প্রিয় স্বরলিপি,
কেমন আছ? মাকে মিস করো? বাবাকে মনে পড়ে কখনো?
আচ্ছা, তুমি কি অভিমান করে আছ এটা ভেবে যে, কেন তোমাকে পৃথিবীতে আনলাম না? রাগ কোরো না, তুমি না জন্মেই বরং ভালো আছ! পৃথিবীটা খুব নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবীর আলো দূষিত, বাতাস দূষিত, এখানে মানুষগুলোও অসভ্য।
যদি কখনো মনে হয়, তোমাকে পৃথিবীতে এনে একটা সুন্দর ও নিরাপদ জীবন দিতে পারব, সেদিন তোমাকে সত্যিই পৃথিবীতে আনব। তুমি আমার কোল ঘেঁষে ঘেঁষে সারাদিন বেড়ালের মতন ম্যাঁও ম্যাঁও করবে, আমি অবাক হয়ে তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি সেকেন্ড অনুভব করব। তুমি হাসলেও আমি হাসব, তুমি কাঁদলেও আমি হাসব। তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার নিঃসঙ্গতার হাজার বছরের দুঃখ ঘুচিয়ে নেব।
জানো, তোমাকে দেখার জন্য আমার বুকে কী যে নিদারুণ তৃষ্ণা জাগে!
তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় আমার চোখদুটো যেন ঝরে পড়ে যেতে চায়! তোমায় একটু ছুঁতে চাওয়ার তীব্রতায়, তোমায় একটু বুকে চেপে ধরার তৃষ্ণায় আমি ব্যাকুল হয়ে যাই!
তোমার অস্তিত্ব আমায় কঠিনভাবে চেপে ধরে আছে। তুমি আমার চোখের সামনে এক-পা এক-পা করে হাঁটতে শিখবে, একটু একটু করে ভুলভাল কথা বলতে শিখবে, আমাকে ‘মা’ বলে ডাকবে, সারাদিন হইহুল্লোড় করে ঘর মাতিয়ে তুলবে। মাঝে মাঝে তোমার বাবা তোমায় দেখতে আসবে, বাবাকে দেখেই তুমি একছুটে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বাবার হাতে থাকবে তোমার জন্য আনা চকলেট, খেলনা, আরও কত-কী! তুমি কী যে ভীষণ খুশি হবে!
আমার ডায়েরিতে প্রতিদিন তোমার একটু একটু করে বেড়ে ওঠার মুহূর্তগুলো লিখে রাখব। তুমি একদিন অনেক বড়ো হলে মায়ের ডায়েরিটা পড়বে। তুমি বাবার মতন মেধাবী হবে, মায়ের মতন শান্তিপ্রিয় হবে। বাবা তোমাকে অঙ্ক-বিজ্ঞান শেখাবে, আর মা তোমাকে মানুষ হতে শেখাবে। তুমি আমার চোখের সামনে একটু একটু করে বড়ো হবে, আমরা একটু একটু করে বুড়ো হব। আমার ধ্যানজ্ঞানজুড়ে শুধুই তুমি থাকবে।
তোমার বাবার দুনিয়াটা অনেক বিশাল, ওখানে তোমার অত জায়গা হবে না। বাবার আলাদা দুনিয়ায় তোমার জন্য সময়ের অভাব থাকবে, ভালোবাসার অভাব থাকবে; কিন্তু মায়ের কাছে তোমার জন্য কিছুরই অভাব থাকবে না।
তুমি থাকলে মা তোমাকে নিয়ে রোজ কবিতা লিখত, রোজ গান বানাত, রোজ রোজ ডায়েরির পাতায় শব্দের কাটাকুটি দিয়ে কথার বিশাল বিশাল দালান গড়ত।
তুমি আর আমি একটা দু-রুমের খুব গোছানো সুন্দর বাসায় থাকব। এক রুমে আমরা, আরেক রুমে তোমার জন্য পুতুল আর তোমার যত প্রিয় খেলনা। ড্রয়িংরুমটায় থাকবে একটা কালো পিয়ানো—তোমাকে দেখে আমি রোজ পিয়ানোয় সুর বুনতাম। আমার সুখের কোনো সীমা থাকত না। আমার জগৎটাই হতো কেবল তুমি, আমি আর তোমার বাবা-ময়। তুমি থাকলে আমি কত-কী যে লিখতাম, তোমার বাবা সেসব লেখা পড়েই শেষ করতে পারত না।
