প্রেমান্ধতা/পর্ব-১

 
আমি সানজিদা আহমেদ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ কমপ্লিট করেছি। ছোটোবেলা থেকেই ছেলে-মেয়ে সবার সাথেই মিশেছি, পড়াশোনা করেছি, তবে কখনও প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে মনে সাহস আসেনি। ভয় পেতাম, কেন জানি না। আমি বেশ দেরিতেই সাবালিকা হই। তাই মানসিকভাবে বেশ পিছিয়ে ছিলাম আর দশটা মেয়ের চেয়ে৷


তবে কেউ আমাকে কখনও প্রপোজ করেইনি, এমনটাও না। ক্লাস টু থেকে কলেজ অবধি ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ ছিলাম। ছিলাম বেশ চটপটে আর মাতব্বর গোছের মেয়ে। তাই আমার দিকে সবার মনোযোগটা একটু বেশিই থাকত। তবে কেউ প্রপোজ করলে খুব ভয় পেতাম। বাসায় এসেই সব বলে দিতাম। পড়াশোনা, কিছু গৃহপালিত পশুপাখির সাথে সময়-দেওয়া, আব্বু-আম্মু আর ভাই। এটাই আমার জগৎ ছিল। বরাবরই স্যারদের পছন্দের তালিকায় থাকতাম। হুট করে কোত্থেকে আইলা-ঝড় এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেল পুরো জীবন। রাস্তার উপর গোলপাতার টংঘর বেঁধে থাকা শুরু করলাম। ত্রাণ হিসেবে পাওয়া চিড়া খেয়ে কম্বলের মধ্যে কাটানো জীবন। শুধু আমাদের নয়, হাজারো মানুষের। এর ভেতরও পড়াশোনা। মনের ভেতর একটাই কথা---বেঁচে থাকলে পড়তে হবে, জীবনটাকে পালটাতে হবে। আর মরলে তো মরে গেলামই!


সারাগায়ে কাদা, পেটে ভাত নেই। তবু আমি পড়ছি। বেঁচে যে থাকব, এমন আশা ছিল না। তবুও যদি বেঁচে যাই, তবে না-পড়লে তো কোথাও ঠাঁই হবে না, এটা মাথায় ছিল সব সময়ই। এমনও হয়েছে, সকালে পড়েছি, বিকেলে সবার সাথে রাস্তায় মাটির কাজে গিয়েছি। রাতে আবারও পড়েছি। এ জীবন কেমন জীবন, যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তারা কখনও বুঝবে না।


এভাবে কাদায় থেকেই স্কুলের প্রথম এ-প্লাসটা আমিই এনে দিয়েছিলাম। একুশেটিভি চ্যানেল থেকে আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করা হয়। দুইটা পেপার আমাকে নিয়ে লেখা ছাপে সে-সময়। অদম্য-মেধাবী কলামে হেডলাইনটা ছিল এমন---আইলা দমাতে পারেনি সানজিদাকে।


এরপর ভাবলাম, এই তো, আমি পারব হয়তো! আর-একটু সামনে যাই। মফস্বলে একটা কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজেও সব গ্রুপ মিলিয়ে প্রথম হলাম। আমার রেজিস্ট্রেশনের ফি কর্তৃপক্ষ ফ্রি করে দিলেন। এইচএসসি’তে আবার এ-প্লাস পেলাম।


তবে ভার্সিটির কথা তখনও জানি না। স্যাররা বলতেন, ‘সানজিদা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো একটা ইউনিটে চান্স পাবে।’ আর আমি মনে মনে জিজ্ঞেস করতাম, ‘ইউনিট তো জানি কারেন্টের হয়। এই ইউনিটে পড়ব মানে কী আবার?’ তবে মানসম্মানের ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারতাম না। হয়তো দেখা যাবে, জিজ্ঞেস করলাম, আর কী কী কথা শুনে ফেললাম! পরে আবার ওটা নিয়ে মন খারাপ হবে! কী দরকার! সময় হোক, সব জেনে যাব।


এইচএসসি পরীক্ষাশেষে সবাই কোচিং-সেন্টারে ভর্তি হয়ে গেলেও আমি তখনও আমার বাসায় বোঝাতে পারছি না যে আমিও এটা করতে চাই। ক্লাসমেটরা অনেকেই শুরু করেছে। বাসায় বোঝালাম, এটা ভালো কিছু এবং আমাকেও করতে হবে। কোচিং-এ ভর্তি হবার পরও আমি আমার আব্বু আর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আর ঢাকা বা চট্টগ্রাম বা খুলনা বা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি কী? এদের মধ্যে কী পার্থক্য? ভালো হবে কোনটা? আমি তো বুঝতে পারছি না।’ তারা বলল, ‘জানি না। তবে ন্যাশনাল, মানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে হয় সব থেকে ভালো। ওটা তো সারা দেশভিত্তিক, আর বাকিগুলি তো এক-একটা অঞ্চলভিত্তিক, মানে আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আঞ্চলিকটাতে পড়ে কী লাভ?’


