এক ডক্টর কি মউত (১৯৯০)

এক ডক্টর কি মউত (১৯৯০)। এটা দেখার আগ পর্যন্ত আমার দেখা সেরা ভারতীয় ফিল্ম ছিল মালায়ালাম ভাষার মুভি ‘দৃশ্যম (২০১৩)’, মোহনলাল অভিনীত; এ সিনেমা দেখার সময় টেনশনে হার্টবিট বন্ধ হবার উপক্রম হয় যেন! তপন সিনহা যদি জীবনে কেবল একটা ‘এক ডক্টর কি মউত’ বানাতেন, তবুও এ মুভির জন্যই অমর হয়ে থাকতেন তিনি। ডাক্তারের ভূমিকায় পঙ্কজ কাপুর যে অভিনয় দেখিয়েছেন, তা বিশ্ব-চলচ্চিত্রের জন্য অমূল্য সম্পদ। মুভিতে আমাদের জাতিগত চরিত্র কতটা নিখুঁতভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তা লেখায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি এই মুভিটি আমলাতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি মানুষের জন্য দেখাটা বাধ্যতামূলক করে দিতাম। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের নাগরিক ও আমলাতন্ত্রের ঈর্ষা, অজ্ঞতা এবং অবহেলার কারণে কীভাবে একটি প্রতিভা প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত থেকে যায় আমৃত্যু, এ মুভিতে তা-ই দেখানো হয়েছে। আমার চোখে চর্যাপদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ লাইন: আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। মানে, হরিণকে তার সুস্বাদু মাংসের জন্যই হত্যা করা হয়। যার মাংস যতো কম সুস্বাদু, বিপদের আশংকা থেকে সে ততো বেশি মুক্ত।

মেধাবী এবং প্রতিভাবান মানুষকে রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র যে কতটা ঘৃণার চোখে দেখে আর সুযোগ পেলে কিংবা সুযোগ তৈরি করে অপদস্থ করে, সেটি এ মুভিতে দেখানো হয়েছে। একজন আমলা সবচাইতে সুখে চাকরি করতে পারেন, যদি তিনি আর দশটা মানুষের মতোই সাধারণ হন। জিনিয়াস কেউ কখনোই আমলাতন্ত্রে শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে সেবা দিতে পারেন না। একজন জিনিয়াস আমলাতন্ত্রের সবচাইতে ঘৃণিত মানুষ। যে কাজটি অন্যরা করলে তা আমলেই নেয়া হয় না, সে একই কাজ তিনি করলে চরম শাস্তি ও নির্যাতনের শিকার হন। সাধারণ মানুষজন তো আরো হিংস্র, বেপরোয়া, মূর্খ। কোনো কারণ ছাড়াই ওরা জিনিয়াসদের নানানভাবে আক্রমণ করে। শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি ‘কিং লিয়ার’-এর লাইন মনে পড়ছে: আই অ্যাম অ্যা ম্যান মোর সিনড অ্যাগেইনস্ট দ্যান সিনিং। যারা অন্যায় করছে, ওদের কিছুই হচ্ছে না, অথচ আমি যে কারণে শাস্তি পাচ্ছি, তা শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো কারণই নয়। ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনে এমনটাই হয়েছিল। অসীম প্রতিভাসম্পন্ন হওয়ার ‘অমার্জনীয় অপরাধে’ এ বাঙালি বিজ্ঞানীকে তাঁর সহকর্মীরা এবং আমলাতন্ত্র পদেপদে অপমান করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যেখানেসেখানে বদলি করেছে, তাঁর কাজে সব ধরনের বাধার সৃষ্টি করেছে। মানুষের কল্যাণে যে কাজটা তিনি করছিলেন, সে কাজ থমিয়ে দেয়ার জন্য যা যা করা দরকার, রাষ্ট্র এবং কিছু ঈর্ষান্বিত মানুষ নিষ্ঠার সাথে তা তা করে গেছে। মানুষের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। তাঁর সুইসাইড নোটে লেখা ছিল: কখন আমি হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবো, তার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করতে আর পারলাম না।

তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে প্রণম্য সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন ‘অভিমন্যু’। সে উপন্যাসেরই সিনেমারূপ ‘এক ডক্টর কি মউত’। বড়ো আশ্চর্য এ ফিল্মটি! এতটা তীব্র ও অকপট বক্তব্যসমৃদ্ধ ফিল্ম বেশি দেখিনি। কেন মরতে হয়েছিল ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে? কোন অপরাধে? খুব সংক্ষেপে বলছি।

