জটিলার (মায়ার) জ্বালা (তাড়না), কুটিলার (মোহের) কুটিল শাসন (আচ্ছন্ন বা আবদ্ধ করে রাখা), আয়ানের (অহংয়ের) কঠিন প্রতিপত্তি (আত্মবিস্মৃত করে আত্মজ্ঞানার্জনের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা) এবং সমাজবন্ধন (মায়ার বাঁধন) ধ্বংস করেও যখন শ্রীরাধার (জীবাত্মা বা মানবাত্মার) মন কেবলই কদমতলার (বিষ্ণুর পরমধামের বা মোক্ষাবস্থার) শ্রীকৃষ্ণের (ব্রহ্মের বা পরমাত্মার) দিকে একান্তভাবে (পেছনের সকল বন্ধন, রিপুর টান, ইন্দ্রিয়ের তাড়নাকে উপেক্ষা করে) ছুটে যেতে চাইল, তখনই এসে জুটল বৃন্দাদূতী (চৈতন্য) এবং বৃন্দার আগমনের অল্প সময়ের মধ্যে এল একে একে বিশাখা-সহ নয় সখী (ভক্তি—শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ এবং অন্যান্য ভক্তিশাস্ত্রে উল্লেখ থাকা নববিধা ভক্তি: শ্রবণ (পরীক্ষিত), কীর্তন (মীরাবাঈ), স্মরণ (প্রহ্লাদ), অর্চন (পৃথু), পদসেবন (লক্ষ্মীদেবী), দাস (হনুমান), সখাত্ব (অর্জুন), বন্দন (অক্রূর) এবং আত্মনিবেদন (বলি মহারাজ))।
সেই বৃন্দা-সহ সখীদের সাহায্যে এবং বহু উপায়ে যোগাযোগের (সাধনার পথ নির্ধারণের ঐকান্তিক প্রয়াসের) পর, বহুবার মিলন-বিচ্ছেদের (সাধনার সঠিক ও ভুল পথে পরিভ্রমণের) পর শ্রীরাধা যখন পূর্ণমিলন (পরমাত্মায় লীন বা ব্রহ্মময় হতে চাওয়া) চাইতে লাগলেন, তখনই তাঁর বিরহজ্বালা (সংসারযাতনা ও নানান পিছুটান) আরও শতগুণে বেড়ে চলল। সেই সীমাহীন অনন্ত বিরহজ্বালায় জ্বলে (সাধনার পথে সৃষ্ট বাধাসমূহে আটকে গিয়ে), কত আশা-নিরাশা'র (পরমাত্মার আভাস পাওয়া এবং পরক্ষণেই ধৈর্যের অভাবে তা হারিয়ে ফেলা) মধ্য দিয়ে বহুদিন বহুরকমের সঙ্কেত (সাধনাসূত্র বা পথের নকশা) পেয়ে, নানাপ্রকারে খুঁজে ও নানারূপে বুঝে (সাধনার রাস্তায় ঠকে ও ঠেকে হাঁটা) একদিন ঘোররাত্রে (অসীম কষ্টভোগের মধ্য দিয়ে সাধনার সর্বোচ্চ স্তরের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে) তিনি সেই প্রিয় কদমতলার পথের সন্ধান পেলেন।
একে বনের পথ (যে অভিনব কিন্তু কাম্য পথে চলার কৌশল অনভিজ্ঞ পথিক জানেন না), তার উপর ঘোররাত্রি। ঝড়-বৃষ্টির পরে (সাধনভজনের কষ্টভোগের পরে) পথ বড়োই পিচ্ছিল (যে-কোনো মুহূর্তে পদস্খলন হয়ে সব শেষ হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাযুক্ত); কঙ্কর আর কাঁটার (আশেপাশের নানান বাধা ও প্রলোভনের) যেন অভাব নেই! চলাই যেন যায় না (সাধনার পথ বড়োই কঠিন ও অভিনব, তাই শুরুতে অবসাদ ও নিরুৎসাহ আসাটাই স্বাভাবিক); আর শ্রীকৃষ্ণ-দর্শন (আত্মজ্ঞানলাভ) হলো না ভেবে রাধা ও বৃন্দা-সহ সখীরা (চৈতন্য ও ভক্তির সম্মিলিত ভাব) সবাই "ত্রাহি মাং মধুসূদন! ভগবন্ নন্দনন্দন! আমাদের এই বাধাবিপদ হতে উদ্ধার করো।"—বলে কাতরস্বরে (মোক্ষাবস্থায় পৌঁছানোর জন্য আকুতি) প্রার্থনা করলেন। তার পরেই মোহনবাঁশির (ব্রহ্মপ্রেমের) সুর শুনতে পেলেন (মোক্ষলাভের সন্নিকটে পৌঁছে গেলেন)। শ্রীরাধা ও বৃন্দাদূতী-সহ সকলেই একে একে সেই প্রিয়তমের (পরমকাঙ্ক্ষিত পরমাত্মার) বাঁশির সুর (পরমাত্মার প্রকট প্রকাশ-লক্ষণ) লক্ষ্য করে ছুটে চললেন।