দিন যায়, আমার চোখ খোলে। বুঝতে শিখি, আমি কোনটায় যাব, কেন যাব। সময়ই বুঝিয়ে দেয় সবকিছু।


একসময় তিনটা ভার্সিটিতে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে তিনটাতেই চান্স পেলাম। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী। ভর্তি হলাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেহেতু আমার বাড়ি খুলনায়। ‘যেহেতু’ শব্দটার মানে হলো, ‘যেহেতু আমার বাসা থেকে আমাকে আমার নিজজেলার বাইরে যেতে দেবে না।’


তখন ছিল মেসেজের যুগ। দুই টাকার এসএমএস-প্যাকেজ কিনে সব বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতাম। আমার কিছু বন্ধু ঢাকাতে কোচিং করত। ওদের অনেকেই ঢাকাতে থেকে গেল। তারা আমাকে নিয়ে কারও কারও কাছে গল্প করত যে আমি ভার্সিটিতে বিবিএ পড়ি, অনেক সংগ্রামের জীবন আমার, প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে আজকের জায়গায় এসেছি…ইত্যাদি।


আমি তখন রিলেশনে বিশ্বাস করতাম না। ওদিকে আমার সম্পর্কে নানা কথা শুনে শুনে এক ছেলে যেচে পড়ে আজ একটু, কাল একটু এভাবে করে যোগাযোগ করতে শুরু করে আমার সাথে,---সে আমার এক বন্ধুর সাথে থাকে, সেই সূত্র ধরে। আমি তখন অনেক পড়াশোনা করি। কথা বলতেও চাইতাম না। তাই সে নানান রকম ইমোশনাল ফন্দি আঁটতে থাকে। ততদিনে আমার ফোন ল্যাপটপ হয়ে গেল। আমার টিউশনি দিয়ে আর আব্বু-ভাই দুজনের ইনকামে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা এল।


ফেইসবুক হোয়াটসঅ্যাপেও যোগাযোগ শুরু হলো ওই ছেলের সাথে। অনেক চেষ্টা করে সে আমার মনের ভেতর জায়গা করল। এরপর আমাদের দুজনের একদিন গোপনে বিয়ে করার ফন্দিও আঁটা শেষ! ততদিনে আমি ফাইনাল-ইয়ারে৷ আমাকে সে টাকা গোছাতে বলল। এরপর হুট করে একদিন বলল, কাল বিকেলেই যদি আমি ওর জেলায় না যাই, ওকে বিয়ে না করি, তবে আর কখনওই আমাদের বিয়েটা হবে না।


এদিকে আমি তখন পুরোপুরি প্রেমে হাবুডুবু অবস্থায়, তাই আমিও আর পিছপা হলাম না। ফাইনাল-ইয়ারের লাস্ট সেমিস্টারের রেজিস্ট্রেশনের লাস্ট-ডেটে আমি বান্ধবীদের বললাম, আমার খুব সমস্যা। আমার কাছে টাকাও নেই। আমার কাজটা যেন ওরা শেষ করে। ওরা করলও তা-ই। আর আমি রেজিস্ট্রেশনের টাকা আর টিউশনি থেকে কিছু গোছানো টাকা নিয়ে ভাগলাম ওকে বিয়ে করব বলে।


বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গিয়ে পৌঁছলাম কোর্টে। ওর সাথে ওরই সাত-আট জন দোসর। আর এদিকে বেচারি আমি একা, আর সাথে আমার টাকা। সবার উপস্থিতিতে ওরা একটা কাগজে সাইন নিল ওর আর আমার। সে বলল, এক লক্ষ টাকা কাবিন রাখবে, কারণ তার নাকি শখ, সে সব টাকা পরিশোধ করবে বাসর-রাতেই। আমি তখন ওকে এতটাই ভালোবেসে ফেলেছি যে এক লক্ষ কেন, একটা ফুটোপয়সা কাবিনেও আমি বিয়ে করতে রাজি!


বিয়ের নামে সাইন হলো। কাগজটা সে নিজের কাছে রেখে দিল এই যুক্তিতে যে, আমার বাসায় কেউ দেখলে আমাকে মেরেই ফেলবে। এর থেকে ওর কাছেই থাকুক। যখন মন চাইবে, তখন আমরা একজায়গায় থাকব। এসব বলে ওর বন্ধুদের ডেকে নিয়ে সবাইকে আমার টাকায় নড়াইলের ‘খানাপিনা’ রেস্টুরেন্টে খাওয়াল।


এরপর সবাইকে বিদায় দিয়ে ওর এক বন্ধু আর তার গার্লফ্রেন্ডসহ সে আমাকে এক আবাসিক হোটেলে নিয়ে গেল। এর আগে হাজারবার সে আমাকে হোটেলে ডেকেছে, কিন্তু আমি পাপ-পুণ্যের হিসেব করে চলি বলে বিয়ের আগে যেতে রাজি হইনি। এবার তো বিয়ে হয়েছে, তাই তার কথায় আমাকে যেতে হবে। গেলাম। ৩৩৩ নম্বর রুমে আমরা থাকলাম, আর পাশের আর-এক রুমে ওর ফ্রেন্ড থাকল গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে। সেদিন বাসায় বললাম, ইমারজেন্সি কাজ আছে ক্যাম্পাসে। সাডেন প্রেজেন্টেশন। আমাকে আজ হলে থাকা লাগছে। পরদিন সে অসুস্থ আমাকে বাসে তুলে পাঠিয়ে দিল। খুব মায়া লাগছিল ওকে রেখে একা আসতে। তবুও আসতে হবে। এলাম।


