প্রিয় মানুষের প্রিয় হতেই কেন হবে? আমার তো মনে হয়, প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকাই সবচেয়ে ভালো। প্রিয় মানুষ থেকে দূরে থাকা ভালো কেন? আমি যাকে পছন্দ করি, যে মানুষটা আমার প্রিয়, আমি যাকে ভালোবাসি, সে-ও যে আমার কাজগুলো পছন্দ করবে, তার কোনও গ্যারান্টি আছে? না, নেই। সে যদি কোনও কারণে আমার কাজগুলো পছন্দ না করে এবং আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে আমাকে যদি কোনও উলটাপালটা কথা বলে, তখন তো আমার মেজাজ খুব খারাপ হবে এবং আমার মনে কষ্ট আসবে। এবং কষ্ট এলে কী হবে? আমি তার কাছ থেকে দূরে সরে আসার চেষ্টা করব। ওই যে কষ্ট এলে আমি তার কাছ থেকে দূরে আসার চেষ্টা করছি, এই বিষয়টা আমাকে অনেক পীড়া দেবে।
বার বারই মনে হবে, উনি কেন এমন করলেন! তাকে আমি ভালোবাসি, এত পছন্দ করি, আমার এত প্রিয় মানুষ, কেন আমার সঙ্গে এমন আচরণ করলেন উনি? কেন আমার সঙ্গে এরকম করে কথা বললেন? এসব কিন্তু আমাকে আরও বেশি কষ্ট দেবে! খেয়াল করে দেখুন, এটা হচ্ছে ডবল যন্ত্রণা। এক যন্ত্রণা হচ্ছে, তিনি আমার কথাগুলো রিসিভ করছেন না, আমাকে আমার মতো করে রিসিভ করছেন না। আর দ্বিতীয় যন্ত্রণা হচ্ছে, তিনি আমার সম্পর্কে উলটাপালটা কথা বলছেন। এই কারণেই, আমি আমি যাকে পছন্দ করি, তার কাছ থেকে এক-শো হাত দূরে থাকি। জীবনেও তার কাছে যাই না। কারণ আমি যাকে ভালোবাসি, যে আমার পছন্দের মানুষ, আমার কাজগুলো যদি তার ভালো না লাগে! তার কাজগুলো আমার ভালো লাগে, ঠিক আছে; কিন্তু আমার কাজগুলো তার ভালো না-ও লাগতে পারে, ঠিক না? তাই তার কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো।
প্রিয় মানুষের প্রিয় হবার চেষ্টা করাটা হচ্ছে একধরনের বোকামি। প্রত্যেকটা মানুষই তার নিজের মতো করে ভাবে। প্রত্যেকটা মানুষেরই কিছু পার্সোনাল আইডিয়োলজি আছে, পার্সোনাল বিলিফ আছে, পার্সোনাল অভিজ্ঞতা বা যা-ই বলুন, আছে; সেগুলো কিন্তু আমার সাথে না-ও যেতে পারে। তাই তাকে আমার ভালো লাগে, ভালোলাগাটা আমি ধরে রাখি, তার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকি। আমি যে-রকম, সে-রকমটা যদি সে পছন্দ না করে, সে এমন একটা কথা বলে বসবে, এমন একটা আচরণ করে বসবে, যা আমার ভালো লাগবে না।
এই কিছু দিন আগে একটা আননৌন নাম্বার থেকে রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় আমার নাম্বারে কল এল। কেউ একজন কল দিয়ে বলছে, আমার লাইফে আপনার অনেক প্রভাব…ব্লা ব্লা ব্লা। আমি এবার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি, আপনাকে অনেক দিন ধরে ফলো করি। এইসব শুনে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। সাড়ে বারোটায়, চিনি না জানি না, এমন একটা উটকো লোকের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করে না! আমি বললাম, আপনি কে? বিরক্ত করছেন কেন? সে বলল, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। ‘ভালোবাসা আপনার পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন, ভাই! ফালতু কথা বাদ দিন, কেন কল দিয়েছেন, তা বলুন।’ আমি একদম এই ভাষাতেই কথা বলেছি, কারণ আমি তখন অনেক ক্লান্ত ও বিরক্ত।
