‘দৃগ্ দৃশ্য বিবেক’ (শ্লোক: ২)

এই প্রকরণ গ্রন্থে মূলত যে-বিষয়টি প্রতিপাদিত হচ্ছে, তা সংক্ষেপে প্রথম শ্লোকে প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর প্রথম শ্লোকের প্রথম পাদে যে-বিষয়টির উল্লেখ হয়েছে, দ্বিতীয় শ্লোক তারই ব্যাখ্যা করছেন:




নীলপীতস্থূলসূক্ষ্মহ্রস্বদীর্ঘাদিভেদতঃ।
নানাবিধানি রূপাণি পশ্যেল্লোচনমেকধা।। ২




অন্বয়। নীলপীতস্থূলসূক্ষ্মহ্রস্বদীর্ঘাদিভেদতঃ, নানাবিধানি রূপাণি লোচনম্ একধা পশ্যেৎ।




অনুবাদ। নীল, পীত (হলুদ), স্থূল, সূক্ষ্ম, হ্রস্ব, দীর্ঘ প্রভৃতি ভেদে রূপ বা দৃশ্য নানান রকমের। চোখ সেই নানান রকমের রূপকে এক করেই দেখবে, অর্থাৎ কেবল রূপ বা দৃশ্য বলেই দেখবে।




টীকা। নানাত্বই দৃশ্যত্বের উৎস বা মূল কারণ এবং একত্বই দ্রষ্টাত্বের উৎস বা মূল কারণ। সে কারণে রূপ বা দৃশ্যসমূহ লাল, নীল, হলুদ ইত্যাদি অনেক প্রকারের ভিন্নতাবশত নানান ধরনের উৎস থেকে সৃষ্ট দৃশ্য বলে গণ্য হয়।




ওরকম ভিন্ন ভিন্ন রঙের রূপ বা দৃশ্যের বাহ্যিক বৈচিত্র্যবশত তাদের মধ্যে ওরকম বিভিন্ন ভেদ ঘটে থাকে। সে সকল স্বরূপ-ভেদ গ্রহণ না করেই চোখ বা দর্শনেন্দ্রিয় নিজের গ্রহণীয় সেই সকল রূপকে ‘একধা’—এক রূপেই ‘পশ্যেৎ’—গ্রহণ করবে; তাহলেই চোখের দ্রষ্টাত্ব সিদ্ধ হবে। (বড়ো কোনো বস্তু দেখার সময় চোখ সেটির সমান বড়ো হয়ে যায় না, সবুজ রঙের ঘাস দেখার সময় চোখ সবুজ হয়ে যায় না; অর্থাৎ দৃশ্যের আকৃতি, রূপ ইত্যাদি পরিবর্তিত হলেও চোখ তার দ্রষ্টাত্ব বজায় রেখে স্থির থাকে।)




দেখা থেকে শুরু করে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সকল ধরনের কাজেই যা Constant বা নিত্যস্বরূপ বা অপরিবর্তনীয়, তা-ই দ্রষ্টা; যা Variable বা অনিত্যস্বরূপ বা পরিবর্তনশীল, তা-ই দৃশ্য। শাস্ত্রীয় টীকাকারগণ দ্রষ্টার এই Constancy বা নিত্যস্বরূপতা কেবল অনুভব দ্বারাই প্রমাণ করে থাকেন। (এমন জ্ঞান তাই স্বজ্ঞালব্ধ।)




যদি বলি, যে আমি ছোটোবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গসুখ পেয়েছিলাম, সেই আমিই বার্ধক্যে নাতির সঙ্গসুখ পাচ্ছি—কারণ একটাই: এখানে Constancy অনুভূতিরই স্বরূপ এবং দ্রষ্টা ও অনুভূতি (সঙ্গসুখ) একই বস্তু। নিত্যচেতন না হলে এটা হতে পারে না। এই নিত্যস্বরূপতা বা একত্ব যেমন দ্রষ্টাত্বের স্বভাব, দৃশ্যকে তার বিপরীত স্বভাবের অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন এবং জড় হতেই হবে। তা না হলে সেটা দৃশ্য হতে পারে না। বাবা-মা, নাতি এখানে দৃশ্য এবং সঙ্গসুখ দ্রষ্টা।




