গীতার আবির্ভাব

গীতার আঠারোটি অধ্যায়ের আলাদা আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের নাম রাখা হয়েছে 'কর্মযোগ' এবং দ্বাদশ অধ্যায়ের নাম 'ভক্তিযোগ'। আবার কোনো কোনো পণ্ডিত পাঠক বলেছেন, গীতার শুরুর ছয় অধ্যায় কর্মের, মাঝের ছয় অধ্যায় ভক্তির এবং শেষ ছয় অধ্যায় জ্ঞানের প্রতিপাদক। অভিজ্ঞতা বলে, গীতা-পাঠকদের কাছে প্রায় সব অধ্যায়েই কর্ম, ভক্তি এবং জ্ঞান—তিনটিরই সমর্থন মিলে যায়। তাই এমন বিভাগের সম্পূর্ণ রহস্য সাধারণ পাঠকের কাছে ঠিক বোধগম্য নয়।




কর্মযোগী এবং ভক্তের আচরণে কি বিশেষ ভেদ আছে? ভগবান কর্মের বিষয়ে এত আগ্রহ প্রকাশ করলেন কেন? কর্মযোগ কাকে বলে? একজন কর্মযোগীর আচরণ কেমন হয়ে থাকে?




যোগের অর্থ যুক্তিও হয়—যোগের পরিভাষা দিতে গিয়ে যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, "যোগঃ কর্ম সুকৌশলম্।", অর্থাৎ কর্মের কৌশলই হলো যোগ। এই কৌশল বা যুক্তি কীরকম?




গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন,
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয় ।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।




শ্লোকটির পদ্যানুবাদ করলে দাঁড়ায়:
যোগী হয়ে করো কর্ম—আসক্তিরহিত।
আসক্তিরহিত কর্ম—ভগবানে প্রীত॥
ধনঞ্জয়! সঙ্গ ত্যাজি তুমি কর্ম করে যাও।
সিদ্ধি বা অসিদ্ধি-সম বৈষম্য ঘোচাও।।
এই সমভাব হয় যোগসিদ্ধি নাম।
সেই সিদ্ধিলাভে পূর্ণ সর্ব মনস্কাম।।




অর্থাৎ, হে অর্জুন! ফলভোগের কামনা পরিত্যাগ করে ভক্তিযোগস্থ হয়ে স্বধর্মবিহিত কর্মাচরণ করো। কর্মের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সম্বন্ধে যে-সমবুদ্ধি, তাকেই যোগ বলা হয়।




ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যোগে যুক্ত হয়ে কর্ম করার নির্দেশ দিচ্ছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যোগ বলতে কী বোঝায়? যোগের অর্থ হচ্ছে, চিত্ত চঞ্চল করে দেয় যে-সকল ইন্দ্রিয়, তা সংযত করে একমনে পরমেশ্বরের ধ্যান করা। পরমেশ্বর কে? সকল কারণের কারণ পরমেশ্বর হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এখানে যেহেতু তিনি নিজেই অর্জুনকে যুদ্ধ করতে আদেশ করছেন, সেহেতু সেই যুদ্ধের ফলাফলের প্রতি অর্জুনের আসক্ত হওয়া উচিত নয়—যুদ্ধের লাভ অথবা জয় নির্ভর করছে শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছার উপর। অর্জুনের কর্তব্য হচ্ছে, শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশ অনুসারে যুদ্ধ করা। ভগবান নিজেই যখন ভক্তের কাজের ফলাফলের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে নেন, তখন ভক্তের একটাই কর্তব্য: ফলাফলের কথা না ভেবে নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাওয়া।




ভগবানের আদেশ পালন করাই হচ্ছে প্রকৃত যোগ এবং কৃষ্ণভাবনাময় ভগবদ্‌ভক্তির মাধ্যমে এই যোগের অনুশীলন করা হয়। ভগবদ্‌ভক্তির প্রভাবেই কেবল অহংকারমুক্ত হওয়া সম্ভব। ভগবানের দাসত্ব বা ভগবানের দাসের (প্রকৃত গুরুর) দাসত্ব (ভাগবত ধর্মের নির্দেশ ও নির্দেশনা পালন অর্থে) বরণ করার ফলে অন্তরে ভগবদ্‌ভক্তির বিকাশ হয় এবং তখন জিতেন্দ্রিয় হয়ে যোগের সাধন করা সম্ভব হয়।




