যৌন নির্যাতনের শিকার যাঁরা

যখন আমরা শব্দদুটি নিয়ে ভাবি: যৌন নির্যাতন, তখন দেখি, ব্যাপারটা হচ্ছে একধরনের যৌন অভিজ্ঞতা। তো যৌন অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা স্বেচ্ছায় হতে পারে কিংবা ইচ্ছার বিরুদ্ধেও হতে পারে। যদি স্বেচ্ছায় হয়, তবে সেটা কোনও নির্যাতনের মধ্যে পড়ে না, সেটা একটা চয়েস, সেটা একটা আনন্দ কিংবা সেটা একটা ইচ্ছে বা সিদ্ধান্ত। আর যদি সেটা সিদ্ধান্ত না হয়, তখন সেটা হয়ে পড়ে নির্যাতন, অর্থাৎ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার সঙ্গে যৌনতার যাপন। তা এমন একটি অভিজ্ঞতা, যেখানে আমার কোনও হাত নেই, যেখানে আমার কোনও দোষ নেই, যেখানে আমার কোনও ভূমিকা নেই, যেখানে আমি চাইলেও কোনও কিছু করতে পারতাম না বা করতে পারিনি।




যৌন নির্যাতন ব্যাপারটা যেহেতু ব্যক্তির হাতে থাকে না, সেহেতু ওই ধরনের একটা ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসাটা খুব কঠিন, সেটা আমি বুঝি। সেটা ভুলে যাওয়াটাও কঠিন। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও তো মানতে হবে যে, সেখানে তার কিছুই করার ছিল না। সে চেষ্টা করেও তা প্রতিহত করার জন্য কোনও কিছু করতে পারেনি। তার মনের সমস্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।




আমাদের লাইফে যা ঘটে যায়, সেটাকে আমরা কখনও বাতিল করতে পারি না। কিন্তু সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে কিংবা সেটা ভুলে গিয়ে কিংবা সেখান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে এনে অনেকদূর যেতে পারি। যৌন নির্যাতনের যে অভিজ্ঞতা, বীভৎস সেই অভিজ্ঞতার কারণে মানুষের মধ্যে কষ্ট তৈরি হবে, একধরনের ট্রমা তৈরি হবে, অবিশ্বাস তৈরি হবে, সুস্থতার অভাব তৈরি হবে---এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে এটা না যে, সেই মানুষটা কোনোভাবেই নিজেকে আর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারবে না! তীব্র ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকলে যে-কোন‌ও‌ বাজে মানসিক অবস্থা থেকে ভালো অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব!




যৌন নির্যাতনের অতীত যে অভিজ্ঞতাটা, সেই অভিজ্ঞতা আপনার মধ্যে ঘৃণা তৈরি করে, বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। যদি আপনি পুরুষ হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার মধ্যে মেয়েদের প্রতি একধরনের ঘৃণার জন্ম হতে পারে। যদি আপনি নারী হয়ে থাকেন, তাহলে পুরুষদের প্রতি আপনার মধ্যে একধরনের ঘৃণার জন্ম হতে পারে। একইসঙ্গে এটাও মনে রাখবেন, হাতের পাঁচটা আঙুল যে-রকম সমান না, তেমনি মানুষ‌ও সকলেই সমান না। সবাই কিন্তু একইরকমের না। এবং, যারা যৌন নির্যাতন করে, তারা সাধারণত অসুস্থ মানুষ, তারা বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ। ওই বিকৃত একটা মানুষের জন্য আপনি সকলকে বিকৃত মনে করবেন, এটা যদি ভাবেন, তাহলে কিন্তু‌ নিজের মনের প্রতিই অবিচার করা হবে।




একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়তোবা মানুষের প্রতি আপনার বিশ্বাস নষ্ট করতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করবেন বিশ্বাসটাকে ফিরিয়ে আনতে। কেননা বিশ্বাসটাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে আপনি আসলে বাঁচতেই পারবেন না! 'বাঁচতেই পারবেন না' কথাটার অর্থ হচ্ছে, কেউ আপনাকে বাঁচতে দিচ্ছে না, তা কিন্তু না! আপনি নিজেই নিজেকে বাঁচতে দিচ্ছেন না। আপনার নিজের মনের মধ্যে একটা বাধা তৈরি হচ্ছে, একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে, যেটা আপনাকে বাঁচার রাস্তায় সবসময় বাধা দিচ্ছে।




যৌন নির্যাতনের যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা, সেখান থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনতে হলে, নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে। এবং, এটাকে খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা হিসেবে ধরে নিতে হবে। যদি ধরে নিতে না পারেন, তবে এইটুকু অন্তত মনে করতে হবে, আপনার লাইফে এমন কিছু ঘটে গেছে, যেটার উপর আপনার কোনও হাত ছিল না। মনে রাখবেন, আমরা যে পৃথিবীতে বসবাস করি, সে পৃথিবীটা ফেয়ার কোনও জায়গা না। এখানে কোনও কিছুই ফেয়ার না। তবে এই আনফেয়ার পৃথিবীতে আপনি যে-রকম বেঁচে আছেন, আপনার যারা পূর্বসূরি বা পূর্বপুরুষ, তাঁরাও ঠিক একইরকম করেই বেঁচে ছিলেন। তাঁরা যেহেতু বেঁচে থাকতে পেরেছেন, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার মতো সামর্থ্য আপনাকেও অর্জন করতে হবে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তাহলেই আপনি ভালো কিছু করতে পারবেন।




দেখুন, একটা অমানুষ আপনার সঙ্গে অন্যায় করেছে; যদি আপনি বার বার সেই অন্যায়টাকে মাথায় রাখেন, সেই অমানুষটাকে আপনার স্মৃতিতে নিয়ে আসেন, সেই অমানুষটাকে আপনার প্রতিদিনের জীবনযাপনে মুখ্য করে তোলেন, তাহলে হচ্ছে কী, জানেন?! সেই অমানুষটা আপনার সঙ্গে যে অন্যায়টা করেছে, সে অন্যায়টাকে আপনি একটা বৈধতা দিচ্ছেন। মনে রাখবেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সবচাইতে ভালো উপায় হচ্ছে, যে অন্যায়টা আপনার সঙ্গে করা হয়েছে, সেই অন্যায়টাকে ছাপিয়ে গিয়ে, ছাড়িয়ে গিয়ে নিজেকে অনেক উপরের একটা জায়গায় তুলে ধরা, অনেক উপরের একটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। যদি সেই কাজটা করতে পারেন, তাহলে দেখবেন, আপনি অবশেষে জিতে গেছেন। কষ্ট পেয়ে কখনও জেতা যায় না। কষ্টটাকে অতিক্রম করার মধ্য দিয়েই জেতা যায়। এ কথাগুলো একটু মাথায় রাখবেন। তাহলে মনে হয় এ সমস্যাগুলো থেকে কিছুটা হলেও নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন।