একদিন মধুদিন

অফিসে যাইনি। আমি অসুস্থ কিংবা বিশেষ কোনো কাজ আছে, এমন কিছু নয়—এমনিতেই অফিসে যাইনি। আমার লাইন ম্যানেজারকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে রেখেছি। তিনি অফিসে না আসার কারণ জানতে চেয়েছেন, জানাতে ইচ্ছে করেনি। মাঝে মাঝে আমি নিজের ইচ্ছেয় চলি। মৃত্যুর আগেই নিজের ইচ্ছেয় বেঁচে না নিলে কি হয়? বাঁচব আর ক-দিন!




আজ ছুটির দিন না হলেও ছুটির দিন; বাঁধাধরা কোনো কাজ নেই বটে, কিন্তু ছুটির দিনে করব বলে অনেক কাজ জমা করে রেখে দিয়েছিলাম; এই যেমন, স্কাই-কালারের শার্টের বোতামের চার নম্বর ঘরটা একটু কমিয়ে দেওয়া, হাত-ব্যাগটার এক জায়গায় মেরামত করা, বইয়ের শেলফে বিভিন্ন তাকে কীটনাশক স্প্রে করা। স্টোররুমটা অনেক দিন ধরে পরিষ্কার করা হয় না, ওটা আজ পরিষ্কার না করলেই নয়; নিজের কিছু পড়া ও লেখার কাজ‌ও রয়েছে, কিছু ইমেইলের রিপ্লাই দেওয়াও দরকার—এ ধরনের টুকিটাকি কিন্তু জরুরি কাজ জমা হয়ে থাকে ছুটির দিনের জন্য।




ছুটির দিন মাথায় রেখে বেশ দেরি করেই ঘুম ভাঙিয়েছি, দুপুর হয়ে যাওয়ায় ব্রেকফাস্ট সারলাম ব্রাঞ্চেই। তবু হিসেব করে দেখি, হাতে অনেক সময়। ওদিকে আবার কাজও তো কম নেই! কখন কোন কাজটা করব ভাবতে ভাবতে, বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়া পৃথিবীর সবচাইতে সহজ ও আনন্দের কাজ।




শুয়ে পড়লাম ঘুমিয়ে পড়ার জন্যে নয় কিংবা একটু বিশ্রাম নিয়ে নেব, তার জন্যেও নয়—শুধু ভাববার সুবিধে হবে বলেই শুয়েছি। মজার ব্যাপার, তারই মধ্যে কখন যে চোখের পাতাদুটো বুজে এসেছে, একটুও বুঝতে পারিনি। সে অবশ্য বেশিক্ষণ নয়; হঠাৎ টের পেলাম, কখন যেন বেলা সোয়া একটা বেজে গেছে—প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেছে কোনদিক দিয়ে! সময় ফুরোতে সময়ই লাগে না!




যেভাবেই হোক, জেগে যে পড়েছি, সে কিন্তু বড়ো ভয়ে ভয়ে—এ কী! এত সব কাজ পড়ে রয়েছে, আর আমি এমন দিনে-দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লাম? যাঃ! সর্বনাশ হয়ে গেল!—এই আর কি ভাবখানা! কিন্তু ঘুমটাকে আবার সর্বনাশ বলেই-বা ভাবি কী করে? কারণ এখনও যে চোখে-মুখে আমার সেই ঘুমের সুখ জড়িয়ে রয়েছে। আহা! বড়ো শান্তি, বড়ো তৃপ্তি! মনে হচ্ছে, এমন ঘুম যেন আমি জীবনে কখনও ঘুমাইনি! এমন অবশ্য আরও বহুবার মনে হয়েছে। জীবনের প্রতিটি ভালো ঘুম‌ই যেন প্রথম ভালো ঘুম।




তাই বলে আরও খানিকক্ষণ যে শুয়ে থাকব—কাজ-কর্ম নাহয় না-ই হবে—সেটি হবার আর জো নেই। কেন নেই, বলছি।




কিন্তু তার আগে আর-একটা কথা বলে নিই—আচ্ছা, কেউ যদি ভোর-সকালে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠেই দেখে যে, তার ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, আসন-বসন, তার বিশ্বসংসার সব একবারে সোনা হয়ে গেছে—তাহলে কেমন হয়? আনন্দ রাখার তার তখন জায়গা থাকে না, নয় কি? সোনার আনন্দ বড়ো আনন্দ!




