গীতার শ্লোকার্থ: ৪/৭, ৪/৮


যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধরমস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।। ৭

পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।। ৮

পদচ্ছেদ। যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিঃ ভবতি ভারত, অভুত্থানম্ অধর্মস্য তদা আত্মানম্ সৃজামি অহম্। ৭।। পরিত্রাণায় সাধূনাম্ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্, ধর্ম-সংস্থাপন অর্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে। ৮।।

অন্বয়। ভারত! যদা যদা হি ধর্মস্য (বর্ণাশ্রমলক্ষণস্য বেদবিহিতস্য ধর্মস্য) গ্লানিঃ (হানিঃ) অধর্মস্য চ অভ্যুত্থানং (সমুদ্ভবঃ) ভবতি তদা অহং আত্মানং সৃজামি (মায়য়া দেহবিশিষ্টমিব দর্শয়ামি)। ৭।। সাধূনাং (বেদমার্গস্থিতানাং স্বধর্ম্মনিরতানাং) পরিত্রাণায় (পরিরক্ষণায়) দুষ্কৃতাং (বেদনার্গবিরোধিনাং স্বধর্মভ্রষ্টানাং) বিনাশায় (বধায়) ধর্ম-সংস্থাপনার্থায় (বেদবিহিতকর্মপ্রবর্তনরূপধর্মস্থাপনং কর্তুম) চ যুগে যুগে (প্রতিযুগম্) সম্ভবামি (স্বসঙ্কল্পেন উৎপদ্যে)। ৮।।

কঠিন শব্দ। যদা যদা হি = যখন যখন-ই। গ্লানি = ঘৃণাকর পঙ্কিলতা। আত্মানম্ সৃজামি = নিজেকে আবির্ভূত করাই; আমার নিত্যসিদ্ধ রূপকেই মায়াবশে এইরূপে সৃষ্টি-করা রূপের মত দেখাই। পরিত্রাণায় = সকল কঠিন পরিস্থিতি হতে রক্ষা করার জন্য। চ = এবং। দুষ্কৃতাম্ = দুষ্টদের, পাপাচারীদের। সম্ভবামি = প্রকটিত, আবির্ভূত হই।

প্রতিশব্দ। ভরতবংশোদ্ভব! যখন ধর্মের হানি হয় এবং অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, তখন আমি আপনাকে সৃষ্টি করি। ৭।। ধর্মনিষ্ঠগণের রক্ষার জন্য, ধর্মভ্রষ্টগণের বধের জন্য এবং ধর্মস্থাপনের জন্য যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করি। ৮।।

ব্যাখ্যা। হে ভরতবংশোদ্ভব অর্জুন! যে যে সময়ে জগতে ধর্মের হীনদশা এবং সঙ্গে সঙ্গে অধর্মের অভ্যুদয় উপস্থিত হয়, তখনই আমি শরীর পরিগ্রহ করে আবির্ভূত হই। ৭।। ধর্মপরায়ণ জনগণের পরিরক্ষণ, ধর্মভ্রষ্ট পাষণ্ডগণের উচ্ছেদসাধন এবং বেদবিহিত ধর্মসংস্থাপনের অভিপ্রায়ে আমি প্রতিযুগে আবির্ভূত হয়ে থাকি। ৮।।

অনুবাদ। হে ভারত (অর্জুন), যখন যখনই ধর্মে পঙ্কিলতা আসে ও অধর্মের উত্থান বা আধিক্য হয়, তখন তখনই আমি নিজেকে আবির্ভূত করাই। সাধুদেরকে রক্ষার জন্য, দুষ্টদেরকে বিনাশের জন্য ও ধর্মকে (সংশোধিতভাবে বা নূতনভাবে) প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুগে যুগে আমি আবির্ভূত হই।

আমি যুগাবতার রূপে বা দেবোপম মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের দ্বারা সময়োপযোগী ধর্মের প্রতিষ্ঠা করাই। কিন্তু কালের নিয়মে, মানুষের সেই ধর্মের প্রতি, নিষ্ঠার শিথিলতা আসতে থাকে, তখন তা পঙ্কিল (পাপযুক্ত) করার জন্য নানা ধরনের বিষয় তাতে প্রবেশ করতে থাকে; সঙ্গে সঙ্গে ছিন্ন-বিচ্ছিন্নকারী নানা মতবাদের জন্ম হয়ে থাকে। সেই পঙ্কিল ধর্মে দুষ্টদের বৃদ্ধি হতে থাকে ও সাধুরা তাদের দ্বারা অত্যাচারিত হতে থাকেন। ক্রমেই পরিস্থিতি এত জটিল ও জঘন্য হয়ে ওঠে যে, মানুষ খুব চেষ্টা করেও তার সংস্কার করতে পারে না। তখন সেই অপবিত্র মৃত, বিকৃত ধর্মকে সরিয়ে ফেলতে ও তার জায়গায় প্রাণবন্ত ও সময়োপযোগী ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত, দুষ্টের দমন ও বিনাশ করতে এবং সাধুদেরকে নিরাপদ রাখতে মানুষের দেহ ধরে, শিক্ষকের ভূমিকায় আমাকে আবার আসতে হয়। আর আসতে হয় সময় বুঝে, যখন আমার জন্য অনেকগুলি কাজ জমা হয়ে পড়ে, যা আমি ছাড়া আর কেউই সম্পন্ন করতে পারে না, যেমন নানা শাপ ও নানা বর, যাতে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে বা আমি নিজে যুক্ত হয়েছি, সেগুলির ফলদান করতে, উদাহরণস্বরূপ, অহল্যাকে উদ্ধার, দণ্ডকারণ্যের ত্রেতার ঋষিদের মনষ্কামনা পূরণ (তারা আমার সেই বরে, এই কৃষ্ণজন্মে আমাকে গোপীভাবে ভজনা করার জন্য পেয়েছিল), জয় বিজয়কে, রাবণ শিশুপাল ইত্যাদিকে উদ্ধার, অঙ্গদকে নিজ হতে বরদান (দ্বাপরে সে ব্যাধ হয়ে, পিতৃবধের শোধ নিতে আমাকে যেন অবলম্বন করতে পারে) ইত্যাদি কাজ আমি ছাড়া আর কারও দ্বারা সম্পাদিত হতো না।

এই কাজগুলি সম্পাদন করতে আমাকেই আসতে হয়। ভগবদ্-ভক্ত ব্যক্তি যদি পীড়নকারী হয়ে থাকে এবং কোনো দেবতার বরে বা পূর্বজন্মের কর্মের ফলে, অন্য কারও দ্বারা বধ্য না হয়, তবে তাকে বিনাশ করতে আমাকেই আসতে হয়। আমি নিজের জায়গায় বসে বসে তার মন ঘুরিয়ে দিলাম বা আমার ইচ্ছার দ্বারা তাকে মেরে ফেললাম, এমন অদ্ভুত কিছু করি না।

ভগবান ও ভগবদ্‌প্রণোদিত ঋষিরা আদর্শস্থাপনের জন্যও আসেন (৩/২৪-২৫)। কারও সত্যপথ ও সুআচরণ দেখে লোকে যা শেখে, হাজারো মৌখিক উপদেশে তা হয় না। যুগে যুগে, শুধু যুগে যুগে নয়, বার বার যখনই প্রয়োজন হয়, তখন ভগবান নিজেকে প্রকটিত করেন। দরকার হলে এক যুগে একাধিক বার অবতীর্ণ হন।