সেদিন আমাকে অফিস করতে হয়েছিল প্রায় রাত নয়টা ত্রিশ পর্যন্ত। পরদিন আবার মিটিং ছিল। আর আমি নিজেও পেইনের মধ্যে ছিলাম, আমার অফিসারদেরও অনেক পেইনের মধ্যে রেখেছি। পরে যখন আমি ঘুমাচ্ছিলাম, তখন যদি কেউ আবার এই যন্ত্রণা দেয়; বলে, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি, আপনার অনেক লেখা পড়েছি, ক্যারিয়ার আড্ডা দেখছি, আমি এবার ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছি…কেমনটা লাগে! আমি ওকে বললাম, ফালতু কথা বাদ দিন। আমি এখন কী করব? আপনি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছেন তো আমার কী? আপনি কেন ফোন করেছেন, বলুন? উত্তর সে, কৃতজ্ঞতা জানাতে! বললাম, আপনি সাড়ে বারোটায় কল করেছেন কৃতজ্ঞতা জানাতে! আপনার বাসায় ঘড়ি নাই!? খবরদার আর কোনোদিন কল দিলে আমি আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবো! এতটাই বিরক্ত হয়েছি ওর উপর যে সামনে থাকলে হয়তো কলার ধরে ইচ্ছেমতো মারতাম! একজন অপরিচিত লোক আমাকে পছন্দ করলেই আমাকে বিরক্ত করার অধিকার পেয়ে যায় না। এ ধরনের কমনসেন্সহীন লোকজনকে আমি ছাগল বলি।
দেখুন, আমার কাছে মনে হতেই পারে, সাড়ে বারোটায় অপরিচিত কাউকে ফোন দেওয়া যেতেই পারে! কিন্তু তার কাছে তো তা মনে না-ও হতে পারে! আমার আক্কেল না-ই থাকতে পারে, কিন্তু সে তো বেআক্কেল না-ও হতে পারে! তাই আমি যেভাবে আছি, আমি যে-রকম করে ভাবি, সেটা কিন্তু আমার পছন্দের মানুষের ভালো না-ও লাগতে পারে। এইজন্য সবচাইতে ভালো হচ্ছে, পছন্দের মানুষ থেকে দূরে থাকা, যাতে করে তার প্রতি আমার অনুভূতিটা নষ্ট না হয়। আমরা একটা সুন্দর অনুভূতি নিয়েই বাঁচি। ভালোভাবে বাঁচার সবচাইতে ভালো রাস্তা হচ্ছে, একটা সুন্দর অনুভূতি নিয়ে বাঁচা। সেই সুন্দর অনুভূতিটাকে যদি আপনি আপনার নিজের হাতে ধরে নষ্ট করে দেন, তাহলে তো হবে না। তাই আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে প্রিয় ভাবল না কেন, তা নিয়ে যন্ত্রণা নেবার কিছুই নেই।
প্রিয় মানুষটাকে তার মতো করে থাকতে দিন, কেননা একটা মানুষকে দূর থেকে দেখতে এক রকম লাগে, কাছে এলে কিন্তু আরেক রকম লাগে। এখন আপনার ব্যাপার, তার কাছাকাছি গেলে আপনার ভালো লাগে, না কি দূর থেকে দেখলে ভালো লাগে। আরেকটু সহজ করে বলি, বাসার লোকজনের, মানে আমার বাসার লোকজনের কথাই বলি। এই যে সুশান্ত পাল, তাকে এত লোক ফলো করে, সে এত পকপক করে, এগুলো কিন্তু বাসার লোকজন দেখে না! আমার বাসার লোকজন আমার কোনও ক্যারিয়ার আড্ডাও দেখে না, আমার কোন লেখাও পড়ে না! তারে জানে কী, সুশান্ত পাল এক গ্লাস পানি ঢেলেও খেতে পারে না। সে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতে পারে না, এক কাপ চা বানিয়ে খেতে পারে না, সে একটা অপদার্থ, তাকে সব কাজ করে দেওয়া লাগে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা জানে যে সুশান্ত তো একটা ফোনও দেয় না, বাসার খোঁজখবর রাখে না, সে ফ্যামিলির অনেক বিষয় নিয়েই ক্যালাস ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাকে কিন্তু তারা কাছ থেকে দেখেছে। আমার এই দিকগুলো তারা জানে এবং জেনেই কিন্তু তারা মেনে নিচ্ছে। আপনাকে যারা আপনার সীমাবদ্ধতাসহ মেনে নেয়, তারাই আপনার কাছের মানুষ, আর যারা আপনার ভালো জিনিসগুলোর জন্য আপনাকে মেনে নেয়, তারা হচ্ছে আপনার দূরের মানুষ। আমার বাসার লোকজন কিন্তু আমার সীমাবদ্ধতাগুলো জানে, আমার নেগেটিভ সাইডগুলো জানে, এইসব জেনেই কিন্তু তারা আমাকে মেনে নিয়েছে। তারাই হচ্ছে আমার কাছের মানুষ। এই যে সুশান্ত পাল লেখে, পকপক করে, এসব তাদের কী দরকার? এগুলো মাথায় রাখার তাদের কোনও দরকার নাই।