অর্জুন ছিলেন ক্ষত্রিয় এবং সেই কারণে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে তিনি বর্ণাশ্রম-ধর্মের আচরণ করতেন। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, বর্ণাশ্রম ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে: শ্রীবিষ্ণুকে তুষ্ট করা। জড়জগতের নীতি হচ্ছে, আমাদের—নিজেকে নয়, বরং শ্রীবিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করা উচিত। তাই কেউ যদি শ্রীবিষ্ণু অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট না করে, তবে সে বর্ণাশ্রম ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করতে পারে না। এভাবে ভগবান নিজেই অর্জুনকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁর নির্দেশ অনুসারে কর্ম করাই হচ্ছে তাঁর একমাত্র কর্তব্য।




'সমত্ব'-ই হচ্ছে যোগ—ভগবান এমনও বলেছেন। তা হলে এই সমত্বের মর্ম কী? ঠিক তেমনি ভক্তিরই-বা তাৎপর্য কী? ভক্তিমার্গ কি কর্মযোগ থেকে ভিন্ন বা আলাদা? ভক্তের আচরণ কীরকম হয়ে থাকে? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ দৈবী সম্পদের লক্ষণ সম্পর্কেও বলেছেন; বলেছেন স্থিতপ্রজ্ঞের সম্পর্কেও। ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ আলাদা করে বলেছেন। এসবে কী ভেদ আছে? বিভিন্ন জ্ঞানযশস্বী গীতাকার এসব প্রশ্নের অত্যন্ত স্পষ্ট ও বোধগম্য উত্তর দিয়েছেন। এসব বিশ্লেষণ এত সহজসরল এবং সাধকের পথকে এত সহজ করে দেয় যে, এর অধ্যয়ন ও মনন সাধনার জন্য একান্ত প্রয়োজন।




গীতা মহাভারতেরই একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। ব্যাসদেব বলেছেন, গীতা হলো সমস্ত উপনিষদের সার—সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ—উপনিষদরূপী গাভীসমূহের দুগ্ধ সাক্ষাৎভগবান শ্রীকৃষ্ণ দোহন করে অর্জুনকে পান করিয়েছেন। বড়ো সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, অর্জুনের জন্য দোহনকৃত এই অমৃতদুগ্ধ ভগবান সোনার বাটিতে ভরে যেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মুমুক্ষুর সামনে রেখে এই মহাআমন্ত্রণ জানিয়েছেন যে, তারা চাইলে সম্পূর্ণ বিনা বাধায় এই দুধ পান করে নিজেদের জ্ঞান-পিপাসা প্রশমিত বা শান্ত করতে পারবে।




গীতায় পুনরুক্তির অভাব নেই। তবে এসব পুনরুক্তি ব্যাসদেব জেনেবুঝেই দিয়ে রেখেছেন। এক ঢোকেই বাটির পুরো দুধ খেয়ে ফেলা সম্ভব নয়; বারবার একটু একটু করে পান করলেই ভাবরসের পুরো আস্বাদ লাভ করা যায়। এই উপমা থেকেই পুনরুক্তির রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়ে যায়। এই অদ্ভুত গ্রন্থ গীতার মহিমা জগদ্‌খ্যাত। সকল দেশে, সকল ভাষায় এই অত্যাশ্চর্য দর্শনসম্ভারের সমাদর করা হয়েছে।




নিবৃত্তি এবং প্রবৃত্তি, এই দুটি পথ প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত হয়ে এসেছে। আচার্যগণ এই নিবৃত্তি-মার্গকে সাংখ্যযোগ নামে চিহ্নিত করেছেন এবং প্রবৃত্তি-মার্গকে ভাগবত ধর্ম বলা হয়েছে, যাতে কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ দুইয়েরই সমন্বয় আছে। এই ভাগবত ধর্মও কোনো নতুন পথ নয়, তবে কালের প্রভাবে একসময় এর মাহাত্ম্য হ্রাস পেয়ে গিয়েছিল। এর পুনরুদ্ধারকর্তা হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।