‘পরিত্রাণ’—এই শব্দের অর্থ শুধু ‘উদ্ধার’ নয়, এতে আরও কয়েকটি সুসংগত ভাব আছে, যেমন সাধুদেরকে আসুরিক ভাবের স্পর্শ বা প্রভাব হতে রক্ষা করা, ভগবানের জন্ম ও কর্ম সাক্ষাৎভাবে উপলব্ধ করিয়ে পুনর্জন্ম হতে পরিত্রাণ দেওয়া; ভগবানের বিরহে সাধুরা যখন অত্যন্ত কাতর ও তাপিত হয়ে ওঠেন, সেই কাতরতা ও তাপ হতে তাঁদেরকে মুক্ত করা।

‘বিনাশায়’—এর সুসংগত অর্থ হবে আসুরিক ভাব নষ্ট করে দেওয়া। অবতার পাপীদের হাতে ধরে বধ করেন, এভাবে বোঝার প্রয়োজন নেই। চৈতন্যদেব বা বুদ্ধদেব কাউকে হাতে ধরে বধ করেননি। মশা মারতে কামান দাগার কী প্রয়োজন? অবতারদের আগমনে যে একটা পুণ্যের বন্যা বয়, মানুষের ভেতরের পাপপুরুষ তাতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়ে যায় (বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্)। পাপের যে নোংরা পচনশীল নদী বইছিল, তার পঙ্কিলতায় সাধুদের আর পড়তে হয় না, পাপস্পর্শ হতে তাঁরা ‘পরিত্রাণ’ পান; মৃত্যুময় সংসারসাগর হতে তাঁরা ত্রাণ পান (তেষামহম্ সমুদ্ধর্তা মৃত্যু-সংসার সাগরাৎ, ১২/৭)। অবতারের আগমনে পৃথিবী আধ্যাত্মিক ভাবের জোয়ারে প্লাবিত হয়।

ধর্ম কী? যোগীরা বলেন, আমাদের অন্তরে মনের ভাবানুযায়ী সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগের উদয় হতে থাকে; বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডে যা হয়, ক্ষুদ্র ব্রহ্মাণ্ডেও (আত্মায়) তা-ই হয়। মানুষ যদি কলিযুগ হতে মানসিক সত্য যুগের ধর্মে নীত হয়ে থাকতে চায়, সেভাবেই তার সাধনার প্রয়োজন হয়। মন যখন অশান্তির গ্লানিতে বিপর্যস্ত হতে থাকে, উদ্ধারের কোনো উপায় পাওয়া যায় না, ভগবানের শরণাগতি তখন একমাত্র উপায় হয়—অকপটভাবে শরণাগত হলে ভগবান সাধকের মনে নিজে অবতরণ করেন। যদি অকপটভাবে তাঁকে ডাকা হয়, তাঁর অসীম কৃপায় সাধক মানসিক উদ্‌বেগ হতে মুক্ত হতে থাকে (পরিত্রাণায় সাধূনাম্) ও ভগবদ্‌পদে যুক্ত হবার বাধাগুলো ক্রমশ দূরীভূত হতে থাকে (বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্)। মানুষকে ভগবান কিছু স্বতন্ত্রতা, কিছু স্বাধীনতা দিয়েছেন; যদি সেসবের অপব্যবহার করে জগৎচক্রের সুষ্ঠু গতিতে মানুষ বিঘ্ন আনতে চেষ্টা করে, তা হতে থাকলে ভগবানকে কিছু অলৌকিক ব্যাপার না ঘটিয়ে বরং মানুষ-রূপে, শিক্ষক হয়ে, শাসক হয়ে পাশে এসে তার প্রতিবিধান করতে হয়। এটাই ঈশ্বরের নিয়ম, তিনিই এ নিয়ম করেছেন।

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে, তাংস্তথৈব ভজামাহম্। কথা হচ্ছে, ঈশ্বর দুষ্কৃতকারীদের মন ঘুরিয়ে দেন না কেন? এর উত্তর, তা-ও তিনি ইচ্ছে করেই করেন না—তাদের স্বাধীনতায় তিনি হস্তক্ষেপ করেন না। তাদের সেই স্বাধীনতা কু-স্বাধীনতা বটে, কিন্তু তা যে জন্মজন্মান্তরের কর্মফলে উৎপন্ন—ঈশ্বর কর্মের নিয়ম কখনও ভঙ্গ করেন না। তিনি শুধু সত্যং নহে, তিনি ঋতম্-সত্যম্ পরমব্রহ্ম। মানুষ যখন ধর্মে বিকট গ্লানি আনে, তখন মানুষ হয়ে ভগবানকে আসতে হয় সেই গ্লানি অপনোদন করতে। অলৌকিকভাবে তিনি দুষ্কৃতদেরকে সরিয়ে ফেলেন না, তার আর-একটি কারণ বোধ হয় এই যে, তিনি চান, মানুষ পুরুষকার (দৈবের উপর নির্ভর না করে নিজ উদ্যম বা প্রচেষ্টা) চালাবে, নিজেই সমাজ সংশোধন করবে। মাত্র তখনই তিনি আসেন, যখন মানুষ পুরুষকার চালিয়েও নিষ্ফল হতে থাকে এবং নিম্ফল হয়ে, কাতরভাবে তাঁর শরণাগত হয়। মানবিক উপায়ে তখন তিনি তাদের প্রার্থনা পূর্ণ করেন। আর, সকল সময়ে, তখনই যে তিনি সাহায্য করেন, তা নয়, হয়তোবা পূর্বজন্মের পাপে বা অন্য কোনো কারণে আর্ত-পীড়িত মানুষ সাহায্য তখনই পায় না। পুরুষকার, কর্মফল, কৃপা—এদের মিশ্রিত ফল স্থান, কাল, পাত্রভেদে কীরকম হয়, কিছুই কেউ বলতে পারে না—মানুষের সাধ্য নেই যুক্তির বলে এর হদিশ পাবার।

কালের গতিতে, যে-নদী প্রথমে প্রাণবন্ত ছিল, সে-ও, অনবরত তার শরীরে লতাপাতা ও আবর্জনাদি পচতে থাকলে, হীনপ্রাণ হয়ে যায় ও তার জল পচতে আরম্ভ করে—ঠিক একইভাবে ধর্মেও তা হয়। দুষ্ট দু-চার জন পাপকাজ করতে আরম্ভ করলে অন্যেরা এটা ভেবে তাদের অনুসরণ করে যে, এরা তো বেশ সুখে আছে, এদের তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, আমরাই-বা কেন এদের মতো সুখে থাকব না? এই ব্যাপার যখন ব্যাপকভাবে ঘটতে থাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে, নানা মুনির নানা মতবাদে ও নানা কাজকর্মে, ধর্মের পূর্বের রূপ চলে যায় ও তাতে বিকৃতি আসে, তখন বলা হয় যে, ধর্মে গ্লানি এসেছে ও অধর্মের প্রাধান্য বাড়ছে। এই গ্লানি যখন বিকট হয়ে ওঠে, যখন তখনকার ভালো মানুষেরা অকপটভাবে চেষ্টা করেও কিছু করে উঠতে পারেন না, যখন দুষ্টদের দ্বারা তাঁরা নির্যাতিত ও নিহত হতে থাকেন, তখন কোনো মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়।

