মহালয়ার আদ্যোপান্ত

মহালয়া কী? দুর্গাপূজার সাথে এর সম্পর্কই-বা কী? মহালয়া থেকেই আমাদের দেশে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু; আবার কোনো কোনো অঞ্চলে মহালয়ার পূর্ববর্তী কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকেই কল্পারম্ভ (পূজাবিধির সূচনা বা দুর্গাপূজার পনেরো দিন আগে থেকে নিত্য পালনীয় কর্মানুষ্ঠান)। তাহলে পিতৃপক্ষের সঙ্গে দুর্গাপূজার পক্ষ বা দেবীপক্ষের সম্পর্ক কী, সেই তত্ত্ব নিয়ে ভাবা যাক। উল্লেখ্য, পিতৃপক্ষ পূর্বপুরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ, আমাদের কাছে যা সাধারণত 'মহালয়া' নামে পরিচিত। এই পক্ষটির আরও কিছু নাম: পিতৃপক্ষ, ষোলাশ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়াপক্ষ ও অপরপক্ষ।




'মহালয়া' শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গবোধক, 'অমাবস্যা' শব্দের বিশেষণ। কিন্তু এই পিতৃপক্ষীয় অমাবস্যাটিই 'মহালয়া' কেন? বিগ্রহবাক্য করতে গেলে— 'মহান্ লয়ো যত্র' কিংবা 'মহান্ আলয়ো যত্র'। এ যদি হয়, তবে এই অমাবস্যাতে কার মহান্ লয় বা বিনাশ? কারই-বা মহান আলয় বা নিবাস? আরেক উপায়ে যদি বলি—'মহস্য উৎসবস্য আলয়ঃ', অর্থাৎ উৎসবের বসতিস্থল বা পরিপূর্ণ উৎসব-দিবস—তাহলে এর কী অর্থ দাঁড়ায়? শাস্ত্র কী বলেন?




'মহালয়' ও 'মহালয়া', দুটি শব্দেরই প্রয়োগ শাস্ত্রে পাওয়া যায়। কাজেই উপরের তৃতীয় বিগ্রহবাক্যও সম্ভবপর; কিংবা যদি বলি—'মহাংশ্চাসৌ আলয়শ্চ ইতি'—পুংলিঙ্গান্ত মহালয়া।




এখন তাহলে বিগ্রহবাক্যগুলি ধরে এগোই।




(১) 'মহান্ লয়ো যত্র': কার লয়? চাঁদের। হ্যাঁ, চাঁদের মহান লয় হয় এই অমাবস্যায়—ব‍্যুৎপত্তিগত অর্থকে অনুসরণ করে ব্যাবহারিক অর্থ প্রকাশিত হয় বিধায় 'মহালয়া' যোগরূঢ় শব্দ—এরকমটাই বলেছেন প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত জীমূতবাহন রচিত হিন্দুর পূজানুষ্ঠান, শুভকর্ম, আচার ও ধর্মোৎসব প্রভৃতির কাল নির্দেশক গ্রন্থ 'কালবিবেক'-এর টীকাকার শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার। চাঁদের ক্ষয় তো প্রতিটি কৃষ্ণপক্ষেই হয়, তবে প্রৌষ্ঠপদী বা ভাদ্রী পূর্ণিমার পরবর্তী অমাবস্যাটিতে চাঁদের আত্যন্তিক বা বিশেষ মাত্রায় ক্ষয়ের কথা আসছে কেন?




ব‍্যুৎপত্তিগত কারণেই তর্কালঙ্কার মহাশয় শব্দটিকে 'যোগরূঢ়' বলেছেন। সবই বুঝলাম, কিন্তু আমরা 'মহালয়া' শব্দের ব্যুৎপত্তি খুঁজতে 'মহান্ লয়ো যত্র'-তেই থাকছি কেন? এ নিয়ে একধরনের খচখচানি থেকেই যাচ্ছে। একটু সহজ করে ভাবি। মহালয়া অমাবস্যাটিতে সারাবছরের সকল প্রযোজ্য তিথিতেই শ্রাদ্ধদানের সুযোগ-সুবিধার বা বাধ্যতার পূর্ণ লয় বা বিনাশ ঘটে—এই অর্থে যদি ধরি, তাহলে তো 'চন্দ্রের লয়' বা 'চাঁদের বিনাশ' অর্থটি আনতেই হয় না; অথচ শাস্ত্রবাক্যও এই অর্থে সুসিদ্ধ হয়ে পড়ে। মহালয়া তাই চাঁদের লয় নয়, বাধ্যতার লয়।