মহাভারত, ভাগবত এবং বিশেষ করে ভগবদ্‌গীতায় এই ভাগবত ধর্মের পথের বিশদ প্রতিপাদন করা হয়েছে। এই লুপ্ত এবং সুপ্ত পথের উদ্ধার করে সেই সময়ের বিভ্রান্ত জনগণকে আপন কর্তব্যপথে ফিরিয়ে আনার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের এই প্রয়াস এবং সেই প্রবৃত্তি-মার্গের দ্বারা এই কর্মযোগ অর্থাৎ সক্রিয় নিষ্কাম কর্মের দিকে সমাজকে প্রেরিত করতে ভাগবত ধর্মের প্রবর্তকগণ প্রচুর সাফল্য লাভ করেছেন। নিষ্কাম কর্মের অর্থ হলো: কর্ম করার সময় ততটুকু চেষ্টা ও শ্রম খরচ করে নিজের কর্তব্যপালন করতে হবে, যার চাইতে বেশি কর্ম কর্মী তার মন ও দেহ, এই দুইয়ের সমন্বয়ে করতে পারে না, তাই কর্মের ফল স্বাভাবিকভাবেই ভগবানের তথা অদৃষ্টের হাতে ন্যস্ত হয়ে যায়—ফলের জন্য দুশ্চিন্তা এক্ষেত্রে কর্মের স্পৃহা কমাতে পারে না এবং কর্মী তার সামর্থ্যের সেরাটুকুই দিতে পারে। নিজের মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্য পুরোপুরি ব্যবহার করে কর্তব্যকর্মের সাধনায় নিযুক্ত হলে ফলের কামনা করেই-বা বাড়তি কী প্রাপ্তি হবে? কর্মের ধর্মই ভাগবত ধর্ম‌ এবং এটিই গীতার প্রধান আলোচ্য বিষয়।




মহাভারতের যুদ্ধ আরম্ভ হবারই ছিল। যুদ্ধের পুরোপুরি প্রস্তুতিও হয়েই গিয়েছিল। চারিদিকে অস্ত্র-শস্ত্রের ঝনঝনানিতে কুরুক্ষেত্র মুখরিত ছিল। সব মহারথী নিজ নিজ শঙ্খধ্বনির সাহায্যে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানিয়ে পরিবেশকে যুদ্ধের উপযোগী করছিলেন। এমন সময় অর্জুন ভগবানকে বলছেন: "ভগবান! এই দুই সেনাদলের মাঝখানে আপনি আমার রথকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করান, যাতে যাঁরা এখানে লড়তে এসেছেন, তাঁদের একটু দেখে নিতে পারি।"




অর্জুন এই কথা বলার পর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সেই বিশাল রথটি দুই সেনাদলের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন এবং ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতি সেনানায়কদের দিকে ইশারা করে বললেন, "অর্জুন! এই সমবেত যোদ্ধৃবৃন্দকে দেখো।"




অর্জুন চারিদিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখতে পেলেন, সব বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, গুরু, পিতামহ, পুত্র, পৌত্র এবং পরিবারের অন্যান্য লোকও যেন মৃত্যুর জন্য স্বেচ্ছায় উপস্থিত হয়ে দণ্ডায়মান। তাঁদের দেখামাত্র অর্জুন কেঁপে উঠলেন। তাঁর সারাদেহ যেন এলিয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন, "কৃষ্ণ! আমার মুখে শুকিয়ে যাচ্ছে। শরীর বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। ধনুক আমার হাত থেকে খসে পড়ছে। এই প্রিয়জনদের মেরে যুদ্ধে যদি আমি জয়লাভও করি, তাতে কী লাভ হবে? যদি এই হিংসাত্মক কর্ম করেও এদের কারও মধ্যেই কোনো গ্লানিবোধ না হয়, তাতে কী এসে যায়—আমি কেন এই কুকর্মে প্রবৃত্ত হতে যাব? তার চেয়ে বরং এ-ই ভালো যে, নিরস্ত্র আমাকে দুর্যোধনেরা যদি মেরে ফেলে। এই পাপের চেয়ে তো মৃত্যুই ভালো।" এই বলে অর্জুন নিজের ধনুক রথের উপর ফেলে চুপ করে বসে গেলেন।