তাঁকে কেউ ভগবান বলতে চায় না তো না বলুক, কিন্তু এই আসাটা ভগবানেরই আসার মতো, কারণ যিনি আসেন, তিনি ভগবানের শক্তির দ্বারা আবিষ্ট থাকেন। মানুষের ভেতর হতেই ভগবানের প্রকাশ হয়, মানুষই ভগবানের প্রতীক হয়। ভগবানের শক্তি যাঁতে অবতরিত হয়, তিনি অবতারই—তাঁকে যদি ভগবান না বলা হয়, না হলো। শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান না বললেও ক্ষতি নেই, কিন্তু ভগবান তাঁর মাধ্যমে সাড়া দিয়েছিলেন—এটা ভাবলে আশা করি কেউ বিরক্ত হবেন না।

যাঁর স্পর্শে, এমনকী যাঁর দৃষ্টিতে মানুষের জ্ঞানোন্মেষ হয়, অজ্ঞানের নাশ হয় (বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্), শাস্ত্র নূতনভাবে প্রকাশ পায় (ধর্ম সংস্থাপনার্থায়) এবং যাঁর কৃপায় পুণ্যাত্মারা “মায়ামেতাম্ তরন্তি তে: দুস্তর মায়া অতিক্রম করতে পারেন” (৭।১৪) এবং এই জীবনেই জীবন্মুক্তি লাভ করেন—যিনি জীবের এভাবে উদ্ধারসাধন করেন এবং জ্ঞানতাপসেরাও যাঁকে আদর্শ ভাবে পেয়ে, বীত-রাগ-ভয়-ক্রোধ হয়ে ঊর্দ্ধতর স্থিতি লাভ করেন, ভগবানের অবতার ছাড়া আর কী নাম তাঁকে দেওয়া যেতে পারে?

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ‘কথামৃত’ থেকে আমাদের উপলব্ধি: বড়ো বড়ো বাহাদুরি কাঠ (শাল, সেগুন প্রভৃতি গাছের বড়ো গুঁড়ি) যখন ভেসে আসে, তখন কত লোক তার উপর চড়ে চলে যায়; তেমনি যখন অবতারাদি আসেন, কত শত লোক তাঁকে আশ্রয় করে তরে যায়; সিদ্ধপুরুষ কষ্টেসৃষ্টে, মাত্র নিজে চলতে সমর্থ হন।

এই দুইটি শ্লোকের আরও একটি অর্থ আছে। আমাদের মনে সু ও কু দুই প্রবৃত্তিই আছে। কু বলে: উপভোগই পরম পুরুষার্থ, এবং সু-কে তা বোঝাতে অনবরত চেষ্টা করে; বশে আনার জন্য সু-কে নানা প্রলোভন দেখায়, তারপর নানা উপায়ে নির্যাতন করে। এই নির্যাতন যখন বাড়তে বাড়তে চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় এবং তাতেও যদি সু ভেঙে না পড়ে, তখন ভগবান যেন তার ভেতরে আবির্ভূত হয়ে তাকে অসীম শক্তিশালী করে তোলেন। কু পরাজিত হয়, সু পতন হতে পরিত্রাণ পায়। কর্মতত্ত্বে এটা একটা বিশেষ সত্য যে, যা কর্তব্য, শত নির্যাতনে তা ছাড়বে না। কর্তব্যে স্থির থাকলে ভগবান সহায় হন।

দুষ্কৃতকারীদের নির্মম নির্যাতন সাধুদের প্রতি চিরকালই হয়ে আসছে, এটাই হয়েছে খ্রিস্ট ধর্মের অভ্যুদয়ে, এটাই হয়েছে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের অভ্যুদয়ে, এটাই হয়েছে হরিদাসের প্রাণ নেবার জন্য নৃশংসভাবে বেত্রাঘাতে, আর এটাই হয়েছে শিখ গুরুদের হত্যাযজ্ঞে। কিন্তু সাধুরা এই নির্যাতনে ভেঙে পড়েন না, প্রাণদান তাঁরা গ্রাহ্য করেন না।

প্রশ্ন যদি ওঠে কর্মযোগের প্রাচীনতা ও তার মহান উদ্দেশ্য সম্পর্কে, তার উত্তর আগেই দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন যদি ওঠে ভগবানের আসা ইত্যাদির সঙ্গে কর্মযোগের সম্বন্ধ কী, এ দুইটি শ্লোক ও এর পরের এ সম্পর্কিত শ্লোকগুলি না জানলে ক্ষতি কী হতো, তার উত্তর উপরে দেওয়া হয়েছে এবং তা সংক্ষেপে এই যে, কর্মতত্ত্বের এটা একটা মহৎ দিক—যা সত্য বলে ধারণা হবে, তাকে ধরে থাকতে হবে—এই ভরসায় বুক বেঁধে যে, ভগবান তা প্রতিষ্ঠিত করেই দেবেন। কখন কী আকারে তিনি তা প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, তা বলা দুঃসাধ্য। আর, তাঁর আসার সম্পর্কে…কখন কীভাবে তিনি আসেন, তা-ও বলা যায় না; তবে এটা ঠিক যে, তিনি আসেন—হয় প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেন, যা তাঁরই আসা বা প্রয়োজন হলে নিজেই আসেন, আর আসেন স্বর্গ হতে লাফিয়ে নয়, মানুষের ভেতর হতে মানুষরূপেই নির্গত হয়ে। আর, এঁদের আসা হয়, মানুষকে শেখাতে—কর্মের অসীমতায় শান্তির অসীমতা নিহিত—এটা কাকে বলে আর শেখাতে, কী করে নির্লিপ্তভাবে, মনে সাম্য ও স্থৈর্য রেখে, কর্মত্যাগে নয়, কর্মযোগে সংশয়শূন্যভাবে, মনে বৈরিতা না রেখে, স্বধর্ম কঠিন কর্ম হলেও, কী করে তার সাধনে নিজেকে যুক্ত রাখতে হয় (৪/৪১)। এভাবে ও এসব শিক্ষা দিতে ভগবান ও তাঁর প্রতিনিধিদের আসা যদি না হতো, তাহলে যুগ-যুগের বিপদআপদের ভেতর দিয়েও জগৎচক্র চলতে থাকত না, কবেই বন্ধ হয়ে যেত!