আমারও ঠিক তা-ই হলো—আনন্দ রাখার আর জায়গা ছিল না। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠেই দেখছি কী—জীবনটা আমার কেমন করে ভারি মিষ্টি হয়ে গেছে। সত্যি সত্যি, জীবনের যেখানে যা-কিছু ছিল—আমার হাসি-কান্না, আশা-আনন্দ, কর্ম-চিন্তা, আধি-ব্যাধি—সব একবারে মিষ্টি হয়ে গেছে। কাজেই এমন মিষ্টি-হওয়া জীবনটা নিয়ে আমি আর কেমন করে শুয়ে থাকি? তাই বাধ্য হয়েই উঠে পড়তে হলো।




এবার আগের একটা ঘটনা স্মরণ করতেই মনে পড়ে গেল, ওই মিষ্টতা আমি গভীর ঘুমের মধ্যেও এতক্ষণ ধরে উপভোগ করছিলাম। সে কারণেই বোধ হয়, ঘুম ভাঙার পর শয্যাত্যাগ করতে এত কষ্ট হচ্ছিল। নিজেকে নিজেই তাই বলছিলাম, "আচ্ছা, এই যে আমার বিশ্বভুবন এমন করে মধুময় হয়ে উঠল—সে মধু'র উৎস কোথায়? কোথা থেকে আসছে এমন মনকেমন-করা মধু?" এসব ভেবে ভেবে ব্যাকুল হয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই মধুর উৎসকে।




দেহ-মন-প্রাণের রাজপথ, অলিগলি, অন্দর-বাহির, যেখানে যা-কিছু ছিল, সব তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেললাম; আমার সুখ-দুঃখের মধ্যে তাকে খুঁজলাম, আমার অতীত-বর্তমানের প্রাপ্তির মধ্যে তাকে খুঁজলাম। কিন্তু না, কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে; বাইরে কোথাও পড়ে নেই সেই মধুর উৎস!




তবু শয্যা আমাকে ছাড়তেই হলো শেষ পর্যন্ত। কারণ অত খোঁজাখুঁজির পরিশ্রমে গলাটা আমার কেমন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। একটু জলপান করে গলাটা তাই ভিজিয়ে নিলাম। তারপর বাথরুমে গিয়ে এক বালতি জল ভরে নিয়ে এসে ফুলগাছের টবে ঢেলে দিলাম।




এসব কাজ কিন্তু একটুও খেয়ালের বশে, কিংবা মনের বর্তমান প্রেরণায় করিনি। শোবার আগে দেখেছিলাম, উঠোনের মাঝখানে লাল জবাফুলের গাছটা দুপুরের কড়া রোদে কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিল। একটু জল দেবার জন্যে গাছটা আমাকে বারবার কাতর মিনতি জানাচ্ছিল। তখনই সেটাতে জল দেবার জন্যে মনে মনে সংকল্প করেছিলাম এবং দিতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ অবধি জল দেওয়া আর হয়ে উঠল না। কেন? ওই যে বললাম, আমার অনেক কাজের তাড়া ছিল; সেই কাজের তাগাদা আমাকে কোনো কাজই সম্পূর্ণ করতে দিল না। অত কাজ মাথায় একসাথে ঘুরলে ঘুমিয়ে পড়ব না তো আর কী করব?




ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জেগে উঠতেই আগের সেই সংকল্পের কথাটিই সবার আগে মনে পড়ল। তাই আর কালবিলম্ব না করে সেই জল-দেওয়ার কাজটি পূরণ করলাম। তারপর, গাছের গোড়ার দিকে ছোট্ট একটা ডাল কীভাবে যেন ভেঙে গিয়েছিল—সবুজ গাছের সঙ্গে প্রাণহীন বিবর্ণ পাতাগুলো আজ চোখে বড়ো বেমানান লাগছে। কয়েক দিন থেকেই অপেক্ষা করে ছিলাম…যদি কোনোরকমে সেটা বেঁচে ওঠে…কিন্তু তা হবার নয় দেখে ডালটি ছেঁটে গাছটিকে সুন্দর করে তুললাম। ভাবতে এবার আনন্দ লাগল যে, একদিন এই শাখাটিরই স্থানে ভাবীকালের সম্ভাবনাপূর্ণ আর-একটি কিশলয়ের আবির্ভাব ঘটবে।