কোনো বস্তুতে দ্রষ্টার মতো নিত্যস্বরূপতার বা একত্বের ভ্রম হলে, তা দ্রষ্টার মতো হয়ে যায়, অর্থাৎ দৃশ্য বলে অনুভূত হয় না। একটা উদাহরণ দিই। দিক ও কাল, এই দুই সত্তার আপাতপ্রতীত নিত্যস্বরূপতা বা একত্বের কারণে এরা দৃশ্য বা গ্রাহ্য হয় না। কিন্তু এই দুইটিই যখন পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ এবং অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এরকম নানা দিকে এবং কালে বিভক্ত হয়, তখন তাদের উপর দৃশ্যত্ব বা গ্রাহ্যত্ব আরোপিত হয়। দৃশ্যের অতর্কিত পরিবর্তনে যেখানে দ্রষ্টার নিজের মধ্যেই নানাত্বের ভ্রম ঘটে, সেখানে দ্রষ্টা নিজের একত্বের অনুসন্ধান করে স্বরূপস্থ হতে চেষ্টা করেন। (উদাহরণস্বরূপ, ‘নেতি নেতি’ বৈদান্তিক প্রক্রিয়ায়)




(অতিদেশ—তার উক্তিই আমার উক্তি, এমন যে-বাক্য। অপদেশ—অন্য বাক্যের দ্বারা যে-কথা সূচিত হয়। উপদেশ—শিক্ষার জন্য যে-বচন বলা যায়। নির্দেশ—আমি সেই ব্যক্তিই বটে, এমন কথা। ব্যপদেশ—ছল করে আত্মাভিলাষ প্রকাশ করা।)




এখন দেখা যাক, কীভাবে সেই দ্রষ্টাকে অদ্বৈত আত্মা (অর্থাৎ আত্মা ও ব্রহ্ম এক) বলে প্রতিপাদন করা যায়।




কোনো একটি বিবৃতির সত্যতা বা মিথ্যাত্বকে আমরা যেমন স্বীকার করি, তেমনি আবার ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকারও করি। কোনো বিবৃতির সত্যতা বা মিথ্যাত্বকে অস্বীকার করাকে বলা হয় ‘নিষেধন’ এবং এর থেকে উদ্ভূত বিবৃতিটিকে বলা হয় নিষেধক বা বাধক।




দৃশ্যসমূহ পরস্পরের বাধক বা নিষেধক। দড়িতে ভুল করে অনুমিত সাপ, বিদ্যুতের বা জলের পাইপ, লাঠি, মালা ইত্যাদি যে-সকল দৃশ্য পরস্পর নিষেধক, তারা অবশ্যই কোনো-না-কোনো আধারে কল্পিত। দ্রষ্টার স্বরূপ, সেই দড়িটির মতোই, সকল দৃশ্যের সাথে অন্বিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে অকল্পিত বা অকৃত্রিম; দড়িকে ভুল করে (দৃশ্যের অবয়বে) সাপ, পাইপ, লাঠি, মালা যা-ই বলা হোক না কেন, দড়িটি দড়িই থাকে। সেই দ্রষ্টা স্বরূপের সাথে ওই দৃশ্যগুলির অন্বয়-ব্যতিরেক সম্বন্ধ, অর্থাৎ প্রথমটা থাকলে দ্বিতীয়টা থাকে, প্রথমটা না থাকলে দ্বিতীয়টা থাকে না। (দড়ি না থাকলে নিশ্চয়ই অতগুলি দৃশ্যের উদ্ভব ঘটত না।) দ্রষ্টা যে অদ্বৈত আত্মা, তা এর সাহায্যেই বুঝতে পারা যায়। দ্বিতীয় শ্লোক এটাই বলছেন।




নীল, হলুদ, স্থূল, সূক্ষ্ম, হ্রস্ব, দীর্ঘ ইত্যাদি ভেদে দৃশ্য বা ঘট বা রূপ নানা রকমের। এখানে ‘ইত্যাদি’ শব্দ দ্বারা বাঁকা, গোলাকার এমন সকল ধরনের রূপও বোঝায়।