অসংখ্য কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত (কঠোর সাধনায় অবসন্ন ও পরিশ্রান্ত) হয়ে, কতই-না হোঁচট ও আছাড় খেয়ে (ক্রমাগত ঠকে ও ঠেকে নিজেকে তৈরি করে) শ্রীরাধার সাথে সকলে (জীবাত্মার সকল অনুষঙ্গ বা বন্ধু, যা যা ব্রহ্মজ্ঞানলাভের সহায়ক) শ্রীকৃষ্ণ-দর্শন পেলেন। নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণও আনন্দে-উৎসাহে (জীবাত্মার একাগ্র সাধনায় তুষ্ট হয়ে) সখিদের (জীবাত্মার সাধনাপথে সবসময়ই সাথে থেকে সহায়তা করেছেন যাঁরা) বলে উঠলেন, "হে সখিগণ! এই ঘোর ভয়ঙ্কর রাত্রে কীজন্য এসেছ (কেন বা কীসের আশায় এত ত্যাগস্বীকার করে সাধনা করেছ)? আর কার জন্যই-বা (সগুণ জীবাত্মার কোন বাসনা বা গুণকে তৃপ্ত করতে) তোমরা এসেছ বলো; কী চাই, তা-ও বলো; আজ আমি তোমাদের সবই (জীবাত্মা ও তাঁর অনুষঙ্গসমূহের অধিকার বা প্রস্তুতি অনুসারে ভগবান যাঁকে যতটা দেবেন) দিতে প্রস্তুত আছি।"
সকলেই মৃদু হাসলেন এবং বৃন্দাদূতী বলে উঠলেন, "হে কৃষ্ণ! নিজের বলতে তোমার কী আছে যে, তুমি তা আমাদেরকে দান করবে, বলো? (ব্রহ্ম বা পরমাত্মা তো কিছু দান করতে পারেন না, কেবলই নিজের প্রকাশ বা অস্তিত্বের জানান দিতে পারেন জীবাত্মায় তথা চৈতন্যে। তাঁর আছেই-বা কী যে, দান করবেন? তাঁর নেইই-বা কী যে, গ্রহণ করবেন?) তোমার যা-কিছু ছিল, সবই তো সকলে চেয়ে চেয়ে (বাহ্যিক সকল আবরণ (ষড়রিপু, পঞ্চেন্দ্রিয় ইত্যাদির তাড়না) সরিয়ে পরমাত্মাকে জানতে চেয়ে) তোমাকে একেবারে নিঃস্ব (নিরাকারত্ব বা সর্বময়ত্বের ভাবপ্রকাশের ফলে 'দানসামর্থ্যের প্রাসঙ্গিকতাহীন' অর্থে) করে দিয়েছে। তুমি তো কাঙাল, ভক্তের কাঙাল (প্রকৃত ব্রহ্মসাধকের সিদ্ধিদর্শনের জন্য সদাপ্রস্তুত)। এমনকী, যে-কেউই ডাকুক, তুমি তার (সকলের মধ্যেই—সর্বময় বিধায়) কাছেই সর্বদা হাজির থাকো—এতই পরাধীন (জীবাত্মা যখন ঈশ্বরচৈতন্য লাভ করেন, তখন পরমাত্মা আপনিই উদ্বোধিত হন) তুমি!"
পরে গর্বের সাথে (সাধনার পথে জীবাত্মার সঙ্গী হবার অহংকার) তাঁরা বললেন, "তবে হ্যাঁ, দিতে পারি (ভ্রান্তিময় অহং-প্রদর্শন করতে পারি—যাঁর বেলায় দান ও গ্রহণ দুই-ই অপ্রাসঙ্গিক, তাঁকে এমন করে বলা ফাঁপা অহংয়ের মূঢ় প্রদর্শন ছাড়া আর কী!) কিছু আমরা, কারণ আমাদের কিছু (আমিত্ব ও অহংকার) আছে। কিন্তু তোমার কী আছে (এভাবেই জীবাত্মা ব্রহ্মজ্ঞানের দোরগোড়ায় পৌঁছেও তা লাভ করতে ব্যর্থ হন রিপু ও ইন্দ্রিয়তাড়নার প্রভাবে—তবে এরও প্রয়োজন আছে। জীবাত্মা ও চৈতন্যাদি ভুল থেকেই শেখে, ভুল তাই এখানে মহান গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ। এমন গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন ক্রোধ, লোভ, মোহ, দম্ভ, দর্প, কষ্ট, অনুশোচনা, দুঃখ, শোক, কাম-সহ যে-কোনো প্রবৃত্তি, অভিজ্ঞতা, অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতা, বিশ্বাস, ধারণা ইত্যাদি। যে-পথ বাধার সৃষ্টি করে, তা-ও গুরু; কেননা তার কল্যাণেই, কেমন পথে যাওয়া যাবে না, সে সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা যায়। গীতা, বাইবেল, উপনিষদ, কথামৃত, ধম্মপদ, কুরআন প্রভৃতি গ্রন্থ একেকটি মহান গ্রন্থ-গুরু। তবে সবচাইতে মহান গুরুর নাম দুঃখ বা দুঃখ-গুরু।) যে দেবে, বলো? হে কৃষ্ণ! আমরা কিছুই নিতে আসিনি, আমরা আমাদের সব কিছু দিতেই এসেছি। (ভগবানের কাছে যে-নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়—তার প্রয়োজন ভগবানের নেই, তবে ভক্তের আছে। ভক্ত তাঁর নিজের প্রয়োজনেই ভগবানের পায়ে নৈবেদ্য নিবেদন করেন। জীবাত্মা নিজের জন্যই পরমাত্মাপ্রাপ্তির সাধনা করেন। তাই এমন সাধনায় যা-কিছু অর্জন, তার সবই জীবাত্মার, পরমাত্মার নয়—এই মহাসত্যটি বুঝতে না পেরেই তাঁরা এভাবে বলছেন। ভগবানকে ভক্ত যা নিবেদন করেন, প্রকৃত বিচারে ভক্ত তা নিজেকেই নিবেদন করেন। ভগবানের ঘর মন্দিরে নয়, ভক্তের অন্তরে। যাঁর ভগবান মন্দিরে, তাঁর ভগবান কোথাও নেই।)"
যা-ই হোক, সবাই সমান সম্মান (নিজ নিজ অবদানের বা ভূমিকার স্বীকৃতি) পেলেন, কিন্তু সবাইকে ছেড়ে দিয়ে (মায়া, মোহ, অহং, চৈতন্য ইত্যাদিকে স্বাভাবিকভাবেই ছেড়ে দিয়ে কেবলই জীবাত্মাকে সঙ্গে নিয়ে—তুলনীয়: রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী' কবিতার মূলভাবটি) শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে নিয়ে সেই বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে (হৃদয়ের গভীরে, নিজের সাথে নিভৃত কথোপকথনের জন্য) লুকিয়ে (জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের উদ্দেশ্যে) গেলেন। আর সবাই খুঁজতে লাগলেন, কাঁদতে লাগলেন; কিন্তু কোথাও আর রাধা-কৃষ্ণের দেখা পাচ্ছেন না (জীবাত্মা যখন পরমাত্মার সাথে মিলিত হবার অভিপ্রায়ে ছোটেন, তখন সমস্ত অহং-মায়াকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখেন)।
এদিকে শ্রীরাধার মনে কিন্তু ক্রমশ অহংকার এসে জুটল। ধীরে ধীরে তাঁর মনে হতে লাগল—"সবচাইতে আমিই বড়ো, তা না হলে বাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে একা আমাকে নিয়ে বৃন্দাবননাথ শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে সানন্দে বিহার করবেন কেন? কেনই-বা আমার এত অনুগত হবেন? আমি নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ হয়েছি, আর তাই কৃষ্ণ আমারই অনুগত দাসানুদাস। (পরমাত্মা জীবাত্মার ভেতরেই থাকেন ব্রহ্মরূপে। বাহ্যিক আবরণগুলি মুক্ত না হলে জীবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিত হতে পারেন না। যদি একটাও আবরণ অজ্ঞানের ('জানা নেই' অর্থে) কারণে রয়ে যায়, তাহলে পরব্রহ্মের সাক্ষাৎ ('অনুভব' অর্থে) মেলে না। ব্রহ্মের ধারণা বা প্রকৃতি বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাহ্যিক সমস্ত আবরণকে দূরে সরিয়ে রাখার স্তরে উন্নীত হবার কাজটি জীবাত্মাকেই করতে হয়, পরমাত্মার এখানে কোনো ভূমিকা নেই—তিনি নির্বিকার, নির্গুণ, নিরুপাধিক, নিশ্চল—এটি উপলব্ধ না হলে পরমাত্মা বা ব্রহ্মের জ্ঞান হওয়া সম্ভব নয়।"
এসব ভেবে তিনি আরাম করে শ্রীকৃষ্ণকে আদেশ করেন—ওই ফুলটা নেব, এই ফলটা নেব…তুলে দাও—এরকম বলতে বলতে একসময় বলে ফেললেন—আর চলতে পারি না, বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমার যদি সঙ্গে নিতে ইচ্ছে হয়, তাহলে কাঁধে করে বহন করো।" (ভগবান ভক্তকে বহন করেন তখনই, যখন ভক্ত নিজেকে ভগবানের পায়ে সমর্পিত করার যোগ্যতা লাভ করেন। অজ্ঞানের কারণে ভক্ত শুরুতে এটা ধরতে পারেন না।)
কৃষ্ণ কাঁধ পেতে দিয়ে বললেন—"এসো।" রাধা যেই কাঁধে চড়তে যাবেন…দেখলেন, কৃষ্ণ নেই! কৃষ্ণ কোথায়? কৃষ্ণ কোথায়, কার মধ্যে লুকোলেন, রাধা তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না। (পরমাত্মা জীবাত্মার মধ্যেই অবস্থান করেন। তাই জীবাত্মাকে সেই সত্তা কী করে বহন করবেন বা জীবাত্মার আদেশ-নির্দেশ পালন করবেন, যিনি জীবাত্মার মধ্যেই আছেন? পরমাত্মা যে সর্বব্যাপী হয়েও নিশ্চল, তবে তিনি কী করে জীবাত্মার দাস হবেন? পরমাত্মা জীবের তথা আত্মার মধ্যেই স্থির হয়ে আছেন—জীব তা টের পেলেও আছেন, টের না পেলেও আছেন। 'কৃষ্ণ কাঁধ পেতে দিচ্ছেন' মানে জীবাত্মাকে জীবাত্মাই কাঁধ পেতে দিচ্ছেন—সেখানে পরমাত্মা নেই, থাকলে নিশ্চল-নির্বিকার-নির্গুণ পরমাত্মা কাঁধ পেতে দিতে পারতেন না। এখানে, পরমাত্মার সাথে মিলিত হবার জন্য নিজেকে পুরোপুরি আবরণমুক্ত করতেই পারেননি জীবাত্মা। তাহলে নিজেরই কাঁধে জীবাত্মা চড়বেন কীভাবে?)
