- হ্যালো!
- হ্যাঁ আদি, বল। কী খবর?
- সুতপা, তুই বুঝলি কী করে যে আমি আদিত্য?
- এই রাত তিনটেয় আমাকে জীবনেও তুই ছাড়া অন্য কেউ ফোন করবে না।
- আমার এখানে তো সাতটা বাজে।
- সে যা-ই হোক, তুই এখন অবধি যে কটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করেছিস, সবই তিনটের পরেই এসেছে। অবশ্য অন্য কোনও দরকারের ফোন যে আসেই না, তা নয়, কিন্তু তোর ফোনটা আমি বুঝতে পারি। ঠিক করে রেখেছিলাম, যে-দিন নিজের নম্বর থেকে ফোন করবি, সে-দিনই রিসিভ করব।
- তোর বসের ফোন কিংবা বাসার কোন ইমারজেনসি ব্যাপার হলেও ফোন ধরিস না?
- আমাকে অন্তত রাত তিনটেয় ফোন করা যাবে না, বস এটা নিজগুণে বুঝে নিয়েছেন, আর বাসায় কিছু হলে বাড়ির লোকজন ওদের বাবাকে ফোন করবে বলেই আমার ধারণা।
- এখনও অমনই আছিস তুই, সুতু? অবশ্য মিলিও তা-ই বলেছে যে তুই অমনই আছিস। একদম নো চেঞ্জ!
- না থাকার তো কিছু নেই। আমি তো আর আবহাওয়া না যে সকালে বিকেলে নিয়ম করে নিজেকে পালটে ফেলব।
- ভাইয়া কেমন আছেন?
- ও তোর ভাইয়া কী করে হলো? আচ্ছা শোন, তোর বউকে কিন্তু আবার আমি ভাবি-টাবি ডাকতে পারব না। তো এসব ডাকাডাকি বন্ধ কর। আমরা চারজনই ভালো আছি।
- তুই তো গোড়াতেই সব থামিয়ে দিচ্ছিস, কী আর বলব? সুতপা, আমাকে মনে আছে তোর?
- ভুলিনি। এক বছর সাত মাস আগে আমাদের শেষ কথা হয়েছিল।
- কী করছিস এখন?
- চা বানাচ্ছি, রাতে চা-খাওয়া আমার নেশা, জানিস তো? চা খাব আর গল্প লিখব। ঈদসংখ্যাটা নাকি বেরুচ্ছে সামনে। তাগাদা পাচ্ছি, তাই।
- তুই তো সারাজীবনই এটা ওটা লিখে শেষ অবধি আর জমা দিতিস না।
- এবারও দেবো না। শুধু শুধুই লিখছি, পড়ে থাকবে কোথাও, ছিঁড়ে ফেলব কিংবা কোথাও ফেলে দেবো।
- এসব করে কী লাভ হয়? তোর লেখা বেশ ভালো, কেন ছাপতে দিস না?
ঘাড় বাঁকিয়ে মোবাইলটা ডানকাঁধ আর কানের চাপে আটকে রেখে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগ্রেট ধরাতে ধরাতে সুতপা বলল, তুইও লেখা বুঝিস নাকি আজকাল?
- সারাজীবনই এই ঘা-টা দিয়ে এলি। হ্যাঁ এটা ঠিক, বুঝি না, কিন্তু সবাই-ই খুব প্রশংসা করত তোর লেখার, তাহলে ভালো তো লিখিস নিশ্চয়ই। এখনও সিগ্রেট খাস?
- লিখতে গেলে সিগ্রেট লাগে আমার বেশ কয়েকটা, আর সাথে রং-চা তো থাকেই!
- এত কাঠখড় পুড়িয়ে লিখিস, আর সেই লেখা কিনা ছাপতেই দিস না! তোকে বোঝা খুব মুশকিল। এসব খেলে তোর বর কিছু বলে না?
- কেরু আর হুইস্কির মতন কড়া ওর মেয়েবন্ধুদের সাথে একই বিছানায় ঘুমিয়ে আমি দিন কাটাচ্ছি যখন, তখন আমার গুটিকয়েক সিগ্রেটের ধোঁয়াটুকু, টেবিলের এককোনায় পড়ে আছে যা, ওটার সাথে আমার সম্পর্ক যে ভাই-বোনের মতন, এটা সে বোঝে অন্তত। এটুকু বোঝাপড়া আছে আমাদের মধ্যে। বিবাহিত জীবনের নিয়মটা তো তুই জানিসই। না কি তোদের মধ্যে বোঝাপড়াটা নেই? অবশ্য তোদের বিলেতি বোঝাপড়া আর আমাদের দেশি বোঝাপড়ার মধ্যে তফাত আছে অনেক। হা হা হা…
- তারপর বল, কেমন আছিস?