শুরু হলো আমার জীবনে যা আগে কখনওই হয়নি, তার সবকিছু। বাসায় মিথ্যাবলা আর অযথাই ওর সব কথায়, কাজে ছাড় দেওয়া। এরপর সে এক মাস পরে এল। থাকলাম খুলনার এক হোটেলে। পুলিশ রেইড দিল। ধরল। এক দালালকে আড়াই হাজার টাকা দিয়ে কোনও রকমে ছাড়া পেলাম।


এরপর পরের মাসে আবার এল। তখন আমার খালাত বোন হসপিটালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এক সপ্তাহ যাবত। ও আমাকে ফোন করে বলল, ও আজই আসবে। নইলে আর আসবে না কয়েক মাসের মধ্যে। আমি বললাম, ‘এসো।’ শহরের এক হোটেলে উঠলাম। সন্ধ্যায় শুনলাম, আমার আপু মারা গেছে। আমি তখন ওর সাথে শোয়া। আমি দোটানায় পড়ে গেলাম। এখন আমি কীভাবে যাব? কী বলব সবাইকে? কোথায় ছিলাম এতক্ষণ? ওকে জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ‘ওদের বলো, আমি হলে আছি খুব ইমারজেন্সি কিছুর জন্য।’ সেটাই বললাম। ভোরের দিকে আমাদের পুলিশে ধরল। হাত পা ধরে নানান কথা বলে, যে টাকা ছিল কাছে, সেটা আর কিছু টাকা বিকাশে ধার করে আবারও এক দালালকে দিয়ে বাঁচলাম।


এই আবাসিক হোটেলের ব্যাপারগুলি আমার চৌদ্দগুষ্টিতে নাই। আমি জীবনে পার্কেও যাই নাই। এমন মেয়ে আমি। ওর সাথে প্রথম দেখা করার দিন আমি ওর জন্য চিংড়ি দিয়ে নুডলস আর দুধ দিয়ে সেমাই রান্না করে নিয়ে যাই। কোনও ছেলের সাথে ওটাই আমার প্রথম দেখা-করা ছিল। ভেবেছিলাম, ক্যাম্পাসে কোনও গাছের ছায়ায় বসে গল্প করব, আর আমার রান্না-করা খাবার ওর মুখে নিজের হাতে তুলে দিয়ে জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কথা শেয়ার করব দুজন মিলে। আর ছেলেদের জিনিস তো অত ভালো আমি বুঝি না, তাই এক ক্লাসমেটকে ওর জন্য কিছু জিনিস কিনতে পাঠিয়েছিলাম। কাছেই একটা দোকানে। এর ভেতর সে এসে পড়বে। তারপর তিন জন মিলে গল্প করব, আড্ডা দেবো। কিন্তু না, সে আমাকে পেয়েই সোজা ‘সিতারা’র মতো বিশ্রী একটা পার্কে নিয়ে গেল। ও সবই ওর ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল, খুলনার কোথায় কী হয়।


জীবনে কোনও দিনই এখানে আমি আসিনি। প্রথমবার ওখানকার ভেতরের পরিবেশ আর ছেলে-মেয়েদের কাজকর্ম দেখে আমি ঘেন্নায়, ভয়ে আর রাগে বের হয়ে চলে আসি। আর ওকে মেসেজ পাঠাই: ‘আমাকে এমন একটা সস্তা মেয়ে ভাবার জন্য ধন্যবাদ।’ কিন্তু সে আমার হাতে পায়ে ধরে মাফ চায়। আমিও গলে যাই। ভালোবেসে ফেলেছিলাম তো, তাই আমাকে যে-কোনও কিছুতে মানিয়ে নেওয়া ওর জন্য সহজ ছিল।


যা-ই হোক, আমাদের গোপনবিয়ের পর তৃতীয়বার হোটেলে গেলাম। ঈদের সময়। ও ঢাকা থেকে ওর বাড়িতে যাওয়ার সময় খুলনা হয়ে যেত। সেবারও এল। ‘রিমঝিম’ পার্কের বিপরীত দিকে ‘রূপসা হোটেল’-এ নিয়ে গেল আমাকে। আমি ওর জন্য টাই, বেল্ট, বডিস্প্রে নিয়ে এসেছি। সামনে ঈদ। এগুলি ওর গিফট। আর ও আমার জন্য কিছু চুলের ক্লিপ আর কানের দুল এনেছিল।


রুমে ঢুকে মাত্র ফ্রেশ হয়ে আমরা গল্প করছি। এর ভেতর পুলিশের রেইড। আমাদেরকে নিয়ে গেল বাইরে। একটা ঘৃণ্য ব্যাপার হচ্ছে, পাশের রুমগুলি থেকে…বিবাহিত মহিলা অন্য পুরুষ নিয়ে আছে, এমন সব লোকজন বের হয়েছিল। আমাকেও তাদের দলে ভেবে নিল সবাই৷ অনেক কথা, অনেক বাজে ব্যবহারের পর পুলিশ আমাদের নিয়ে গেল থানায়।