চারদিক শূন্য (কেননা পরমাত্মার অনুভূতি জীবাত্মা নিজের পরাজ্ঞানের অভাবেই হারিয়ে ফেলেছেন) দেখে আবার সেই বিরহজ্বালায় জ্বলতে লাগলেন। সেই জ্বালায় নিজেকে ধিক্কার দিয়ে (সামান্য ভুলের কারণে এতদিনের সাধনা নিষ্ফল হয়ে যাবার তীব্র অনুশোচনায়) আছাড় খেয়ে পড়ে শ্রীরাধা আর্তনাদে (যে-ভুলের সমস্ত দায় কেবলই নিজের, তা মেনে নেবার ক্ষমতা জীবাত্মার শুরুতে থাকে না, তাই এমন আর্তনাদ) কেঁদে উঠলেন—ওঠার আর শক্তি তাঁর নেই (পরমাত্মা আবারও অন্তরে অন্তর্হিত হলেন বিধায় জীবাত্মাকে তাঁর অভিমুখে পরিচালনা করার জন্য তো তিনি নিজেই সেখানে ছিলেন না)।
ঠিক সেসময় সখীরাও কৃষ্ণকে খুঁজছিলেন (জীবাত্মা সঠিক পথে না চললে চৈতন্যাদি স্বাভাবিকভাবেই পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে); তাঁরা সেখানে এসে রাধার দুরবস্থা দেখলেন। (চৈতন্য, মোহ, মায়া ইত্যাদি সবাই মিলে পরমাত্মার দিকে জীবাত্মাকে পরিচালিত করার জন্য যথার্থ পথে চলার উপক্রম করলেও জীবাত্মাকে তাঁরা হতোদ্যম অবস্থায় দেখতে পেলেন।) রাধাকে দেখে সকলেই দুঃখ পেলেন ও রাধাকে ধরে ওঠালেন। (ওই সকল সত্তা মিলে জীবাত্মাকে আবারও সচল ও স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন—যা মূলত অনুতপ্ত জীব নিজেই করছেন।) রাধা-সহ সকলে মিলে আবার খুঁজতে আরম্ভ করলেন। (সাধনারসে জারিত হয়ে জীবাত্মা আবার শুরু করলেন পরমাত্মার সাথে যুক্ত হবার জন্য সাধনভজন।)
দুর্গম বন; ঘন অন্ধকার রাত্রে অবলা হিসেবে পরিচিত সেই নারীরা কোনো ভয় করেননি, মনে কোনো দ্বিধা বা চিন্তা রাখেননি। (গীতায়ও বলা হয়েছে যে, সাধক যখন জেনে ও বুঝে যান, কীভাবে সাধনা করতে হবে, তখন কখনো সাধনার পথ থেকে বিচ্যুত হলেও আবার সাধনার পথে ফিরতে বেশি বেগ পেতে হয় না। এখানে জীবাত্মা তো জেনেই গেছেন, কীভাবে সাধনার সুকঠিন পথে চলতে হবে। তাই তাঁর পক্ষে নিজেকে এবং নিজের অন্তর্সত্তাগুলিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাটা খুব শক্ত নয়।)
নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণ—সেই রাধাবল্লভ, সেই গোপীবল্লভকে না পেয়ে সকলে কাতরস্বরে ডেকে উঠলেন, "হে কৃষ্ণ! কোথায় তুমি?" গোপীদের ব্যাকুল আহ্বানে (কঠোর সাধনার ফলশ্রুতিতে) পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ আবার এসে দেখা দিলেন। সকলেই আবার মহানন্দে নেচে উঠলেন। কত মান-অভিমানের কথা চলল, কত ন্যায়-অন্যায়ের বিচার হলো (সাধকের সাধনায় সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগে, যদি পূর্বের ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয় এবং সঠিক পথ অনুসরণ করা হয়। জীবাত্মা আবারও সাধনার মাধ্যমে পরমাত্মার নিকটবর্তী হতে পেরেছেন। পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সেটি কাজে লাগানোর ফলে পরমাত্মাকে জীবাত্মা ভুল করে অবগুণ্ঠিত করে ফেলেননি। অতীতের ভুল থেকেই বর্তমানের সঠিক পথের বিচার ও সিদ্ধান্ত সম্পন্ন হলো।); পরে বৃন্দাদূতী বলে উঠলেন, "হে নন্দরাজনন্দন! বৃন্দাবনরাজ! রাখালরাজ শ্রীকৃষ্ণ! আজ সত্যিই বিচার করে (চৈতন্যের যাত্রা সবসময়ই সত্যের অভিমুখে।) বলো দেখি, কেমন লোক একজন অপরজনকে ভজনা করলে সে-ও তাকে ভজনা করে? আর তার বিপরীতই-বা কেমন লোক করে? আর কেউ কাউকে ভজনা করলেও কোনজন ভজনা করে না—তা-ও বলো।"
বৃন্দাদূতীর প্রশ্নে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কিছুক্ষণ চিন্তা (পরমাত্মায় পৌঁছোনোর বা পরমাত্মার সাথে মিলনের ঠিক আগমুহূর্তে জীবাত্মা মন ও বুদ্ধির সাহায্যে ভাবলেন—অবস্থাদৃষ্টে যেটিকে পরমাত্মার ভাবনা বলেই ভ্রম হচ্ছে।) করে বললেন, "সখি! পারস্পরিক স্বার্থ (পরমাত্মারূপী শ্রীকৃষ্ণ যখন জীবাত্মারূপী শ্রীরাধা (বা গীতায় অর্জুনকে) ভক্ত বা অনুরাগিণী (বা শিষ্য বা সখা) হিসেবে জাগিয়ে নিজে গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। গুরুর উৎকর্ষসাধন শিষ্যের উৎকর্ষ-অর্জনের চেষ্টার উপর নির্ভর করে। যোগ্য শিষ্যের জোরেই যোগ্য গুরুর আবির্ভাব হয়। এখানে জীবাত্মা নিজের প্রয়োজনেই পরমাত্মাকে প্রকাশ করছেন। পরমাত্মা নিজেকে প্রকাশ করছেন না, তবে জীবাত্মার ভেতরে তাঁকে পাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগছে তিনি আছেন বলেই।) থাকলেই পরস্পর ভজনা করে থাকে। এতে ধর্ম বা সৌহার্দ্য থাকে না; স্বার্থই একমাত্র উদ্দেশ্য। (পরমাত্মার সাথে মিলিত হবার জন্যই জীবাত্মা এত সাধনা করেন। এখানে ধর্মাচরণ, সৌহার্দ্যরক্ষা, পুণ্যবান হওয়া—এরকম কোনো ভাবনাই জীবাত্মার মধ্যে থাকে না। মা সন্তানকে স্নেহ দিয়ে বড়ো করেন নিজে আনন্দ বা তৃপ্তি পান বলেই—এটি ধর্ম নয়, স্বার্থ।)