কিন্তু এই যে এতসব সুন্দর সুন্দর কাজ করে চলেছি, তবুও আমার ভেতরের ব্যাকুলতা কিছুতেই ঘুচতে চাইছে না, কর্মের আনন্দে অন্তরটা কিছুতেই পূর্ণ হয়ে উঠছে না। কেবলই মনে হচ্ছে, এসব কাজ নয়, অন্য একটা, কী যেন আর-একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার রয়েছে। সবসময়ই এমন হয়। শুধুই মনে হয়, কী একটা জরুরি কাজ করা বাকি থেকে যাচ্ছে। জীবনের সেই বিশেষ কাজটাই সবার আগে করা প্রয়োজন! কিন্তু সেটা কোন কাজ? সেই বিশেষ কাজটাই যে এখনও মনে আনতে পারছি না! আমার সব কাজই বোধ হয় অজরুরি কাজ!




মাঝখান থেকে আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি। ওদিকে আমার কত কাজ পড়ে রয়েছে, তার ঠিক আছে? অথচ এমন তাড়াহুড়োর সময়ে কিনা শুধু শুধু বাজে কাজে, বাজে চিন্তায় সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! হঠাৎ মনে হলো, প্রয়োজনীয় কাজ বলতে যা বোঝায়, সেরকম কাজ আমার কিছুই নেই। মেঘদূত-এর যক্ষের অমূলক বিরহের মতো আমার সমস্ত কাজের কথাটা নিছকই বাজে কথা! তা না হলে, যে-প্রিয়র পথ চেয়ে মানুষ বসে থাকে, সেই প্রিয় যখন এসে উপস্থিত হয়, তখন যে-কোনো মানুষই প্রয়োজনের কাজকে ভুলতে পারে। আমিও পারতাম— স্টোর পরিষ্কার, সেলাই, লেখাপড়া ইত্যাদি সব প্রয়োজনীয় কাজকে দূরে ছুড়ে ফেলতে পারতাম আমিও!




আসলে, কোনো কাজ নয়; আমার অন্তরের মধ্যেই রয়েছে এক সৃষ্টিছাড়া ব্যাকুলতা। কী যেন করতে হবে; যা করছি, তার চেয়ে জরুরি কী যেন করা হচ্ছে না; আমি বোধ হয় ভুল কাজটি করে চলেছি দিনের পর দিন—এমন সব অস্থিরতা কিছুতেই কখনও কাটে না। কাজ-কর্ম করছি, কিন্তু সেই ব্যাকুলতা একটুও স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে না; অন্তরের গভীরে হু-হু করে জ্বলছে অনির্বাণ হোমশিখার মতো। এই ব্যাকুলতা যে কিছু-একটা করতেই হবে, শুধু তারই জন্যে—তা কিন্তু ঠিক নয়; সকল সত্তা ব্যেপে ওই যে বিপুল আনন্দ এল, তাকে দিয়ে তেমন কিছুই করিয়ে নেবার নেই, তারই জন্যে এ ব্যাকুলতা। কিংবা আরও সত্য করে বললে বলতে হয়—এ ব্যাকুলতা আমার নিজের নয়, স্থূল জড় দেহ-মন-প্রাণের। তারা তাদের সবটুকু অস্তিত্ব দিয়ে ওই বিপুল আনন্দকে ধারণ করতে পারছে না, তাই সেই আনন্দ পরিপূর্ণরূপে আনন্দ হয়ে উঠতেই পারছে না। আর তারই জন্যে এসেছে যত ব্যাকুলতা! জগতের চারিদিকে এত এত আনন্দ, আমি সেই আনন্দে গা ভাসাতে পারছি না—এর চেয়ে বড়ো অসহায়ত্ব আর হয়?




এই গোপন কথাটাই এতক্ষণ ধরে আমি বুঝতে পারছিলাম না। এবার মনে হলো, পেয়েছি সেই কাজের সন্ধান, যার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম—আমাকে আকাশ হতে হবে, ওই আনন্দকে ধারণ করে বৃহৎ হতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো কাজ আমার নেই। মুক্ত হতে না পারলে আনন্দ উপভোগ করব কীভাবে? ওই আনন্দ দিয়ে আমার দৈনন্দিন জীবনের কোনো প্রয়োজনই সাধিত হবে না, আমার সকল প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের অনেক ঊর্ধ্বে সেই আনন্দ।