কর্মযোগে এ দুটি শ্লোক অপ্রাসঙ্গিক মোটেও নয়; যে তত্ত্বগুলি এরা বর্ণনা করছে—কর্মযোগকে বুঝতে, তাদের বিশেষভাবে জানা আমাদের প্রয়োজন। এই জানাই জ্ঞানযোগ।

এই শ্লোকদুটো কাব্যের ভাবে এবং গৌরবে অতি মহত্ত্বপূর্ণ; ভরসাহীনের হৃদয়ে বল এনে দেয়। শ্লোকদুটো প্রায়ই উদ্ধৃত হয়।

শ্রীকৃষ্ণের বহু অবতার—২২টি শ্রীমদ্‌ভাগবতে বর্ণিত হয়েছে; সেগুলির দশটি দশাবতার স্তোত্রে স্তুত হয়। (মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি)। শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবান বা মূল বা পূর্ণ ধরা হয় বলে, অবতারদের ভেতর তাঁর নাম নেই। অবতারগণকে সাধারণত ছয় ভাগে বিভক্ত করা হয়—পুরুষাবতার, গুণাবতার, লীলাবতার, মন্বন্তরাবতার, যুগাবতার, শক্তি-আবেশ অবতার।

এই দুই শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন:

বর্ণাশ্রম ইত্যাদির যা লক্ষণ, প্রাণীদের উন্নতি ও পরম কল্যাণের যা সাধন, সেই ধর্মের যখন যখন হানি হয়, তখন তখনই আমি মায়া দ্বারা নিজ স্বরূপের রচনা করি। সৎমার্গে স্থিত সাধুদের রক্ষার জন্য, ইত্যাদি কারণে প্রত্যেক যুগে আমি প্রকটিত হই।

আমার প্রাকট্যের জন্য কালের নিয়ম নেই। যখন যখন বেদোক্ত ধর্মের, চারিবর্ণের, চারিআশ্রমের ও সুব্যবস্থিত মানবসমাজের হানি হতে থাকে এবং এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় ঘটে, তখন তখন আমি স্বয়ং নিজসঙ্কল্পে, পূর্ব প্রকারে নিজেকে রচনা করে নিই। পূর্বোক্ত লক্ষণযুক্ত ধর্মশীল বৈষ্ণবশ্রেণীর সাধুরা, আমার নাম, কর্ম ও স্বরূপকে মন ও বাণীর দ্বারা গ্রহণ করতে না পারায় এবং সেজন্য জীবনে সুখ না পাওয়ায়, অদর্শনের এক এক মুহূর্ত সহস্র কল্পের সমান প্রতীত হতে থাকায়, বিরহতাপে শিথিলাঙ্গ হয়ে প্রাণ যাবার ভাব হওয়ায়—তাদের নিজ স্বরূপ ও লীলা দর্শন করিয়ে ও তাদের সাথে কথাবার্তা বলে তাদের বিরহতাপ হতে পরিত্রাণ করি। আমার আরাধনা রূপ বৈদিক ধর্ম সংস্থাপন করতে যুগে যুগে দেবতা ও মানুষ রূপে প্রকট হই।

দুষ্টের নিগ্রহ করি বলে আমাকে নিষ্ঠুর ভেবো না। যা বললাম—যেমন সন্তানলালনের প্রয়োজনে শাসন করলে সেখানে মায়ের দয়াহীনতা প্রকাশ পায় না, তেমনি গুণ-দোষের নিয়ন্তা পরমেশ্বরের নির্দয়তা নেই।

যা বেদবিহিত এবং যা প্রাণীগণের অভ্যুদয়ের ও নিঃশ্রেয়সের (মঙ্গলের) হেতু প্রবৃত্তি (বিধি) এবং নিবৃত্তি (নিষেধ) যার লক্ষণ (অর্থাৎ বিধি ও নিষেধ যার জ্ঞাপক, কারণবিহিত কর্মের অনুষ্ঠান ও নিষিদ্ধ কর্মের পরিবর্জন হতেই ধর্ম হয়ে থাকে) এবং যা বর্ণাশ্রম ও বর্ণাশ্রমানুযায়ী আচারের দ্বারা অভিব্যক্ত হয়, তা-ই ধর্ম।

তোমাদের কি এমন একজন পরিত্রাতারই প্রয়োজন নয়, যিনি তোমাদেরকে হাজার প্রলোভনের মধ্যে তলিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করবেন?

কৃষ্ণের জন্ম মানেই তো মানুষের আত্মায় জ্ঞানের উদ্‌ভব হ‌ওয়া। জন্মাষ্টমী মানেই তাই সেই ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের জন্ম উদ্‌যাপন করা, যা অজ্ঞতা ও স্বার্থপরতার বিনাশ করে। জ্ঞানরূপ এই পরমব্রহ্মের জন্ম বা মৃত্যু নেই, কেবলই জাগরণ আছে এবং তা ঘটে তখনই, যখন মানুষ তীব্র রকমের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সংকটের মধ্যে জীবন কাটায়।

অবতার মানেই আগমন— স্বর্গ থেকে মর্ত্যে—সেই সীমারেখা পেরিয়ে, যা স্বর্গ থেকে মর্ত্যকে পৃথক করে রাখে। সত্য‌ই শেষমেশ জয়ী হয়। পৃথিবীকে যাঁরা বদলে দেন, তাঁরা সাধারণের মধ্যে বাস করলেও অসাধারণ মানুষ, তাঁরা অবতারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁরা নতুন পৃথিবী, নতুন ধর্মের সূচনা করেন, আমাদের মনের গতিপথ বদলে দেন। অবতারের এই মহিমা সব কিছু ছাপিয়ে মানবাত্মার সেই গূঢ় প্রদেশে পৌঁছে যায়, যেখানে মানুষের মুক্তি নিহিত।

‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ কেবল পারলৌকিক বৈদিক কর্ম নয়, বরং চারিবর্ণের ধর্ম, ন্যায়, নীতি প্রভৃতির বিষয়েরও ধর্মে সমাবেশ ঘটে। ভগবান কোন কাজ কী জন্য করেন, তা মুক্ত স্বয়ং ভগবান ছাড়া মায়াভিভূত জীব সহজে বুঝতে পারে না। দুষ্টের বিনাশ তাদেরই কল্যাণের জন্য।

ভগবান বলছেন, আমার দ্বারা দুষ্টেরা বিনাশপ্রাপ্ত হয়ে আমাকেই পায়। এই বিনাশ করা আমার নিষ্ঠুরতা নয়। সৃষ্টি সম্বন্ধে কেউ বলেন, জগৎ ঈশ্বরের বিভূতি; কেউ বলেন, এটা ঈশ্বরের স্বরূপ; কেউ বলেন, এটা নট-মায়া-স্বরূপ; কেউ বলেন, সত্যসঙ্কল্প প্রভুর ইচ্ছা; কেউ বলেন, কাম হতে সৃষ্টি; কেউ বলেন, ভোগার্থে… কেউ বলেন, ক্রীড়ার্থে… কেউ বলেন, বন্ধ্যার পুত্রবৎ—এই জগৎ।

যখন যখনই ভূতগণের প্রাকৃতিক ধর্মের হানি হয় এবং অস্বাভাবিকতার আবির্ভাব হয়, তখন ভগবান নিজেই প্রাকৃতিক ক্রিয়ার প্রবর্তন করেন। ধর্মের অর্থ: প্রাকৃতিক সাম্যভাব।

সাধুদের পরিত্রাণ করি, এর অর্থ: আমার বিরহরূপ উৎকট দুঃখ হতে তাদের পরিত্রাণ। পাপের সমুদ্রে ভালো মানুষদের যখন বাঁচতে কষ্ট হয়, তখন তারা আমার অভাববোধ করে, এবং তা বুঝতে পেরে আমি মানুষের বেশেই পৃথিবীতে অবতার হয়ে আবির্ভূত হ‌ই। (মানুষের বেশে না এলে মানুষকে শেখানো কঠিন।)