তাঁদের (জীবাত্মা ও তাঁর অনুষঙ্গসমূহের) এই ভজনাও দুই প্রকার—যেমন পিতা-মাতা: প্রথমত দয়ালু, দ্বিতীয়ত স্নেহময়। প্রথম গুণটি দ্বারা দয়ালু ব্যক্তিগণ নিষ্কৃতি ধর্মলাভ করেন, আর স্নেহময় ব্যক্তিগণ সৌহার্দ্য পান। এই ভজনার ফলে আনন্দধর্ম ও সৌহার্দ্যধর্ম দুই-ই আছে। (জীবাত্মার জন্য যা নিষ্কৃতি, তাঁর সঙ্গী তথা চৈতন্য, বুদ্ধি, মন, বিবেক, মোহ, মায়া ইত্যাদি সত্তার জন্য তা-ই সৌহার্দ্য। পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়ে গেলে জীবাত্মা মুক্তি পান, আর চৈতন্যাদি পান জীবাত্মাকে সাধনায় বন্ধুর মতো করে সাহায্য করার অনাবিল আনন্দ। সকল জীবের মধ্যেই ব্রহ্ম বিরাজ করছেন পরমাত্মা রূপে। এই পরমাত্মার শাশ্বত উপস্থিতির ধরন সম্পর্কে জীবাত্মা যেভাবে বোধপ্রাপ্ত হন বা বোঝেন, ঠিক সেভাবেই জীবাত্মা তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বা সময়মতো ফেলে রেখে পরমাত্মার দিকে ধাবিত হন। ঠিক একইভাবে, মাতা-পিতা'র মেজাজ বা ধরন সন্তান যেভাবে বোঝে, ঠিক সেভাবেই তাঁদের কাছ থেকে দয়া বা স্নেহ আদায় করে নেবার স্বার্থে নিজেকে ওরকম করেই পরিচালিত বা উপস্থাপিত করে।)"
"আর যারা আত্মারাম ও আত্মকাম, অর্থাৎ চরমভাবে আত্মতৃপ্ত এবং গুরুদ্রোহী, তারা কাউকেও ভজনা করে না—তাদের কথা দূরেই থাকুক। হে সখি! যাদেরকে সবসময় ভজনা করলেও তারা কখনও ভজনা করে না, তাদের কথা বলি—তাদের মধ্যে একজন আমি (পরমপুরুষ)। আমাকে কেউ ভজনা করলেও আমি তাকে ভজনা করি না। এর কারণ এই যে, সে আমার চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে যাবে, আর অন্য কোনো চিন্তাই তার হৃদয়ে স্থান পাবে না। যেমন তোমরা ধর্মাধর্ম, লোক, সমাজ, জাতি, পরিবার, সন্তান—সমস্ত কিছুই পরিত্যাগ করে, একমাত্র আমাকেই লক্ষ করে ছুটে এসেছ।" (পরমাত্মাকে পাবার জন্য জীবাত্মা সাধনা করেন, কিন্তু পরমাত্মা বা ব্রহ্ম নির্গুণ, নিশ্চল, নির্বিকার বিধায় তিনি কারও সাধনা করার গুণরহিত। আত্মতৃপ্ত জীব পরমাত্মার সন্ধানে সাধনা করে না। তাই তাদের কথা বলেও-বা কী হবে? তারা তো সাধনার পথে যেতেই চায় না! কিন্তু জীবাত্মা যখন পরমাত্মার শাশ্বত উপস্থিতির জানান অনুভব করতে চান, তখন পরমাত্মার সাধনায় বারবার ব্যর্থ হলেও সাধনা পরিত্যাগ করেন না, কেননা পরমাত্মার প্রতি এই টান তাঁর মন ও বুদ্ধির পুরোটাই অধিকৃত করে ফেলে এবং তিনি শত কষ্ট সহ্য করেও সব ছেড়েছুড়ে পরমাত্মার অভিমুখেই ধাবিত হন।)
"হে প্রিয় সখি! আমি লুকিয়ে (নিরাকার অবস্থায়, কেননা তুমি জীবাত্মা আমাকে আবরণের মধ্যে ঢেকে অদৃশ্য করে রেখেছিলে) ছিলাম, সত্য। কিন্তু তোমাদের ডাকে আর লুকিয়ে থাকতে পারিলাম না। (তোমাদের ঐকান্তিক সাধনা আমাকে আবারও অনাবৃত ও প্রকাশিত করেছে।) আর তোমরা সেজন্য আমার প্রতি কোনোরূপ দোষারোপ কোরো না। (দোষ কখনোই অন্য কারও নয়, জীবাত্মা নিজের ফাঁদে নিজেই আটকে পড়ে মুক্তির জন্য ছটফট করে।) আজ হতে তোমাদের চারিদিক আমি ঘিরে থাকব। তোমরা যখনই যেদিকে তাকাবে—সব দিক, সব কিছুই আমিময় দেখবে। (পরমাত্মা সকল বস্তুতেই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন। তাঁর এই অস্তিত্ব টের পেতে জানতে হয়। এই জানাটাই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা। জীবাত্মা ক্রমাগত সাধনার মাধ্যমে রিপু-ইন্দ্রিয়াদি জয় করে সেই জ্ঞান লাভ করেন। তারপর থেকে সব দিকেই পরমাত্মার প্রকট অস্তিত্ব জীবাত্মা অনুভব করতে পারেন।)