২৮ রমজান সেদিন। আমাকে একরুমে বসিয়ে রেখে ওকে হাজতে ঢুকিয়ে দিল। আমি জানিও না, ও কোথায় আছে। বসে বসে ভাবছি, কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেই ওকে আমার এখানে নিয়ে আসবে। তিন-চার ঘণ্টা একা বসে বসে আমি ওর জন্য কাঁদছি, এমন সময় জানতে পারি, ওই বিয়ের কাগজে কারও সাইন নাই। ওটা ভুয়া বিয়ে। এরকম নাকি অহরহই হয়।


এখন ওকে ওরা আদালতে চালান করে দেবে। থানা থেকে বলল, একটা উপায়ই খোলা আছে, তা হলো, ওর আর আমার পরিবার থেকে লোকজন এসে যদি বলে, ‘হ্যাঁ, এরা ম্যারিড, আমরা সবাই জানি।’, তবেই ওরা ওকে ছেড়ে দেবে, নইলে কাল সকালেই আদালতে চালান দেবে। আমি নিরুপায় হয়ে ওর এক ফ্রেন্ডকে জানালাম, যে শুরু থেকে সবই জানত, যে বিয়ের দিন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আমাদের সাথে হোটেলে ছিল।


সেই ফ্রেন্ড সব শুনে ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখল। একপর্যায়ে ওর বাসায় ব্যাপারটা জানল। ওরা সমস্যাটা না বুঝে, কোনও সমাধানের পথ না দেখে উলটা আমাকে জেরা করতে শুরু করে দিল। তাদের দুধেধোয়া তুলসিপাতা ছেলেকে আমি নাকি ফুসলিয়ে হোটেলে নিয়ে গেছি। তারা আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। দুনিয়ার হ্যান ত্যান…। তখন সে আমাকে বাধ্য হয়ে বলল আমার আম্মুকে ফোন করে হাতে পায়ে ধরে কান্না করতে যাতে আমার আম্মু অন্তত এসে ওকে এখান থেকে বের করে নেয়।


ও যা-ই বলে, আমি কখনও ফেলি না। আমি আম্মুকে ফোন করলাম। সারাদিন আমি আম্মুর ফোন ধরিনি বার বার মিথ্যাবলার ভয়ে। ২৮ রমজানের দিন সেদিন। সারাদিন রোজা রেখে আম্মু কেবল ইফতার নিয়ে বসেছে। এখনও ইফতার হয়নি।


আমি ফোন করে আম্মুকে কিছু বলার আগেই পুলিশ ফোন কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আপনার মেয়ে এখন থানায়। সে হোটেলে বাজে কাজ-করা অবস্থায় ছেলেসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছে। সকালেই ওকে আদালতে চালান করব। বাঁচাতে হলে এক্ষুনি আসেন।’ এরপর আমাকে কথা বলতে দিল। ফোন হাতে নিয়ে আমি শুধু কান্না করছি আর বলছি, ‘মা, বাঁচাও! প্লিজ, বাঁচাও! ওঁরা যা বললেন, সব সত্যি না। আর এখানে এসে বলবে, ওরা বিবাহিত। আমরা কাবিন করে রেখেছি।’ আমার কথা শুনে আম্মু তো স্ট্রোক করার মতো অবস্থা!


একে তো সারা দিন না-খাওয়া অবস্থায়, ইফতারটাইম, ঘরে তার অসুস্থ হাইপ্রেশারের রোগী স্বামী, সুযোগের অপেক্ষায় থাকা ছেলেবউ। আম্মু যেন এক-পা কবরে দিয়েই ফেলল! তবু শক্ত হয়ে আম্মু এল নন্দীরপাড় থানাতে।


এসে অনেক রিকোয়েস্ট করল। কাজ হলো না। সে আমাকে শিখিয়ে দিল যেন আমি আর আমার আম্মু মিলে পুলিশের পা জাপটে ধরে রিকোয়েস্ট করি। আমি আম্মুকে তা-ই বললাম। জান বাঁচানোর তাগিদে আমি আর আম্মু তা-ই করলাম। তবুও পুলিশের মন গলে না। এক দিন পরই ঈদ। তাদেরও টাকার দরকার। তারা অনেক টাকা দাবি করল। পাঁচ হাজার। আম্মুর সাথে-থাকা টাকা, তার কাছে আর আমার কাছে যা টাকা ছিল, সব মিলিয়ে পুরোটা দিতেও রাজি হলাম, দিলামও।


ওসি সাহেব ওইদিন একটা কথা বলেছিলেন, যা আমার আজীবন মনে থাকবে। ‘এই ছেলের চোখ-মুখ বলছে, ও কোনও দিনই আপনার মেয়ে নিয়ে সংসার করবে না। খেয়ে ছেড়ে দেওয়া বোঝেন? এটা তেমন ছেলে। আমার কথায় রাগ করবেন না। আমরা মানুষ চড়িয়ে খাই, আমরা চোখ দেখলে বুঝতে পারি। কথাটা আজ লিখে রাখেন। পরে মিলিয়ে নিয়েন। এরকম হাজারটা কেইস আমরা হ্যান্ডেল করি। অভিজ্ঞতা থেকেই এত কথা বললাম।’


