মানুষের সঙ্গীর প্রয়োজন সবচাইতে বেশি হয় কখন জানেন? বৃদ্ধবয়সে। মানুষ প্রচণ্ড রকমের নিঃসঙ্গতায় ভোগে কখন জানেন? বৃদ্ধবয়সে। মানুষের বন্ধুর প্রয়োজন খুব বেশি হয় কখন জানেন? বৃদ্ধবয়সে। অথচ কী আশ্চর্য, এ সমাজে বৃদ্ধবয়সেই সঙ্গী বাছাইয়ে আরোপ করা আছে নানান ধরনের অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা, বন্ধুদের সঙ্গে বৃদ্ধকালে সময় কাটানোকে ধরা হয় চরম বিলাসিতা। অদ্ভুত না ব্যাপারটা? বৃদ্ধবয়সে দীর্ঘদিন ধরে নিঃসঙ্গতায় আর অবসাদে ভুগে ভুগে যারা আত্মহত্যা করছে, সেটা আত্মহত্যা নয়, মূলত হত্যাই। আমাদের সমাজ আর সমাজের নিয়মগুলোই তাদের বাধ্য করে ওই পথে হাঁটতে। এ সমাজ পাশে দাঁড়াতে না পারলেও পেছনে লাথিটা ঠিকই মারতে পারে। এ জগতে নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভয়ানক রোগ আর একটাও নেই। যৌবনে আমরা আমাদের সময়টা চাইলেই কাজে, ব্যস্ততায় কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে-আড্ডায় অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারি। যে সময়টা আমরা চাইলেই কোনও-না-কোনও একভাবে ঠিক কাটিয়ে দিতে পারি, সে সময়টাতে আমাদের বলা হয়: সঙ্গী নাও, বন্ধু নাও, আনন্দ করো। অথচ যে সময়টাতে মানুষ বয়সের ভারে নুয়ে যায়, নিঃসঙ্গতায় ডুবে যায়, একাকিত্বে জঘন্যভাবে মরে যায় প্রতিটি মুহূর্তে, সে সময়টাতে সমাজে অনেকটা নিয়ম করেই বলা হয়: তোমার সঙ্গী বাছাই অন্যায়, আনন্দ করা অযৌক্তিক। উদ্ভট না এইসব নিয়ম!? মানুষের যতই বয়স বাড়ে, সে ততই জীবনের রং হারাতে থাকে; যতই বৃদ্ধ হয়, মানুষ ততই একা হয়ে যায়, কাছের মানুষেরা দূরে সরতে থাকে, বন্ধুরা হারাতে থাকে, অত্যন্ত প্রিয় সন্তানেরাও ব্যস্ত হয়ে যায়; কেউই তাকে সময় দিতে চায় না কিংবা পারে না। ঠিক এই সময়টাতেই একজন মানুষের প্রিয় বুকে মুখ গুঁজে চুপ হয়ে থাকাটা খুব দরকার, আবোলতাবোল কথা বলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে বন্ধুদের গায়ে ঢলে পড়াটা সত্যিই দরকার। হ্যাঁ, এই বয়সেই দরকার অগাধ প্রেম, অশেষ বন্ধুত্ব কিংবা তথাকথিত অযৌক্তিক আনন্দযাপন। অথচ এই সময়টাতেই যেন সবই ঘোরতর অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়! আমাদেরই তৈরি সমাজের কাঁটাতারে "বেমানান" ট্যাগ দিয়ে যাদের চামড়া আমরা ছিলে নিই, একদিন সময় গড়িয়ে সেই একই কাঁটাতারে তাদেরই মতন আমাদের চামড়াও ছিঁড়ে যায়। আমি চাই, প্রেমের কোনও বয়স না থাকুক, সঙ্গী বাছাইয়ে বয়সের কোনও সীমানা না থাকুক, বৃদ্ধকালে হো হো করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়াটাকে কেউ অভদ্রতা হিসেবে না ধরুক; আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাক। আশি বছর বয়সে বিয়ে করতে চাওয়াকে কেউ ভীমরতি না বলুক, পঞ্চাশের পরও কপালে টিপ, নীল শাড়ি কিংবা ম্যাচিং-করা চুড়ি পরাটাকে কেউ বেখাপ্পা না বলুক। স্বামী মারা যাবার পর লাল শাড়ি পরাকে কেউ ঢং না বলুক। সন্তানদের বিয়ের পর যে বিপত্নীক কিংবা বিধবা মানুষটি একাকিত্ব ঘোচাতে বিয়ে করে, তাকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা না করুক। আসুন, ওদের বাঁচাই। কিছু মানুষের কাছে সঙ্গী বলতে মোটেও যৌনচাহিদা মেটানোর বস্তু নয়; একসময় মানুষের সঙ্গী লাগে শুধু দু-চারটে কথা বলার জন্য, পাশাপাশি বসে ফিক করে একটুখানি হাসার জন্য। বিশ্বাস করুন, একটা সময় সঙ্গী লাগে আর কিছু নয়, শুধু চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার জন্য, একজোড়া প্রিয় চোখের দৃষ্টিতে বাঁচার জন্য। সত্যিই আর কিছুই নয়! আসুন, বদলাই। এক দিন এক দিন করে আমরাও তো ওদেরই দলে যাচ্ছি, তাই না?