তাই এবার ফুলগাছের পরিচর্যার কাজটি শেষ করে রৌদ্রতপ্ত নৈঃশব্দ্যমুখর মধ্যাহ্নে ঘরের কোণে টেবিলের সামনে এসে বসে রইলাম। বসে থাকতে থাকতে লক্ষ্য করলাম—আমার চারিদিকের পৃথিবী ধীরে ধীরে মূক-বধির হয়ে উঠছে। এ যেন আমার সেই চিরপরিচিত পৃথিবী নয়, এ পৃথিবী পশুপাখি-জনমানবশূন্য ধু-ধু বিজন বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আর আমি তারই মাঝে একা একা বসে রয়েছি। আমার ডানে-বামে, সামনে-পেছনে প্রতিবেশীদের সশব্দ কোলাহলকে, জীবনের সমস্ত উচ্ছল প্রকাশকে ছাপিয়ে, কেমন করে জানি না, সেই বিপুল তীব্র নৈঃশব্দ্যতার অনুভূতি সংগোপনে এসে আমার বুকের গভীরে এক অনাস্বাদিত সুখের সুচ ফুটিয়ে দিয়ে যাচ্ছে! যে-সুখে কখনোই ভাসিনি, তা না পাবার দুঃখ কেন এত তীব্র? সত্যিই কি আমি ওদের চেয়ে দুঃখী?




আমি যেন কারও জন্যে, কীসের আশায় অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জেগে বসে রয়েছি—এই অপেক্ষা করে থাকার আনন্দই পথের সব কষ্টকে, সব প্রয়োজনীয় কর্মকে ভুলিয়ে দিয়ে পাহাড়ের চূড়ার মতো আমাকে নিঃস্পন্দ ঊর্ধ্বমুখী করে রাখছে...আমি জানিই না, আমি কার জন্য বা কীসের জন্য অপেক্ষা করে আছি। বারবারই শুধু মনে হয়…কী যেন নেই, কে যেন নেই…আমার জীবনটাই কীরকম জানি 'নেই'ময় হয়ে উঠেছে। এত 'নেই'য়ের মধ্যে যার বাস, তার জীবনে মধুসুর এলেই-বা কী!




কিন্তু ওই যে…ওই আবার তীব্রবেগে এসে পড়ল সেই সব কিছুই মিষ্টি হয়ে যাওয়ার আনন্দ…মিষ্টি হওয়ার আনন্দ ক্ষণে ক্ষণে নূতন রূপে উপস্থিত হয়ে আমাকে বারবার উতলা করে তুলতে চাইছে। সেই আনন্দ আমাকে আর-একটু আরাম করে ঘুমোতে দিল না; অন্য কিছু কাজ যে করব, তা-ও করতে দিল না। আমাকে শুধু জেগে বসে থাকতে হবে—এই তার একমাত্র দাবি, তাহলেই সে খুশি। অহর্নিশ আমাকে কেবল জাগিয়ে রাখাতেই তার আনন্দ। আর আমি যে তার এমন নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ করব, তাই-বা পারছি কোথায়? প্রতিবাদ করব কী! আমার এই স্থূল দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, প্রতিটি শারীরকোষ পর্যন্ত যে মধুময় হয়ে গেছে! তা ছাড়া, আরও আশ্চর্য কী—এই রকম মধুময় হওয়া ছাড়া দেহটিরও যেন আর কিছু কামনা নেই, অন্য কোনো গৌরব নেই।




এখন এই জড়ভৌতিক দেহটার পর্যন্ত কোনো ক্রিয়া নেই, চাঞ্চল্য নেই; সকল চঞ্চলতা তার কখন যেন থেমে গেছে, রয়েছে শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদুমন্দ ক্রিয়া। যেখানে হাত-পা দুটো রাখা ছিল, জড়পুত্তলিকার মতো ঠিক সেখানেই তারা এখনও রয়ে গেছে, একটু যে এদিক-ওদিক নড়াচড়া করব, তার পর্যন্ত সামর্থ্য নেই। আবার সামর্থ্য যদি-বা আসে, তবু আমায় নাড়াতে যে একটুআধটু চেষ্টা করবে, তার আর ইচ্ছেই হয় না। সে শুধু সমস্ত ক্রিয়া, সকল প্রয়াস স্তব্ধ করে দিয়ে মধু হয়ে উঠতে চায়। আরাম, শুধুই আরাম…কোথাও কোনো উদ্যম নেই, কোনো তাড়া নেই, পালিয়ে যাবার পথ নেই।