আর এটাও আমি বলছি যে, তোমরা যে সুদৃঢ় গৃহশৃঙ্খল (বিষ্ণুমায়ার বন্ধন, মোহের পিছুটান, রিপুর তাড়না ইত্যাদি) ভেঙে আজ আমার সাথে মিলিত হয়েছ, এতে দোষ বা নিন্দার কিছুই নেই। আমি দেবতার পরমায়ু পেলেও তোমাদের এই আগমনের প্রত্যুপকার করতে পারব না। আমি যুগে যুগে তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম। এ ঋণ আমার আর শোধ হবার নয়। (ব্রহ্ম এই ঋণ শোধ করতে অক্ষম, কেননা তিনি নির্গুণ, নিরাকার, নিশ্চল। তিনি আছেন, এইটুকুই তাঁর পরিচয়। কারও জন্য কিছু করতে তিনি সক্ষম নন। তিনি সাক্ষীও নন, দ্রষ্টাও নন, স্রষ্টাও নন। তিনি সব জায়গাতেই আছেন, তবে তাঁকে কোনো সত্তাই ধারণ করতে পারে না। তিনি বাতাসের মতন। পাশ দিয়ে সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ যা-ই প্রবাহিত হোক না কেন, সেটার অংশ তিনি নন। আবার ওই দুইয়ের প্রবাহের উপরও তাঁর অস্তিত্ব নির্ভরশীল নয়। তিনি তাঁর জায়গাতেই আছেন, তাঁর সামনে অন্য কোনো সত্তা থাকুক বা না থাকুক। অন্য কোনো সত্তার থাকা না থাকার উপর ব্রহ্মের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব নির্ভর করে না।)"
শ্রীনন্দনন্দনের মুখে ওরকম সান্ত্বনাবাক্য (জীবাত্মার প্রতি আশ্বাস বা প্রেরণাবাণী, যা তাঁকে সাধনার পথেই রাখে) শুনে শ্রীরাধা-সহ সখীগণ বিরহহেতু সন্তাপ (অতীতের ভুলের কারণে মিলনে বিলম্বহেতু ক্রন্দন-অনুশোচনা) পরিত্যাগ করে পূর্ণকামা (বাসনা সিদ্ধ হয়েছে এমন—পরমাত্মার সন্ধান জানার পর জীবাত্মা সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন।) হয়ে রাসমঞ্চে (সংসারের ঊর্দ্ধে পরমশান্তিময় ও আনন্দময় মিলনমঞ্চে—জীবাত্মা, তাঁর সকল প্রবৃত্তি-সহ) দাঁড়ালেন। নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণ সাদর সাগ্রহে অনন্ত অপরূপ আনন্দে অবর্ণনীয় রাসলীলা আরম্ভ করলেন। প্রত্যেক গোপিনীর নিকট শ্রীকৃষ্ণ বিরাট জ্যোতির্ময়, প্রেমময় মূর্তিতে দেখা দিলেন। "গোপনন্দন শ্রীকৃষ্ণ আমার কাছেই!"—এটাই গোপিনীরা দেখতে লাগলেন; রাসের উৎসব আরম্ভ হলো। (পরমাত্মার প্রকৃত রূপ যখন জীবাত্মা তাঁর সকল সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে অবলোকন করলেন, তখন মুক্তির বা মোক্ষলাভের পরমানন্দে সকলে মেতে উঠলেন। জীবাত্মার সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে তৃপ্তির স্রোত বয়ে গেল। এক স্বর্গীয় প্রেমরসে সিঞ্চিত হলো জীবাত্মা, চৈত্যচেতন, মন, বুদ্ধি, বিবেক…সব কিছু! পরমাত্মার সাথে তাঁদের আর কোনো ভেদাভেদ রইল না—এখানে কেউ বড়ো নয়, কেউ ছোটো নয়, সবাই সমান। ভগবানের সাহচর্যে এক অনন্ত অভেদ প্রত্যক্ষ করে সবাই প্রেমানন্দে উদ্বেল হয়ে গেলেন।)
সস্ত্রীক দেবগণে আকাশ পূর্ণ হলো। (পৃথিবীর বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে জীবাত্মা যেন ঊর্দ্ধলোকের সন্ধান পেলেন। চারিদিক যেন স্বর্গের সুষমায় ও বারতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। পৃথিবীতেই স্বর্গ নেমে এল।) দুন্দুভি (সত্যের আহ্বায়ক বা সত্যের পথনির্দেশক), ডঙ্কা (ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথে সমস্ত বাধাকে প্রচণ্ড নিনাদে দূরে সরিয়ে রাখে যে-সত্তা) বেজে উঠল। পুষ্প (ঐকান্তিক ভক্তি ও নিঃশর্ত আত্মনিবেদন) বর্ষিত হলো; দিকে দিকে গন্ধর্বগণ (চারিদিকে সকল জীবই যেন একমুহূর্তে পরমস্বর্গীয় হয়ে উঠলেন।) করজোড়ে যশোগান করতে লাগলেন। (পরমাত্মার জয়গান, ব্রহ্মসংগীত—উদ্যাপনের সুখসংগীত) সখীদের কিঙ্কিনী, বলয় আর নূপুরের তুমুল শব্দ হতে লাগল। (ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য জীবাত্মা এবং তাঁর আনুষাঙ্গিক সত্তাসমূহের বদ্ধতানের সম্মিলিত সুরলহরী ঐকতানের মতো করে বাজল যেন! এই জ্ঞানের পথে বাধার সৃষ্টি করতে পারে, এমন অবাঞ্ছিত কিছু কোথাও আর রইল না।) শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গস্পর্শে আনন্দিত হয়ে সখীরা উচ্চস্বরে গান আরম্ভ করলেন। (পরমাত্মার দর্শনে বা অনুভবে সকলেরই মধ্যে আনন্দের অফুরন্ত ঝরনা বইতে লাগল। জীবাত্মা তাঁর বিবেক-চৈতন্য-বুদ্ধি-মোহ-মায়া-বোধ…সকল সত্তা দিয়ে পরমাত্মার এই উন্মোচনকে অন্তরে ধারণ ও উপভোগ করছিলেন।)
