(স্পয়লার আছে।)
মানুষ কেন কাঁদে?
তুমি জানো না? কখনো কাঁদোনি?
একবার কেঁদেছিলাম, অনেক আগে।
যখন সবাই তোমাকে ছেড়ে চলে গেল, তখন?……….অনেক কারণেই মানুষ কাঁদে। যখন কেউ মারা যায়, যখন কেউ তাকে ছেড়ে চলে যায়………..যখন সে কোনোকিছু আর সহ্য করতে পারে না……….
কী সহ্য করতে পারে না?
বেঁচেথাকা। যখন কেউ তাকে আঘাত করে।
তো? কিছুই কি করার নেই?
একবার মারচিনের খুব দাঁতেব্যথা হল। ইস্ত্রিটা গরম করে সেটা নিজের বাঁ-কাঁধে চেপে ধরল। কাঁধের ব্যথায় সে দাঁতের কথা ভুলেই গেল।
ভালোবাসার মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে, খুব কাঁদছে। কেন, জানা নেই। জানার উপায়ই নেই। মাগদার কান্না থামানোর জন্য তোমেক কিছুই করতে পারছে না। তোমেকের ভালোবাসার কথা মাগদা জানে না, এ ভালোবাসা একতরফা, সে তার ভালোবাসার কোনো প্রতিদান চায়ও না, তাই একছুটে যে মাগদার কাছে চলে যাবে, এটাও সম্ভব নয়। তোমেককে অসহায় হয়ে দেখতে হচ্ছে: মাগদা কাঁদছে, তোমেক এখন কী করবে? পাঁচটি আঙুল ছড়িয়ে বামহাতটি টেবিলের উপর রাখল। দুচোখ বন্ধ করে বন্ধ স্টিলের কাঁচির সূচালো প্রান্ত দিয়ে আঙুলের ফাঁকের ছয়টি জায়গায় টেবিলের উপর ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। ফলে সে যা চেয়েছে, তা-ই হল। কাঁচির ধারালো মুখ তোমেকের তর্জনী বিদ্ধ করল, রক্ত ঝরল। ওদিকে মাগদা টেবিলের উপর পড়েযাওয়া দুধের বোতল থেকে ছড়িয়েপড়া দুধ হাতড়ে কষ্ট গিলছে, এদিকে আঙুলের ব্যথার তীব্রতায় তোমেক আগের কষ্টকে সরানোর চেষ্টা করছে। এ যন্ত্রণা কিংবা দুকানের উপর বরফ চেপে ধরার পর তোমেকের যে যন্ত্রণা হয়েছে, দুটোই তোমেকের জন্য ভালোবাসার পুরস্কার।
তোমকের বয়স ২০, আর দশটা তরুণের চেয়ে একটু আলাদা, কোমল মনের, তীব্রভাবে ভালোবাসতে ও কষ্ট পেতে জানে, মানসিকভাবে অপরিপক্ব, কল্পনা ও আবেগ-প্রবণ, অনেক বেশি সংবেদনশীল; কৌমার্য এখনো অটুট আছে। মাগদা তোমেকের চেয়ে বয়সে অন্তত ১২-১৫ বছরের বড়ো, কামুক প্রকৃতির, মানসিকভাবে পরিপক্ব, শরীরকেন্দ্রিক ভালোবাসায় বিশ্বাসী, বাস্তববাদী, একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে তার তেমন কোনো আপত্তি নেই। মজার ব্যাপার, তোমেক মাগদার এই দিকগুলি সম্পর্কে জানে। সব জেনেও সে মাগদাকে ভালোবাসে। মাগদা তাকে ভালোবাসে কি বাসে না, তা নিয়ে তার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তার দর্শন হল, ভালোবাসাটা ব্যক্তিগত অনুভূতি, পারস্পরিক হতেই হবে, এমন নয়। ওদের কথোপকথন থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।
ওটা কোথায় পেলে?
