা পাচ্ছো মনে হয়!?” আমরা যখন বলতাম, “নাহ!” তখন বলতেন, “ছি ছি! তুমি নির্লজ্জ?” (শুভ মনে করিয়ে দিলো)

# দুইজন স্টুডেন্ট দেরি করে এসেছে। ওরা কাজিন, তোরান আর তুরিন; সবসময় একসাথেই আসে। “তুরিন, দেরি হল কেন?” “স্যার, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।” “তোরান, তোমার কেন দেরি হল?” “স্যার, ওকে ডাকতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে।” “ও আচ্ছা, বুঝেছি। ওকে ডাকতে গিয়ে ওর সাথে তুমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তাই না?”

# থাপ্পড় মেরে জানালা দিয়ে ফেলে দিবো। (কে মনে করিয়ে দিলো বলা যাবে না)

# পর্দার লাঠিগুলা খুলে পিটাবো। (কে মনে করিয়ে দিলো বলা যাবে না)

আরও কী কী যেন বলতাম; মনে নেই।

খুব বেশি কড়াকড়ি করতাম কোচিংয়ে, রীতিমতো হিটলারি শাসন। ছেলেদের ‘তুমি’ আর মেয়েদের ‘তুই’ করে ডাকতাম; এর ব্যাখ্যা কোনওদিন কাউকে দিইনি। সেসব কথা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়। আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম ইংরেজি আর বাংলা পড়াতে। একেকটা বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে পড়ানোর সুখ পৃথিবীর আর কোনওকিছুতেই পাওয়া যায় না। ঠিক ওইসময়ে মনে হতো, আমি যেন ওটা আরেকবার সৃষ্টি করছি! অন্যান্য বিষয়গুলোও সমানতালে পড়াতাম। আমি ওইসময়ে ভূতের মতো পরিশ্রম করে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে স্টুডেন্টদের জন্যে বিশাল-বিশাল লেকচার শিট রেডি করতাম, কঠিন-কঠিন সব সাহিত্যিক স্টাইলের নোট দিতাম। সারাংশ আর সারমর্মের নোটগুলির কথা স্টুডেন্টরা এখনও বলে। জিআরই ওয়ার্ড দিয়ে কঠিন গ্রামাটিক্যাল স্ট্রাকচারে ইংরেজি নোট দিতাম। যেদিন অ্যাকাডেমিক ক্লাস থাকত না, সেদিন ওদেরকে আইবিএ, ভার্সিটি আর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাডমিশনের জন্য ফ্রিতে পড়াতাম, ওয়ার্কশিট সলভ করাতাম। আহহ! সেইসব দিনগুলো!! ম্যাট্রিক-ইন্টারের বইগুলো যে কয়শ’ বার পড়েছি পড়িয়েছি, তার কোনও ইয়ত্তা নেই।

২০০২ থেকে ২০১১। দীর্ঘ সময়!! সবাই বলতো, লাইফটাকে স্টুডেন্ট পড়িয়ে-পড়িয়ে নষ্ট করছি। সবাই ধরেই নিয়েছিল, আমি মাস্টারি করেই জীবন কাটিয়ে দেবো। অথচ আমার ওই কাজটাই করতে সহজ লাগতো, তাই ভাল লাগতো, পড়াশোনা একটুও ভালো লাগতো না। আমার কী দোষ! পরে দেখলাম, ওই পড়ানোটাই আমার লাইফে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে। “জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা– ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা,” জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়, কীভাবে নিয়ে যায়, আমরা কখনও তা ভাবতেই পারি না৷ Life is always stranger than fiction. খুব মিস করি সেইসব দিনগুলো। ক্লাসভর্তি এতগুলো মুগ্ধ চোখের সামনে নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পড়ানো, কিছু মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া, এতোগুলো স্টুডেন্টের স্বপ্নযাত্রা শুরু করে দেয়া; এ অনেক বড় প্রাপ্তি! আমি আর কোনওকিছুতেই এতটা শান্তি পাই না। তাইতো এখনও সুযোগ পেলেই মন-খারাপ-করে-থাকা বন্ধুদের স্বপ্নকে স্পর্শকের স্পর্ধায় ছুঁয়ে ফেলার শপথ নিতে শেখাই; যতোটা পারি, যেভাবে পারি; এবং যতদিন পারি, আমি শিখিয়ে যাবো। কেননা আর কেউ জানুক আর না-ই বা জানুক, আমার নিজের জীবন থেকে আমি তো জানি, মন-খারাপ-করে-থাকা’টা কী ভয়াবহ কষ্টের একটা ব্যাপার!