দয়া

 
 আমাদের এ জীবনে যা-কিছুই ঘটুক না কেন, তার চাইতে বাজে কিছুও তো ঘটতে পারত, তাই না? যেমন আছি, ভালোই আছি! তাই জীবনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে সবচাইতে ভালো যে কাজটা আমরা করতে পারি, তা হলো, মানুষের প্রতি দয়ালু হওয়া।
  
 অনেক দিন আগের কথা। বোধ হয় ক্লাস সেভেনে। একদিন আমাদের ক্লাসে নতুন একটা ছেলে এল। দেখতে ছোটোখাটো, লাজুক গোছের। ওর চোখে ছিল বেশ মোটা ফ্রেমের চশমা।
  
 ওরকম চশমা আমাদের বয়েসি কেউ পরত না, কেবল বুড়োরাই পরত। ওকে ওর বাবা-মা ওটাই কিনে দিয়েছিল, তো বেচারা আর কী পরবে! আমরা যখন ওকে খ্যাপাতাম, ওর পেছনে লাগতাম, ও তখন ভয়ে আরও জড়সড় হয়ে যেত এবং হাতের বলপেনটা আরও বেশি করে কামড়াত।
  
 ও যে কলম কামড়াতে পছন্দ করত, তা নয়; ওটা ছিল ওর অভ্যেস। আমরা কেউই ওর বন্ধু ছিলাম না। ওর সঙ্গেও বন্ধুত্ব করা যায়, এটাই আমাদের কারও মাথায় কখনও আসেনি। তবুও ওকে আমাদের লাগত, খ্যাপানোর জন্য, মজা করার জন্য। ‘কী রে! তোর কলমটা খেতে খুব মজা নাকি? দেখি, দে তো, দে তো!’ বলেই ওর হাত থেকে কলমটা কেড়ে নিয়ে দূরে কোথাও ছুড়ে মারতাম। এটাই ছিল আমাদের খেলা। আমরা চাইতাম, ও আমাদের সঙ্গে চ্যাঁচামেচি করুক, যাতে আমরা সবাই মিলে ওকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিতে পারি!
  
 কিন্তু ও আমাদের কিছু বলত না। যতদূর মনে পড়ছে, (বোধ হয় চোখের জল আড়াল করতেই) ও চোখদুটোকে দ্রুত নামিয়ে ফেলত, কীরকম একটা সংকোচে কুঁকড়ে যেত, আর হঠাৎ দৌড়ে পালাত। ওর দিকে তাকালে মনে হতো যেন কী একটা অপরাধ ও করে ফেলেছে! অন্যায় করতাম আমরা; অথচ পালাতে হতো, যার প্রতি অন্যায় করেছি, তাকে! ছোটোবেলাতেই আমরা এমন একটা ভুল শিক্ষা পেয়ে বড়ো হচ্ছিলাম।
  
 বাসায় ফেরার পর ওর মা হয়তোবা ওকে জিজ্ঞেস করত, ‘স্কুলে আজ কী কী করলি রে?’ ‘অনেক মজা করেছি, মা!’ ‘নতুন বন্ধু হয়েছে?’ ‘হ্যাঁ মা, অনেক!’
  
 আমরা নাহয় ওকে কানা দেখি, ওর মা তো আর দেখে না! ও কাঁদলে আমরা নাহয় মজা পাই, ওর মা তো আর পায় না! কী দরকার মায়ের মনে কষ্ট দেবার!
  
 মাঝে মাঝে ও আমাদের স্কুলমাঠের এককোনায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের খেলা দেখত। ওকে দেখলে মনে হতো, বেচারা কী-একটা যেন বড়ো অপরাধ করে ফেলেছে!
  
 এভাবেই চলছিল।
  
 একদিন ওরা চলে গেল। ওর বাবা অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গিয়েছিলেন।
 ব্যস্‌, এইটুকুই! এর বাইরে আর কোনও দুর্ঘটনা নেই, ওকে নিয়ে বড়ো কোনও ঘটনাও ঘটেনি।
 একদিন ও আমাদের ক্লাসে ছিল, এখন আর নেই।
 ওর কোনও বন্ধু ছিল না। ওকে কেউ মিস করেনি। গল্প শেষ।
 ধরে নিই, ওর নাম বাবলু। বাবলুদের কেউ মিস করে না। বাবলুদের মিস করার কিছু নেই।
 এখন কথা হচ্ছে, আজ, এতদিন পর, আমি কেন এসব লিখছি? অনুশোচনা হচ্ছে, তাই? হয় যদি, কেন হচ্ছে? দুই যুগ পরে এসে এমন অনুশোচনার কী অর্থ?
  
