বাবার জন্মদিনে

(কোনও এক সাতাশে জানুয়ারিতে বাবার জন্মদিনে নিচের কথাগুলো লিখেছিলাম।)

আজকে একজন সহজ মানুষের জন্মদিন। তিনি আমার বাবা।

কখনোই জিততে চাননি বলেই কখনো হারেনওনি। আশেপাশের সবাই জিতে যাচ্ছে এই ব্যাপারটা বাবার মতো এতোটা খুশিমনে সারল্য নিয়ে আর কাউকে কখনো বলতে শুনিনি। আজকের দিন পর্যন্ত কোনও ব্যাপার নিয়েই বাবাকে কখনো আফসোস করতে দেখিনি। “কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি কোরো না।” ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি। বাবার এই নির্দেশ সবসময়ই মেনে চলেছি, আজীবন মেনে চলব। আজকের তারিখ পর্যন্ত কখনওই কারও কোনও ক্ষতি করিনি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করবও না। আমি বিশ্বাস করি, আমার যতো অর্জন, আমার বাবা-মা’র ভাল কাজের পুণ্যফল। জীবনের হিসাব মেলানোর চেষ্টাও করেননি কোনওদিন, তবুও সব হিসাব মিলে গেছে নিখুঁতভাবে। খুব উঁচুতে পৌঁছতে চাননি বলেই বাবার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরী হয়নি এখনো। কাউকেই কখনো ঈর্ষা না করেও ঈর্ষণীয় হয়ে থেকেছেন। খুব অল্পেও বাবাকে দেখেছি শিশুর মতো খুশিতে হাসতে। বাবা এখনো পর্যন্ত হারেননি। হারবেন কী, জিততেই তো চাননি কখনো। জেতা কাকে বলে, সেটার সবচে’ ভাল উত্তরটা পেয়েছি বাবাকে দেখে। আফসোস ছাড়া প্রতিদিন বাঁচাই জেতা।

