প্রথম শ্লোকের দ্বিতীয় পাদে যে-বিষয়ের উল্লেখ হয়েছে, তা (দ্বিতীয় শ্লোকের মতোই) বিশদভাবে, চোখ বা দর্শনেন্দ্রিয়ে যে-যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে, তা-ই শ্রবণ এবং বাকি তিনটি ইন্দ্রিয়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্লোকটি অতিদেশ করছেন:
আন্ধ্য মান্দ্য পটুত্বেষু নেত্রধর্মেষু চৈকধা। সঙ্কল্পয়েন্মনঃ শ্রোত্রত্বগাদৌ যোজ্যতামিদম্।। ৩
অন্বয়। আন্ধ্যমান্দ্যপটুত্বেষু নেত্রধর্মেষু মনঃ একধা সঙ্কল্পয়েৎ। ইদং শ্রোত্রত্বগাদৌ চ যোজ্যতাম্।
অনুবাদ। চোখের অন্ধতা, মন্দতা, পটুতা—এ সকল ধর্মকে মন কেবলই ধর্ম মনে করে এক প্রকারেই গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে চোখ দৃশ্য এবং মন দ্রষ্টা। কান, ত্বক, নাক, জিভ ইন্দ্রিয়ের বেলাতেও মনের এই দ্রষ্টাত্ব এভাবে বুঝে নিতে হবে।
টীকা। ‘আন্ধ্যম্’—চোখের অন্ধতা বলতে বোঝায়: ঘটের স্বগ্রহণ—কোনো ঘটনা বা বস্তুর কারণ বা প্রকৃতিকে ঠিক সেভাবেই বোঝার অক্ষমতা—যোগ্য বা বিবেচ্য বস্তুকে সামান্য আকারেও অর্থাৎ কেবল ‘একটা-কিছু’ রূপেও গ্রহণ করতে না পারা। দৃষ্টিহীন বা অন্ধ জীবের চোখ থাকলেও তা কোনো কাজে লাগে না।
‘মান্দ্যম্’—স্বগ্রাহ্য ঘটাদি বস্তুকে, অর্থাৎ যে ঘটনা বা বস্তুর কারণ বা প্রকৃতি স্বাভাবিক চোখ নিজেই গ্রহণ করতে বা বুঝতে পারে, তা কেবল সামান্য আকারে অর্থাৎ ‘একটা-কিছু’—মাত্র এটুক আকারে গ্রহণ করার সামর্থ্য। ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন চোখের গ্রহণ করার সামর্থ্য কম, ফলে ঘটনা বা বস্তুর প্রকৃত ধারণা জন্মে না।
‘পটুত্বম্’—স্বগ্রাহ্য বিষয়টি সূক্ষ্মভাবে বা বিশেষাকারেও গ্রহণের সামর্থ্য। স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির চোখ কোনো ঘটনা বা বস্তু তার স্বরূপেই দেখতে সক্ষম।
অন্ধ লোকের মন কিন্তু অন্ধ নয়, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকের মনও তেমনি ক্ষীণ নয়। চোখের তিন রকমের অবস্থাকে মন এক রূপেই গ্রহণ করবে, অর্থাৎ “আমার চোখ অন্ধ।”, “আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ।” “আমার দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক।”—এভাবে চোখ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের বেলায় সামর্থ্যের বিচারে ভেদ ঘটানোর উপযোগী দৃশ্য গ্রহণ না করে কেবলই চোখের বা ইন্দ্রিয়ের ধর্ম হিসেবে মন গ্রহণ করবে। তাহলেই মনের দ্রষ্টাত্ব প্রতিপন্ন হবে। চোখ যতটা দেখল, মন ততটাই বুঝবে।
