'বেদান্ত' মানে 'বেদের অন্ত'। 'অন্ত' মানে 'যার পর আর কোথাও যাবার নেই' বা 'জ্ঞানের চূড়ান্ত স্তর'। তাহলে বেদ কী? 'বিদ্' (জানা) ধাতু থেকে 'বেদ' (জ্ঞান) শব্দটি এসেছে। তাই জ্ঞানের শেষকথাই বেদান্ত। বেদের শেষ ভাগ উপনিষদকেই 'বেদান্ত' বলা হয়। শ্রেষ্ঠ বেদান্তদর্শনগ্রন্থের নাম 'গীতা', যেখানে অন্যান্য উপনিষদের সমস্ত শিক্ষার সারবস্তু সংকলিত হয়েছে। উপনিষদ গ্রন্থগুলি শ্রুতিশাস্ত্রের অন্তর্গত হলেও, মহাভারত-এর অংশ বিধায় 'গীতা' স্মৃতিশাস্ত্রের অন্তর্গত।
যে-জ্ঞান লাভ হলে মানুষের আর কিছু লভ্য থাকে না—সেই জ্ঞানকেই আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান বলা হয়। এখন, ব্রহ্ম কী? পৃথিবীজুড়ে যে-সত্তা ছড়িয়ে আছেন, যাঁর চেয়ে বড়ো আর কিছুই হতে পারে না, তিনিই ব্রহ্ম। পৃথিবীর মানুষ এঁকে বিভিন্ন নামে এবং নানাভাবে সম্বোধন করে থাকে। হিন্দুরা ঈশ্বর বা ভগবান, মুসলমানেরা খোদা বা আল্লাহ, খ্রিষ্টানেরা গড, বৌদ্ধরা বুদ্ধ, এভাবে নানা মতের মানুষ নানা নামে এক ব্রহ্মকেই ডাকেন। জলকে কেউ ওয়াটার বলে, কেউ বলে পানি, এবং এমনি করে নানান ভাষায় একই জল নানান নামে পরিচিত; এতে কিন্তু জলের বৈশিষ্ট্য বদলে যায় না। যে যা-ই বলুক না কেন, পান করলে জল পিপাসা মেটাবেই—সকলেরই, একই কায়দায়।
হিন্দুদর্শনের বেদান্ত শাখার তিনটি প্রধান শাস্ত্রের অন্যতম ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্তসূত্র (ন্যায়প্রস্থান বা যুক্তিভিত্তিক প্রস্থান)। বাকি দুটোর নাম উপনিষদ (শ্রুতিপ্রস্থান) ও গীতা (স্মৃতিপ্রস্থান)।
বেদান্তসূত্রের প্রথম সূত্রটি হলো: "অথাতো ব্রহ্মজিজ্ঞাসা।" (ব্রহ্মসূত্র-১/১/১), যার অর্থ: যজ্ঞাদি ক্রিয়ার ফল ক্ষণস্থায়ী জানার পর আধ্যাত্মিক সাধনার প্রয়োজনীয় গুণগুলি অর্জন করে সর্বপ্রকার সংশয় হতে মুক্ত হয়ে "অতঃপর এখান থেকে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা" শুরু হলো। ব্রহ্ম সম্পর্কে জানার ইচ্ছে যার হয়েছে, সে-ই তাঁকে জানতে পারবে। তাঁকে জানলে সকলেরই জ্ঞানের পিপাসা মিটে যায়, আর এই জ্ঞানলাভ তথা মনুষ্যত্ববিকাশই মানবজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
ব্রহ্ম যে এক, তা সম্পর্কে বেদ বলছেন:
১। একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋগ্বেদ, ১/১৬৪/৪৬)—একই সত্তাকেই জ্ঞানীগণ বহুভাবে ব্যক্ত করছেন।
২। একং জ্যোতির্বহুধা বিভাতি (অথর্ববেদ, ১৩/৩/১৭)—একই জ্যোতি (ব্রহ্ম) নানারূপে প্রকাশিত হন।
৩। একং সন্তং বহুধা কল্পয়তি (ঋগ্বেদ, ১/১১৪/৫)—সত্য একই, যা বহুরূপে কল্পিত হচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে, বেদ তাঁকে (ব্রহ্মকে) 'এক' বলছেন। সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের একটাই বৃহত্তম শক্তি—তাঁকে আমরা কেউ ঈশ্বর বলি, কেউ বলি আল্লাহ, কেউ গড; আবার আরও অনেক নামেই সেই এক তাঁকেই ডাকি। সেই মহান সত্তা যে এক, সে সম্পর্কে আরও একটি উপমা দেওয়া যেতে পারে। একজন পুরুষ একটি বড়ো পরিবারের কর্তা—গৃহস্বামী। তাঁর ছেলের কাছে তিনি পিতা, তাঁর মা-বাবা'র কাছে তিনি পুত্র, তাঁর স্ত্রীর কাছে তিনি স্বামী, তাঁর ভাই-বোন'দের কাছে তিনি ভাই, আবার তাঁর বন্ধুদের কাছে তিনি বন্ধু। যদি এই একটি মাত্র পরিবারের একটি মাত্র ব্যক্তি বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন নামে অভিহিত হতে পারেন, তবে বিশাল পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষ এই সুবৃহৎ পরিবারের কর্তাকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করবে, এটাই তো স্বাভাবিক ও সুন্দর।
