এই তুমিই আমার আত্মা। এই আত্মত্বে আমি তোমার সঙ্গে এক, এটা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। তোমার সঙ্গে এক বলেই তুমি আমাকে তোমার দর্শন দেবার জন্যেই এই নিভৃত স্থানে নিয়ে এসেছ। এখানে আর কেউ নেই। অন্ধকার ছাড়া আর কোনও বস্তুও নেই। তুমি এই অন্ধকারের জ্ঞাতা, এর আশ্রয়। এতে তোমার অখণ্ডত্ব, অদ্বিতীয়ত্ব, ভঙ্গ হচ্ছে না। তুমি এই অন্ধকারবোধরূপে প্রকাশ পাচ্ছ। এই বোধ আমার। এই বোধে তুমি আমি এক। কিন্তু এই একত্ব সত্ত্বেও 'তুমি' আর 'আমি'র ভেদ গেল না।
আমি তোমাকে আমার আত্মারূপে জানছি। এমন স্পষ্টভাবে জানছি, যেভাবে ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্তও জানতে পারিনি। তোমার এই অভেদ ভাবের ভেতর আমি অনির্বচনীয়ভাবে ভিন্ন হয়ে আছি। ভিন্ন না হলে আমার এই দেখার আনন্দ থাকত না। তোমার সঙ্গে আমার এই ভেদাভেদটা আরও স্পষ্টরূপে দেখাচ্ছ আস্তে আস্তে এই অন্ধকার দূর করে। আমার জগৎস্মৃতি তো প্রায় লুপ্ত করে দিয়েছিলে, এখন আস্তে আস্তে সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনছ। আমার ঘরের স্মৃতি, অন্য বস্তুর স্মৃতি এনে এই অন্ধকার দূর করে দিচ্ছ। আমিই জগৎ ভুলেছিলাম, তুমি ভোলোনি। আমি ভোলা, তুমি অভোলা। ভোলা-অভোলা একসঙ্গে না থাকলে এই স্মৃতি-বিস্মৃতির, এই জ্ঞান-অজ্ঞানের ব্যাপারটি হতো না।
আমার দৈনন্দিন জীবনে ক্রমাগত এই ব্যাপার, এই লীলা করছ। তোমার লীলার বৈচিত্র্যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলি। তোমার সঙ্গে একত্ববোধ ছাড়া তোমার সাক্ষাৎদর্শন অসম্ভব হয়ে যায়। এখন আমি তোমাকে আমার আত্মারূপে দেখি, বিশ্বাত্মারূপে দেখি। এই যে অল্পে অল্পে তোমার বিশ্বাত্মারূপ দেখাচ্ছ, ওতে তোমাকে বিশ্বরূপে দেখা আমার পক্ষে সুগম হচ্ছে। তোমাকে আত্মরূপে না দেখলে বিশ্বরূপে দেখা তো সম্ভবই হয় না। তোমার আত্মরূপদর্শন হারিয়ে যে বিশ্বদর্শন করি, তাতে তোমাকে দেখেও দেখা হয় না। তাতে শান্তি পাই না, আনন্দ পাই না, বল পাই না।
আমার আত্মারূপী তুমি যখন বিশ্বাত্মারূপে প্রকট হও, তখনই কৃতার্থ হই। সেই দেখা যদি সর্বদা দিতে, তবে আর ঘাবড়াতাম না, বিষাদগ্রস্ত হতাম না, কার্যক্ষেত্র ছেড়ে যখন-তখনই নির্জনে তোমাকে খুঁজতে যেতাম না। নির্জন সাধন আমার ভালো করে হয়নি, তোমাকে এখনও ভালো করে আত্মারূপে ধরতে পারিনি। আমার আত্মজ্ঞান ও তোমার জ্ঞান এখনও এক হয়নি। অহংকার এখনও চূর্ণ হয়নি। সময় সময় তা একটু ভাঙে, তবে একেবারে ভেঙে যায়নি। তাই আমি তোমাকে হারাই, আর হারিয়ে অশান্ত হই, নানা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হই, তোমার কাছে শান্তি খুঁজতে যাই।
শান্তি তো কেবল তোমার দর্শনে, তোমাকে ভালোবাসায়, তোমাতে মগ্ন হওয়ায়। আমি আজ সেই মগ্নভাব চাই। আমার আত্মারূপী তুমি যে সর্বত্র, সর্বরূপী, আমার জীবনের, আমার জগতের, নিয়ন্তা, আমার চিরসঙ্গী, আমাকে তা উজ্জ্বলভাবে, স্থায়ীভাবে, দেখতে দাও। আমি অজ্ঞানী, ভোলা, নিদ্রাশীল, ক্ষুদ্র হয়েও আমার অন্তরাত্মারূপে তোমাকে ধারণ করে আছি, আর আমার এই উচ্চতর আমিত্বই নিকটে, দূরে, সর্বাশ্রয়, সর্বাধার, বিশ্বরূপী হয়ে বিরাজ করছে; এই দুর্লভ, মুক্তিপ্রদ দর্শন আমাকে দাও।
আমার সকল হৃদরোগের ওষুধ যে এই দর্শন, এই বিশ্বাস, এই ধারণা, এই ধ্যান, এই সমাধি, তা তুমি বার বার আমাকে বলেছ। কিন্তু এই ওষুধ আমাকে তুমি এখনও ভালো করে খাওয়াচ্ছ না। এই ওষুধ খাওয়া সম্বন্ধে আমার অহংকারমূলক সমুদয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এখন তোমার অহেতুকী কৃপার শরণাপন্ন হই। আমার অন্তর-বাহির অধিকার করো, আমাকে সমাধিস্থ করে আমার জীবন সার্থক করো, এই অশান্ত জীবনে তোমার শান্তির রাজ্য স্থাপন করো।