ওটা একটা স্যুভেনির। ওটা এখন তোমার।
আমি ভাল না। এটা আমাকে দিয়ো না। তুমি তো জানোই আমি ভাল না। সত্যিই আমি ভাল না।
আমার ওতে কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
ক্রিস্তফ কিসলোভস্কির ‘অ্যা শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট লাভ (১৯৮৮)’ মুভির নায়ক তোমেক তার রুমের জানালার স্বচ্ছ কাঁচের এদিকে টেলিস্কোপে চোখ রেখে নায়িকা মাগদাকে দেখে, সাথে আমরাও দেখি। আমরা দেখি ঘণ্টাখানেক, সে দেখে প্রায় এক বছর ধরে, লুকিয়ে। মাগদা কখন ঘরে ফিরে, ঘরে ফিরে কী কী করে, ওর কাছে কে আসে, কেন আসে, দূর থেকে এসব দেখেদেখে তোমেক মাগদার প্রেমে পড়ে যায়। কখনো-বা ফোন করে, কথা বলে না। মাগদা এসবের কিছুই জানতো না। যেদিন জানতে পারে, সেদিন তোমেক নিজ থেকেই ধরা দিয়েছে বলেই জানতে পারে। মাগদাকে কাছ থেকে একনজর দেখার জন্য তোমেক পোস্ট অফিসের চাকরির পাশাপাশি বাড়িবাড়ি গিয়ে দুধ পৌঁছে দেয়ার কাজ নেয়। মাগদার বাসার দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকে, দরোজা খুললে দুধের বোতলটা দিয়েই চলে আসে। সে কিন্তু জানে, মাগদা তাকে ভালোবাসে না, অন্য পুরুষের সাথে শোয়, তার জন্য মাগদার মনে কোনো অনুভূতি নেই। (আসলে কারো জন্যই মাগদাদের মনে কোনো অনুভূতি থাকে না।) টেলিস্কোপ দিয়ে সে যখন দেখে মাগদার সাথে অন্য পুরুষ ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, সে মুহূর্তেই তোমেক টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়, পরের দৃশ্যগুলি সে আর দেখে না। আমরা কখন কোনো ঘটনা থেকে চোখ সরিয়ে নিই? দুটো কারণে। এক। চোখ সরিয়ে নিলে আমরা তো ঘটনাটা আর দেখলাম না। যা দেখিনি, তা তো ঘটেইনি, এটা মনে আনতে ভাল লাগে। আমরা কোনো ঘটনা সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারি? দেখে কিংবা শুনে। এর কোনোটাই না করলে ঘটনাটি ঘটেইনি ভাবতে ভুল কোথায়? আমি যা দেখিনি, যা সম্পর্কে শুনিনি, ফলে জানি না, তা ঘটছে না ভেবে নিতে এক ধরনের সুখ আছে। জঙ্গলে একটা গাছ মাটিতে পড়ে গেছে। কেউ দেখল না, কেউ শুনল না। কোথাও কোনো গাছ পড়ে যায়নি, এটা বিশ্বাস করে বাঁচলে কি কোনো অনর্থ হবে? দুই। ঘটনাটি দেখতে ভাল লাগছে না বলে চোখ সরিয়ে নিলাম। সহজ হিসেব! এখন কথা হল, সব জেনেবুঝেও তার চাইতে বয়সে বেশ বড়ো এক মহিলার প্রেমে পড়ার পেছনে তোমেকের কী মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে? দেখা যাক।
তুমি আমাকে লুকিয়েলুকিয়ে দেখ কেন?
কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। সত্যিই বাসি।
তো, তুমি কী চাও?
আমি জানি না।
তুমি কি আমাকে চুমু খেতে চাও?
না।
বোধহয় তুমি আমার সাথে শুতে চাও।
না।
তাহলে? আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে? কোনো হ্রদের ধারে? কিংবা বুদাপেস্টে?
না।
তাহলে কী চাও তুমি?
কিছুই চাই না।
কিছুই না?