এই আত্মজ্ঞানটি লাভ করতে হলে, আচার্য শঙ্করের মতে, পরপর চার প্রকারের সাধনপ্রণালী অবলম্বন করতে হবে। সেই সাধন-চতুষ্টয় সম্পর্কে বেদান্ত বলছেন:
প্রথমেই 'বিবেক' বা কোন বস্তু নিত্য এবং কোন বস্তু অনিত্য, তার বিচার করা চাই। এই জ্ঞান লাভ করতে হলে জানতে হবে—যা চিরদিন আছে ও থাকবে, যার ক্ষয় নেই, ধ্বংস নেই, তাকেই নিত্য বস্তু বলে; এবং যা আজ আছে, কাল নেই অথবা যা কাল থাকবে, পূর্বে ছিল না এবং দু-দিন পরেও থাকবে না, তাকে অনিত্য বস্তু বলে। যা নিত্য বস্তু, তা-ই গ্রহণ করতে হবে। অনিত্য বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ত্যাগ করতে হবে। যা-কিছু সৎ বা সদ্বস্তু, তার সবই পরমাত্মার প্রকাশ, অর্থাৎ বুদ্ধি বা জ্ঞানস্বরূপ। সদ্বস্তুই নিত্য এবং এর বাইরের সবই অনিত্য বা অসৎ। অনিত্য বস্তু গ্রহণ করলে পরিণামে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী, তাই এমন সব বস্তু চিনে নিয়ে সচেতনভাবেই পরিত্যাগ করতে হবে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে বৈরাগ্য বা স্টোয়িসিজম—ইহামূত্রফলভোগবিরাগঃ (বেদান্তসার-১৫), অর্থাৎ, ইহলোক বা পরলোকে কোনো রকম ফল ভোগের আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্মের দর্শন অনুযায়ী, কর্মফলের প্রতি জোর না দিয়ে কর্মসাধনের প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে কর্ম করলে ফল আপনাআপনি সর্বোত্তমটিই হবে, তাই তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে নিজের কর্মক্ষমতাকে হ্রাস করে ফেলা চরম নির্বুদ্ধিতা। অভীষ্ট লক্ষ্যের সাধনপ্রক্রিয়ায় অপ্রয়োজনীয় কর্মের সমস্ত ক্ষেত্র হতে মনোযোগ সরিয়ে ফেলতে হবে।
তৃতীয় সাধনে পারমার্থিক সম্পত্তি অর্জনের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আমাদের—'শমদমাদি ষট্-সম্পত্তি'—শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, শ্রদ্ধা ও সমাধান—এই ছয় প্রকারের অতীন্দ্রিয় অন্তর্জাগতিক পারমার্থিক সম্পত্তির অধিকারী হতে হবে।
শম কী? অন্তরিন্দ্রিয় নিগ্রহ, অর্থাৎ অন্তরস্থ সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গুলিকে (মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহম্ বা আমিত্বভাব) অন্তর্মুখী সংযম দ্বারা সংযত করে আত্মাভিমুখে নিয়ে যাওয়াই হলো শম।
আমরা সাধারণ সংসারী মানুষ সহজেই ইন্দ্রিয়ের দাস হয়ে পড়ি। আমাদের ধৈর্য খুব অল্প। ইন্দ্রিয় আমাদের যেদিকে চালায়, আমরা সেদিকেই ছুটি। চোখের, কানের, নাকের, জিভের, ত্বকের—এদের কারও ইচ্ছেকেই আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না। মহাপুরুষেরা ইন্দ্রিয়ের এবং মনের দাস হন না, বরং এই দুইকে নিজের ইচ্ছের অধীন বানিয়ে রাখেন।
আমরা মনের? না কি মন আমাদের? আমরা যদি মনের হই, তাহলে 'আমার মন' কথাটা বলি কেন? 'আমার মন' কথাটা বলিই যদি, তবে মনের দাসত্ব করি কেন? মন যদি আমারই হয়ে থাকে, তাহলে তো বরং মনই আমার দাস হবার কথা ছিল, তাই না?