‘নানাবিধানি রূপাণি’—এভাবে পরস্পর বাধকরূপ সকল ঘটকে ‘পশ্যৎ লোচনম্ একধা’—দেখে যে-চোখ, তা এক প্রকারের‌ই, অর্থাৎ তা অব্যভিচারি (কোনোরূপ প্রতিকূল কারণ দ্বারা নিবারণ বা পরিবর্তন করতে অশক্য বা অসাধ্য এবং অলক্ষ্যেও যার সমন্বয় বা বিকার হয় না, অর্থাৎ যা স্থির, নিত্য, অবিকল, অভিন্ন)। চোখের বাইরে সেই রূপের অস্তিত্ব আছে, এর কোনো প্রমাণ নেই; কেননা চোখ যখনই দর্শন করে, তখনই রূপের প্রতীতি বা উপলব্ধি হয় এবং অন্য সময়ে তা হয় না।




যা আগে দেখা হয়েছে, তাকে পরে দেখলে, “এটা আমি আগেও দেখেছি” ভেবে তা চিনতে পারাকে প্রত্যভিজ্ঞা বলে। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আগে যে-বস্তুটি দেখা গিয়েছিল, তা সত্য অর্থাৎ বাইরে তার অস্তি বা বিদ্যমানতা আছে। এতে সেই প্রত্যভিজ্ঞার অন্য ধরনের উপপত্তি (যুক্তি, প্রমাণ, সিদ্ধান্ত, মীমাংসা, সম্পাদন, প্রাপ্তি, সংস্থান) হয় বা তা অপ্রমাণ (আগের সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুতি) বলে প্রতিপন্ন হয়।




(বেদের শ্লোকাত্মক অংশকে ‘মন্ত্র’ বলে এবং বেদের ব্যাখ্যাত্মক অংশকে ‘ব্রাহ্মণ’ বলে। মন্ত্রে যা অল্প কথায় থাকে, ব্রাহ্মণে তা বিস্তারিতভাবে থাকে। মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ সমন্বিত বেদ সৃষ্টি করতে ঈশ্বরকে একটুও কষ্ট করতে হয়নি। জীবগণ যেমন বিনা আয়াসে নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করে, ঈশ্বর তেমনি বিনা প্রযত্নে বেদকে প্রকটিত করেছিলেন। অন্যান্য শাস্ত্রোক্ত বাক্য প্রত্যক্ষের অথবা অনুমানের অথবা বেদের বিরুদ্ধ হলে অপ্রমাণ হয়। বেদ কিন্তু অন্য প্রমাণের অপেক্ষা করে না। বেদে যা কথিত আছে, তাহা স্বতঃই বা নিজেই প্রমাণ বলে গ্রাহ্য হয়। কোনো জায়গায় যদি বেদের কোনো অংশকে প্রত্যক্ষ শব্দ বা অনুমানমূলক কোনো অংশের বিরুদ্ধ বলে বোধ হয়, তাহলে সেই অংশ অপ্রমাণ বলে পরিত্যক্ত হবে না। সেখানে বুঝতে হবে যে, হয় আমরা বেদের যথার্থ মর্ম গ্রহণ করতে পারছি না অথবা মরীচিকা দেখার মতো আমাদের প্রত্যক্ষ দেখায় কোনো প্রকারের ভ্রম আছে অথবা আমাদের শব্দজ্ঞানে বা অনুমানে কোনোরূপ প্রমাদ হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে বেদ নির্ভুল এবং অন্য-প্রমাণ-নিরপেক্ষ। এই সপ্রমাণ বেদ যে উৎস হতে উদ্ভূত হয়েছে, তিনি নিশ্চয়ই সর্বজ্ঞ।)