অর্জুনের এই দৌর্বল্য দেখে ভগবানের মধ্যে কৃপাভাবের উদয় হলো এবং তিনি অর্জুনকে একটু হেসে বললেন, "অর্জুন, এই অনার্য বৃত্তি, যা নরকে ছুড়ে ফেলে, তা তোমার মধ্যে কী করে জন্মাল? এই কাপুরুষতাকে ত্যাগ করো এবং উঠে দাঁড়াও।" কিন্তু অর্জুন সেই বিষাদে এমন ব্যথিত-অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি ওই ধরনের কথাই বলে চললেন। আবারও তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, "হে কৃষ্ণ! আমার বুদ্ধি কাজ করছে না। আমি লড়ব না।" এটুকু বলে তিনি চুপ হয়ে গেলেন।




ঠিক এখান থেকেই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশামৃত আরম্ভ হলো। প্রথম সাংখ্যযোগ, অর্থাৎ নিবৃত্তি-মার্গের পটভূমিকায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝালেন যে, এই আত্মা হল সর্বব্যাপক, অজর, অমর—কে মারে এবং কে-ইবা কাকে মারায়!




মুণ্ডকোপনিষদের আচার্য বাক্যের সাহায্যে যতটা বলা যায়, ততটা বলে সেই আত্মাকে নানা বিশেষণ দিয়ে বর্ণনা করেছেন এভাবে—




যৎ তদদৃশ্যমগ্রাহ্যমগোত্রমবর্ণম্
চক্ষুঃ শ্রোত্রং তদপাণিপাদম্।
নিত্যং বিভুং সর্বগতং সুসূক্ষ্ণং
তদব্যয়ং তদ্ ভূতযোনিং পরিপশ্যন্তি ধীরাঃ।




অর্থ: যা দেখা যায় না, যা ইন্দ্রিয়গম্য নয়, যা কখনও জন্মায় না, যার কোনো বর্ণ নেই, যার না আছে কান…না চোখ, যার না আছে হাত…না পা, যে নিত্য, যার থেকে ব্যক্তের প্রভব বা উৎপত্তি এবং যা সবাইকে ছেয়ে আছে, যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম, যা অব্যয়, যা থেকে সমগ্র প্রকৃতি তথা ভূত ও প্রাণী প্রসূত হয়—এইভাবে ধীর পুরুষগণ সেই অব্যক্তকে জেনেছেন।




একই ধরনের ভাষাবন্ধেই অন্য উপনিষদগুলিতেও আত্মা অর্থাৎ সর্বব্যাপক সত্যের বর্ণনা করা হয়েছে।




গীতাতেও তারই পুনরুক্তি করা হয়েছে। আরও এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণ বললেন, "যেমন মানুষ পুরোনো কাপড় ফেলে দিয়ে নতুন কাপড় গ্রহণ করে, এ শরীরের অবস্থাও তা-ই বলে বোঝো। মৃত্যু কেবলই—জীর্ণ শরীরকে ফেলে দিয়ে নতুন শরীর ধারণ করা। তাই মৃত্যুতে এই শোক কীসের জন্য? এমন সমস্ত চিন্তাধারাই তো অজ্ঞানজনিত! তোমাতে এ শোভা পায় না। এই শরীর না ছিল আদিতে, না থাকবে ভবিষ্যতে। এ কেবল মাঝখানেই দেখা দিয়ে থাকে, সেই কারণেই এ অসত্য-মায়া। বুদ্ধিমান লোক এতে শোক করেন না। তুমি কথা তো জ্ঞানীর মতো বলছ, কিন্তু আসলে তুমি হচ্ছ নিরেট মূর্খ।"




ব্যাবহারিক দৃষ্টিতেও, যদি তুমি যুদ্ধ না করো, তা হলে লোকে বলবে, অর্জুন ভীরু, সে ভয় পেয়ে যুদ্ধ থেকে পালাল, ইত্যাদি নানাধরনের এমন প্রচুর নিন্দা হবে।"




আমি তোমায় সাংখ্যমার্গের দৃষ্টিতে এটা বোঝালাম। এখন আমি কর্মযোগের দৃষ্টিতেও বলছি। এ থেকে তুমি বুঝে যাবে, সমবুদ্ধিতে মানুষ যখন কোনো ধর্ম-কর্মের আচরণ করে, তখন সে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যায়।"




বাস্তবে গীতার উপদেশ হলো কর্মযোগের প্রতিপাদন এবং তা দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৩৯ নম্বর শ্লোক থেকে আরম্ভ হয়েছে। এরপর প্রত্যেক অধ্যায়ে কর্মযোগ এবং ভক্তিযোগ দুইয়েরই বারবার বিশ্লেষণ, প্রতিপাদন ও সমর্থন হয়েই চলেছে এবং তার পুনরুক্তিও লক্ষণীয়। কর্ম এবং ভক্তি এই দুইয়ের সাধনের দ্বারা শেষে জ্ঞাননিষ্ঠা লাভ হবে এবং এই বিনাশশীল সংসার থেকে মুক্তি মিলবে। এ-ই হলো সমস্ত উপদেশের সার।




শ্রীকৃষ্ণ বারবার বলছেন, "'কর্ম' কখনও ছেড়ো না।" কিন্তু সেকালের প্রচলিত ধারণা অনুসারে যাগযজ্ঞ এবং স্বর্গলাভের জন্য অনুষ্ঠিত নানা ক্রিয়াকলাপ, যজ্ঞে পশুবধ, সোমরসপান ইত্যাদি ধরনের বিধিবিধানকেও কর্মই বলা হতো। কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে এই প্রচলিত বিভ্রান্তিমূলক ধারণাকে দূর করার জন্য তাই অর্জুনকে স্বধর্মাচরণের জন্য উদ্‌বুদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভগবানকে এ-ও বোঝাতে হলো যে, এসব বেদের প্রলোভনমূলক বাক্যে যে-সব কর্মের প্রশংসা করা হয়েছে, আমি তার সমর্থন করছি না। যে-সব লোক ইন্দ্রিয়সমূহের বিষয়েই রত হয়ে আছে, শ্রেয়কে ছেড়ে প্রেয়ের (আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর) পেছনেই ছুটে মরে এবং তার প্রাপ্তির বা লাভের জন্য নানাপ্রকার ক্রিয়াকলাপ অত্যন্ত আয়াস-প্রয়াসের সঙ্গে করে থাকে, সেই যাগ-যজ্ঞানুষ্ঠানকারীদের না প্রাপ্তি হয় নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি (পরমাত্মাকে পেতে হবে, তাতে যা-ই হোক না কেন—এমন বুদ্ধি), না লাভ হয় শান্তি বা মুক্তি।




এজন্য আমি যা বলছি, তা হলো, এই বিনাশশীল সুখ, স্বর্গ ইত্যাদির লালসা থেকে মনকে সরিয়ে এনে সত্ত্বে (সত্ত্ব: ধার্মিকতা, ইতিবাচকতা, সত্য, শান্ততা, ভারসাম্য, শান্তিপূর্ণতা এবং মহত্ত্বের গুণ, যা ধর্ম ও জ্ঞানের দিকে নিয়ে যায়) যাও। স্বধর্মকর্ম থেকে কখনও বিচলিত বা বিচ্যুত হয়ো না। কর্তব্যকর্ম করো, কিন্তু তার ফলের তৃষ্ণা ত্যাগ করো। নিজের ধর্ম জেনেই সমস্ত কর্ম করো। কর্মই পরম ধর্ম।




প্রাণীর অধিকার শুধু কর্ম করাতে—ফল তো ঈশ্বরের হাতে, তাঁরই অধীন। যখন ফলের উপর তোমার কোনো জোরই নেই, তাহলে ফলের কামনায় মনকে এই টালমাটাল অবস্থায় বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে বিক্ষিপ্ত করে রেখে লাভ কী? সেই ফলের তৃষ্ণায় তার পেছনে দৌড়োলে মন কেবল অব্যবস্থিত ও অশান্তই হয়ে থাকে।




কর্ম অনুষ্ঠানের জন্য আগ্রহ দেখানোর সাথে সাথে উপরোক্ত স্পষ্টীকরণ‌ও শ্রীকৃষ্ণের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন ছিল, কেননা যেমনটা আগেই বলা হয়েছে—বৈদিক কর্মকাণ্ড‌ও সেই সময়ের প্রচলিত ব্যাখ্যানুসারে কর্ম বলেই পরিচিত ছিল; কৃষ্ণের কর্মযোগে এই জাতীয়, স্বর্গলাভের আশায় কৃত যাগযজ্ঞাদিপালন তথা কাম্যকর্মে'র সমর্থন ছিল না। এ কারণেই গীতার বাণী চিরন্তন ও কালজয়ী।