বকরূপী ধর্মরাজের তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে রাজা যুধিষ্ঠির বলছেন, "মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ"। এর অর্থ, পণ্ডিত কাশীরাম দাসের পদ্যানুবাদে: "সেই পথ গ্রাহ্য যাহে যায় মহাজন।" মহাপুরুষেরা নিজের মন ও ইন্দ্রিয়কে দাস করে রাখেন। এই দুইয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে না পারলে সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি সঠিক উপায়ে করা সম্ভব নয়।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ৫/২/৩ শ্লোকটি বলছেন, একজন ভালো, বিকশিত ব্যক্তির তিনটি বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসংযম (দম), সমবেদনা এবং সমস্ত সংবেদনশীল জীবনের প্রতি সহানুভূতি (দয়া), এবং দাতব্য (দান)। 'শম' বলতে বোঝায় 'মানসিক শান্তি'। কীভাবে আসবে এই শান্তি? 'শম' শব্দটির প্রকৃত অন্তর্নিহিত অর্থ 'আত্মশাসন'। 'শম্' এবং 'দম্' দুটো 'ধাতু'-ই প্রায় সমপর্যায়ের। শম্ ধাতুর পর 'ক্ত' প্রত্যয় করে হয় শান্ত। আর 'দম্' ধাতুর সঙ্গে 'অনট্' প্রত্যয় যোগ করে 'দমন'। 'শম' অর্থ শান্তি, নিবৃত্তি, কাম-ক্রোধের উপশম, চিত্তের স্থিরতা বা সংযম, বাসনার নিবৃত্তি। 'দম' অর্থ শাসন, দমন, ইন্দ্রিয়সংযম, কুকর্ম থেকে চিত্তের নিবারণ।
'উপরতি' হচ্ছে জাগতিক ক্রিয়াকর্ম থেকে নিষ্কৃতি এবং ভোগে অনিচ্ছা (নিস্পৃহতা); 'তিতিক্ষা' হলো প্রতিকূল অবস্থাতেও শান্ত থাকা বা দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা; 'শ্রদ্ধা' মানে ঈশ্বরে বা (যথার্থ) গুরুবাক্যে বিশ্বাস; 'সমাধান' বলতে বোঝায় নিজের মনকে সংযত করে ইষ্ট বা উপাস্য বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে চিত্তকে সম্পূর্ণভাবে স্থাপন করা।
এই ষট্সম্পত্তি লাভ করা হয়ে গেলে শেষ বা চতুর্থ সাধন 'মুমুক্ষতা'য় পৌঁছোনোর চেষ্টা করতে হয়। মানুষ মুক্ত হতে চায়। মুক্তি মিললেই শান্তি মেলে। শান্তির খোঁজেই মানুষ ও অন্যান্য জীব ছোটে। পিঁপড়া এককণা চিনি পেলে ভাবে, সে খুব শান্তি পেল। কিন্তু এর পরই শুরু হয় আরেক অশান্তি। চিনির কণাটি ভোগ করা শেষ হতে না হতেই আরেক কণা চিনি পাবার জন্য সে আবারও অশান্ত হয়ে ছুটতে আরম্ভ করে। আগের কণাটি তাকে শান্তি দিতে পারে না, পরের কণাগুলিও তাকে শান্তি দিতে পারে না। সে আজীবনই শান্তির খোঁজে ছোটে আর ছোটে।
আমরা শান্তির জন্য, আনন্দের জন্য ছুটোছুটি করছি—নানান জায়গায়, নানান কায়দায়, নানান প্রত্যাশায়—আড্ডায়, নাচে, গানে, পার্কে, সিনেমায়, দূরদেশে যাই শান্তি পাবার আশায়। কিছু পেয়ে গেলে মনে হয়, বুঝি শান্তি পেয়ে গেছি। অথচ কিছু সময় পরেই আবার অশান্ত হয়ে পড়ি। আরও চাই—ওটা নেই, সেটা চাই। এভাবে আমরা কোথাও শান্তি খুঁজে পাই না।
