১। ধরুন আপনার একটা বন্ধুর কথা, যার মাথায় বেশ ঘিলু আছে, কিংবা যার অনেক বেশি জানাশোনা আছে। আপনি তার সমবয়সি হবার পরেও সেই জানাশোনার সিকিভাগও অর্জন করতে পারেননি, বাকি জনম সাধনা করলেও হয়তো পারবেন না। খুঁজে দেখুন, এরকম বন্ধু আপনার অন্তত একজন হলেও আছে। আর অত খোঁজাও লাগবে না বোধহয়, এরকম আলাদা গোছের মানুষের মুখে একটা উজ্জ্বল আলো এমনিতেই লেপটে থাকে, তাকে দূর থেকে দেখলেও বোঝা যায়, হ্যাঁ, এ-ই তো সেই মানুষ! তো এবার তাকে একটু লক্ষ করুন। হয়তো সে কোনও স্টেজ-শো’তে নাচবে নিছকই শখের বসে অথবা মজা করেই। সে আসলে নাচতে পারেই না, নাচার মানুষই সে না। তো, সে যখন পারফর্ম করবে, তখন তাকে খেয়াল করে দেখবেন, হয়তো সে মোটা বলে আর তার ড্রেসসেন্স খারাপ বলে সব মিলিয়ে মনে হবে, যেন আস্ত একটা হাতি ঘুঙুর পায়ে নাচছে! এখানে সবচাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয়টা কী, জানেন? তার নাচটা জঘন্য হলেও আপনি তা মন দিয়েই দেখবেন, আর আপনার কাছে তা দেখতে অতটা খারাপ লাগবে না। আপনি চাইলেও ওর বাজে পারফরম্যান্সটাকে ইগনোর করতে পারবেন না। মনে হবে, ওর নাচটাও তো বেশ ভালো! এর কারণ কী? ওই যে---গ্রে ম্যাটার! অ্যান্ড, বিলিভ মি, গ্রে ম্যাটার রিয়েলি ম্যাটারস! একজন আইনস্টাইন যখন পিয়ানো বাজান, তখন সেটাই বড়ো কথা; পিয়ানোটা বাজাচ্ছেন কেমন, সেটা কোনও ব্যাপার না। কবির নিজের কণ্ঠে নিজের কবিতাপাঠ এ কারণেই খুব জনপ্রিয়, যদিও এক জয় গোস্বামী বাদে আর তেমন কোনও বাঙালি কবিকে আমি আজ পর্যন্ত নিজের লেখা কবিতা ভালো আবৃত্তি করতে দেখলাম না। আরও দু-একজনকে দেখেছি বোধহয়, নাম মনে আসছে না এই মুহূর্তে। সুনীলের কণ্ঠে ‘কেউ কথা রাখেনি’ শুনে দেখেছেন কখনও? ২। ধরি, একজন মানুষের একসময় অনেক প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা ছিল, এবং তিনি তাঁর বর্তমান পার্টনারের সাথে যথেষ্ট সুখে আছেন, অন্তত শারীরিক সম্পর্কের দিক থেকে দারুণ অবস্থানে আছেন। কিন্তু তিনি না চাইতেও মনে মনে একটা লিস্ট করে ফেলবেন, এইসব মানুষের মধ্য থেকে তাঁকে সবচাইতে বেশি নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন কোন জন। এমন একটা তুলনার জায়গায় তিনি একদিন-না-একদিন আসবেনই। মানুষকে এই ভালোবাসার কাছে ফিরে আসতেই হয়, উপায় নেই তো আর। এক ভালোবাসার কাছে ফিরে না গিয়ে মানুষ আর কোথায় যাবে! অনেকেই সেক্স আর ভালোবাসার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। কেউ কেউ বলেন, সেক্স ছাড়া ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না; আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, ভালোবাসা ছাড়া সেক্সের কোনও মানে হয় না। এটা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা ব্যাপার হচ্ছে, সেক্সের সাথে ভালোবাসার তুলনা করাটাই এক ধরনের বোকামো। সেক্স একটা বেসিক নিড, খাওয়া কিংবা ঘুমের মতন। আর ভালোবাসার জায়গাটাই তো আলাদা। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা দিব্যি টিকে থাকতে পারে। উদাহরণ দিই। সারাবছর পার্টনারের সাথে সেক্স করার পরেও একজন মানুষ মনে মনে তাঁর সেই ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে বেড়ান, যার সাথে হয়তো এখন আর যোগাযোগটা নেই, অথবা যোগাযোগের সেই সুযোগটা নেই। সেই মানুষের সাথে, সারাটা বছর অপেক্ষার পরেও, অন্তত দশমিনিট কথা বলার সুযোগ পেলেও আপনি ছাড়বেন না। ছোট্ট একটা ফোনকল, হোক তা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, কিংবা স্রেফ একটা ‘কেমন আছো?’র উত্তর-পাওয়া, এইটুকুই, ব্যস্! মনে হবে, এই পাওয়াটাই অনেক বিশাল কিছু। সেজন্য এই দুটো ব্যাপারের তুলনাই চলে না আসলে। তবুও যদি তুলনা করতেই হয়, কোনটা প্রথম আর কোনটা দ্বিতীয় হবে, এটা যদি জানতেই হয়, আর জানার সৎসাহসটা যদি আপনার থাকে, তবে তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের সাথে সেই দশমিনিটের তুলনা করে দেখুন। কিছু বোঝা গেল? ৩। অনেক সময়, আপনি হয়তো খুব আন্তরিকতার সাথে কাউকে, তার জন্য যেটা ভালো, সেটা বোঝাতে গেলেন। খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ধরনের যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে বললেন, এটা কেন তার জন্য ভালো, আর ওটাই-বা কেন ভালো না। তখন খুব কম মানুষই উপদেশটা গ্রহণ করবে। আমরা আবার এমন যে, কেউ নিজে এসে ভালো পরামর্শ দিলে সেটা নিয়ে হাসাহাসিই করি বেশি। যা-ই হোক, তো সেই জিনিসটা তার জন্য কেন ভালো বা ভালো না, এবার সে তার ‘যুক্তি’ দিয়ে বোঝাতে আসবে। ধরুন, আপনি বললেন, “এই ছেলেটা তোমার জন্য ভালো না, তুমি বরং অন্য কাউকে নিয়ে ভাবো।” সে এর উত্তরে ‘যুক্তি’ দেবে: “তা ভাই, তোমার চুলের কালারটা এত বাজে কেন? মানায় না তো তোমাকে! তুমি এটা নিয়ে কেন ভাবছো না?” আবার ধরুন, তাকে আপনি বলবেন, “রেজাল্টটা ভালো করো, না হলে…” সে আপনাকে থামিয়ে দিয়ে বলবে: “আপু, আপনার ব্রেকআপ হয়ে গেছে, তাই না?” মানে, আপনি যুক্তি দিয়ে কাউকে ওর ভালোটা বোঝাতে গেলে আপনি এমন কথা শুনবেন, যেটার সাথে ওই টপিকের কোনও সম্পর্কই নেই। আর সেইসব খোঁড়া যুক্তিকে কিনা তারা বলে পালটা-যুক্তি! ভাবা যায়? এইসব মাথায় এলে আপনার ইচ্ছে করবে---যাক যে যার মতো করে নষ্ট হয়ে! ৪। আপনার বন্ধু যদি তার প্রিয় কিংবা ভালোবাসার মানুষের কোনও ছোটো বা বড়ো ভুলের জন্য তার উপর প্রতিশোধ নেবার চিন্তা করে থাকে, তাহলে ওই মুহূর্তেই সেখান থেকে পালিয়ে যান। আপনার ওই বন্ধু যে-কোনও মুহূর্তে আপনাকেই খুন করে ফেলতে পারে। যে তার প্রিয় কিংবা ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি করতে পারে, তার পক্ষে যে কাউকেই খুন করা সম্ভব। ৫। কোনও নারীর অহংকার যদি থাকে চামড়ায়, তবে পুরুষের অহংকার থাকে চামড়ার মানিব্যাগে। একটা সময় পরে সেই নারী টাকা দিয়েও সেই আগের চামড়া, ফেলেআসা বয়স ফিরিয়ে আনতে পারে না, অপর দিকে, একজন পুরুষ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ফেলেও একটা সময়ের পর একাকিত্বকে জয় করতে পারে না। ‘আমি একসময় কী যে সুন্দর ছিলাম, কত পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছি!’ আর ‘কত টাকা লাগবে, নিয়ে যাও! আমার কি টাকার অভাব আছে নাকি?’ খেয়াল করে দেখুন, এই দুইটি দম্ভোক্তি যে নারীর বা পুরুষের, তাকেই একটা সময় কতটা অসহায় হয়ে যেতে হয়! এর মানে কী দাঁড়ায় আসলে? দিনশেষে ভালো মানুষ হওয়ার আর কোনও বিকল্প রাস্তা নেই। রূপ বা অর্থ মানুষকে শেষপর্যন্ত শান্তিতে রাখতে পারে না। ৬। আপনি সারা দিন যাদের সাথে মেলামেশা করেন, ফোনে কথা বলেন কিংবা ঘরে বসে শুধুই টেক্সট আদান-প্রদান করেন, যার সাথে প্রেম করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি, দিনশেষে আপনি তাদের অভ্যাসগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলেন। তাদের বলা ভাষা, এমনকি তাদের ব্যবহৃত টুকটাক গালিও আপনার মুখ থেকে বেরুতে থাকবে, যে মানুষ আপনি হয়তো জীবনে কখনও গালি দিয়েই দেখেননি! এসব কী করে ঘটবে, তা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না। বেশিরভাগ মানুষই, যাদের সাথে সময় কাটায়, তাদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়। ৭। আন্তরিকতার সাথে, ভালোবেসে ও পরিশ্রম করে সারাজীবন ধরে নিজের কাজগুলো করে যেতে পারলে মৃত্যুর পর মনে রাখার জন্য শুধু কিছু মানুষ না, অনেকেই থাকত। মানুষ অমর হতে চায়, আর ফাতরামি করে জীবন কাটায়। ৮। দুনিয়ার সব মানুষই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সেক্স করতে চায়। কিন্তু মুখে স্বীকার করতে চায় না। মানুষ এই জায়গায় সবচাইতে বেশি কপটতার আশ্রয় নেয়। এটাই হয়ে এসেছে, হচ্ছে এখনও। তখন ওরা মুখে কী বলে? খুবই সহজ ও গ্রহণযোগ্য একটা কথা: ‘আই লাভ ইউ।’ বা ‘আমি তোমায় ভালোবাসি।’। কাউকে ‘আমি তোমার সাথে শুতে চাই।’ বললে যেখানে সে তেড়ে আসত রেগেমেগে, সেখানে তার সাথে ভালোবাসার মিনমিনে আলাপ করলে সে আদর করেই বুকে টেনে নেয়। এরপর চাহিদা শেষ হয়ে গেলে ভালোবাসার কাহিনিও শেষ হয়ে যায়। টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মোছার সময় লোকে টিস্যুর ভাঁজ ভাঙে না, মোছা শেষ হলে সেই যত্নে-রাখা টিস্যুকেই দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। আমরা যদি সত্য কথাটি সরাসরি বললে সহজে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে শিখতাম, তবে ভালোবাসার ছদ্মবেশে আসা অনেক যন্ত্রণার হাত থেকে বেঁচে যেতাম। ভালোবাসার নামে কেউ আমাদের সাথে বেড শেয়ার করলে, তার প্রস্থানের পরও তাকে সারাজীবন ভুলতে পারি না; অথচ যে আমাদের সাথে বেড শেয়ার করার কথা সরাসরি বলেছিল বলে যাকে চরম হেনস্তা করেছি একসময়, তাকে সারাজীবন ক্ষমা করতে পারি না। যতদিন পর্যন্ত মানুষ ভালোবাসার মতোই যৌনতাকে সহজভাবে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে না শিখবে, ততদিন পর্যন্ত ভালোবাসার চড়া দামে যৌনতার মূল্যবিহীন কেনা-বেচা চলতেই থাকবে। ভালো থাকতে চাইলে, আপনার মনের ল্যাপটপে ভালোবাসা ও যৌনতাকে দুটো আলাদা আলাদা ফোল্ডারে রাখুন, যাতে ফোল্ডারে ঢুকলেই ওই দুটো একসাথে চোখে না পড়ে। মনে রাখবেন, যদি ‘এস’ বর্ণটি শোনার মতো মানসিক বয়স আপনার এখনও না হয়ে থাকে, তবে কেউ-না-কেউ, আপনার কানের সামনে এসে ‘এল’ বর্ণটি উচ্চারণ করে করে ঘ্যানরঘ্যান করবে, এবং সেই ‘এস’ বর্ণেই আপনাকে সুকৌশলে টেনে নিয়ে যাবে। অবশ্য, সেক্ষেত্রে আপনাকে টেনে নিতে হবেই না, আপনি নিজেই লাফাতে লাফাতে খুশিমনে ‘এস’ বর্ণে মহাআনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বেন! এরপর? কখন যে ‘বি’ বর্ণটি এসে আপনাকে একলাথিতে ছুড়ে ফেলে দেবে, তা আপনি টেরই পাবেন না! কম্পিউটারের ফোল্ডারে রাখার সময় ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’ এবং ‘তুমি দিয়ো না গো বাসরঘরের বাত্তি নিভাইয়া…’ এই দুটো গানকে আপনি দুই ফোল্ডারে রাখেন, অথচ জীবনের ফোল্ডারে রাখার সময় দুটোকেই রেখে দেন একই ফোল্ডারে! তালিয়া তালিয়া! অভিধানে ‘দুঃখ’ শব্দটি এসেছেই তো আপনার জন্য! ৯। আপনি যদি সব বিষয়েই ছাড়-দেওয়া টাইপের মানুষ হয়ে থাকেন, তবে আজ থেকে ছাড় দেওয়াটা একটু কমিয়ে দিয়ে একটা পরীক্ষা করে দেখুন, কত মানুষ আপনাকে ছেড়ে চলে যায়! লোকে আপনাকে পছন্দ করে না, আপনার আত্মত্যাগকে পছন্দ করে। ধান্দা হাসিল, বান্দা উধাও! এটাই মানুষের ধর্ম। ১০। যে নারীর লিপস্টিকের রং যত কড়া, তার যন্ত্রণাগুলিও সেরকম কড়া। সে তার ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া সাদা ঠোঁট দুটিকে গাঢ় কমলা গোলাপি রঙে ঢেকে ফেলে, আর চোখের ডার্ক সার্কেলগুলিকে ঢাকে চকচকে আইশেড দিয়ে। তেমনি যে পুরুষের জীবন কষ্টে যত বেশি এলোমেলো থাকে, তার শার্ট, পাঞ্জাবি তত নিখুঁত করে ইস্ত্রিকরা থাকে। আপনি বাইরের গেটআপ দেখে কখনও একজন মানুষের মনের খবর জানতে পারবেন না। যারা মনে অগোছালো, তারাই বাইরে বেশি পরিপাটি। এই টাইপের মানুষের সাথে অন্যদের তফাতটা কোথায়, জানেন? তাদেরও অন্যদের মতন দুঃখ আছে, বরং অন্যদের তুলনায় বেশিই আছে, কিন্তু তারা জানে, কীভাবে দুঃখের সাথে হ্যান্ডশেক করে জীবনে বাঁচতে হয়।