আমরা কিছু বললাম না। এরপর আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। আমি আম্মুর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে, এখুনিই মরে যাই। তবুও মনে হচ্ছে, আমি তো আমার স্বামীর জন্যই যা করার করেছি। আমার এত কুণ্ঠা কীসের? আম্মুর সাথে আমি বাসায় ফিরলাম। এখন আমাকে বাসায় জানে মেরে ফেলে কি না, এটাই ভয়।


আর ও রইল থানার সামনে বসে। ওর কাছে টাকা নাই আর। গাড়িভাড়াও নেই। আমি বাসায় গিয়ে খাইনি। শুয়ে আছি। একটু পর পর মেসেজ পাঠিয়ে খোঁজ নিলাম, ও কোথায়, কী করছে। ভোর চারটায় আমি সবার আগে উঠে চুরি করে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। চলে গেলাম ওর কাছে। বাসা থেকে কিছু টাকা এনেছি। ওর হাতে সে টাকাটা দিলাম, ও চলে গেল বাড়িতে।


এর অনেক দিন পর আমার মাথায় এল ওই কথাটা। ‘ভুয়া বিয়ে’ মানে কী? সে এটা কেন করল! আমি অনলাইনে কিছু অ্যাডভোকেটের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সাইন ছাড়া কোর্ট-ম্যারেজের কোনও দাম নেই। তা-ও আবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার পরে কোর্টে আবার কে বিয়ে পড়াল! এমন জালিয়াতি কাজ এখন নাকি অহরহ হয়। মুড়িবই থেকে ওই কাগজটা ছিঁড়ে ফেললেই খেল খতম!


আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে কথা ঘুরিয়ে দেয়। আমাকে কথাই বলতে দেয় না এ ব্যাপারে। এই বন্ধু সেই বন্ধুর উপর দোষ চাপিয়ে দেয়। অথচ সাইনের জন্যই সে আমাকে একা একা খুলনা থেকে নড়াইলে যেতে বলেছিল। ওর সাত-আট জন ফ্রেন্ডকে আমিই খাওয়ালাম রেস্টুরেন্টে। আর এক লাখ টাকার কাবিনের বাসর-রাতে সে আমাকে পাঁচটাকার একটা কয়েন দেয় টোকেন-পেমেন্ট হিসেবে। সেটা আজও আমার কাছে আছে। ওকে জিজ্ঞেস করলে রাগত স্বরে বলে, ‘এখন আমি তোমাকে ডিভোর্স দিলে বুঝবে এটা বিয়ে ছিল কি না।’ আমি ভয়ে চুপ করে থাকি।


এরপর থেকে সে আর সময় দেয় না। কল দিলে ওয়েটিং-এ পাই। ঝগড়া হয় প্রচুর। এদিকে আমারও পড়াশেষে বেকারত্বের শুরু। সারাক্ষণই একা একা লাগে। কিন্তু ওকে পাই না একটুও। একদিন অনেক ঝগড়া হলো। ও তখন বাড়িতে। এদিকে আর আসে না। সেদিন ওদের বাসার কেউ কেউ ব্যাপারটা জেনে গেল। ওর এক বড়ো ভাই আমার বিষয়ে ওর পরিবারে জানালেন। আমাকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বললেন। বললেন, ‘পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট। দেখতে একেবারে খারাপ না। সামনে বড়ো চাকরি পাবে। আমাদের গ্রামের সেরা বউ হবে।’ এক পর্যায়ে তারা লোভে পড়ে রাজি হলো এনগেজমেন্ট করার জন্য।


সব কথা পাকাপাকি। ওরা আসবে। ওরা বলল, ‘যেহেতু তারা নিজেরাই অনেক দূর এগিয়ে গেছে, তাহলে আমাদের আর কিছু করার নাই। আমরা যাব ফরমালিটিজ রক্ষার্থে। আংটিবদল হবে। আর কাবিন হবে ওই দিনই। কয়দিন পর বউ করে তুলে আনব।’ ওরা এল আমাদের বাসায়। ওর ছোটো আপু, ছোটো দুলাভাই, বড়ো দুলাভাই, বড়ো দুই ভাই আর ও নিজে।


এসে আমাদের ভাড়াবাসা দেখে সাথে সাথেই সব ডিসিশন ঘুরে গেল ওদের। এখানে কিছুই করবে না ওরা! আমার আব্বু অসুস্থ। ভাই একা ইনকাম করে। অতএব হবে না এসব কিছুই! আমাদের রিফিউজ করে ওদের চলে-যাওয়া দেখে আমার ভাই, দুলাভাই, পাশের লোকজন বলে উঠল, তাহলে তখন কেন বলল যে সব করবে? কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে ওর ছোটো আপু ভাবল, যদি আমরা এখন ওদের মারধর করি, তখন কে ঠেকাবে, যেহেতু অন্য জেলাতে!