মহাপুরুষেরা জেনেছেন কোনটা সত্য (নিত্য) আর কোনটা অসত্য (অনিত্য), তাই তাঁরা আর অসত্য বস্তুর জন্য ছোটাছুটি করেন না—সত্য বা নিত্য বস্তুর লাভ করার জন্যই ছুটে যান। সংসার-সম্বন্ধের অনিত্যতা বুঝে দস্যু রত্নাকর যখন সত্যের সন্ধান পেলেন, তখন তিনি সাধনার বলে ঋষি বাল্মিকী হয়ে রামায়ণের মহাকবি-রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন।
মৃত্যু অনিবার্য, জন্ম হলে মৃত্যু অবধারিত। কাজেই যে-সত্য লাভ করলে আমরা মৃত্যুর পারে যেতে পারি প্রসন্ন চিত্তে, যা লাভ করার পর কিছুই আর অলভ্য থাকে না, তা লাভ করাই মানবজীবনের চরম সার্থকতা। এর বাইরে আর কোনো মূল্যবান বস্তু নেই, জীবনের উদ্দেশ্যও নেই। সকল ধর্মই এমন কথা বলেন। চিত্রকর যেমনি নিজের সৃষ্টির এককোণে নিজের নামটি লিখে রাখেন, ঠিক তেমনি ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করার পর মানুষের মূল যে অংশ—আত্মা, তাঁর মধ্যে নিজের নামটি স্থায়ীভাবে রেখে দেন। তাই আমরা সঠিক পথে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চলার মাধ্যমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি এবং আত্মার এমন উদ্বোধনই মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
সকল প্রকার দানের মধ্যে জ্ঞানদানই শ্রেষ্ঠ। অন্নবস্ত্র দান করলে মানুষের সাময়িক অভাব দূর হয়, স্থায়ী উপকার হয় না—আবার অভাব দেখা দেয়। কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ হয়ে গেলে মানুষের আর কোনো অভাব থাকে না, বরং পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হয়, এবং সেই আত্মজ্ঞান লাভ করা যে-কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব। কারণ প্রত্যেকের মধ্যেই পরমব্রহ্ম সমভাবে বিরাজমান—সকলেই পূর্ণ, কেবল সেই পূর্ণতার খোঁজে চলতে হয়; কেউ বড়ো বা কেউ ছোটো নয়, সবাই-ই সমান। মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আমরা সত্য দেখতে পাই না। যাঁদের মায়া কেটে গেছে, তাঁরাই দেখতে পান—আমি পূর্ণ, আমিই ব্রহ্ম। আত্মজ্ঞান লাভের পথে একটাই বিঘ্ন: নিজের সম্পর্কে অজ্ঞানতা।
মা তাঁর শিশুসন্তানের সামনেই ফ্রিজের ডোরে চকলেট রাখেন। দুপুরে লাঞ্চের পর মা ঘুমিয়ে পড়লে শিশুটি প্রতিদিনই ফ্রিজ খুলে দেখে, ওখানে চকলেট নেই। এর রহস্যটা শিশু কিছুতেই ধরতে পারে না। তার ধারণা, মা জাদু জানে। পুরো ফ্রিজ তন্নতন্ন করে খুঁজেও শিশুটি কোনোদিনই চকলেটের খোঁজ পায় না। এর পেছনের ঘটনাটি হচ্ছে, শিশুকে দেখিয়ে চকলেট রাখার উদ্দেশ্য—শিশুটিকে বলে দেওয়া যে, দেখো, "এখানে চকলেট আছে। তুমি এখানে খুঁজলে চকলেট পাবে।" কিন্তু দুপুরে ঘুমোতে যাবার আগেই শিশুটির চোখের আড়ালে কৌশলে সেই চকলেট নিয়ে মা শিশুর বালিশের কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে রাখেন। হাতের কাছে যে-চকলেট, তার দিকে হাত না বাড়িয়ে চকলেটের খোঁজে শিশুর সমস্ত মনোযোগ পড়ে থাকে পুরো ফ্রিজের প্রতি, কেননা প্রকৃত সত্যের বিষয়ে তাকে কৌশলে অন্ধ করে রাখা হয়েছে।