উদাহরণ দিই। কেউ ঝিনুকে মুক্তো দেখল। এখানে এই মুক্তো রয়েছে—এভাবে তার মধ্যে অনেকক্ষণ বা অল্পক্ষণ ধরে অনুভূতি হলো। পরে ঝিনুকে মুক্তো কীভাবে হয়, তা সম্পর্কিত জ্ঞান আহরণ বা মস্তিষ্কে ধারণ বা স্মৃতি হতে আনয়নের সাহায্যে সেই অনুভূতি বাধাগ্রস্ত হবার আগেই, অন্যান্য বস্তু দেখে চোখ আবার সেই ঝিনুকে পড়ল। চোখের দোষ (অর্থাৎ ঝিনুকে মুক্তো দেখার ভ্রম) তখনও কাটেনি, তেমনই রয়েছে। তার প্রত্যভিজ্ঞা হলো—এটিই সেই মুক্তো। (যার সম্পর্কে আমাদের মন ভুল বা অসত্য বিচার করে, তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানার আগেই যদি অন্যান্য বস্তু বা ঘটনা আমাদের চোখের সামনে এসে পড়ে, তবে আগের ব্যক্তি বা বস্তু বা ঘটনাটি আবার হঠাৎ চোখে পড়লে তার সম্পর্কে আমাদের মন যা বলবে, তা প্রত্যভিজ্ঞা থেকে উৎপন্ন, সুতরাং তা নিঃসন্দেহে ভ্রান্ত।)




এমন ক্ষেত্রে প্রত্যভিজ্ঞাকে প্রমাণ বলে গণ্য করা যেতে পারে না, কেননা আরোপিত বস্তুর শরীর প্রাতিভাসিক (বাস্তব না হয়েও বাস্তবরূপে প্রতীয়মান, এমন) অর্থাৎ প্রতিভাসের বা ‘ব্যক্তিগত প্রতীতি’র (যা ভুল হলেও সঠিক বলে মনে হয়) উপর নির্ভর করে। এভাবে যে পর্যন্ত না অধিষ্ঠানের (যার উপর প্রতীতি জন্মেছে) স্বরূপজ্ঞান হয়, সেই পর্যন্ত, তাতে যে-বস্তুবিশেষ দেখা গেছে, তা বাধিত বা মিথ্যা বলে জানার আগে তার বা তার মতন ঘটের বা বস্তুর বা ঘটনার অন্য ভ্রান্তি উদিত হলে, তা প্রত্যভিজ্ঞাজনিত ভ্রম ছাড়া আর কিছু (অর্থাৎ প্রমাণ বা সত্য) নয়। ফলে এক্ষেত্রে দ্রষ্টা তথা চোখ এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই দৃশ্যের কল্পিত বা অনুমিত অস্তিত্ব, যা সত্য না হলেও প্রত্যভিজ্ঞার কারণে সত্য বলে মনে হয়।




পর-প্রতীতি পূর্ব-প্রতীতির সদৃশ বা অনুরূপ হ‌ওয়া সত্ত্বেও এই দুই ভিন্ন এবং তাই অপ্রমাণ বলে গৃহীত হলে, দৃশ্য ও দর্শনের বোধ বা জ্ঞান দ্রষ্টার অখণ্ড নয়, বরং খণ্ডিত ও ভ্রান্ত রূপ প্রকাশ করে। এই যুক্তিতে, এক, নিত্য, অখণ্ড, সৎ, একরস চৈতন্য স্বরূপ যে-আত্মা রয়েছেন, তিনি সকল প্রকার ভ্রমের অধিষ্ঠান। তাই এই ধাপে, অর্থাৎ ইন্দ্রিয় যখন দ্রষ্টা, তখন, আমাদের সিদ্ধান্তে একটুও দোষ নেই—এই যুক্তি মেনে নিয়ে পরের ধাপে অগ্রসর হতে হবে। কোনো একসময় দড়ি দেখে সাপ ভাবলে (পূর্ব-প্রতীতি) পরবর্তীতে দড়ি দেখে (পর-প্রতীতি) মালা ভাবলে এবং এভাবে একেক সময় একেক প্রতীতির জন্ম হলে, এমন ঘটনা প্রত্যভিজ্ঞাজনিত ভ্রম এবং তা দ্রষ্টার (চোখের) খণ্ডিত ও ভ্রান্ত রূপ প্রকাশ করে। স্মৃতি ও বিবেক, এই দুইয়ের সমন্বয়ে অপ্রমাণকে প্রমাণে উন্নীত করা যায়।