গোটা বিশ্বে দ্বিতীয় ভারতে প্রথম টেস্টটিউব বেবি দুর্গার জন্মদান প্রক্রিয়ার যে কর্মযজ্ঞ, সেটির প্রধান ছিলেন বিজ্ঞানী সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তিনি এ অর্জনের কথা প্রেসকে জানিয়েছিলেন। অভিযোগ এল, সরকারকে জানানোর আগে প্রেসকে জানানোর আস্পর্ধা একজন সামান্য ডাক্তারের হল কীকরে? আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী সম্মেলনে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তাঁর গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। একজন রেডিও ফিজিওলজিস্টকে প্রধান করে প্রজনন সংক্রান্ত আবিষ্কার-অপরাধের তদন্ত কমিটি গঠন করা হল, পাঁচ সদস্যের। কমিটির বাকিরা স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ‚ সাইকোলজিস্ট‚ ফিজিসিস্ট ও নিউরোলজিস্ট। সেখানে কোনো বিজ্ঞানী কিংবা যে বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে, সে বিষয়ের গবেষক ছিলেন না। তাঁকে কমিটির হাজির করে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমান করা হল। অথর্ব কিছু লোক অথর্ব কিছু প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। এই পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটির কারোরই আধুনিক প্রজননবিদ্যা বিষয়ক গবেষণা নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না, যার ফলভোগ করতে হয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে।

অবশেষে কমিটি প্রতিবেদন দিল, ডক্টর মুখার্জি যা করেছেন, তা ফালতু, তাঁর সব গবেষণাই ভুয়া। বড়োবড়ো বিজ্ঞানী যা করতে পারলেন না, তা কিনা এই ডাক্তার সরকারি সহায়তা ছাড়াই করে ফেললেন! তাঁর এতো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম, সাধনা, সাফল্যকে এক লহমায় ধূলিসাৎ করে দেয়া হল। ডক্টর সুভাষকে বদলি করা হয় বাঙ্কুরা মেডিকেল কলেজে। ১৯৮০ সালে তিনি হার্ট অ্যাটাক করেন, তখন তাঁকে বদলি করা হয় আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হসপিটালে। এভাবে বারবার জায়গা বদলের ফলে প্রজনন শারীরবিদ্যা সম্পর্কিত সমস্ত গবেষণা পুরোপুরি থেমে যায় ডক্টর সুভাষের। ১৯৮১ সালের জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যদপ্তর চলমান শাস্তির অংশ হিসেবে সুভাষকে রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব অপথ্যালমোলজি নামক প্রতিষ্ঠানে চক্ষুবিভাগের ইলেক্ট্রো-ফিজিওলজির প্রফেসর হিসেবে বদলি করে, অথচ তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি কিংবা গবেষণা দুটোই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। কর্তৃপক্ষের এ ক্রোধ অক্ষমের ক্রোধ। তাঁর অপরাধ, তিনি যা করেছিলেন, সেটি বোঝার সামর্থ্য কিংবা সদিচ্ছা রাষ্ট্রের ও তাঁর সমসাময়িক ডাক্তারদের ছিল না। অন্যদের চাইতে কিংবা সময়ের চাইতে এগিয়েথাকা কাউকে রাষ্ট্র সহ্যই করতে পারে না। সরকারের আমলাতান্ত্রিকতার অভিশাপে ও পশ্চিমবঙ্গের ঈর্ষান্বিত চিকিৎসক সমাজ দ্বারা ক্রমাগত বিদ্রুপ ও অপমানে হতাশ হয়ে সর্বশেষ বদলির কয়েক দিনের মধ্যে সুভাষ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুন কলকাতায় নিজের বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তখন তাঁর বয়স ৫০।

দুর্গার জন্মের মাত্র ৬৭ দিন আগে বিশ্বের প্রথম টেস্টটিউব বেবি লুইস জন ব্রাউনের জন্ম হয়। তারিখটা ২৫ জুলাই ১৯৭৮। এর নেপথ্যকারিগর ব্রিটিশ গবেষক রবার্ট জিওফ্রি এডওয়ার্ডস। এ যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য তিনি ২০১০ সালে চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পান। সে পুরস্কারের ভাগীদার হতে পারতেন ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। অথচ এ হতভাগ্য বিজ্ঞানী কী পেলেন? অপমান, নির্যাতন, অপবাদ। আমলাতন্ত্র ও চিকিৎসক সমাজ তাঁকে বাধ্য করল আত্মহননের পথ বেছে নিতে। এটি কি খুন নয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়? মেধা আর প্রতিভার মূল্যায়ন যেখানে হয় না, বরং কপালে জোটে বঞ্চনা, গঞ্জনা, শোষণ-সহ সব ধরনের অত্যাচার ও অসহযোগিতা, সেখানে জন্ম নেয়াই সবচাইতে বড়ো পাপ। বড়ো ভুল সময়ে ভুল জায়গায় একজন সুভাষের জন্ম হয়েছিল।