ভাগবত ধর্ম বৈদিক কর্মকাণ্ডের দুর্বলতায় চাপা পড়ে গিয়েছিল এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে নিবৃত্তি-মার্গের প্রচলনও ধর্ম থেকে জনসাধারণকে বিচ্যুত করে অলস করে তুলছিল। এই দু-রকম পথিককেই সক্রিয় এবং নিঃস্বার্থ হয়ে 'সর্বভূতহিতে রতাঃ' বা 'সকল জীব এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুসমূহের পাঁচটি মূল উপাদানের কল্যাণে নিবেদিত'-র ছাঁচে ঢালার জন্যই শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত প্রয়াস নির্দিষ্ট ছিল। এটাই হলো ভাগবত ধর্ম। সকলের জন্য প্রযোজ্য মঙ্গলোপদেশে সমৃদ্ধ হয়েই আমাদের জীবনের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত গীতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।




যেখানে যেখানে গীতায় কর্মযোগের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে, সেসব স্থানে গীতার তাৎপর্য শুধু স্বধর্ম-আচরণ, লোক-কল্যাণের জন্য অনুষ্ঠিত নিষ্কাম কর্মের দিকে এবং ফলসমূহে আসত্তির প্রতি বিরোধে। এজন্য কর্ম করার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করার সময় শ্রীকৃষ্ণকে বারবার এ কথাও বোঝাতে হয়েছে যে, কর্ম বলতে আমার সিদ্ধান্ত হলো ধর্মাচরণ ও কর্তব্যকর্ম। এই সিদ্ধান্তকে মাথায় রেখেই গীতার অধ্যয়ন ও অনুশীলন করা আবশ্যক। যাগযজ্ঞাদি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কর্তব্যকর্মের উপর জোর দেওয়া হয়েছে বিধায় গীতা সকল মত ও পথের মানুষেরই শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও পথপ্রদর্শক হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।




গীতার আরম্ভ হয়েছে অর্জুনের বিষাদ থেকে। "আমি যুদ্ধ করব না।"—এই বলে তিনি মূক হয়ে বসে পড়লেন। এ-ই হলো গীতার আরম্ভ। এরপর অর্জুন নানা ধরনের বিচিত্র সব প্রশ্ন করেছেন শ্রীকৃষ্ণকে। ভগবান পরম স্নেহভরে সেসবের উত্তর দিয়ে গিয়েছেন এবং অর্জুনের সব সমস্যার সমাধান করে চলেছেন। নিজের বিভূতিসমূহেরও বর্ণনা করেছেন ধাপে ধাপে। বিশ্বদর্শনও করিয়েছেন সখা অর্জুনকে, জ্ঞানযোগও বুঝিয়েছেন। এই গীতারূপ মহাআধারের গহ্বরে সতত ধারায় প্রবাহিত রয়েছে কেবলই কর্মযোগ। কর্ম সম্পর্কিত সকল ধরনের উপদেশের পর গীতা শেষ হয়েছে। ভগবান অর্জুনকে বলছেন, "অর্জুন! তোমাকে যা বোঝাবার ছিল, সব বলা হয়ে গিয়েছে। এখন তোমার যা উচিত মনে হয়, তা-ই করো।" শুনে অর্জুন বললেন, "আমার মোহ বিনষ্ট হয়েছে। আমি এখন স্বস্থ-সমাহিতচিত্ত হয়েছি। এখন আপনি যা বলবেন, তা-ই করব।"




ভক্তের জন্য যা করা সবচাইতে মঙ্গলকর, তা-ই ভক্তকে দিয়ে করিয়ে নেওয়া—এখানেই ভক্তের প্রতি ভগবানের ভালোবাসা ও কৃপাবর্ষণ। তবে এই মহাপ্রসাদ পেতে চাইলে অর্জুনের মতো করে নিজের সবকিছুই শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সমর্পণ করে দিতে হবে। এমন সমর্পণের মধ্যেই সকল তৃপ্তি ও প্রাপ্তি নিহিত।