ধর্ম হচ্ছে তা-ই, ঈশ্বর ছাড়া অন্য কেউ যা মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। ধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্যই ভগবানের অবতাররূপে পৃথিবীতে আগমন ঘটে। ভগবান কখনো মূর্তি পরিগ্রহ করেন, কখনো জীবহৃদয়ে জ্ঞানরূপে আবির্ভূত হয়ে, কখনো মুক্ত পুরুষের বুদ্ধিস্থ হয়ে, জগতের কল্যাণের জন্য অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। (নিচেই নামেন, না হলে মানুষ তাঁর নাগাল পাবে কীভাবে? সপ্তম জ্ঞানভূমিতে আরূঢ় পুরুষ, জগতের কোনো কথা ভাবতে পারেন না; জীবের প্রতি করুণা করে ভগবান পঞ্চম ভূমিতে নেমে আসেন। যখন সত্যের প্রতি লোকের আদর থাকে না... অভক্ষ্য ভক্ষণে তৎপর হয়, নারীদের মধ্যে সতীত্ব থাকে না, ইত্যাদি অনাচার ঘটে, তখন বুঝতে হবে, ধর্মের গ্লানি হয়েছে। জগৎ টলমল করতে থাকে; যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী হয় চতুর্দিকে। ধর্মচক্র ঘনঘন আন্দোলিত হয়, তার ফলে শক্তিমান বিভিন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয়, কখনো কখনো স্বয়ং ভগবান জগতে অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। বহির্বিচরণশীল মনকে অন্তর্মুখী করে দেবার জন্য, তিনি শ্রীগুরুরূপে উদিত হন।

ব্যষ্টির মনোভাবে সত্য, ত্রেতা ইত্যাদি হয়। ধর্মের চারিপাদ—সত্যযুগে তপঃ, শৌচ, দয়া ও সত্য। কিন্তু গর্ব দ্বারা তপঃ, প্রবল ভোগাসক্তি দ্বারা শৌচ, এবং মত্ততা দ্বারা দয়া নামক পাদ বিলীন হয়ে গেছে। তবে যিনি এই চার ধারণ করে রাখতে পেরেছেন, তিনি কলির জীব হলেও সত্যযুগে প্রতিষ্ঠিত। ধর্ম মানে ধারণযন্ত্র—যার দ্বারা এই গুণগুলিকে ধারণ করা যায়। স্বধর্মপালন, এটা পুরোমাত্রায় হলেই ব্যক্তি মানসিকভাবে সত্যযুগে অবস্থান করেন। দেহ, প্রাণ, মন, বুদ্ধি—এই চারটির পূর্ণ নির্মলতাই সত্যযুগ; প্রতি পরপর যুগে এই নির্মলতার এক এক পাদ হ্রাস হয়ে যায়। কলিযুগে জীবের প্রধান আসক্তি এই দেহের উপর। যখন প্রাণের সাধনায় দেহধর্মের (স্বার্থভাব ও কামোপভোগ ইত্যাদির) উপর অনাস্থা হয়, তখন দ্বাপর যুগ; প্রাণের সাধনায় প্রাণ স্থির ও ইন্দ্রিয়সমূহ নির্মল হয়ে যখন ঈশ্বরমুখী হয়, তখন ত্রেতাযুগ; মনের চাঞ্চল্য (বিক্ষেপ) সম্পূর্ণ দূর হলে, বুদ্ধি স্থির ও একাগ্র হয়ে, নিরুদ্ধ ও ঈশ্বরাপিত হয়ে যখন পরমজ্ঞানের উদয় হয়, তখন সত্যযুগ। যুগের উৎপত্তি ও বিকাশ, দুই-ই মনে মনে। কলিযুগে বাস করেও মানুষ সত্যযুগের প্রশান্তি উপভোগ করতে পারে।

কলিযুগে কেবল বাইরে বাইরে কাজ করার চেষ্টা দেখা যায়, দ্বাপরে মন অন্তর্মুখী হয়ে একাগ্রতা লাভ করার চেষ্টা করে, ত্রেতায় প্রাণের স্থিরতা হতে মনে অসীম ধৈর্য আসে ও বুদ্ধি নির্মল হয়। সত্যযুগে বুদ্ধি অত্যন্ত নির্মল হয়ে ব্রহ্মের মধ্যে প্রবেশ লাভ করে। কলিযুগে যত দেহাত্ম বুদ্ধি ও দেহাভিমান বাড়তে থাকে, ততই জীব ভগবান হতে দূরে সরে পড়ে। বিভিন্ন যুগে মানবাত্মার এই পরিভ্রমণ মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তির উপর নির্ভর করে। তাই মানুষকে আধ্যাত্মিক তথা আত্মিক সংকট থেকে পরিত্রাণ দিতে পৃথিবীতে অবতারের আগমন ঘটে।

সাধুদের অনেক রকমের বিপত্তি আসে। তখন ভগবানের শরণ গ্রহণ করতে হয়, আর তিনিই দয়া করেন। শরণাগতিতে "দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে—আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন" (১০/১০)—এটাই সাধুদের পরিত্রাণ।

ভগবান যা করেন, তা হলো: রাক্ষস ও আসুর প্রকৃতি ধারণকারী দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ। তবে কি তিনি হিংসাপরায়ণ? না, এ সংহার স্থিতিমূলক; এ সংহার না থাকলে জগতে আর কেউ বাস করতে পারত না। কীর্তি, শ্রী, বাক্, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি, ক্ষমা—এই সপ্ত মাতৃকা আসুর ভাবের বৃদ্ধিতে লোপ পেয়ে যায়।

ধর্মই জগৎকে ধারণ করে আছে। ধর্মের মূল বা কেন্দ্র ভগবান। কেন্দ্র হতে শক্তি স্ফুরিত হয়ে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়; আবার পরিধি হতে কেন্দ্রে ফিরে আসে। এভাবে আবর্তন ও বিবর্তনই ধর্মচক্রের নিয়ম; এটাই সর্গ ও বিসর্গ, সৃষ্টি ও লয়। জীব নিজের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে, ক্লেশ পায়; ভগবান তার প্রতিবিধান করেন না এজন্য যে, যাতে জীবের জ্ঞানসঞ্চার হয়। ধর্মের মানদণ্ডে বিষমতা এলেই, তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ভগবানের আবির্ভাবের প্রয়োজন হয়। মানুষের শরীর, মন ও প্রাণের মধ্য দিয়েও ধর্ম সংস্থাপনের কাজ চলে। দ্বিদল বা আজ্ঞাচক্রে আত্মার প্রকাশের আধিক্য দেখা যায়। মনের স্বস্থানও ওই দ্বিদল পদ্ম। কিন্তু পঞ্চতত্ত্বের সাথে মন নামতেই দেহ ও ইন্দ্রিয়বিষয় ছাড়া সব ভুলে যায়, অজস্র প্রাণপ্রবাহের মধ্যে পড়ে দিশাহারা হয়। জ্ঞানস্বভাব চিৎ ও চৈত্য ভাবে স্ফুরিত হলে আত্মবিস্মৃত হয়, চিতের মধ্যে স্পন্দন হলেই চৈত্য ভাব ফুটে ওঠে, প্রাণস্পন্দন আরম্ভ হয়।