হ্যাঁ।
তোমকের এই কিছু না-চাওয়ার ব্যাপারটা মাগদা বুঝতে পারে না। একটা ছেলে একটা মেয়েকে ভালোবাসে, অথচ সে মেয়েটার কাছ থেকে কিছুই চায় না। এ প্রেমের সুখ নগদেরও না, বাকিরও না। এর মানে কী তবে? এমন অদ্ভুত কারো সাথে তো মাগদার কখনো দেখা হয়নি! এ ছেলের সমস্যাটা কোথায়? মাগদার উৎসাহ তৈরি হয়। সেও তোমেককে দূরবীন দিয়ে দেখতে শুরু করে। মেয়েরা মুখে যা-ই বলুক না কেন, যে ছেলেটাকে কোনো গ্রামারে ফেলা যায় না, সে ছেলের ব্যাপারে প্রায় মেয়েই কৌতূহলী। তোমেক মাগদাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে মাগদা তোমককে কায়দা করে বাসায় নিয়ে আসে। মাগদা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলে তোমেক সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসে। বাসায় এসে রেজরের ব্লেড দিয়ে নিজের কব্জি কেটে ফেলে, রক্ত ঝরায়, হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ কাজটা তোমেক কেন করল? যৌনতার প্রথম প্রত্যক্ষ পাঠের ধকল সামলাতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে? নাকি, যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে, সে মানুষটাই তার ভালোবাসাকে তুচ্ছ শারীরিক প্রেমের উপলক্ষ বানাতে উদগ্রীব দেখে? যাকে তোমেক প্রেমে বাঁধতে চায়, সে-ই কিনা তোমেককে কামে টানতে চায়? ভালোবাসার এমন অবমাননা আর অপমান বেচারা তোমেক মেনে নিতে পারেনি হয়তো। সে ঘটনার পর তোমকের জন্য মাগদার মনে ভালোবাসা তৈরি হয়। সত্যিকারের ভালোবাসা। কীরকম? বাইবেলের ‘দশ আজ্ঞা’র সপ্তমটি হল: তোমরা ব্যভিচার করো না।…….তোমেক হাসপাতালে ভর্তি হবার পর মাগদার প্রেমিক মাগদার অ্যাপার্টমেন্টে আসে। মাগদা দরোজা না খুলেই ওকে চলে যেতে বলে। সে তার পোশাকে ও চলাফেরায় পরিবর্তন নিয়ে আসে, সে তার পুরনো জীবন হতে ফিরে আসতে চায় যেন। সে নিজের আবেগ ও অনুভূতি তোমকের জন্যই সমর্পণ করে দিতে চায়। আর চায় বলেই সে অন্য পুরুষের ছায়া আর মাড়াবে না।
এ সিনেমায় যা বলা হয়নি, আমরা যেন তা-ই শুনতে পাই। যা প্রকাশ করা হয়নি, তা-ই যেন অনুভব করতে পারি। পুরো সিনেমায় ব্যাকগ্রাউন্ড ইন্সট্রুমেন্টালের নির্বাচন ও প্রয়োগ আমাদের মুগ্ধ করে রাখে, ঘটনার সাথেসাথে আমরাও সুরের যাদুতে সামনের দিকে এগোতে থাকি। আমাদের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। আচ্ছা, তোমেকের ব্যাপারটা কী আসলে? ঘোর? নাকি ভালোবাসা? কিসলোভস্কির উত্তর হল, এর নাম ভালোবাসা। এ ভালোবাসা এমনই এক ভালোবাসা, যার শুদ্ধতা ও তীব্রতা সম্পর্কে এ আটপৌরে পৃথিবীর মাগদা-রা কখনো ভাবতেও পারে না। এ ভালোবাসা অনুভব করলে মাথায় যেন সমস্ত আকাশটা ভেঙে পড়ে, সে ব্যাপ্তির সামনে নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হয়। বয়সের তুলনায় তোমেক মানসিকভাবে অপরিপক্ব। মাগদার জন্য সে যা অনুভব করছে, তার জন্য সে কতদূর পাড়ি দিতে পারবে কিংবা এমন একটা ইমোশনাল ফুলের হাত ধরে জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত মাগদা আদৌ নেবে কি না, এর কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত সিনেমায় নেই। নেই, তাই সিনেমাটি সুন্দর। সব-পেয়েছি’র দেশ যেমনি কুৎসিত, সব-পেয়েছি’র সিনেমাও তেমনি অর্থহীন।
একটা প্রশ্ন। একজন মহিলা তার রুমের জানালা খোলা রাখছে, লাইট অফ করছে না, সে অবস্থাতেই কাপড় বদলাচ্ছে, সঙ্গীর কাছে আসছে, টেলিস্কোপে তার প্রাইভেট লাইফটা দেখতে তোমেকের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, এমন কি হয় বাস্তবে? না, হয় না। তবে সিনেমার থিমটা গ্রহণ করার আর সিনেমাদেখার প্রয়োজনে আমাদের এটা মেনে নিতে হবে। যে যতো শুদ্ধভাবে ভালোবাসে, সে ততো শুদ্ধভাবে যন্ত্রণাভোগ করে। এটাই পৃথিবীতে হয়ে আসছে। তোমেকের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। মাগদার জন্য তোমকের ভালোবাসা তোমেককে দিয়েছে কষ্ট আর তোমেকের জন্য মাগদার ঔদাসীন্য আমাদের দিয়েছে আফসোস। পরবর্তীতে তোমেকের জন্য মাগদার যে ভালোবাসা ও টান, তা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কারো প্রতি সত্যিকারের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেরিতে হলেও তার হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম দেয়। কিসলোভস্কি আমাদের বিশ্বাস করিয়ে ফেলেন: ক্ষণিক প্রেমের উত্তেজনার চাইতে চিরন্তন ভালোবাসার আঘাতও পরম সুখের।