অবশেষে রাজি হলো। হ্যাঁ, তারা কাবিন করবে। তবে মাত্র বিশ-ত্রিশ হাজার টাকায়। আমরা এই শর্তে রাজি না হলে ওরা চলে যাবে, চলে গেলে আর ফিরবে না। ডাকলে তখন ডিভোর্স দিয়ে দেবে, ব্যস্‌! অনেক কথাবার্তার পর তিন লক্ষ টাকায় কাবিন হলো। আর ওরা আমাকে কিছু শর্ত দিল---
এক, দুই বছরের মধ্যে কোনও দেখা করা যাবে না।
দুই, সপ্তাহে চার-পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলা যাবে না।
তিন, দুই বছরের ভেতর ওরা আমাকে নিয়ে যাবে না।
চার, দুই বছরের মধ্যেই আমাকে চাকরি পেয়ে আমার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
পাঁচ, আজ চাকরি পেলে কালই নিয়ে যাবে। আর না-পেলে তখন সেটা নির্ভর করবে সম্পূর্ণই তার মরজির উপর। আর ওদের সবাই নাকি ওর কথাতেই চলে।


আমি বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, আমি রাজি।’ সে আমাকে বার বার মেসেজ দিয়ে বলছিল, ‘রাজি হও। ওরা যা বলে, তাতেই রাজি হও। আমি তো আছি।’ পরে দেখা যাবে সব। ওরা চলে গেল। আর গ্রামে গিয়ে সবার কাছে আমাদের নামে যতটা নিন্দা করা যায়, বাদ রাখেনি তার একফোঁটাও।


অক্টোবরের ৩ তারিখ কাবিন হলো। এরপর আমি টুকটাক চাকরির পরীক্ষায় টেকা শুরু করলাম। ওরা ভাবল, হুট করে যদি চাকরি একটা পেয়েই যাই, তবে সেটা ওদের বাসায় গিয়ে পেলে বরং ওদের সুনাম হবে সবার কাছে। আর ওদিকে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে উঠে গেছে, ছেলে বিয়ে দিয়েছ, বউ আনো না কেন? কতদিন আর রেখে দেবে ওদের বাড়িতে?


এদিকে আমি ঢাকাতে যাই পরীক্ষা দিতে। ওর কাছে থাকি। ওর বাসায় কেউ জানে না। সবাই জানে, আমাদের দেখা হয় না।


২০১৯ সালের ৭ জুন রাত ৯টায় ওরা ফোন করে বলল, আমাকে নিয়ে যাবে। আর ৮ তারিখ সকাল ৮টার ভেতরেই ওরা এসে হাজির। একদমই খালিহাতে ওর দুই দুলাভাই এসে আমাকে নিয়ে গেল।


এইসব মাথায় এলে আমি স্থির রাখতে পারি না নিজেকে। কালও সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, আমি সেটাও পারি না। এক গর্দভের জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আগমন আমার! এইটুকু লিখে মাত্র মূল ঘটনার সূচনায় এলাম। মূল ঘটনা এবার সামনে! কিন্তু গল্পটা নিয়ে আরও সামনে যে যাব, আমার সে সাহসে কুলাচ্ছে না।


আমার আব্বু অসুস্থ। অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল ২০১৭ সালের বাবা-দিবসে। এরপর থেকে আর কিছু করতে পারে না। আব্বু স্বয়ং যমের সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছে। ২২ দিন ঢাকা মেডিকেলে থাকতে হয়েছিল আব্বুকে। ডাক্তার বলেছেন, এখন থেকে আব্বুর মাথায় কিছুতেই কোনও ধরনের টেনশন দেওয়া যাবে না।


আর আমি সেই কুলাঙ্গার মেয়ে, যে কিনা আব্বু-আম্মুকে ফেলে খুলনা থেকে নড়াইল যাচ্ছি। আমার খালাত ভাবির ঈদের শাড়ি পরে আর আমার জন্য আব্বু-আম্মুর বানানো গয়না গায়ে দিয়ে গিয়েছি। যাওয়ার সময় আব্বু-আম্মুর সামনে দিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতেই গিয়েছি যেন তারা বোঝে, আমি খুবই খুশি। আমার কোনও কষ্টই হচ্ছে না, যেন তারাও কষ্ট না পায়।


যখন ওরা খালিহাতে আমাকে নিতে আসে, তখন আব্বু-আম্মু আর আশেপাশের লোকজন অনেক মন খারাপ করেছিল যে কেন ওরা হাতে করে কিছুই নিয়ে এল না! আমার বিয়ের তো কোনও স্মৃতিই রইল না৷ সস্তা হোক, তবুও সামান্য একটা লাল-ফিতে দিলেও সেটা নিয়ে দেখতাম, আর ভাবতাম, এটা আমার বিয়ের গিফট!