‘চ’ পদটি ‘শ্রোত্রত্বগাদি’ পদের সাথে সম্বন্ধযুক্ত। বোঝার সুবিধার্থে—ইদম্ শ্রোত্রত্বগাদৌ চ যোজ্যতাম্—কান, ত্বক, জিহ্বা, নাক, চোখ—ইন্দ্রিয়গুলিও নিজ নিজ গ্রহণীয় বিষয় বা দৃশ্যের তুলনায় দ্রষ্টাত্ব এবং নিজ নিজ প্রকাশক মনের তুলনায় দৃশ্যত্ব—এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বধিরতা, অনুভূতিহীনতা, স্বাদ-ঘ্রাণ-দর্শন ইত্যাদির অক্ষমতা বুঝে নিতে হবে।
এই শ্লোক একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ে দ্রষ্টাত্ব ও দৃশ্যত্ব বিচার দেখিয়ে অন্যান্য ইন্দ্রিয়েও একইরকম বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি বুঝে নেবার ‘অতিদেশ’ করছেন। আচার্য ভারতীতীর্থের অভিপ্রায় এই যে, পাঠক তথা শিষ্যগণ নিজ-নিজ বুদ্ধির সাহায্যে এমন দৃগ দৃশ্য বিবেক অর্থাৎ ‘দ্রষ্টাত্ব ও দৃশ্যত্ব বিচার’ করলে চারটি পুরুষার্থ (ধর্ম: ধর্মীয় ও সামাজিক নীতিবোধ, আধ্যাত্মিক ও আনুষ্ঠানিক কর্তব্যকর্ম; অর্থ: জাগতিক ও অর্থনৈতিক প্রগতি; কাম: পার্থিব সুখ; মোক্ষ: আধ্যাত্মিক মুক্তি) সাধন করতে পারবে।
বহুপ্রকার অর্থাৎ পরস্পর-ব্যভিচারী দৃশ্য হতে, তাদের দ্রষ্টারূপে মান্য অব্যভিচারী চোখও সাক্ষাৎ দ্রষ্টা নয়, কেননা সেই চোখেরও একরূপতার ব্যভিচার (প্রত্যভিজ্ঞার বা সামর্থ্যের রকমফেরের ফলে সৃষ্ট) দেখতে পাওয়া যায়। এই কারণে চোখও দৃশ্য। সেই কারণে চোখের দ্রষ্টা মনের বাইরে, চোখের অস্তিত্ব তথা ভূমিকাই নেই, এ কথাই এ শ্লোকে বোঝানো হয়েছে।
একই পুরুষে চোখ অভিন্ন হলেও, তা এক অবস্থায় থাকে না। তা কখনো অন্ধ, কখনো মন্দ ইত্যাদি অবস্থান্তর প্রাপ্ত হয়ে বিকৃত হয়, এবং যা বিকারী, তার পক্ষে নিজের বিকারের দ্রষ্টা হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং তা যে মাটির ঘটের মতোই অন্যের দৃশ্য, এ কথা অবশ্যই মানতে হবে। সেই চোখেরও যে-দ্রষ্টা, তাঁর খোঁজ করতে গেলে দেখা যায়, অন্তঃকরণ তার দ্রষ্টারূপে তার সাথে সম্বন্ধযুক্ত। এ কথাই আলোচ্য শ্লোক বলছেন সঙ্কল্পয়েন্মনঃ ইত্যাদি পদ দ্বারা।
আন্ধ্য মান্দ্য পটুত্বেষু নেত্রধর্মেষু—(সৎস্থ বা আত্মাস্থ) “আমি অন্ধ”, “আমি মন্দদৃষ্টি”, “আমি সমর্থদর্শন” (পটুনেত্র), এমন বাক্য প্রয়োগকারী মানুষে অনেক প্রকারে, বিবিধরূপে ‘সঙ্কল্পয়েৎ’ সম্যক্ প্রকার কল্পনাকারী ‘মনঃ’ তথা অন্তঃকরণ, চোখের পরস্পর ব্যভিচারী অবস্থার মধ্যেও অব্যভিচারী থাকে বলে দ্রষ্টারূপে সিদ্ধ হন।
এক জায়গায় নির্ণীত শাস্ত্রার্থ, অন্য জায়গায়ও প্রযোজ্য—এই নিয়মানুসারে চোখ সম্পর্কে যে-নিয়ম আবিষ্কৃত হলো, তা অন্য ইন্দ্রিয়ের বিষয়েও প্রযোজ্য হবে, এটাই বলা হচ্ছে: শ্রোত্রত্বগাদৌ চ যোজ্যতাম্—দর্শন সম্বন্ধে যে-নিয়ম আবিষ্কৃত হলো, তা শ্রবণ, ঘ্রাণ, আস্বাদন, স্পর্শ বিষয়েও প্রযোজ্য এবং চোখ সম্বন্ধে যে-নিয়ম আবিষ্কৃত হলো, তা কান, নাক, জিভ, ত্বক প্রভৃতি ইন্দ্রিয়েও প্রযোজ্য।