এই প্রাণ স্পন্দিত হতে হতে উনপঞ্চাশ বায়ু (প্রাণশক্তি) রূপে অজস্র নাড়িপ্রবাহের মধ্য দিয়েই বহির্মুখী হয়ে পড়ে, ইন্দ্রিয়শক্তিগুলিকে বিষয় গ্রহণের জন্য আন্দোলিত করে...মন দ্বিদলচ্যুত হলে দেহাত্মবোধ হয়—ওটাই সমস্ত পাপের মূল। মনকে স্বস্থানে আটকাবার চেষ্টাই ধর্ম সংস্থাপন। মনকে আবার আজ্ঞাচক্রে নিয়ে যেতে হবে, তখন তা ধর্মে স্থির হবে। রজোগুণকে শান্ত করলে ব্রহ্মের সাথে মিলনরূপ যোগমুখ প্রাপ্ত হওয়া যায় (৬/২৭)। মন দিয়ে বার বার প্রাণায়াম করলেই প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সকল অবস্থাই আসতে পারবে।...তারপর ‘যুগে যুগে’-র ব্যাখ্যায় প্রাণের চাঞ্চল্য ভাবই শ্বাসপ্রশ্বাস; এটা কখনো বাম নাসিকার বা ইড়া নাড়িতে, কখনোবা দক্ষিণ নাসিকার বা পিঙ্গলায় প্রবাহিত হয়; এই ইড়া পিঙ্গলায় শ্বাস প্রবাহিত হবার নামই সংসার; এটাই রজস্তম ভাব, সমস্ত পাপবাসনার মূল।... কিন্তু ভগবান বলছেন, তিনি পাপকে নাশ করতে যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। যুগ, অর্থাৎ যুগ্ম বা যুগল। শ্বাস ইড়া হতে যখন একবার পিঙ্গলায় যায়, তখন সুষুম্না হয়ে আসে—এই যে সুষুম্নার সাথে যোগ, এটাই যুগ; এই সন্ধিক্ষণে ভগবানের আবির্ভাব হয়; যোগীরা মিলনক্ষণকে সাধনা দ্বারা পরিবৃদ্ধি করেন।... যেখানে এলেই জীব তাঁর নাগাল পায়, তিনি সেখানে অবতরণ করেন। ভ্রমধ্যে তিনি স্ব-মহিমায় নিত্যবিরাজিত। মন যদি কোনো প্রকারে সেখানে একবার প্রবেশ করতে পারে, তবে তার আত্মবিস্মৃতি ছুটে যাবেই। ভগবানের জন্ম ও কর্ম এমনই অলৌকিক।

প্রথম শ্লোকের সংক্ষিপ্ত তাৎপর্য। তুমি সচ্চিদানন্দঘন পরম পুরষ, তবু তোমাকে দেহীর মতো ব্যবহার কেন করতে হয় এবং কেমন সময়েই-বা তোমাকে আবির্ভূত হতে হয়—অর্জুন এমন সব প্রশ্নে জিজ্ঞাসু হতে পারেন মনে করেই, এই শ্লোক অবতারিত হচ্ছে। যখন জগতে বেদবিহিত ধর্মকর্মের বিপ্লব উপস্থিত হয়, যখন মানুষেরা নিঃশ্রেয়সাধন প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি-লক্ষণ সদাচার-বিরহিত হয়ে ওঠে, যখন বর্ণাশ্রমবিহিত আচার-ব্যবহার-পরিভ্রষ্ট হয়ে মানুষেরা উন্মার্গগামী হয় এবং যখন হতাদর ও অপরিপালনের কারণে ধর্ম ক্ষীণকায় ও পরিম্লান হতে থাকে, অথচ অপর দিকে যখন বেদ-বিরুদ্ধ বিবিধ অসদনুষ্ঠান প্রবল হয়ে ওঠে, যখন মানুষেরা নানাপ্রকার দুঃখ-দুর্গতি বিধায়ক অধর্ম কর্মের সেবক হয় এবং যখন অধর্ম নিজের নিন্দিত ও কুৎসিত কলেবর স্ফীত করে সগর্বে মাথা উঁচু করে, তখনই, হে অর্জুন! আমি স্বীয় মায়াপ্রভাবে আত্মসৃষ্টি করে অবতাররূপে আবির্ভূত হই। তুমি ভরতবংশজাত অথবা তুমি ভা অর্থাৎ জ্ঞানরত; সুতরাং ধর্মরক্ষার জন্য যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে এবং অধর্মকে নির্জিত করতে প্রবৃত্ত হয়ে, অনর্থক নিবৃত্ত হওয়া তোমার পক্ষে বিধেয় নয়। তুমি আমার সখা; আমার যা প্রিয়ব্রত, তোমারও তা-ই অবলম্বন করা আবশ্যক। (ভগবদ্‌-আবির্ভাবের কোনো নির্ধারিত সময় নেই; সমুচিত প্রয়োজন উপস্থিত হলে তিনি পূর্বোক্ত উপায়ে স্বকীয় সঙ্কল্প দ্বারা আত্মসৃষ্টি করে থাকেন।) ৭।।

দ্বিতীয় শ্লোকের সংক্ষিপ্ত তাৎপর্য। তবে কি ধর্মের হানি এবং অধর্মের বৃদ্ধি তোমার বিশেষ পরিতোষজনক বলেই তুমি কেবল তখনই আবির্ভূত হয়ে থাকো? তাহলে তোমার অবতার অশেষ অনর্থের কারণে সৃষ্ট বলেই মনে করতে হবে।—এমন আশঙ্কার অমূলকত্ব প্রতিপাদন করতেই ভগবদ্-অবতারের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করা হচ্ছে। সমাজে ধর্মহানির মতো দুর্দশা উপস্থিত হলে, ধর্মনিষ্ঠ বেদবিহিত কর্মপরায়ণ, পুণ্যশীল সাধুপুরুষদের প্রায়শ হীনভাব ও ক্ষয় সংঘটিত হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তিগণকে সেই দারুণ দুর্দৈব হতে সর্বতোভাবে রক্ষা করা আমার অবতারের একটি উদ্দেশ্য। ঠিক যেমন ধর্মহানির সময়ে বেদনির্দিষ্ট পন্থা পরিভ্রষ্ট, ধর্মবিরুদ্ধ কর্ম-নিরত, পাপ-পরায়ণ জনগণের স্ফীত ও সংবর্ধিত ভাব উৎপন্ন হয়ে থাকে, তেমনি দুষ্কৃতদের  উচ্ছেদসাধন আমার অবতারের আর-একটি উদ্দেশ্য। এরকম দুষ্টের নিগ্রহ এবং শিষ্টের পালন ও বেদবিহিত কর্মের প্রবর্তন দ্বারা সম্যক্‌রূপে ধর্মসংস্থাপন আমার অবতারের আর-একটি উদ্দেশ্য। এ সকল উদ্দেশ্য পূরণ করার অভিপ্রায়ে আমি যথাযোগ্য সময়ে, পূর্বোক্ত উপায়ে অবতীর্ণ হয়ে থাকি।

যখন দুর্বৃত্ত হিরণ্যকশপুর দৌরাত্ম্যে পৃথিবী পাপ-পরিপ্লাবিত-প্রায় হয়ে উঠল, তখন সেই দৈত্যাধমকে নিধনের এবং ভক্তোত্তম ও সাধুচূড়ামণি প্রহ্লাদের পরিরক্ষণের জন্য ভগবান শ্রীহরি নর-সিংহরূপ ধার করে ভূতলে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যখন বলগর্বিত ও তেজোন্মত্ত দশানন নিরন্তর পাপানুষ্ঠানে ত্রিভুবনকে উৎপীড়িত করে তুলছিল, তখন সেই রাক্ষসাধমকে সবংশে বিনষ্ট করে, ধার্মিক-শিরোমণি বিভীষণকে রক্ষা করার জন্য গোলকবিহারী শ্রীহরি শ্রীরামরূপ পরিগ্রহ করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যখন দুরাচার কংস, মন্দমতি জরাসন্ধ, হীনচেতা শিশুপাল প্রভৃতির অত্যাচারে ধার্মিক ব্যক্তিগণ যৎপরোনাস্তি অবসন্ন‌ হয়ে পড়লেন এবং পাপভারে ধরাধাম নরকতুল্য হয়ে উঠল, তখন বসুদেব, দেবকী, রুক্মিণী, ক্ষত্রিয় রাজগণ ও অন্যান্য সাধুর রক্ষাবিধানের জন্য সেই বৈকুণ্ঠেশ্বর নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণরূপ ধারণ করে জগতে মানবজন্মগ্রহণ করলেন।