(২) 'মহান্ আলয়ো যত্র': শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতা বলছেন—




দ্বে সৃতী অশৃণবং পিতৃণামহং দেবানামুত মর্ত্যানাম্‌।
তাভ্যামিদং বিশ্বমেজৎসমেতি যদন্তরা পিতরং মাতরং চ।। (১৯/৪৭)




অর্থ: হে মানবগণ! (অহম্) আমি যে (পিতৃণাম্) পিতা প্রভৃতি (মর্ত্যানাম্) মানবদের (চ) এবং (দেবানাম্) বিদ্বানদের (দ্বে) দুই গতি [পিতৃযান ও দেবযান], (সৃতী) যাতে আগমন-প্রস্থান অর্থাৎ জন্ম-মরণ প্রাপ্ত হয়, তাকে (অশৃণবম্) শ্রবণ করি, (তাভ্যাম্) সেই দুই গতি দ্বারা (ইদম্) এই (বিশ্ব) সমগ্র জগৎ (মেজৎ) চলায়মান হয়ে (সমেতি) উত্তম ভাব প্রাপ্ত হয় (উত) এবং (যৎ) যে (পিতরম্) পিতা এবং (মাতরম্) মাতা থেকে (অন্তরা) পৃথক হয়ে অন্য শরীর দ্বারা অন্য মাতা-পিতাকে প্রাপ্ত হয়, সেটি তোমরা জানো।




দেবগণ ও পিতৃগণের অধিকার অনুসারে দুইটি সরণি রয়েছে—একটি দক্ষিণায়ন, অপরটি উত্তরায়ন। মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়—এই ছয় মাস উত্তরায়ন এবং শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ—এই ছয় মাস দক্ষিণায়ন। দক্ষিণায়ন‌ই পিতৃগণের অধিকৃত কাল।




দক্ষিণায়নের ছয় মাস সময়ের মধ্যে, কেশব (ভগবান বিষ্ণু) যখন আবারও ঘুমিয়ে থাকেন, সেই সময়টাই প্রশস্ত। ওই ছয় মাসের মধ্যে আবার প্রৌষ্ঠপদীর অর্থাৎ ভাদ্র পৌর্ণমাসীর পর-পক্ষ প্রশস্ত। আবার তার মধ্যে তিথি বিচারে, প্রথমা বা প্রতিপদ থেকে পঞ্চমী, ষষ্ঠী থেকে দশমী এবং একাদশী থেকে অমাবস্যা পর্যন্ত, অর্থাৎ মহালয়া পর্যন্ত যথাক্রমে প্রশস্ত, প্রশস্ততর ও প্রশস্ততম কাল।




ত্রয়োদশী যদি মঘা-নক্ষত্রযুক্ত (জ্যোতিষশাস্ত্রে বিচার্য ২৭টি নক্ষত্রের মধ্যে মঘা উজ্জ্বলতম নক্ষত্র) হয়, তবে তা সবচাইতে প্রশস্ত। যদি মধু এবং পায়েস দ্বারা শ্রাদ্ধপ্রদান করা হয়, তাহলে সে শ্রাদ্ধ অক্ষয় হয়। যে যেমন অবস্থাতেই থাকুক—শাস্ত্রানুযায়ী, এ সময়ে সকলের পক্ষে শ্রাদ্ধ একান্ত বিহিত।




বৃহদ্রাজ-মার্তণ্ড-ধৃত মৎস্যপুরাণেও পাই—
কন্যাং গতে সবিতরি দিনানি দশ পঞ্চ চ।
পার্বণেন বিধানেন শ্রাদ্ধং তত্র বিধীয়তে।।
অর্থ: সূর্য যখন কন্যারাশিতে উপস্থিত হন, তখন পার্বণ-বিধানে শ্রাদ্ধ বিহিত।




মীমাংসকাচার্য কার্ষ্ণাজিনি তাঁর মীমাংসায় ভবিষ্যপুরাণ থেকে উদ্ধৃত করেছেন—
নভস্যস্যাপরে পক্ষে শ্রাদ্ধং কুর্যাদ্ দিনে দিনে।
নৈব নন্দাদি বর্জ্যং স্যান্নৈব বর্জ্যা চতুর্দশী।।
অর্থ: গৌণ ভাদ্রমাসের অপরপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষে প্রতি তিথিতেই শ্রাদ্ধ বিহিত; তখন নন্দাও (প্রতিপদ, ষষ্ঠী ও একাদশী) বর্জনীয় নয়, চতুর্দশীও বর্জনীয় নয়।