ছোটোবেলা থেকে শুনে-আসা সাবিনা ইয়াসমিনের গানের লাইন মনে পড়ছে…"(আমার) হাতের কাছে ভরা কলস, তৃষ্ণা মেটে না।"—মিটবে কী করে, কলসের খোঁজ জানতে হবে তো! শিশুর মাথার পাশেই চকলেট, অথচ অজ্ঞানতার কারণে তা থেকে দূরে গিয়ে বেচারা চকলেটের খোঁজে মরে! আমরাও তা-ই করি—শান্তির খোঁজে অন্ধের মতো সারাপৃথিবীজুড়ে ভীষণ ছোটাছুটি করি, অথচ মনের ভেতরে ডুব দিতেই ভুলে যাই। শান্তির আশায় এর-ওর কাছে যাই, কিন্তু নিজের কাছে কখনোই যাই না। বহির্জগতে প্রকৃত শান্তি নেই। বৈষয়িক আনন্দের চেয়ে অন্তর্জগতের আত্মিক আনন্দের শান্তি অনেক বেশি। এই শান্তির ঘর যে অন্তরের মধ্যে, অন্তরের বাইরে গিয়ে পৃথিবীর সব ঘরে খুঁজলেও তা পাওয়া যাবে কীভাবে?
এ পৃথিবীর কোন বস্তুটি চিরন্তন? একসময় গ্রিস, রোম প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সভ্যতার উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিল, অথচ আজ তারা কোথায়? টিকে আছে কেবল তাদের জ্ঞানৈশ্বর্য—এ জগতে কেবল এই একটি ঐশ্বর্যই নিত্য। পার্থিব সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে, কেবলই অপার্থিব সম্পদ বেঁচে থাকবে। নিজে বড়ো হবার জন্য যে যতই ঝগড়া-বিবাদ-যুদ্ধ করুক না কেন, যদি অন্তঃস্থিত শক্তির উপযুক্ত মর্যাদা রক্ষা না করে, তবে শেষে গিয়ে সে কখনও কৃতকার্য হতে পারে না, বুদ্বুদের মতোই তার অস্তিত্ব নিমিষেই বিলীন হয়ে যায়। কি ব্যক্তি, কি ব্যষ্টি, সকলের ক্ষেত্রেই এটা সত্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ পৃথিবীতে যার যা প্রাপ্য, তাকে তা দিলে সত্যের মর্যাদা যতটা রক্ষিত হয়, আর কোনো কিছুতেই ততটা হয় না। গুরুকে সম্মান না করে পৃথিবীতে বড়ো হতে পেরেছে কে কোথায়? বাবা-মা'য়ের মর্যাদা রক্ষা না করে সন্তান বড়ো হতে পারে না, গুরুর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা না দেখিয়ে শিক্ষার্থীর প্রকৃত শক্তি বিকশিত হতে পারে না। পৃথিবীতে বড়ো হবার একটাই মন্ত্র: নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড়ো না ভাবা—এতে সবাইকে সম্মান দেখানো হয় এবং নিজেকে বাকির সবার চেয়ে ঊর্দ্ধে নিয়ে যাবার প্রেরণা জাগ্রত হয়।
মর্যাদা না দিলে অন্তর্নিহিত শক্তি ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে থাকে। যত্নের অভাবে যে-কোনো ক্ষমতাই একসময় নষ্ট হয়ে যায়। মানুষ নিজেকে চেনে না বলেই এত গোলমাল। নিজের আত্মা সম্বন্ধে কিছুই জানে না বলেই নিজের মধ্যে না ঢুকে বাইরে সব জায়গায় শান্তির জন্য ছোটাছুটি করে। ওতে সুখ হয়তো মেলে, কিন্তু শান্তি মেলে না কিছুতেই।
দ্বৈতমতাবলম্বীরা একটি আপত্তি করেন এভাবে: যদি ব্রহ্মের সাথে জীবের বাস্তবিক ভেদ না থাকে এবং জীবই পরব্রহ্মস্বরূপ হয়, তবে জীবের ভ্রম হবে কেন? ব্রহ্মভাবপ্রাপ্তিরূপ পরম মুক্তি তো এখানে স্বতঃসিদ্ধই আছে, তার জন্য তত্ত্বজ্ঞানের কী প্রয়োজন? সিদ্ধবস্তুর সাধনে বাড়তি চেষ্টা করতে হবে কেন? মানুষ, বস্তু, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বিশ্বাস ইত্যাদি গুরুর ভূমিকাই-বা এখানে কোথায়?