আমার নিজের তো ভাই দরকার হচ্ছে, কেউ একটু ভালো রান্না-টান্না করে খাওয়াবে, একটু চা-টা বানিয়ে দেবে, যখন কফি লাগবে তখন কফি দেবে। আপনারা যারা আমার ক্যারিয়ার আড্ডা শোনেন, তারা কি জীবনেও আমাকে এককাপ চা বানিয়ে খাইয়েছেন? খাওয়াননি! আমার খোঁজখবর নিয়েছেন কখনও? আমার যখন জ্বর ওঠে, শরীরে যখন ১০২/১০৩ জ্বরে কাঁপতে থাকি, তখন আপনারা কোনোদিন একটা প্যারাসিটামল কিনে পাঠিয়েছেন? পাঠাননি। আপনার জীবনে আমি অনেক কিছু হতে পারি, কিন্তু আমার জীবনে আপনার তেমন কোনও ভূমিকাই তো নেই! হ্যাঁ, আপনার জায়গা হচ্ছে ওখানে, আমার ঘরের বাইরে। আপনি আমার পার্সোনাল লাইফে আসেন কেন? এলে তো আপনি গালি খাবেনই। আমাকে আপনি বিরক্ত করলে আমি কি আপনাকে পূজা করব? চুমু খাবো, হুঁ? আপনার জায়গা তো এখানে না, আপনার জায়গা হলো আমার ঘরের দরজার বাইরে। আপনি সেখানে থাকুন। আপনি যদি ঘরে আসতে চান, তবে তো আপনি মহাবেকুব; অন্তত আমি তা-ই বলব।
হ্যাঁ, প্রিয় মানুষ থেকে দূরে থাকুন। তাকে আপনি যে কারণে প্রিয় ভাবেন, সেই কারণেই থাকুন, এর বেশি কখনও যাবেন না। তিনি আপনার প্রিয় মানুষ, তিনি আপনাকে আনন্দ দিচ্ছেন, সে জায়গাতেই থাকুন। আপনি যদি আমাকে প্রিয় মনে করেন, আপনার যদি মনে হয় যে আমি আপনার ভালোলাগার মানুষ, তাহলে যে কারণে ভালোলাগার মানুষ, সেইটুকু কারণেই থাকুন। আপনি আমার ক্যারিয়ার আড্ডা দেখেন, আপনি আমার লেখা পড়েন। খুব ভালো! কেন এসব করেন? নিজের দরকারেই কিন্তু! আর কিছু নয়! আপনি আমার লেখা না পড়লেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আপনি আমার ক্যারিয়ার আড্ডা না দেখলেও আমার কিচ্ছু যায় আসে না। একদমই কিছু যায় আসে না। এটা আমার চাকরি না, এটা আমার কোনও কিছুই না। আপনি যে আমার ক্যারিয়ার আড্ডা দেখেন, আপনি যে আমার লেখাগুলো পড়েন, এটা অ্যাবসুলিউটলি আপনার নিজের কারণেই দেখেন ও পড়েন। আমার এখানে কোনও ব্যাপার-স্যাপার নাই। আপনি না পড়লেও কিচ্ছু এসে যাবে না আমার। আপনি না দেখেন ক্যারিয়ার আড্ডা, তাতে কী হবে, ভাই! আপনি আমার ক্যারিয়ার আড্ডা দেখেন, আপনি আমার লেখা পড়েন, এ সবই আপনার লাইফের জন্যই তো করেন। আপনার ভালো লাগে বলেই পড়েন বা দেখেন। আমি একদমই খোলামেলা কথা বলছি; এতে আপনারা কিছু মনে করলেও আমার কিছু করার নাই।
এখন এই বিষয়গুলো দিয়ে আমাকে পেইন দেওয়া কি ঠিক? আপনি যদি ভাবেন, আমি তার ক্যারিয়ার আড্ডা দেখে উলটিয়ে ফেলেছি, একটা বিশাল কিছু করে ফেলেছি, আমি তার লেখা পড়ে তার জন্য বিশাল ফেভার করে ফেলেছি…এর জন্য তাকে আমি ফোন দিতে পারব, তাকে আমি যা ইচ্ছে তা করতে পারব, তার ওয়ালে এসে যা ইচ্ছে তা কমেন্ট করতে পারব, তবে বলব, এগুলো থেকে সরে আসুন। আপনি আমার কেউই নন। আপনি যা করেন, তা আপনার নিজের প্রয়োজনেই করেন, আপনার দরকার হয় বলেই আপনি কাজগুলো করেন, আপনার ভালো লাগে বলেই আপনি কাজগুলো করেন, আপনার মনকে শান্তি দেয় বলেই আপনি কাজগুলো করেন।
আমি যে প্রসঙ্গে ছিলাম…যিনি আপনার প্রিয় মানুষ, তাঁর প্রিয় মানুষ আপনি না-ও হতে পারেন। যদি তাকে প্রিয় মানুষের জায়গায় রাখতে হয়, যদি মানসিকভাবে শান্তি চান, তাহলে কখনোই তাকে ওভাবে পেইন দেবেন না কিংবা আমি তার প্রিয় হলাম না কেন, ওটার জন্য আমি গবেষণা করি, প্রিয় হবার চেষ্টা করি---এই রাস্তায় হাঁটার দরকার নাই। এই রাস্তায় না হাঁটলে আপনি ভালো থাকবেন এবং সে মানুষটাও ভালো থাকবে। কাউকে ভালোবাসার চাইতে অনেক বেশি জরুরি হলো, তাকে বিরক্ত না করা।