নাহ্, এসবের কোনোটাই হয়নি! আমার তোমাকে দেখা হয়ে ওঠেনি। দিনদিন তুমি অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছ, তোমাকে নিয়ে তৈরি হওয়া সব লেখাও কেমন আধমরা আধমরা হয়ে যাচ্ছে! কত গান-কবিতা-গল্প, কত সুখ-অসুখের ডায়েরির পাতা তোমার মতোই, না জন্মেই শেষ হয়ে গেল! তোমার অজন্মের সাথে কত ভয়ানক সুন্দর সব ডায়েরির পাতাও অজন্মানোই রয়ে গেল।
প্রিয় কন্যা, তোমাকে একটা দুঃসংবাদ দিই। তোমার মা এখন আর আগের মতো তোমার বাবার পা ধরে কেঁদে ফেলে না, আগের মতো তোমাকে নিয়ে গল্প লিখতে অস্থির হয় না। তোমার মা এখন ভীষণ প্র্যাকটিক্যাল!
আর তোমার বাবা আগের মতোই তার জীবন নিয়ে প্র্যাকটিক্যাল। সে তোমাকে নিয়ে ভাবার অত সময় পায় না। তোমারই মতন ছোট্ট একটা পুতুল আছে তার। পুতুল এবং পুতুলটার মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। তুমি যেমন আমার কাছে গোটা একটা দুনিয়া ছিলে, তোমার বাবারও গোটা একটা দুনিয়া আছে পুতুল আর পুতুলের মাকে নিয়ে। তোমাকে তার মনেই পড়বে না কখনও। মনে পড়ার প্রয়োজনই তো হয় না!
আমি মাঝেমধ্যেই তোমাকে প্রচণ্ড রকমের মিস করি। কথা দিলাম, মাঝে মাঝে তোমাকে চিঠি লিখব। মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে তোমাকে কল্পনা করব। জীবন আমাকে যতদিন না আরও ব্যস্ত করে দেয়, তোমাকে আরও কটা দিন কল্পনায় বাঁচিয়ে রাখব। তুমি কল্পনার মানুষ, আদরের মানুষ, স্মৃতির মানুষ—যতদিন মনে রাখব, ততদিন বেঁচে থাকবে, আর ভুলে গেলেই তো তোমার মৃত্যু!
প্রিয় স্বরলিপি, আমায় ক্ষমা কোরো। তোমাকে পৃথিবীতে আনতে পারিনি, আমিও একজন অসাধারণ মা হয়ে উঠতে পারিনি, তার সাথে তোমাকে নিয়ে লেখা ডায়েরিটাও আর লেখা হয়ে ওঠেনি। তোমার জন্ম না হওয়াটা শুধু তোমারই জন্মহীনতা না, আমার অনেক কবিতা, গান, গল্পেরও জন্ম না হওয়া; কেননা তুমি যে আমার কলম ছিলে আর তোমার বাবা ছিল আমার ডানহাত।
এখন আমরা কেউ কারও না। কী ভয়ানক, কী অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল, অথচ তোমার বাবা-মা টেরই পেল না, তাই না?
রাগ কোরো না, মৃত্যুর পর যদি সত্যিই জন্ম থাকে, তবে আমাদের দেখা হবে। তোমাকে আর তোমার নানুকে আমি জীবনের প্রথম বারের মতো দেখব। আমার সবটুকু পুণ্যের ফলস্বরূপ তোমাদের দু-জনকে আমি একসাথে দেখব। যদি জন্মান্তর মিথ্যে হয়, তবে আমাদের আর কখনোই, কোনোদিনই দেখা হবে না। কী কষ্ট! কী কষ্ট!
আজ আর নয়। আরেক দিন কখনো তোমাকে আবারও মা চিঠি লিখবে, ততদিন ঝাপসা হয়ে যেয়ো না যেন! মনে থাকবে?
ইতি তোমার মা