অতএব, মহালয়া-সম্পর্কিত এই পক্ষ অত্যন্ত প্রশস্ত বিধায় এই সময়ে বহুবিধ শ্রাদ্ধ বিহিত। এই বিষয়সমূহ নিত্য বা নিত্য পালনীয়।




প্রসিদ্ধ স্মৃতিকার‌ নন্দপণ্ডিত বা বিনায়কপণ্ডিতের 'শ্রাদ্ধকল্পলতা' গ্রন্থে পাই—"আষাঢ্যাঃ পঞ্চমে পক্ষে কন্যাসংস্থে দিবাকরে। মৃতাহনি পুনযোং বৈ শ্রাদ্ধং দাস্যতি মানবঃ॥"—সূর্য কন্যাগত হলে, অর্থাৎ আশ্বিনে—আষাঢ় থেকে পঞ্চম পক্ষে—সেই শ্রেষ্ঠ পক্ষে, সকল তিথির মধ্যে পিতৃকর্ম-শ্রাদ্ধাদিতে অমাবস্যা তথা মহালয়াই প্রশস্ততম বিধায় অপরপক্ষের এই বিশেষ অমাবস্যাটিই সারাবছরের মধ্যে পিতৃশ্রাদ্ধের শ্রেষ্ঠ দিন।




এই অপরপক্ষ বা পিতৃপক্ষে পিতৃগণ আপন পুরী থেকে মনুষ্যলোকে এসে পুত্র-পৌত্রাদি-প্ৰদত্ত ভোজ্যাদি গ্রহণের জন্য সমবেত হন। তাঁরা এই তিথিতেই প্রেতপুরী থেকে এসে সমবেত হন—আলীন হন, অর্থাৎ এই তিথির আলয়ে বা নিবাসে আসেন বলেই এর নাম মহালয়া।




(৩) 'মহস্য উৎসবস্য আলয়ঃ': 'মহ' শব্দের অর্থ 'উৎসব'। এই অপরপক্ষের অমাবস্যায় প্রেতপুরী খালি করে সকলে এসে মর্ত্যভূমিতে সমবেত হন—যমরাজের অনুশাসনে—এবং তাঁরা বৃশ্চিকরাশিতে সূর্য উপনীত হওয়ার সময় পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। বৃশ্চিকে সূর্যদেবের উপস্থিতির সময়ের মধ্যে যদি পিতৃগণ শ্রাদ্ধ না পান, তাহলে তাঁরা নিদারুণ ক্ষোভে, অভিমানে, অনুতাপে দারুণ শাপ দেন বর্তমান বংশধরগণকে এবং পুনরায় প্রেতপুরীতে বিষম হতাশায় ফিরে যেতে বাধ্য হন।




অমাবস্যা তিথিতেই তাঁদের শ্রাদ্ধ-গ্রহণের শ্রেষ্ঠ দিন—সেজন্য তাঁদের উৎসবের দিন বলে চিহ্নিত করার জন্যই এই তিথিটিকে 'মহালয়া' নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। নব্যস্মৃতির প্রবর্তক শূলপাণি তাঁর রচিত শ্রাদ্ধ বিষয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ 'শ্রাদ্ধবিবেক'-এ আদিপুরাণ 'ব্রহ্মপুরাণ' থেকে উদ্ধৃত করেছেন:




যাবচ্চ কন্যাতুলয়োঃ ক্রমাদাস্তে দিবাকরঃ।
তাবচ্ছ্রাদ্ধস্য কালঃ স্যাৎ শূন্যং প্রেতপুরং তদা।।




অর্থ: যখন সূর্যদেব কন্যা ও তুলার সংক্রমণে ব্যাপৃত, তখন শ্রাদ্ধের কাল বিহিত, তখন প্রেতপুরী শূন্য থাকে।




'শ্রাদ্ধবিবেক'-এ পাচ্ছি, 'ভবিষ্যপুরাণ'-ও এই বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন করেছেন।




এই মহালয়ার দিনটিই পিতৃপুরুষের জন্য কেন শ্রেষ্ঠ আনন্দের দিন—এটা প্রমাণ করতে গেলে শ্রাদ্ধদানের বিধিক্রমটি পর্যালোচনা করতে হয়।