আমি আব্বু-আম্মুকে বোঝালাম, টাকাপয়সা, গিফট এসব কিচ্ছু না। শাড়ি চুড়ি দেয়নি বলে মন খারাপ করার কোনও মানে নেই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের হাত-পা আর মেধা দিয়েছেন। ইচ্ছা থাকলে একদিন সবই নিজহতে গড়ে নেব। এসব বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমি হাসতে হাসতে ওদের সাথে রওনা দিলাম।


আসার সময় ওরা এসেছিল একটা মাইক্রো ভাড়া করে। যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে গেল কিছু দূর হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে, এরপর লোকাল বাস, এরপর নছিমন আর তারপর ৩০ মিনিট আবার হাঁটিয়ে। ওদের বাসায় গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে গেল।


যখন গিয়ে পৌঁছলাম, গ্রাম তো, তাই হুড়মুড় করে ওই রাত থেকেই লোকজন দলে দলে আসা শুরু করল। ওরা দেখে, আর সবার মুখে একটাই কমন কথা। ‘কই তোমরা যা বলেছিলে, বউ তো ওরকম না। ভালোই তো দেখতে! তোমরা যে কী যা-তা বললে, আমাদের কিন্তু বউ পছন্দ হয়েছে!’ আমি অবাক হতে লাগলাম ওদের কথাগুলি শুনে।


এরপর ওই রাতেই নিহালের (আমার এক্স-হাজব্যান্ড) ছোটো দুলাভাই ওর বোনকে ধরে মারে, আর নিহালের বাসায় নিহালের বোনকে দিয়ে ফোন করিয়ে বলতে বলে যে, সে তাকে মেরেছে! তার বোনও স্বামীর কথামতো এটা করে। সেই মারের কথা শুনে নিহাল এবং নিহালের বাড়ির লোকজন খুব চিৎকার-চেঁচামেচি করে। ওরা বলে, সকালে গিয়েই নিহালের ছোটো দুলাভাইয়ের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে। তার বোনকে নিয়ে আসবে, ডিভোর্স করাবে। আমি চুপচাপ দেখলাম, এরকম অনেক ভাবনা ভাবা এদের শেষ!


সকালে উঠে নিহালের আব্বু নিহালকে বললেন, ‘ওসব করা লাগবে না। ওদের দাওয়াত দিতে হবে।’ পরদিন নিহাল গিয়ে বোনকে নিয়ে এল। আমি নতুন বউ, রান্নাবান্না, শাড়ি-পরা, শ্বশুরবাড়ির লোকজন, হাঁড়িপাতিল সব মিলে আমার কাছে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।


ওদের আলমারিতে অনেক আগের কিছু পুরনো শাড়ি ছিল। আমাকে সেখান থেকে দুইটা শাড়ি পরতে দিল, পাশের লোকজনের কথার প্রেক্ষিতে। শাড়ি ধোয়ার পর খালের পাড়ে গরু জবাই করলে খালের পানির যে অবস্থা হয়, শাড়ির ঠিক ওই অবস্থা হলো। একেবারে রংটং উঠে একাকার অবস্থা! আমার তখন সবই ভালো লাগছে। সেই রং-ওঠা পুরনো শাড়িটাও ভীষণ স্বপ্নের বলে মনে হচ্ছে।


তখন জুন মাস। টিনশেড ঘরে প্রচুর গরম, আর এমনিতেও আমার একটু বেশিই গরম লাগে। শাড়ি পরে সারাদিন কাজ করেছি। তখন কী যে এক অলৌকিক ভালোলাগা কাজ করছিল, আমি আজ জানি না।


আশেপাশের লোকজন জিজ্ঞেস করলে নিহালের আম্মু সবাইকে বলেন, ‘বউ এখনও ছাত্রী। ও এখন ছেলের সাথে ঢাকায় যাবে। পরীক্ষা আছে সামনে। চাকরি হয়ে গেলে তখন বাড়িতে আসবে পোস্টিং গ্রামে নিয়ে। আর এই সময়টা মাসে একবার বা দুই-চার মাস পর পর একবার এসে এসে ঘুরে যাবে।’ সবাই বলে, ‘বাহ্‌ ভালো!’ গ্রামের মানুষ অবশ্য সবকিছুতেই বলে, ‘বাহ্‌ ভালো!’ শুধু ওদের একটু ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে হয়। গ্রামের লোকজনের সাধারণত নিজস্ব কোনও মতামত থাকে না। সবার মতই ওদের মত।


জুনের ৯ কি ১০ তারিখ। ওর ছোটো দুলাভাই এল ওদের বাসায়। সে এসেই বলল, ‘কীসের পড়াশোনা? শখ হয়েছিল, পড়েছিল। এখন আর পড়াশোনা বা চাকরি করা লাগবে না। মেয়েমানুষ কী করবে চাকরি করে? ওই সাত-আট হাজার ইনকাম করতে ঢাকা যাওয়া লাগবে না। বাড়িতে রান্নাবান্না করবে, দিনশেষে ভাত জুটলে খাবে, না-জুটলে না খেয়ে পড়ে থাকবে। কীসের পড়াশোনা? কীসের চাকরি? বাড়ির বউ বাড়িই থাকবে। এটাই ফাইনাল।’