 যা বলছি, তা বিশ্বাস করা না করা আপনার উপর। বাবলুর প্রতি আমি ক্লাসের অন্যদের তুলনায় সত্যিই বেশি সদয় ছিলাম। কখনও ওকে একটাও গালি দিইনি, ওর সঙ্গে কোনোদিনই রুক্ষভাবে একটাও কথা বলিনি। অন্যরা যখন ওর কলমটা নিয়ে ছুড়ে মারত, খেপিয়ে দিতে ওকে ধাক্কা দিত, কানা কানা বলে ওর পিছু নিত, তখন আমি মাঝেমধ্যে ওদের বোঝাতে চেষ্টা করতাম। তবে কখনও খুব যে জোর প্রতিবাদ করেছি, এমন নয়। আমি খুব হাবাগোবা টাইপের ছিলাম, আমার ভয় হতো এই ভেবে যে, যদি ওরা আমাকে মারে!
  
 আমি বাবলুর সঙ্গে কখনও খারাপ আচরণ করিনি, কিন্তু ওসব স্মৃতি আজও আমাকে বাজেভাবে নাড়া দেয়।
  
 কিছু সত্য আমাকে কষ্ট দেয়। এই কথাগুলি হয়তো গতানুগতিক শোনাবে, কিন্তু আমি এসব নিয়ে না ভেবে পারি না। ভাবি বলেই এ জীবনের এমন কিছু ব্যর্থতা আমাকে কষ্ট দেয়।
  
 সবচাইতে বেশি অনুশোচনা হয়, যখন দেখি, অনেকের প্রতি, চাইলেই আমি আরও একটু দয়ালু হতে পারতাম, কিন্তু হইনি। ইচ্ছে করেই হইনি বোধ হয়। কিংবা 'ইচ্ছে করে হইনি', ব্যাপারটা এরকমও না, এমনিতেই হইনি আর কি!
  
 আমার চোখের সামনেই কেউ একজন কষ্ট পাচ্ছে, যাকে আমি চিনি না। তাকে সাহায্য করেছি মাঝে মাঝে, তবে তা আমার সুযোগ ও সামর্থ্যের তুলনায় অল্প। আমি চাইলে মানুষটার কষ্ট আরও একটু কমাতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। যেহেতু সে আমার কেউ হয় না, সেহেতু তার কষ্ট নিয়ে আমি ততটা ভাবিইনি!
  
 আমরা কারও দিকে তাকাই যখন, তার আগেই চোখের সামনে একটা দূরবীন রেখে দিই। হিসেব করে দেখি, সে কি আমার কেউ হয়, না কি হয় না। যদি কেউ হয়, তবে সে অনেক দূরে অবস্থান করলেও তাকে চোখের ঠিক সামনে দেখতে পাই। যদি কেউ না হয়, তবে সে চোখের ঠিক সামনে অবস্থান করলেও তাকে অনেক দূরে দেখতে চাই।
  
 এবার নিজের দিকেই একটু তাকানো যাক। আমি কাকে সবসময়ই মনে রাখি? যে আমার কাছের ছিল, কিন্তু পাশে ছিল না, তাকে? না কি যে আমার পাশে ছিল, যদিও কাছের ছিল না, তাকে? বিপদের সময় আমাদের হৃদয়ে কে বেশি উষ্ণতা ছড়ায়? দূরে-থাকা কাছের মানুষ? না কি পাশে-থাকা দূরের মানুষ?
  
 যে আমার কষ্টের সময় আমার প্রতি দয়ালু ছিল না, তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখার আদৌ কি কোনও দরকার আছে?
 দয়া জীবনকে দেখতে শেখায়। যদি কাউকে দয়া দেখাতে গিয়ে কিছু সাময়িক ক্ষতিও আপনাকে মেনে নিতে হয়, তবুও তার প্রতি দয়ালু হোন। দেখবেন, একদিন এই ক্ষতিটুকুই আপনার জীবনে আশীর্বাদ ও শান্তি হয়ে ফিরে এসেছে। যে দয়ালু হতে পারে, তাকে আর স্বর্গে যেতে হয় না, সে স্বর্গেই থাকে!
  
 আমার বিপদের সময় যারা যুক্তি খুঁজেছে, তাদের কথা মাথায় এলেও আমার প্রচণ্ড ঘেন্না হয়। আর সেসময় যারা দয়া দেখিয়েছে, তাদের কথা মাথায় এলেই আমি তাদের পায়ের ধুলোয় নিজেকে একেবারে মিশিয়ে ফেলি।