প্রথমত, মৃততিথিবিহিত সাংবৎসরিক শ্রাদ্ধ পুত্রাদির অবশ্যকর্তব্য। 'শ্রাদ্ধবিবেক' গ্রন্থ ছাড়াও রঘুনন্দন ভট্টাচার্য প্রণীত 'অষ্টাবিংশতি তত্ত্বম্'-এ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে—প্রতিমাসে বিহিত কৃষ্ণপক্ষীয় পার্বণশ্রাদ্ধও নিত্য। (মহালয়া প্রভৃতি বিশেষ হিন্দু আচার উপলক্ষ্যে এবং বিশেষ তিথিতে কারও মৃত্যু হলে তার উদ্দেশে যে-শ্রাদ্ধ করা হয় তার নাম পার্বণশ্রাদ্ধ।) সেগুলির মধ্যে আবার অপরাহ্ণ শ্রেয়ান্—"মাসি মাসি অপরপক্ষস্য অপরাহ্ণঃ শ্রেয়ান্"।




নিগম বলছেন,"অপরপক্ষে যদহঃ সম্পদ্যতে অমাবাস্যায়ান্তু বিশেষণে।"— "কৃষ্ণপক্ষে যে-কোনো তিথিতেই শ্রাদ্ধ করতে পারে, অমাবস্যায় শ্রাদ্ধ করলে বিশেষ ফল হয়।" যে-ব্যক্তি সতত যাগশীল ও যাঁর যজ্ঞাগ্নি নির্বাপিত হয় না এমন নিয়ত যজ্ঞকারী সাগ্নিক যিনি, তিনি কেবল অমাবস্যাতেই যজ্ঞ করেন। শ্রুতি বলছেন, "পূর্বঃপক্ষো দেবানাম্ পরঃপক্ষো পিতৃণাম্।"—শুক্লপক্ষ দেবতাদের, কৃষ্ণপক্ষ পিতৃগণের। ব্রহ্মা প্রথমে শুক্লপক্ষের সৃষ্টি করেছিলেন। পরে তিনি কৃষ্ণপক্ষের সৃষ্টি করেন বলে এর নাম অপরপক্ষ।




'মনুসংহিতা'র তৃতীয় অধ্যায়ে নির্দেশিত আছে—




ন পৈতৃযজ্ঞিয়ো হোমো লৌকিকেহগ্নৌ বিধীয়তে।
ন দর্শেন বিনা শ্রাদ্ধমাহিতাগ্নের্দ্বিজন্মনঃ॥ (৩/২৮২)




অর্থ: (শ্রৌত, স্মার্ত ব্যতিরিক্ত) লৌকিক অগ্নিতে পিতৃ যজ্ঞবিহিত হোম বিহিত নয়। সাগ্নিক দ্বিজের শ্রাদ্ধ অমাবস্যাভিন্ন (অন্য তিথিতে) হয় না।




কিন্তু কেউ যদি প্রতিমাসের কৃষ্ণপক্ষে পার্বণশ্রাদ্ধ করতে না পারেন, তাহলে 'মনুসংহিতা'য় নির্দেশ আছে—




অনেন বিধিনা শ্রাদ্ধং ত্রিরব্দস্যেহ নিৰ্বপেৎ।
হেমন্তগ্রীষ্মবর্ষাসু পাঞ্চযজ্ঞিকমম্বহম্॥ (৩/২৮১)




এই নিয়মানুসারে, বছরে হেমন্ত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা, এই তিনবার শ্রাদ্ধ করবে, পঞ্চ যজ্ঞান্তর্গত শ্রাদ্ধ প্রতিদিন করণীয়।




নতুবা—"কন্যাকুন্ত বৃষস্থের্কে কৃষ্ণপক্ষে চ সর্বদা"—সারাবছরের মধ্যে তিন দিন শ্রাদ্ধ করতে হবে: সূর্য যখন কন্যারাশিতে অর্থাৎ সৌর-আশ্বিন, সৌর-ফাল্গুন এবং সৌর-জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণপক্ষে, বিশেষত অমাবস্যায়।




তাতেও যদি কেউ অসমর্থ হন, তাহলে—




হংসে বর্ষাসু কন্যাস্থে শাকেনাপি গৃহে বসন্।
পঞ্চম্যা উত্তরে দদ্যউরউভয়ওর্বংশয়ওরঋণম্।।




এই শাস্ত্রবিধি অনুসারে সূর্য কন্যারাশিতে উপগত হলে অমাবস্যায় শাক দিয়ে হলেও গৃহস্থ একবার অন্তত শ্রাদ্ধ করবেন।—এটাই তো 'মহালয়া' অমাবস্যা।