যে-শয্যাতে আমি শুয়েছিলাম, সে-ও যেমন মধুময় হয়ে ছিল, তেমনি শয্যা ছেড়ে উঠেও দেখি—সমস্ত ঘরময় সে মধু বিরাজ করছে। ওই যে সামনের দেয়ালটি, বইয়ের আলমারিটি, আর এই যে টেবিলের পাশে বসে আছি আমি, এইসব অনুভবের কথা সবই, সব কিছুই এখন মধুময় হয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে যে-বাতাসটুকু ঢুকেছিল, সে-ও মধু না হয়ে পারেনি। এখন আমি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গেও সেই মধু গ্রহণ করতে লাগলাম। চোখে চাইছি, স্পষ্ট অনুভব হচ্ছে—আমার সে-দৃষ্টিতেও অফুরন্ত ধারার মধু রয়েছে, চোখের দৃষ্টির যেন এখন আর কোনো ক্রিয়া নেই—শুধু সেই মধু ঝরানো ছাড়া। আর যদিই-বা কোনো ক্রিয়া থেকে থাকে তো…সে হলো, তার বহুদিনের পুরোনো অভ্যেসের জের টেনে চলা—তাতে না রয়েছে আমার বিশেষ মনোযোগ দেবার প্রয়োজন, আর না রয়েছে প্রয়াস করার সংকল্প। সেই ক্রিয়া হয়তো মধু ঝরানোর সঙ্গে পাশাপাশিভাবে আপনা হতেই চলছিল। পালাতে খুব ইচ্ছে করে—কিন্তু ইচ্ছেকে কেবলই ইচ্ছেতে রেখে দিলে এ জগতে কিছু হয় কি কখনো?




আজকের দিনটিও কেমন করে যেন একমুহূর্তে মিষ্টি হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে—অন্য সব কিছুর মতোই দিনটিরও মিষ্টতা অনুভব করা যায়। আজকের দিনটিও এভাবে কেটে যাক। আমার জরুরি কাজগুলি আরেক দিন হবে। মধ্যাহ্নে নিশ্চয়ই দিন আরম্ভ হয়নি—কখন সেই প্রভাত থেকে, কিংবা তারও অনেক আগে থেকে আজকের দিন আরম্ভ হয়েছে। অথচ দিনের যখন পূর্ণ যৌবন, তখনই এল এই মধুর অনুভব। এই কারণে, নিজের মনেই প্রশ্ন জাগছে—তাহলে দিনের সেই শৈশব-কৈশোরের অংশই-বা কেমন ছিল? আর আমার মনের অবস্থাই-বা তখন কেমন ছিল? অপূর্ণতার ভাবটাই তো তখনও আসেনি! তাহলে তখন জীবন শূন্য হবেই-বা কী করে? এসব দেখার কাজে স্মৃতিই একমাত্র দিশারী, স্মৃতির আলোতেই সেইসব দিনকে দেখতে হবে। কিন্তু সে স্মৃতিও যে মিষ্টি হয়ে গেছে। তাকে যেখানেই ফেলছি, রঙিন কাঁচ দিয়ে দেখার মতো সেখানেই আলোর পরিবর্তে দৃশ্যবস্তু শুধু মধু হয়ে ওঠে—শুষ্ক জ্ঞানের পরিবর্তে মধুরসে রসময় হয়ে ওঠে।




তাই দেখে অনুমান করছি—এখনও মধু, আগেও মধু; বর্তমান‌ও মধু, অতীতেও মধু! আবার গভীরে চেতনার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখছি, সে-ও মধু। চেতনার যে জীবন্ত জাগ্ৰত আশ্ৰয়, যেখান থেকে চেতনা বিকশিত হয়ে ওঠে, সে-ও মধুময়—যেন অমৃত! জীবন অমৃতের এক ভাণ্ড!




আজকের দিনে তাই অন্তরে প্রার্থনা জাগছে—জীবনের সবকটি দিন এমনই মধুময় হয়ে যাক। সারাপৃথিবীই এ মধুতে ভরে উঠুক। সকল মানুষের জীবন এমনই সুন্দর হয়ে উঠুক। আকাশ-বাতাস মধুময় হোক। মধুময় হোক এই পার্থিব যাপন। এখন ভালো থাকি, পরে যা হয় হোক!