: আবিদ, তোমার সাথে একটা ছবি তুলি? : জি স্যার। ভালো লাগল। অনেক বড়ো একজন মানুষের সাথে আজ ছবি তুললাম। গর্বের ব্যাপার, এমন বড়ো মানুষ বাংলাদেশে আরও অনেক আছেন। আবিদের বাবা মারা যান ২০২১ সালের জানুয়ারির ২৩ তারিখে। ছোটো ভাই তখন সবেমাত্র ক্লাস সিক্সে। মা গৃহিণী। আবিদ কলেজে উঠেছে। ওরা একসময় ঢাকায় থাকত। আবিদের বাবা কাজ করতেন প্রাইম ব্যাংকে। কিডনিতে অসুখ হবার পর ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে বরিশালে চলে আসেন। চিকিৎসা করাতে গিয়ে, যে সামান্য জমি ছিল, তা-ও বিক্রি করে দিতে হলো। তবু শেষরক্ষা হয়নি। মৃত্যুর সময় গ্রামের ভিটেবাড়ি, স্ত্রী, দুই পুত্র ছাড়া আর কিছু রেখে যেতে পারেননি তিনি। মধ্যবিত্ত বাবারা অল্প বয়সে মারা গেলে এর চাইতে বেশি আর কীই-বা রেখে যেতে পারেন? মধ্যবিত্ত হবার অনেক যন্ত্রণা—বেঁচেও শান্তি নেই, মরেও শান্তি নেই। পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেলে ছোটোভাইটির পড়াশোনা ঠিকভাবে হতো না হয়তো। আবিদ তখন হাতেম আলী কলেজে এইচএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। দুইটা টিউশনি করত সে, চার হাজার টাকা পেত। কিন্তু ওইটুকুতে কি আর সব খরচ কুলোনো যায়? মা ও ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অগত্যা সিএনজি-চালিত অটোরিকশা চালাতে আরম্ভ করল আবিদ। সে না ধরলে আর কে ধরবে পরিবারের হাল? সে যে পরিবারের বড়োছেলে! বড়োছেলে হয়ে ওঠা কি মুখের কথা? পরিবারের ভরণপোষণের পুরো দায়িত্ব আবিদের কাঁধে। নিজের ও ছোটোভাইটির পড়াশোনা, ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া, মায়ের চিকিৎসা-সহ সব ধরনের খরচ আবিদকেই চালাতে হয়। এভাবেই সে এইচএসসি পরীক্ষা দেয় এবং জিপিএ-ফাইভ পায়। ভর্তি পরীক্ষায় আর দেড় নম্বর বেশি পেলে মেডিক্যালে পড়তে পারত। এখন পড়ছে বিএম কলেজে, প্রাণিবিদ্যা বিভাগে, ফার্স্ট ইয়ারে। সকালে নিজের পড়াশোনা এবং ঘরের কিছু কাজ শেষ করে অটো নিয়ে বের হয় আবিদ। ছয়-শো টাকা মালিকের হাতে দিতে হয়, আরও ছয়-সাত'শো টাকা---সব মিলিয়ে মোটামুটি বারো-তেরো'শো টাকা আয় হলেই গাড়ি ফেরত দিয়ে বাসায় ফিরে যায় সে। বাজার করতে হয়, ভাইকে পড়াতে হয়, মায়ের দেখাশোনা করতে হয়, নিজের পড়াশোনাও আছে। কখনো ভেঙে পড়লে আবিদ এবং ওর ছোটোভাইকে ওদের মা সুশান্ত পালের ভিডিয়ো দেখতে বলেন, লেখা পড়তে বলেন। বাবার মৃত্যুর পর মনের শক্তি ধরে রাখতে আবিদ সুশান্ত পালের ভিডিয়ো দেখা শুরু করেছিল। সেই থেকেই আবিদ এবং তার ছোট্ট পরিবারটি সুশান্ত পালের সঙ্গে আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা চাইলে অনেকদূর যেতে পারে। ওদের মধ্যে এমন কিছু কষ্ট আছে, যা অন্য অনেকেরই নেই। কষ্টের চাইতেও টাটকা বারুদ আর হয়? আবিদ কথা খুব অল্প বলে, তার আত্মসম্মানবোধ ও দায়িত্ববোধ চোখে পড়ার মতন। দারিদ্র্য সত্যিই সবচাইতে বড়ো বিশ্ববিদ্যালয়। ওর একটা কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি: স্যার, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। মেডিক্যাল বা ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পাইনি ভালোই হয়েছে। চান্স পেলে তখন দুই জায়গায় খরচ চালাতে হতো। অটো চালানোর মতো সময় কি পেতাম আদৌ? টিউশনি করে তো এত টাকা ইনকাম করতে পারতাম না। আমার জন্য তাই এটাই ভালো।