এভাবে অনন্ত ভাবে ও অনন্ত উদ্দেশ্যে সেই অনন্ত পুরুষ অনন্ত কাল জগতে দেব ও মানবরূপে লীলা বিস্তার করে ভক্তবৃন্দকে দর্শনদানে চরিতার্থ ও ধন্য করছেন। যাঁরা সেই সনাতন পুরুষের নামমাত্র শ্রবণে প্রেমে পুলকিত-তনু হয়ে থাকেন এবং তাঁর গুণকীর্তনে যাঁদের চোখ হতে অজস্র ধারায় প্রেমাশ্রু বিনিঃসৃত হয়, সেই ভক্তোত্তমগণকে ধর্মবিপ্লবকালে, সেই ভক্তাভীষ্ট-ফলদায়ী ভগবান যদি রক্ষা না করেন, তবে আর কে রক্ষা করবে?

শ্লোকে ‘যুগে যুগে’ শব্দগুচ্ছে, প্রত্যেক যুগে একটি মাত্র অবতারের আবির্ভাব হয়, এমন অর্থ প্রকাশ করে না। ভগবানের অবতার অনন্ত এবং একই যুগে বহুবার প্রয়োজন হলে, বহুবারই সেই কৃপাসিন্ধু দীনবন্ধু হরি আবির্ভূত হয়ে থাকেন।

বার বার সেই পরমেশ্বর অবর্তীর্ণ হয়ে দুষ্টগণকে বিনষ্ট করেন, কিন্তু এতে তাঁর উপর নির্দয়তার কারণে নিন্দা কখনোই আরোপ করা যাবে না। স্নেহময় বাবা-মা সন্তানের মঙ্গলের জন্য কখনোবা তাকে আদর করে কোলে তুলে নেন, কখনোবা তাকে কঠোর শাসন বা প্রহারের মধ্য দিয়ে দণ্ডের ব্যবস্থা করেন। সন্তানের প্রতি এমন ব্যবহারে বাবা-মা'য়ের স্নেহহীনতা বা নির্দয়তা কখনোই প্রতিপন্ন হয় না। ঠিক একইভাবে সেই সর্বনিয়ন্তা পরমেশ্বরের কোনো কাজেই গুণদোষের সম্ভাবনা নেই। ৮।।

এখন অবতার নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। অব+তৃ+ঘঞ্ = অবতার। অব পূর্বক তৃ ধাতুর অর্থ ‘অবতরণ বা নেমে আসা’। ‘অবতার’ শব্দের অর্থও ‘অবতরণ’। তাই ভগবানের অবতার বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রশ্ন মাথায় আসে যে, যদি অবতরণ করা বা নেমে আসাই অবতার শব্দের অর্থ হয়, তবে ভগবানের আবার অবতার কী? তিনি কোথা হতে নেমে আসেন? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে লঘুভাগবতামৃত গ্রন্থের মূল ও টীকা হতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে দেখাচ্ছি:

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রপঞ্চাতীত পরমব্যোমাখ্য ধামসমূহে স্বয়ং রূপ, তদেকাত্ম রূপ ও আবেশ—এই ত্রিরূপে অবতরিত হন, কিন্তু যে-সময়ে কিনি ভক্তদের দুঃখ দূরীকরণ, বৈদিক ধর্ম সংরক্ষণ, অসুরনিধন ইত্যাদি প্রয়োজন উপলক্ষ্যে সেই প্রপঞ্চাতীত ধাম হতে এই পরিদৃশ্যমান প্রপঞ্চে অবতরণ করেন বা নেমে আসেন, সে সময়ে তাঁর তেমন অবতরণ বা নেমে আসার নামই তাঁর ‘অবতার’। ভগবানের অবতার অসংখ্য, স্বয়ং‌ রূপোদ্‌ভূত ভেদ ও বিশেষ বিশেষ লক্ষণযুক্ত। (লঘুভাগবতামৃত গ্রন্থে ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলা বিংশতি পরিচ্ছেদে দ্রষ্টব্য।)

ভগবান হরি নানা উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নানা সময়ে নানা মূর্তিতে জন্মগ্রহণ করেন। নারায়ণ-পরিগৃহীত সে সকল মূর্তি তাঁর অবতার নামে খ্যাত। অবতার অসংখ্য ও তাঁদের কাজও অনন্ত। কোনো অবতারে ভগবান পূর্ণস্বরূপে বিরাজিত, কোনো অবতারে তাঁর অংশমাত্র পরিস্ফুট এবং কোনো অবতারে তাঁর আবেশমাত্র প্রতিফলিত। ভগবানের অবতার সম্পর্কে নানাশাস্ত্রে নানারকম বর্ণনা আছে। সাধারণত তাঁর দশাবতারের কথা সব জায়গায় বর্ণিত হয়ে থাকে। কিন্তু শ্রীমদ্‌ভাগবতে ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে অনেক অবতারের উল্লেখ আছে। শ্রীমদ্‌ভাগবতের প্রথম স্কন্ধে তৃতীয় অধ্যায়ে অবতার প্রসঙ্গে কী বলা আছে, দেখা যাক:

সেই ভগবান (বিরাট পুরুষ) আদিতে ব্রহ্মারূপে অবতীর্ণ হয়ে, সনৎকুমারাদি কৌমার সৃষ্টি করার জন্য অখণ্ড ভাবে দুশ্চর ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলেন। [ব্রহ্মা অবতার-১]

যজ্ঞেশ, এ সকল জীবের উৎপত্তি করার জন্য, রসাতলগত পৃথিবীকে উদ্ধার করবেন বলে, দ্বিতীয় বার বরাহশরীর গ্রহণ করেছিলেন। [বরাহ অবতার-২]

তিনি ঋষি-সৃষ্টি করার জন্য, তৃতীয় বার দেবর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে, বৈষ্ণবশাস্ত্র সম্পর্কে বলেছিলেন: যে-শাস্ত্র হতে কর্মফল, নিষ্কামরূপে অনুষ্ঠিত হওয়াতে, শুদ্ধ মোক্ষফল প্রসব করে। [নারদ অবতার-৩]

চতুর্থ অবতারে, যিনি ধর্মের অর্ধাংশ স্বরূপ ভার্যা সৃষ্টি করতে, নর-নারায়ণরূপ যুগলমূর্তি ধারণ করে, প্রশান্তচিত্তে দুশ্চর তপস্যা করেছিলেন। [অর্ধনারীশ্বর অবতার-৪] (নর অংশটা নারী ও নারায়ণ অংশটা নর, এমন অর্ধনারী-অর্ধনরের যে-যুগলমূর্তি, তা-ই নর-নারায়ণরূপ যুগলমূর্তি বুঝতে হবে।)