সেই রাসনৃত্যে গোপিনীরা ক্লান্ত হলেন। এজন্য তাঁরা নিজের আভরণাদি (ধৈর্যাদি) ধারণ করতে আর পারছিলেন না। (ভগবদ্প্রেমে জীবাত্মা যখন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পরমাত্মার কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে নিজেদেরকে নিবেদন করেন, তখন আর কোনো ভাবনা থাকে না, বাহ্যিক শক্তির প্রয়োজনও ক্রমে ফুরিয়ে আসে।) ঘর্মবিন্দুতে (ভগবদ্ভাবে, পরমাত্মাকে পাবার আনন্দে) সকলের মুখ অপূর্ব শোভা ধারণ করল (মোক্ষলাভের আনন্দে পরিপূর্ণ হলো); সকলের কেশকলাপ (সংসার-বন্ধন) ও মালা (সংসার-মায়া) খুলে পড়ল (সকল বন্ধন, দায়, সংশয় ও পিছুটান হতে জীবাত্মা মুক্ত হলেন), অবারিত হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়ে শ্রীনন্দনন্দনও সবার সাথে খেললেন এবং নিজের চিবোনো পান (ব্রহ্মজ্ঞানকে স্মরণ করে) শ্রীরাধার ঠোঁটে অর্পণ করলেন। (পরমাত্মা নিজের সম্পর্কে সকল জ্ঞান অবারিতভাবে অজ্ঞানী জীবাত্মার মধ্যে সঞ্চারিত করে তাঁকে পরমজ্ঞানী বা ব্রহ্মজ্ঞানী করলেন—এখানেও একই বিচার—এই কাজটি জীবাত্মাই করছে, অর্জনটি জীবাত্মারই, যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে…পরমাত্মার।)
এই রাশ দর্শন করতে করতে চন্দ্রমা-সহ (ভগবদ্শক্তিশালী মন-সহ) তারকাপুঞ্জ (শরীরের ক্ষয়কারী বৈশিষ্ট্যসমূহ) নিজের গতি ভুলে গেলেন; তাতে রাত্রিও (পরমায়ুও) বৃদ্ধি পেল। (দৈহিক ক্ষয় ও মৃত্যুর অনেক ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে জীবাত্মা তখন পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়ে গেলেন। সকল রিপুপীড়ন ও ইন্দ্রিয়তাড়নাকে জয় করে জীবাত্মা তখন অসীম আনন্দ ও আয়ুর অংশ পেলেন। ভগবদ্ভক্তি মানুষকে শারীরিকভাবে জরামুক্ত তথা জরার ভীতিমুক্ত করে দেয়। জ্বরে শরীর যেন পুড়ে যায়, অথচ মনে তখনও আগুনের অদম্য তেজ—এমনই অবিশ্বাস্য শক্তি ব্রহ্মজ্ঞানের!)
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মঙ্গলময় হাতে রাসক্রীড়ায় ক্লান্ত (স্তব্ধ ও নির্ভার) গোপিনীদের মুখমণ্ডল (অন্ধদৃষ্টি) মুছে দিয়ে (ব্রহ্ম-আলোকের সন্ধান দিয়ে), কল্যাণময় শ্রীপাদপদ্ম (ব্রহ্মজ্ঞানের কৃপারাশি) সকলের বুকের উপরিভাগে (অন্থরস্থলে) স্থাপন করলেন। (জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার সন্ধান স্পষ্ট ও স্থায়ীভাবে জ্ঞাপিত হলো।) সেই স্পর্শে (সিদ্ধিলাভে) গোপিনীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, তখনই শ্রীকৃষ্ণ সবাইকে নিয়ে যমুনার জলে (জ্ঞানস্রোতে, অজ্ঞানকে সম্পূর্ণভাবে দূর করতে) ক্রীড়া করলেন। (এতে করে সকলের অজ্ঞান দূরে সরল, ব্রহ্মজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপিত হলো, সংশয়ের জায়গায় আত্মবিশ্বাস তার শক্ত স্তম্ভ তৈরি করল, জীবাত্মা বন্ধনমুক্ত হলেন।) স্নানের (সকল অশুদ্ধি সরিয়ে আত্মশুদ্ধি লাভের) পর সত্যপ্রত্যয়ী অনুরাগিণী (সত্যের জন্য চিরসঙ্কল্পবদ্ধ) শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণেই আত্মাঞ্জলি দান করলেন (জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার চিরমিলন ঘটে গেল)। তার সাথে সাথে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণ-কামা (মোক্ষকামী) পবিত্র রমণীমণ্ডলীও (ইন্দ্রিয়সমূহও) সেই শ্রীকৃষ্ণ চরণেই আত্মাঞ্জলি দান করে পূজা করলেন। (মুক্তির স্বাদ পেয়ে জীবাত্মার সাথে সাথে সকল চৈতন্য, ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, মন, বোধ ইত্যাদি নিজেদেরকে অনিত্য, মিথ্যা, কূটভাবনা, জটিলতা থেকে দূরে সরালেন এবং শুদ্ধ সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। পরমাত্মার সাথে মিলনের ফলে যে আনন্দ ও শান্তির সন্ধান মিলল, তা অনুভব করে জীবাত্মা ও চৈতন্যাদি এমন ভগবদ্অবস্থান থেকে আর কখনোই বিচ্যুত না হবার বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।)