এই কথা শুনে নিহাল আর ওর পরিবারের সব মত পালটে গেল। নিহাল কয়েকবার করে টিকিট-কাউন্টারে গেছে, সে একাই ঢাকা যাবে, তাই একটাই টিকিট কাটতে গেছে। আমাকে কিছুই বলেনি। আমি যদি জিজ্ঞেস করি, ‘ঢাকা যাবে কবে?’ সে বেশ প্যাঁচগোচ দিয়ে টিয়ে বলে যে সে তখনও শিওর না কবে যাবে। হয়তো এক সপ্তাহ ছুটি নেবে। এদিকে কয়েকবার টিকিট খোঁজ করা শেষ, কিন্তু পায়নি, এটাই ছিল আসল কথা।


একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমাকে ওদের বাড়িতে নেওয়ার আগে ওদের গ্রামের লোকজন বলত, ‘ছেলে বিয়ে করিয়েছ, বউ কেন আনো না? তোমাদের ছোটো জামাইয়ের অত্যাচারের জন্যই বউ আনা হচ্ছে না, বউ আনলে সে তো তোমাদের এসব কাণ্ড দেখবে।’ ইত্যাদি কথাবার্তা। সেসব কথার প্রেক্ষিতে একদিন ওর আব্বু আমাকে ফোন দিলেন। ওরা সবাই তখন একজায়গায় বসা। ওর আব্বু ফোন দিয়ে আমাকে বললেন, ‘সানজিদা, আমি তোমাকে আজ কিছু কথা বলব, এবং তোমাকে সেগুলি শুনতে হবে।’ আমি বললাম, ‘জি।’


উনি বললেন, ‘তোমাকে আমাদের ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারণ তোমরা চেয়েছিলে। এখন আমি চাইছি, প্রথমবার তোমাকে তোমার মতো করে একা একাই খুলনা থেকে নড়াইল আমাদের বাড়িতে আসতে হবে, যদি সংসার করতে চাও। কোনও আত্মীয় বা পরিচিত কাউকেই সাথে আনতে পারবে না, এবং আমার বাড়ি থেকেও কেউ তোমাকে আনতে যাবে না। যদি এখানে আসতে চাও, তবে এটা করতে হবে। তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। তবে সিদ্ধান্ত যা দিয়েছি, ওটাই চূড়ান্ত।’


আমি বলেছিলাম, ‘আপনি আব্বু, আপনি যা বলবেন, আমি নিঃসন্দেহে সেটাই করব। তবে যদি আমাকে নিজের মেয়ে ভাবেন, তবে আমি বলি কী, যদি আমার জায়গায় আপনার দুই মেয়ের কেউ একজন হতো, আর তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে এভাবে বলত, তবে আপনার কেমন লাগত? আপনি কি পারতেন এভাবে মেয়েকে প্রথমবার এত দূরে খুলনা থেকে নড়াইল একা যেতে দিতে? তো আমার আব্বু-আম্মুর কেমন লাগবে একটু ভেবেছেন?’


উনি বললেন, ‘আমি নিরুপায়। জানি, এটা অসম্ভব। তবে আমার কিছুই করার নাই।’


উনি মুখে সরাসরি কিছু বলেননি, তবে জানতে পেরেছিলাম পরে, সেটা ওর ছোটো দুলাভাইয়ের সিদ্ধান্ত ছিল। যা-ই হোক, সেভাবে আমার যাওয়া হয়নি।


এখন ফিরে আসি, যে প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম, সেখানে। এরপর ও যখন টিকিট পায় না, তখন আমি তা জেনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে আবারও উত্তর দেয় উলটাপালটা। সরাসরি কিচ্ছু বলে না। আমি দেখলাম, ওরা আমাকে পুরাই বানরের মতো নাচাচ্ছে যে যার মতো করে।


১২ জুন ২০১৯ তারিখ সে দুপুরে রেস্ট নেওয়ার সময় আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, আর ও তখন পুরো অচেনা মানুষের মতো আচরণ করতে শুরু করল। আমি কেঁদে কেঁদে বললাম, আমি কাকে বিশ্বাস করে এতদূর এলাম! আমার সেই মানুষটি কই!


ও রেগে গিয়ে আমাকে বলে, ‘কী চাস রে তুই? হ্যাঁ…? কী চাস? ডিভোর্স?’ আমি তখন ওর কথার প্রেক্ষিতে বলেই ফেললাম, ‘হ্যাঁ, চাই।’ আর অমনিই ও বলল, ‘দাঁড়া, তোকে শায়েস্তা করছি! লোক ডাকছি!’ বলেই ওর দুই বোনকে ডাকল। তারাও শুধু একটা অজুহাত খুঁজছিল আমাকে ধরার। ওরা ঘরে ঢুকেই কিচ্ছু না জিজ্ঞেস করেই আমাকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করল, আর ওকেও বলল মারতে। চিৎকার করে করে বলল, ‘বেশ্যা কোথাকার! এখনও আমাদের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে! মার, আজকেই এই বেশ্যাকে মেরে ফেলব।’ এরপর দরজা-জানালা বন্ধ করে ওরা ৩ ভাই-বোন মিলে আমাকে ইচ্ছামতো মারল। লাথি, কিল, চড়, ঘুসি, গায়ের উপর উঠে লাফানো, দেয়ালে মাথা আছড়ে দেওয়া। কিছুই বাদ যায়নি।


(চলবে…)