‘কপিল’ নামের মহাত্মা তাঁর পঞ্চম অবতার। সেই সিদ্ধেশ, অর্থাৎ অণিমাদি সিদ্ধিসম্পন্ন যোগিগণের মধ্যে অতিশ্রেষ্ঠ, কপিলদেবই কাল পদার্থের খণ্ডনকারী ও সকল তত্ত্ববস্তুর নির্ণয়কারী ‘সাংখ্য’ শাস্ত্রটি প্রথমে আচার্য আসুরিকে বলে যান। [কপিল অবতার-৫] (অণিমাদি সিদ্ধি বলতে—অণিমা, গরিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব, বশিত্ব—এই আট প্রকার লক্ষণ)

ষষ্ঠ অবতারে, “আমার মতো পুত্র কামনা করে, আমাকেই তো পুত্র করতে বাসনা করেছে!”—এমন দোষ-দৃষ্টি না করে, শুদ্ধ দয়া করেই যিনি অত্রির পুত্রত্ব প্রাপ্ত হন, সেই দত্তাত্রেয় ভগবান আচার্য অলর্ককে আম্বিক্ষীকিশাস্ত্র (তর্কশাস্ত্র) উপদেশ করে যান। [দত্তাত্রেয় অবতার-৬] (বরদত্ত হয়েছেন যিনি, তিনি দত্তাত্রি; তাঁর পুত্র তাই ‘দত্তাত্রেয়’।)

এরপর যিনি সপ্তম অবতারে, আকুতী দেবীর গর্ভে রুচি দেবের ঔরসে, যজ্ঞ নামে জন্মগ্রহণ করেন, সেই যজ্ঞপুরুষ ভগবান আত্মজ ‘যামা’ প্রভৃতি সুরের সাথে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরকে রক্ষা করে যান। [যজ্ঞ অবতার-৭]

অষ্টম অবতারে, মেরু দেবীর গর্ভে, নাভি দেবের (অগ্নীধ্রপুত্রের) ঔরসে, উরুক্রম (ঋষভ) দেব জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ধীরস্বভাব মানুষের সম্পর্কে সর্বাশ্রম-নমস্কৃত (মান্য) কর্তব্য পথ দেখিয়ে, লীলাসংবরণ করেন। [ঋষভ অবতার-৮]

ঋষিগণের প্রার্থনায়, নবম বার পৃথু শরীর গ্রহণ করেন, সেই ভগবান পৃথুদেব এই সর্বরত্নপরিপূর্ণা কামদুঘা পৃথিবী হতে সমস্ত ভালো ভালো বস্তুর দোহন (আবিষ্কার) করেছিলেন। হে বিপ্রগণ। ইনি সেই কারণে লোকেদের কাছে বিশেষ আদরণীয় ছিলেন। [পৃথুরাজ অবতার-৯]

দশম অবতারে, ভগবান মৎস্যরূপ গ্রহণ করেন। সেই মৎস্যরূপী ভগবান ‘চাক্ষুষ’ মন্বন্তরে যখন সমুদ্র-প্লাবন হয়, তখন মহীময়ী (অর্থাৎ পার্থিব পদার্থের মধ্যে একটিমাত্র নৌকা ভাসছিল।) নৌকাতে আরোহণ করিয়ে ‘বৈবস্বত’ মনুকে রক্ষা করেছিলেন। [মৎস্য অবতার-১০]

একাদশ অবতারে, সুরাসুরগণ সকলে সমবেত হয়ে, যখন সমুদ্রমন্থন করতে মন্দর পর্বতকে মন্থনদণ্ড করেন, তখন বিভু কমঠরূপে নিজের পৃষ্ঠদেশে তা ধারণ করেছিলেন। [কূর্ম অবতার-১১]

দ্বাদশে ‘ধন্বন্তরি’ রূপ ধারণ করে, অমৃত এনে, ত্রয়োদশে মোহিনী স্ত্রী মূর্তি দ্বারা অসুরগণকে মোহিত করে সুরগণকে তা পান করান। [ধন্বন্তরি ও মোহিনী স্ত্রী অবতার-১২ ও ১৩]

চতুর্দশ বার নরসিংহ রূপ ধারণ করে, মহাবল পরাক্রান্ত দৈত্যেন্দ্রকে (হিরণ্যকশিপুকে) ঊরুদেশে স্থাপন করে কটকৃতের (যারা মাদুর চাটাই প্রভৃতি প্রস্তুত করে) এরকা (গ্রন্থিশূন্য তৃণবিশেষ; বোধ হয় মাদুর যা দ্বারা তৈরি হয়, সেই তৃণ) বিদীর্ণ করার মতো, অনায়াসেই বিদীর্ণ করেছিলেন। [নরসিংহ অবতার-১৪]

পঞ্চদশ বারে বামনরূপ ধারণ করে, বলিরাজার যজ্ঞে গিয়েছিলেন, তাঁর কাছে মাত্র তিন-পা পরিমাণ ভূমি প্রার্থনা করে, পায়ের সাহায্যে স্বর্গ পর্যন্ত ব্যাপ্ত করে নিয়ে নিতে ইচ্ছা পোষণ করেন। [ বামন অবতার-১৫]

ষোড়শ অবতারে, রাজন্যবর্গকে ব্রাহ্মণ-বিদ্রোহী দেখে, রেগে গিয়ে পৃথিবীকে ত্রিসপ্ত (একুশ) বার নিঃক্ষত্রিয়া করেন। [পরশুরাম অবতার-১৬]

তারপর সপ্তদশ অবতারে, সত্যবতীর গর্ভে পরাশরের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি মানুষদের অল্পমেধাবী দেখে বেদবৃক্ষের শাখা করে যান। [বেদব্যাস অবতার-১৭]

এরপর সুর-কাজ সাধন করার ইচ্ছায় নরদেবত্ব (রাম-রূপ) প্রাপ্ত হন, যিনি সমুদ্র-বন্ধন প্রভৃতি বিস্তর বীর্যকর কাজ করে যান। [রাম অবতার-১৮]

ঊনবিংশ অবতারে ও বিংশ অবতারে, রাম ও কৃষ্ণ—এই দুই ভগবান, বৃষ্ণিবংশে জন্মে পৃথিবীর ভার হরণ করে যান। [বলরাম ও কৃষ্ণ-১৯ ও ২০]

তারপর যখন ভালো করে ‘কলি’ প্রবৃত্ত হবে, তখন দেব-বিদ্বেষী প্রাণিগণকে সম্মোহিত করার জন্য কীকট (গয়া) প্রদেশে ‘বুদ্ধ’ নামক অঞ্জনপুত্র ('অঞ্জ' নামক এক ব্যক্তির পুত্র) হবেন। [বুদ্ধ অবতার-২১]

অতঃপর, এই জগৎরক্ষক ভগবানই, যখন যুগের (কলিযুগের) সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হবে, অর্থাৎ যে-অবস্থায় প্রায় সমস্ত রাজাই দস্যু হয়ে উঠবে, তখন বিষ্ণুযশার ঔরসে ভগবান ‘কল্কি’ নামে জন্মাবেন। [কল্কি অবতার-২২] (পুরাণে বলা হয়েছে যে, শম্ভল গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে  ‘কল্কি’ জন্মগ্রহণ করবে, যার পিতা-মাতার নাম হবে বিষ্ণুযশা ও সুমতী।)