শ্রীনন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণ— চৈতন্য-পুরুষ, চৈতন্যেই স্থির থেকে (পূর্ণ থেকে, পরব্রহ্মের স্বরূপে (প্রকৃতিগত কারণে স্বাভাবিকভাবেই) স্থির থেকে) সবাইকেই প্রেমমিলন যোগানন্দ (ব্রহ্মজ্ঞান—যা জীবাত্মাকে পরমাত্মার অনুভূতি দান করে বা জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মহামিলন ঘটায়) দান করলেন (জীবাত্মারই কর্ম পরমাত্মার কর্মরূপে প্রতিভাত)। সেই শুভমিলনে চৈতন্য-আনন্দ লাভ করে শ্রীরাধা-সহ সখী-গোপিনীরা প্রেমসাধনায় (আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনসাধনায়) সিদ্ধির স্রোতে চিরতরে ভেসে গেলেন। (মুক্তি বা মোক্ষরূপ সিদ্ধিলাভ করলেন এবং এই মুক্তি থেকে যেন কখনোই ভ্রষ্ট না হন, তার জন্য চিরদিনের সাধনায় নিরত হলেন। পরমাত্মার সাথে মিলন একবার ঘটে গেলে তখন সংসারের ঢেউ এসে মনকে আর বিচ্ছিন্ন করতে পারে না। সাগরের পাড়ে যে-পাহাড় থাকে, সাগরের ঢেউ যাতে পায়ে এসে না লাগে, তার জন্য নিজেকে সেই পাহাড়ের গায়ে ভূপৃষ্ঠ হতে ন্যূনতম একটা উচ্চতায় রাখতে হয়—খুব নিচের দিকে দাঁড়ানো যায় না। ওটা থেকে নিচে নামলেই বিপদ—ঢেউগুলি এসে শরীরকে তথা মনকে বিক্ষিপ্ত করে দেবে। মোক্ষলাভের পর নিজেকে সেই ঊর্দ্ধস্থান থেকে আর কিছুতেই নিচে নামানো যায় না—নামালেই আবার সংসারসমুদ্রের মাতাল ঢেউ এসে অন্তরের শান্তি-স্বস্তি নষ্ট করে ফেলবে। 'সিদ্ধির স্রোত'-এ ভাসার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সাধনার প্রয়োজন।)
জটিলা, কুটিলা, আয়ান-গোপ বা অন্যান্য গোপগোপীর (যাঁরা আত্মজ্ঞানের সন্ধানে নিরত হননি) কেউই সেই সত্যপ্রতিজ্ঞ শ্রীরাধা-সহ গোপিনীদের তত্ত্ব পেলেন না। (আত্মজ্ঞানের পথ বড়ো কঠিন। সকলে সে পথে হাঁটতে চান না। বেশিরভাগ মানুষই হাঁটতে শুরুই করেন না, আবার কেউ কেউ হাঁটতে শুরু করেও মাঝপথে পালিয়ে যান।) সেই প্রেমময়ী শ্রীরাধার তত্ত্ব (ঐকান্তিক ভক্তির প্রদর্শন বা ভক্তিযোগ) কেবল নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণই জানতে পারেন। (ভগবানই ভক্তের মন পড়তে পারেন। ভক্তের ভগবদ্ভক্তির অস্তিত্ব কেবল ভগবানই টের পান। ভগবানের গুণেই ভক্তের আবির্ভাব ঘটে। নিজের গুণ বা বৈশিষ্ট্যের জন্যই পরমাত্মা নিজের দিকে জীবাত্মাকে ভগবদ্রসের শক্তিতে টানতে পারেন—আপাতবিচারে, অবস্থাদৃষ্টে; যদিও এই সাধনভজনের পথটি পাড়ি দিতে হয় জীবাত্মাকেই—পরমাত্মার স্বপ্রকাশের গুণে।) কৃষ্ণভক্ত (পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে জানতে উৎসুক জীবাত্মা) অনেক পাওয়া যায়, কিন্তু রাধাভক্ত (পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছেন যে-জীবাত্মা, তাঁর ভক্ত তথা পরমাত্মা) একমাত্র শ্রীকৃষ্ণই।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণই পারেন সকল বাহ্যিকতা থেকে শ্রীরাধার দৃষ্টি সরিয়ে পরমার্থবস্তুর দিকে সমস্ত মন-প্রাণ নিবদ্ধ করে দিতে। একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে আমার এই নিবেদনের ইতি টানছি।
আপনি আপনার স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় গেলেন কফিপান করতে। ধরুন, ওঁরা কফির পেয়ালার পাশে চিনির ছোট্ট ব্যাগের বদলে তিনটা চিনির পুতুল দিলেন—বেড়াল, হাতি, ঘোড়া। ওগুলি দেখে আপনার শিশুটি বলল, "একটা বেড়াল, একটা হাতি, একটা ঘোড়া।" বিচারে কোনো ভুল নেই, কেননা ওগুলি সত্যিই তা-ই। এমন বিচারের নাম দ্বৈতবাদ। আপনার স্ত্রী হেসে বললেন, "বাবা, এগুলি হচ্ছে চিনির বেড়াল, চিনির হাতি, চিনির ঘোড়া।" বিচারে এখনও কোনো ভুল নেই, কেননা ওগুলি সত্যিই তা-ই। এমন বিচারের নাম বিশিষ্টঅদ্বৈতবাদ বা বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ—তিনি মূলের (চিনির) দিকে দৃষ্টি দিতে পেরেছেন। এবার আপনার পালা। আপনি এখানে কোনো বেড়াল-হাতি-ঘোড়া দেখছেন না, কেবলই চিনি দেখছেন। যেমনই আকার বা আকৃতি নিয়েই থাকুক না কেন, চিনির পুতুল মূলত চিনিই—যেমনি মাটির তৈরি সকল বস্তু মূলত মাটিই। আপনার যে-বিচার, তা-ও সঠিক। এমন বিচারের নাম অদ্বৈতবাদ।
যে যেভাবে ভাবে, সে সেভাবে বাঁচে। যার যতটা ভাব, তার ততটা লাভ। জীবাত্মা যখন কেবলই চিনি দেখতে শিখে যান, তখনই তিনি পরমার্থিক জ্ঞানের উপযুক্ততা প্রাপ্ত হন। এমন শিক্ষার জন্য কেবল উপযুক্ত গুরু (শ্রীকৃষ্ণ) নয়, উপযুক্ত শিষ্যও (শ্রীরাধাও) প্রয়োজন।