এখানে বোঝায় একটু ভুল আছে। নিজেকে চিনতে মানুষ ভুল করে। যা চোখের সামনে আছে, তা অন্যে দেখিয়ে না দিলে মানুষ প্রায়ই তা দেখতেই পায় না। "তুমি পারবে।"—এইটুকু আশ্বাস অন্যের মুখ থেকে না শুনলে মানুষ পারার জন্য চেষ্টাই করে না। দশ জন মূঢ় ব্যক্তি নদী পার হলেন। সবাই ঠিকভাবে এসেছে কি না, তা দেখতে দশ জনের প্রত্যেকেই নিজেকে বাদ দিয়ে গুনে দেখলেন যে, মোট নয় জন হয়, দশ জন কিছুতেই মেলে না। তখন ওঁরা সবাই ধরে নিলেন, ওই পাড়ে দশ জন থাকলেও এই পাড়ে নয় জন পার হতে পেরেছেন, কেননা এক জনকে বোধ হয় কুমিরে খেয়ে নিয়েছে। এটা ভেবে যখন ওঁরা সবাই মিলে কাঁদতে আরম্ভ করলেন, তখন সেই পথ দিয়ে হেঁটে-যাওয়া এক বুদ্ধিমান পথিক ওঁদের উদ্দেশ করে বললেন—দশমস্ত্বমসি—দশম তুমি! পথিকের কথা শুনে নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করে গোনার পর ওঁরা এই সিদ্ধান্তে এলেন: চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমাদের মধ্যে কেউই কুমিরের পেটে যাননি, আমরা দশ জনই আছি।
মানুষ এভাবে নিজেকেই দেখতে পায় না। নিজেকে দেখার জন্য গুরুর সাহায্য লাগে। এই দেখার নামই আত্মজ্ঞান লাভ করা। গুরুর পায়ের কাছে বসে মাথা নত করে একাগ্রচিত্তে সমস্ত অহংকার দূরে ছুড়ে ফেলে এই জ্ঞান লাভ করতে হয়। তাই জীব ব্রহ্মস্বরূপ হলেও অজ্ঞানতা দূর করে সেই পরব্রহ্মের সন্ধান পেতে শ্রুতি এবং স্মৃতি, তথা ন্যূনতম ৭৬টি গ্রন্থ—৪ বেদ, ৬ বেদাঙ্গ, ১৮ ব্রাহ্মণ, ৯ আরণ্যক, ১০ উপনিষদ, ৪ উপবেদ, ২০ সংহিতা বা স্মৃতি বা নীতিশাস্ত্র ও ২ সমন্বয়ী: গীতা ও ব্রহ্মসূত্র—পরমগুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। এতে করে অদ্বৈত মত খণ্ডিত তো হয়ই না, বরং আত্মজ্ঞানলাভের মধ্য দিয়ে অদ্বৈতবাদের প্রকৃত ভিত্তি সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়।
গুরুই আমাদের বলে দেন: ধর্ম বাইরে নয়, শান্তি বাইরে নয়, জ্ঞান বাইরে নয়—একেবারে ভেতরে, অন্তরের মধ্যেই। প্রত্যেক আত্মাই স্বভাবত পূর্ণ ও পবিত্র—তাঁকে জাগ্রত করাই আমাদের কর্তব্য। কেবল বাহ্যিক ধর্মাচরণেই ধর্ম হয় না, তার জন্য আত্মজ্ঞান জরুরি এবং এই জ্ঞানের জন্য আত্মবিশ্লেষণ অপরিহার্য। এ পথে চললে আত্মোন্নতি হয় এবং তার ফলে মানুষ সিদ্ধি বা পরিপূর্ণতা লাভ করে।
হিন্দুধর্ম বিশ্বাস করে—যেখানে নর, সেখানে নারায়ণ; যেখানে নারী, সেখানে গৌরী। মানুষের মাঝে ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠা হিন্দুধর্মদর্শনে মান্যতা পেয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ঘোষণা করেছিলেন: যেখানেই জীব, সেখানেই শিব; ধারণাটি তাঁর অদ্বৈতবাদী বোধ থেকে উৎসারিত। মানুষে এবং ভগবানে কোনো দ্বৈততা আর থাকে না, যখন মানুষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে এবং নিজেকে আত্মার সাথে এক ও অভিন্ন সত্তায় উন্নীত করতে পারে। এটা করতে হলে শুধু মানুষে নয়, সকল প্রাণীতেই সমদৃষ্টি স্থাপন করতে হবে—আত্মদৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।
