প্রথমেই এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে দিলে ভালো যে ভালোবাসা মানেই বিয়েশাদি টাইপ কোনও কাহিনি না। সেই কাহিনি পর্যন্ত গড়াতেও পারে, কিন্তু গড়াতেই হবে, এমন কিছু না। বিয়েতে ভালোবাসা থাকে বা লাগে, এসব রূপকথা ছোটোবেলায় বিশ্বাস করতাম। এখন আমরা বড়ো হয়েছি। এখন একটু বড়োদের মতো করে ভাবা শিখতে হবে, ঋত্বিক ঘটকের ভাষায়, 'ভাবা প্র্যাকটিস' করতে হবে। প্রায় ক্ষেত্রেই, বিয়ে জিনিসটাই তো একটা সামাজিক চুক্তি, আর ভালোবাসায় চুক্তি লাগে, এটা আমার মনে হয়নি কখনও। বরং শুরুর দিকে, বিয়ের এই চুক্তির সাথে কিছুটা মিল আছে যৌনতার সম্মত যাপনের। আমরা যেসব শিশুকে দেখি, ওরা সবাই-ই কিন্তু ভালোবাসায় জন্ম নেয়নি। কেউ ভুলে জন্ম নিয়েছে, কেউ অভ্যস্ততায় জন্ম নিয়েছে, কেউ সামাজিকতায় জন্ম নিয়েছে, কেউ তার দাদা-দাদি নানা-নানি'র চাপের কারণে জন্ম নিয়েছে। সব সন্তান ভালোবাসার ফসল নয়, তবে প্রায় সন্তানই ভালোবাসার ধন। ভালোবাসায় যা সবচাইতে বেশি লাগে, তা হলো পারস্পরিক সম্মানবোধ। আপনি যাকে সম্মান করেন না, তাকে আপনি ভালোবাসেন না। তবে আপনি যাকে ভালোবাসেন না, তাকে আপনি সম্মান করলেও করতে পারেন। ভালোবাসায় সম্মান থাকবেই, সম্মানে ভালোবাসা না-ও থাকতে পারে। সহজ জিনিস, না প্যাঁচালেই ভালো। কারও সাথে শুতে মন চাইল আর ইনিয়ে-বিনিয়ে তাকে বলে দিলাম, ভালোবাসি! ব্যাপারটা কেমন জানি ছোটোলোকি টাইপের! আমার কাছে দুইটাকেই স্টুপিড আর ছ্যাঁচড়া লাগে। যৌনতায় যেতে চাইলে ভালোবাসা লাগে, এই ভণ্ডামি থেকে যতদিন আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না, ততদিন পর্যন্ত এই জাতির প্রধান খাদ্য হবে ভাতের পাশাপাশি 'সেন্টি'। যৌনতার যাপনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে। ভালোবাসা যদি কেবল সেক্স আর সেন্টির মধ্যেই ঘুরপাক খায়, তবে তার চাইতে বিশ্রী জিনিস আর হয় না। প্রেমের নামে চুক্তির চাইতে প্রেমের নামে হাত অনেক অনেক ভালো; আরও ভালো হচ্ছে, চুক্তির নামেই চুক্তি। প্রেম আর কাম, এই দুই জিনিসের মধ্যে সম্পর্ক থাকতেও পারে, আবার না-ও থাকতে পারে, এটা বুঝতে আইনস্টাইন হতে হয় না। এটা বুঝেও যদি আপনার মন মেনে নিতে না চায়, তবে কিছু কষ্ট আপনি নিশ্চয়ই ডিজার্ভ করেন। মানুষ বিচিত্র প্রাণী। একেক জনের প্রায়োরিটি একেক রকমের। কোনোটাই ভুল নয়, যে যেভাবে ভালো থাকে! কেউ ভালোবাসলে শোয়, কেউ শুলে ভালোবাসে; কেউ ভালোবাসতে শোয়, কেউ শুতে ভালোবাসে; কেউ শুতে শোয়, কেউ ভালোবাসতে ভালোবাসে; কেউ ভালোবাসলেও শোয় না, কেউ শুলেও ভালোবাসে না। একটা কথা আমাদের মেনে নেওয়া দরকার, শুতে ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা লাগেই এমন নয়, তবে হ্যাঁ, থাকলে আনন্দের পরিমাণটা অনেক বেড়ে যায়। মিথ্যে ভালোবাসার নামে সঙ্গম একধরনের নীরব মানসিক ধর্ষণ। যদি কাউকে ভালোবাসেন, তবে সে কাচ্চি বিরিয়ানি ভালো রাঁধতে পারে না, এটা মাথায় আসার আগে, তার হাতের ডাল-বেগুনভাজি খেতে অমৃত লাগে, এটা আপনার মাথায় আসবে। যার বেগুনভাজি নিয়ে আপনি দুইটা ভালো কথা বলতে জানেন না, আমি মনে করি, আপনাকে