- আছি রে।
- আমি ফোন করতে চাই তোকে, সাহস হয় না আসলে।
- হবার কথাও না। তুই সাহস দিয়ে কী করবি? ওসব তোর জন্য না। সারাজীবন শুনেছি, মানুষের প্রেমিকা পালায়, আর আমার বেলায় ঘটল উলটোটা। হাসি পায় এখন এসব ভাবলে।
- সুতপা, আসলে…
- থাম, অন্য কিছু বল। ওসব আর শুনতে ইচ্ছে করে না।
- তুইও তো স্বামী-সংসার নিয়ে বেশ আছিস! আমি তো সবাইকে বাজি ধরে বলেছিলাম, আমি যা-ই করি না কেন, সুতপা অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। সারাজীবন একাই থেকে যাবে দরকার পড়লে। ও কখনওই অন্য কাউকে ভালোবাসবে না। সেই তুই আজ…
- শোন, বিয়ে আমাদের জীবনে নিয়ম করে তিনবেলা ভাত-খাওয়া, দুপুরে গোসল-করা আর রাত নামলে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার মতনই একটা সাধারণ ব্যাপার। হ্যাঁ, তবে আমি স্বীকার করি, ভালোবাসা অন্য জিনিস। বাই দ্য ওয়ে, ভালোবাসা-টাসা নিয়েও ভাবছিস নাকি রে ইদানীং?
- বরকে তুই ভালোবাসিস তো? তা না হলে বাচ্চারা…? প্রথমবার মা হয়েছিস যখন শুনলাম, ভেবেছি, ভুলেও তো হয়ে যায় এসব। তবে দ্বিতীয়বার…?
- হা হা হা…এড়িয়ে গেলি তো? শোন, বিয়ে যদি হয় জীবনে একটা গাছ লাগানোর মতন, বাচ্চারা হচ্ছে সেই গাছের ডালপালা। ওরা প্রকৃতির নিয়মেই আসে, আসতে বাধ্য। এসব ছোটোখাটো ব্যাপারের সাথে ভালোবাসার তুলনা টানিস না, আদি। এসব হাজারটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েও ভালোবাসার মতন বড়ো একটা ব্যাপারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না। এসব বিয়ে, বাচ্চা, সংসারের মতন ডালভাতের সাথে ভালোবাসার মতন এত হেভেনলি একটা ব্যাপারের তুলনা করাটাও বোকামো। সংসার করাটা এই জগতের অলিখিত নিয়ম, তাই করছি। যদিও আমি নিয়ম ভেঙেই অভ্যস্ত, তবুও এই একটা নিয়ম কেন জানি না বাধ্য মেয়ের মতন মেনে যাচ্ছি।
- তাহলে বলতে চাইছিস, তোর বরকে তুই ভালোবাসিস না?
- বলতে চাইছি না, এটাই তুই আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিস। আদি, প্রশ্নটা সরাসরি করলেই তো হয়! সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেল দেখি?
…………………………………………………………………
…………………………………………………………………
- পারলি না তো? জানতাম, পারবি না।
- আমাদের কাটানো সময়গুলো তোর মনে আছে, সুতপা?
- আছে।
- ফোন করিস না তো কখনও।
- তোকে নিয়মিত আমার খবরটা রাখতেই হচ্ছে যখন, তখন আমার ফোন করার দরকার তো দেখি না।
- আমার কথা জানতে তোর ইচ্ছে হয় না?
…………………………………………………………………
…………………………………………………………………
- ভালোবাসিস এখনও আমাকে, সুতু?
ফোনটা কেটে দিল সুতপা। সিগ্রেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে খুব শব্দ করে হাসল, আর বলল, তোর মতন কাপুরুষের জন্য ঘৃণাও আসে না। ঘৃণাও তো একটা দামি অনুভূতি! তুই সত্যটা জানার জন্য আরও অনেক অনেক রাত তিনটেয় ফোন করে যাবি, তবু তোকে কখনও বলা হবে না, আদিত্য, তোর জন্য আমার কাছে না আছে ভালোবাসা, না আছে ঘৃণা। ভালোবাসার মানুষের মনে এ দুটোর মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা আর বেঁচে না থাকা তো একই কথা!