এখানে আর-একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই পিতৃগণের 'মহানন্দ-দিবস'-এ ষোড়শপিণ্ড-দান একান্ত কর্তব্য।




উনিশটি পিণ্ডদানক্রিয়াকেই ষোড়শপিণ্ডদান বলে। এই শব্দটা পারিভাষিক, অর্থাৎ উনিশটি পিণ্ডের নামই ষোড়শপিণ্ড। প্রেতপক্ষের অমাবস্যায় এবং তীর্থপ্রাপ্তিতে যথাবিধানে পার্বণশ্রাদ্ধ করে ১৯টা পিণ্ড দান করতে হয়। গয়াতে প্রেতশিলায় যে-রীতি অনুসারে মাতৃষোড়শী ও পিতৃষোড়শী মন্ত্র দ্বারা ষোড়শপিণ্ডদান করতে হয়, সেই প্রণালী অনুসারে এই পিণ্ডদান করা বিধেয়, তাই এই শব্দটি পঞ্চাম্র বা নিপাতনে সিদ্ধ শব্দের মতো পারিভাষিক বুঝতে হবে। (শ্রীরঘুনন্দন ভট্টাচার্যের 'তিথিতত্ত্ব' অনুযায়ী লেখা হলো।)




যথাবিধানে পার্বণশ্রাদ্ধ শেষ করে ষোড়শপিণ্ডদান করতে হবে। ১৯টি মন্ত্রপাঠ করে ১৯টি পিণ্ড দিয়ে এই ষোড়শপিণ্ডদান সম্পন্ন হয়। শ্রাদ্ধতত্ত্ব ও শ্রাদ্ধপদ্ধতিতে এই মত বর্ণিত হয়েছে। তীর্থস্থলে তীর্থপ্রাপ্তির জন্য শ্রাদ্ধ ও মহালয়ায় পার্বণ করে এভাবে ষোড়শপিণ্ড দিতে হবে।




সংক্ষেপে বলতে গেলে, নীচ ও উচ্চ, পাপী ও নিষ্পাপ, বিভিন্ন যোনিজ—কারও জন্য শ্রাদ্ধ-দাতার মহালয়ার এই মঙ্গলতম দিনে কোনো ভেদবুদ্ধি নেই—সকলকেই শ্রাদ্ধ-দাতা শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করছেন—




ওঁ আব্রহ্মস্তম্ভ পর্যন্তং দেবর্ষি পিতৃমানবাঃ।
তৃপ্যন্তু পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহা দয়ঃ।।
(শ্রীশ্রীগয়ামাহাত্ম্য, ১/২১)




অর্থ: আব্রহ্ম-স্তম্ভ (ব্রহ্ম থেকে আরম্ভ করে সামান্য স্তম্ভ অর্থাৎ তৃণ পর্যন্ত জগৎ-সংসার) স্থিত দেবগণ, ঋষিগণ ও পিতৃগণ এবং সম্বন্ধীয় মানবগণ, আর মাতা মাতামহাদি যে-সকল পিতৃলোক আছেন, তাঁরা আমার তিল-জলাঞ্জলি প্রাপ্তে পরিতৃপ্ত হোন৷




এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যদি কোনো কারণে মহালয়াতেও পিতৃগণের শ্রাদ্ধ কেউ দুর্ভাগ্যবশত করতে না পারেন, তাহলে পিতৃগণের তুষ্টিবিধানের কি কোনো উপায় নেই? নিবন্ধকারগণ এই বিষয়ে এই গৌণকল্পের বিধান দিয়ে ভবিষ্যপুরাণ বলছেন:




যেযং দীপান্বিতা রাজন্ খ্যাতা পঞ্চদশী ভুবি।
তস্যাং দদ্যান্ন চেদ্দত্তং পিতৃণাং বৈ মহালয়ে॥




অর্থাৎ, তাঁকে আশ্বিনের পঞ্চদশ তিথির অমাবস্যায় দীপের সমারোহে শ্রাদ্ধদানের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু এই গৌণকল্পে ষোড়শপিণ্ডদান হবে না।




অপর বা পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ, এই দুই অঙ্গাঙ্গিভাবে সংবদ্ধ। অপরপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষের মহালয়া তিথি মহাজননীর আগমনের শঙ্খনিনাদ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করে। পিতৃগণের মহানন্দ ও জগজ্জননীর আগমনের পদধ্বনি—উভয়ে মিলে মহালয়া মানুষের কাছে এত আদরের ও আনন্দের দিন।