খাওয়ানোর জন্য কাচ্চি রান্না শিখে নেওয়ার তার কোনও দরকার নেই। ভালোবাসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভাবে না, তা নয়, তবে ভালোবাসা সীমাবদ্ধতা নিয়ে নাচে না। যাকে ভালোবাসেন, সে কী কী পারে, তার মধ্যে কী কী গুণ আছে, সে চাইলে আরও কী কী করতে পারত, সে চাইলে কোন কোন বিষয় নিয়ে আরও একটু মনোযোগ বাড়াতে পারে, তার এইসব দিক নিয়ে আপনার মাথায় ভাবনা আসবেই আসবে! না আসে যদি, তবে আমি বলব, হৃদয়ের সাথে বিছানার বিরোধ বা প্রেম কোনোটাই নেই যেহেতু, সেহেতু একটা আরেকটাকে ছাড়া থাকতে পারে, এবং ভালোভাবেই থাকতে পারে; দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই এই সুখের মিথ্যা থেকে বেরিয়ে এলে দু-জনই সামনের অনেক ফালতু পেইন থেকে বেঁচে যাবেন। লাভ এবং লাস্ট ব্যাপার দুইটা মিউচ্যুয়ালি ইনক্লুসিভও না, এক্সক্লুসিভও না। যদি আপনি কারও মধ্যে কোনও আলো না দেখেন, কেবলই অন্ধকার দেখেন, তবে তার প্রতি আপনার যা আছে, তার নাম অভ্যস্ততা, টান কিংবা যৌনতা, ভালোবাসা নয়। দু-জন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসলে দু-জনই দু-জনের ভালো ভালো দিক নিয়ে ভাবে ও আলাপ করে, সেগুলিকে ডেভেলাপ করার চেষ্টা করে দু-জনই। আপনার ভালোবাসার মানুষের গুণ যদি আপনার সংস্পর্শে এসে বিকশিত না হয়, তবে আমি বলব, আপনার সাথে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে তার আরেক বার ভেবে দেখা উচিত। আপনার নিজের বেলাতেও একই কথা খাটে। যদি কারও সঙ্গে থাকলে আপনি ভালো ফিল না করেন, লো ফিল করেন, তবে হয় আপনি তাকে ভালোবাসেন না, নতুবা সে আপনাকে ভালোবাসে না। আপনাদের লাভমেকিং চমৎকার হতে পারে, কিন্তু লাভফিলিং-এ খুব সম্ভবত ভেজাল আছে। 'দুই মিলে এক হয়ে যাওয়া'র নামই ভালোবাসা। ভালোবাসি যাকে, সে যদি ভালো না থাকে, তবে আমি ভালো থাকি কী করে? ভালোবাসি যাকে, আমার কারণে যদি সে নিজের গুণের চর্চা বাড়াতে না পারে, তবে আমার চাইতে অথর্ব আর কে আছে? ভালোবাসা নিঃস্বার্থভাবে দিতে শেখায়, কৃতজ্ঞতাভরে নিতে শেখায়। এখানেই সুখ, এখানেই স্বস্তি। কী দিলে কী পাবো, এই ভাবনা যেখানে থাকে, হ্যাঁ, সেখানেও 'দুই মিলে এক হয়ে যাওয়া'র থিয়োরি সমানভাবে সত্য...তবে শুধুই বিছানায়! পুনশ্চ। বিয়েকে সামাজিক চুক্তি বলায়, যাদের মেনে নিতে সমস্যা হচ্ছে, তাদের বলছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, কমপক্ষে ৯৬% প্রেমেই ব্রেকআপ হয়ে যায়। যাদের ব্রেকআপ হয়, দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে, তারা তো কেউ আর বিয়ে না করে বসে থাকে না, তাই না? তো বিয়েটা করে যারা, ওদের বেশিরভাগেরই তো আগে প্রেম ছিল না! বিয়ের শুরু থেকেই দু-জন অপরিচিত মানুষ পরস্পরের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে, এটা আমার কখনওই মনে হয়নি। বরং বিয়ের পর একসাথে দুই যুগ কাটিয়ে দেওয়ার পরও ভালোবাসায় নয়, দু-জন দু-জনকে কেবলই মায়ায় বা অভ্যস্ততায় জড়িয়ে রাখে, এমন অনেক দম্পতি আমরা দেখেছি, দেখছি। সেক্ষেত্রে বিয়েটা একধরনের মায়াময় কিংবা মায়াহীন সামাজিক চুক্তি নয় তো আর কী?