মৃত্যুর পর নিজ দেশসহ পুরো পৃথিবীতেই স্বীকৃতি পেয়েছেন ডক্টর সুভাষ। ১৯৮৬ সালের ১৬ আগস্ট ভারতেরই আরেক বিজ্ঞানী টি. সি. আনন্দ কুমারের গবেষণার ফলে জন্ম নেয় আরেক টেস্টটিউব শিশু হর্ষবর্ধন রেডি। ভারত সরকার আনন্দ কুমারকেই ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশু গবেষকের খেতাব দেয়। ১৯৯৭ সালে আনন্দ কুমার কলকাতা শহরে অনুষ্ঠিত একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিতে এলে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমূল্য গবেষণা নথিগুলি তাঁর হাতে আসে। সেই ডকুমেন্টগুলো দেখে আর দুর্গার পরিবারের সাথে কথা বলে আনন্দ কুমার বুঝতে পারেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই ভারতে প্রথম টেস্টটিউব শিশুর স্রষ্টা। আনন্দ কুমারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডক্টর সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের প্রথম সফল টেস্টটিউব শিশুর গবেষক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আমার একটা প্রিয় গান মনে বাজছে, সন্তোষ সেনগুপ্তের: জীবনে যারে কভু দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল? মুখপানে যার কভু চাওনি ফিরে, কেন তারই লাগি আজি অশ্রু আকুল?

‘এক ডক্টর কি মউত’ মুভির গল্পটাও মোটামুটি এরকমই। এখানে ডাক্তার দীপঙ্কর রায় আবিষ্কার করেছিলেন কুষ্ঠরোগের টিকা। ১০ বছরের নিরলস অক্লান্ত অবিশ্বাস্য পরিশ্রমের পর। এ আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি স্ত্রীর প্রতি দায়িত্বপালন করতে পারেননি, নিজেকে সব ধরনের লৌকিকতা ও আনন্দ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন। বছরের পর বছর। ডক্টর রয় এবং তাঁর স্ত্রীর সীমার মধ্যকার যে দাম্পত্য সম্পর্ক মুভিতে দেখানো হয়েছে, সেটি একজন জিনিয়াসের স্ত্রী সংসার করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যে সকল বাস্তবতার মুখোমুখি হন এবং কেমন করে স্বামীকে ভালোবেসে দিনের পর দিন সব রকমের সমর্থন ও সহযোগিতা করে যান, তার নিপুণ প্রতিফলন। স্বামীর যেকোনো অর্জনের পেছনেই স্ত্রীর নীরব ত্যাগ ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুভিতে বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেননি, তবে তদন্ত কমিটির সামনে দুইহাত তুলে বলেছেন, আই সারেন্ডার! এটি নতিস্বীকার নয়, বরং কিছু উচ্চপদস্থ ও উচ্চশিক্ষিত মূর্খ, ঈর্ষান্বিত, দাম্ভিক, অথর্ব, অবিবেচক আমলা ও চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণাধীন ভগ্ন সিস্টেমের প্রতি করুণা ও বিতৃষ্ণার তীব্র প্রকাশ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তদন্ত করতে নয়, তাঁকে শেষ করে দিতেই তাঁকে এখানে ডাকা হয়েছে। আমলাতন্ত্র ও ঈর্ষান্বিত চিকিৎসকমহল তাঁকে ক্রমাগত অপমান ও নির্যাতন করে গেছে, তাঁকে সময়মত গবেষণাপত্র তৈরি করতে দেওয়া হয়নি, ফলে তিনি আন্তর্জাতিক জার্নালে তাঁর পেপার পাবলিশ করতে পারেননি।

দুইজন আমেরিকান ডাক্তার তাঁর পরে কুষ্ঠরোগের টিকা আবিষ্কার করেও তাঁর আগেই আবিষ্কারকের কৃতিত্ব পেয়ে যান। এতো ত্যাগ ও অমানুষিক শ্রমের পার্থিব ফল হল শূন্য! সে রাতে তিনি তাঁর ল্যাবের সব প্রাণীকে মেরে ফেললেন, যেগুলির উপর তিনি এতো বছর ধরে গবেষণা চালিয়ে আসছিলেন। প্রাণীগুলি ছিল তাঁর কাছে সন্তানতুল্য। ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণীর মৃতদেহ টেবিলের উপর সারিসারি সাজানো, তিনি নিরাশ ও বিষণ্ণ মনে বসে আছেন—এ দৃশ্যটি দেখে তাঁর আত্মিক মৃত্যুর কথাই মনে আসে। জোহান অ্যান্ডারসন ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে বিদেশের ল্যাবে গবেষক হিসেবে কাজ করার জন্য এই অভিমানী মানুষটি দেশ ছেড়ে যান। এ মুভি দেখার সময় ও শেষ হবার পর শেক্সপিয়ারের ‘মেজার ফর মেজার’ নাটকের একটা কথা মনে পড়ে: কারো হয় পাপে উত্থান, কারো-বা পতন হয় পুণ্যে।