বেদান্তের শেষকথা—কোনো কিছুতেই ভেদজ্ঞান রাখা যাবে না, কেননা সব কিছুতেই সেই বিশাল আত্মা তথা পরব্রহ্ম রয়েছেন। এখানে তাই কোনো ধরনের ভেদবিভেদ থাকতে পারে না—এখানে আছে শুধু প্রেম, মানুষের মধ্যে যার উদয় হলে মানুষে মানুষে আর কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র সম্পর্কিত প্রশ্ন থাকে না, মতবাদের দূরত্ব থাকে না—বরং এসবের বদলে এক মহান ঐক্য দেখা দেয়।
আজ মানুষ শান্তিস্থাপনের জন্য এত যে চেষ্টা করছে, কোনো-না-কোনো পথে বা মতে বেদান্তের মহান শিক্ষা গ্রহণ করলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বেদান্তের শিক্ষাগুলি সকল ধর্মমতেই বিদ্যমান, হয়তো ভিন্ন ভিন্ন ভাষাবন্ধে—সেগুলি গ্রহণ করে কাজে লাগালে শান্তি আসবেই।
কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ তৈত্তিরীয় উপনিষদ নির্দেশ দিচ্ছেন: মাতৃদেবো ভব। পিতৃদেবো ভব। আচার্যদেবো ভব। অতিথিদেবো ভব। (২-২৩)—মাকে, বাবাকে, গুরুকে, অতিথিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করবে। (লক্ষ করুন, মায়ের স্থানটিই বেদ সবার আগে রাখছেন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই হিন্দুধর্মে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত।) স্বামী বিবেকানন্দ একে আরও বাড়িয়ে বলেছেন: "দরিদ্রদেবো ভব। মূর্খদেবো ভব।"—এই যে অসংখ্য গরিব মানুষ না খেতে পেয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে, দেবতাজ্ঞানে তাদের সেবা করতে হবে। যারা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে আছে, দেবতাবোধে সেইসব নিতান্তই সাধারণ মানুষকে আলোর খোঁজ দিতে হবে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীগণ যুগে যুগে অভ্রান্ত দর্শন বেদান্ত তথা গীতা-উপনিষদ তথা ব্রহ্মজ্ঞানের অপরিহার্যতা ঘোষণা করে গেছেন। প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে ঘোষিত বেদান্তের বাণী—তা নবীনতর ধর্মসমূহেও, যেভাবেই বলা হোক না কেন—পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য সর্বজনীন হিসেবে শ্রদ্ধা পেয়েছেন।
বেদান্তশিক্ষার উদ্বোধনে এবং ক্রমবিকাশে মানুষ ভাই-ভাই হয়ে যায়—আর কোনো ধরনের ভেদভাব, বিবাদ-বিসংবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ থাকে না—পৃথিবীতে এক মহান ঐক্যের, মহান ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি হয়, পৃথিবী চিরশান্তির পথ খুঁজে পায়। মানুষ তখন একধরনের ভয়শূন্য স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করতে পারে। শান্তির প্রতিষ্ঠায় এবং পরবর্তী বিকাশে বেদান্তের শিক্ষা পরিত্রাতারূপে আবির্ভূত হতে পারে। মানুষের চৈতন্যকে জাগিয়ে জ্ঞানযোগ এবং কর্মযোগের সমন্বয়ে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ স্ফুরণ ঘটাতে পারে কেবলই বেদান্তের শিক্ষা ও তার সঠিক প্রয়োগ। মানুষের মাঝে ঈশ্বরের যে-অধিষ্ঠান, তাকে জাগাতে পারে এক বেদান্তই। এমন জাগরণেই যে সমগ্র মানবজাতির তথা জগৎসভ্যতার অগ্রযাত্রা সাধিত হবে, এই সহজ সত্যটা বোঝার সময় এসে গেছে বহু আগেই।