জীবনটাকে সহজভাবে নেয়ার মতো কঠিন কাজটা কতটা সাবলীলভাবে করা যায়, সেটা বাবাকে দেখে শেখার চেষ্টা করি। ঘোরানোপ্যাঁচানো ব্যাপারগুলো বাবা বুঝতে পারেন না বলেই হয়তো জীবন তাঁর কাছে সবসময় সহজভাবে ধরা দিয়েছে। বাবার জীবনদর্শন হলো, একেবারে সাদামাটাভাবে জীবন কাটিয়ে, চিন্তার উন্মেষ ঘটানো। জীবন আবর্তে অল্প বিত্তে অধিক চিত্তে সুখের নৃত্যে মনের বৃত্তে। সবসময়ই খুব সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন। বাবাকে কখনোই অপরিচিত কাউকে ‘তুমি’ করে বলতে শুনিনি; মানুষকে প্রচণ্ড সম্মান দিয়ে কথা বলেন সবসময়। বাবাকে শেষ কবে রাগতে দেখেছি, মনে নেই; তাই, একটু মন খারাপ করে কিছু বললেও নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে। বাবা বলেন, এমন সব জিনিস কখনও কিনো না যেগুলো তোমাকে হঠাৎ কিনতে শুরু করে। বাবার ধারণা, মা হলেন হোম মিনিস্টার, ঘরে-বাইরে তাঁর যতো অর্জন, মা-ই সব করেছেন। বাবাকে দেখেছি, উনি মা’কে সবসময়ই জিতিয়ে দেন, যতো ক্রেডিট সব মা’কে দিয়ে দেন। আমার একরৈখিক চিন্তার ধরন বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। যা ভাবেন, বিশ্বাস করেন, বাবা তা-ই বলেছেন সারাজীবন। আমি হিপোক্রিসি সহ্য করতে পারি না, এটাও বাবার কাছ থেকে পাওয়া। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু বেশিই খরচ করেন। নিজে ভোজনরসিক, অন্যদেরও যত্ন করে খাওয়াতে খুউব পছন্দ করেন। উইকএন্ডে বাজার বেশি হয়, মা’এর পাশে বসে মাছ মাংস তরকারি কেটেকুটে দেন, সাথে কতো-কতো ঠাট্টাইয়ার্কি চলতে থাকে, মা’কে এখনো ক্ষ্যাপান সুযোগ পেলেই। (মা কি এতে আরও খুশি হয়ে ওঠেন না?) বাবাকে দেখতাম, কতো গরীব মক্কেল থেকে পয়সা নিতেন না, উল্টো আদালতের টুকিটাকি খরচ নিজের পকেট থেকে দিয়ে দিতেন। ছোটোবেলায় কেমন জানি রাগ হতো এসব দেখলে। বাবা বলতেন, দেখিস, ওদের আশীর্বাদে তোরা দুই ভাই অনেক বড়ো হবি। কেউ মামলা জিতে খুশি হয়ে বাড়তি ফি দিলে নিতেন না, এখনো নেন না। কোর্ট থেকে কখনোই খালি হাতে ফিরতেন না, আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম, কখন বাবা ফিরবেন, সন্ধ্যায় একসাথে বসে নাস্তা করবো। হোক তা সামান্য কিছু, তবু বাবার হাতে তা অমূল্য হয়ে উঠত। কখনও ঝুউম বৃষ্টি নামত, বাবা কোর্ট বিল্ডিং থেকে নেমে ঠিক মতো রিক্সা পেতেন না, হয়তো তেমন কোনও টিফিনও সাথে আনার সময় পেতেন না, তবু আর কিছু না হোক, এক ডজন চাঁপাকলা হলেও কিনে নিয়ে আসতেন। সে খাবারও যে কত তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। কত বছর কেটে গেলো, এখন খাবারের বৈচিত্র্য বেড়েছে, পরিমাণ বেড়েছে যথেচ্ছ ভাবে, তবু সে সুখ আর পাই কই? খুব মিস করি অল্প টাকায় বেশি বাঁচার দিনগুলিকে। ব্রেকফাস্ট আর ডিনারও আমরা ৪জন একসাথে করতাম; বাসায় থাকলে এখনো করি। আমাদের এই ফ্যামিলিয়াল বন্ডেজ বাবার হাতে গড়া। বাবা বলেন, কাউকে কখনো ধার দিলে সেটা বারবার ফেরত চেয়ো না, ওতে সম্পর্ক নষ্ট হয়। আমার বই পড়ার অভ্যেস বাবাকে দেখেই। বাবা এখনো প্রচুর বই পড়েন। ইংরেজিতে অসাধারণ স্টাইলে লিখতে পারতেন, প্রচুর ইংরেজি শব্দ জানতেন, ছোটোবেলায় আমাদের শেখাতেন। যখন ছোটো ছিলাম, বাবার কোলে চড়ে মেলায় যেতাম, বাবা বাঁশি, পাখি, মিঠাই, আরও কীসব মাটির খেলনা কিনে দিতেন। মা বলতেন, এগুলো কিনে দাও কেনো, ভেঙে ফেলবে তো! বাবা বলতেন, ভাঙার জন্যই তো কিনে দিয়েছি। মা-বাবা কতো লোকের উপকার করেছেন, কতো স্টুডেন্টকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন, পার্থিব সম্পদের চাইতে মনের ঐশ্বর্য বাড়াতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনোই ওদেরকে বিন্দুমাত্রও অহংকার দেখাতে দেখিনি। কতো লোকের শুভকামনা বাবার সাথে; এখনো তেমন কোনও কষ্টে বাবাকে পড়তে দেখিনি। বাবা সবসময়ই নিজের কাজ নিজে করেন। আমাদের বলেন, নিজের কাজ নিজে করবে। নিজের কাজ নিজে না করা মানে, নিজেকে চালানোর ভার অন্যের হাতে দিয়ে দেয়া; এটা বড়ো কষ্টের, বাবা। বাসার ময়লা ফেলা, কাপড় কাচা, ঘর মোছা, খাওয়ার পর থালাবাসন ধুয়ে রাখা থেকে শুরু করে বাসার টুকিটাকি অনেক কাজই আমরা দুইভাই করতে শিখেছি। বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব এই যে, শুধু নিন্দে করার জন্যেই জন্ম নিয়েছে এমন লোকজনকেও বাবাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি কখনোই। এটা মাথায় এলেও অনেক আনন্দ হয়।

বাবা, তুমি আমাদের অনেক-অনেক হাসিখুশি সুখী স্বচ্ছল একটা পরিবার উপহার দিয়েছো। নির্ভার চিত্তের চেয়ে বড়ো বিত্ত তো আর নেই। বাবা, তুমি অনেক বেশিই সফল ও সার্থক।

হে ঈশ্বর! আজকের এই দিনে মন থেকে প্রার্থনা করছি, বাবাকে আমার কিছু আয়ু দিয়ে দিয়ো।

Content Protection by DMCA.com